একটা অস্বাভাবিক বিরক্তির সাথে টিভিটা বন্ধ করল হারু।সাথে সাথে সারা ঘরটা কেমন যেন চুপ মেরে গেল।চোখ বন্ধ করতেই হারুর কানে এল, ‘টিক,টিক,টিক…’। নাহ, সময় কে রিমোট দিয়ে থামানো যাবে না।ঘড়িটার টিকটিকানি উপেক্ষা করে হারু খুব মন দিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করল, ‘এবার কি করবে!’।

আজ দুদিন ধরে চলছে লক ডাউন। ভেবেছিল শুক্রবার পর্যন্ত, মানে আরও দুটো দিন কোনোরকমে চালিয়ে নেবে। কিন্তু বাদ সাধল আজকের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটা। তার সমস্ত প্ল্যান পরিকল্পনা তে যেন গরম জল ঢেলে দিল। নরমাল জল হলেও হত। কিন্তু একেবারে গরমজল! প্ল্যানটার বারোটা বাজানোর সাথে সাথে তার অন্তরেও যেন ছ্যাঁকা দিয়ে গেল। পুরো তিন সপ্তাহের লক ডাউন। বাড়ি থেকে বেরোনো যাবে না। মানে সব মানুষ বাড়িতে থাকবে। আর বাইরে থাকবে পুলিশ। আর মানুষ বাড়িতে থাকা মানে হারুর ব্যাবসার গুড়ে বালি।

না না, হারু কোনো দোকান চালায় না। হারু চোর।

‘আহ!’ – নিজের অজান্তেই যেন তার ভারাক্রান্ত অন্তরটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

কত আশা করেছিল। কত স্বপ্ন দেখেছিল। গ্রীষ্মকাল আসছে। মানুষ গরমের চোটে রাত পর্যন্ত বাইরেই থাকবে। আর তার মানে হারুর মাঠ ফাঁকা। শুধু টুক করে সেরকম বাড়িতে ঢুকে, মনের মতো এটা ওটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারলেই ‘গোল’। কিন্তু ওই যে, ভগবানের মার। কথায় বলে, ‘দেনে বালা জবভি দেতা, ছপ্পড় ফাড়কে দেতা হ্যায়’, কিন্তু কেউ এটা বলে না যে যদি ‘দেনেবালা দেনা নেহি চাহতা হ্যায়’ তাহলে সেই ‘ছপ্পড়’ কে ‘ফাড়া’ ত দূরের কথা,তুমি একটা আচড় কেটে দেখাও দিকি!

খেতে বসে হারু। দুটো ভাতে-ভাত আর আলু সিদ্ধ। হারু ব্যাচেলার। তাই দুপুরের খাবারটা বাইরে সারলেও, রাতে নিজের হাতেই ফুটিয়ে নেয় যাহোক। না, রাতের খাবারের ক্ষেত্রে রিস্ক নেওয়া চলে না। যদি অম্বল হয়! যদি কাজ করতে গিয়ে পেট সাথ না দেয়! রোজ এই সময়টাই খেতে বসলেই হারুর একটা অফিস যাবার ফিলিংস আসে। যেমন সব চাকুরীজীবিরা যায়। কিন্তু আজ যেন কোনোকিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। তবে কি হারু এই লক ডাউনের জেরে বেকার হয়ে যাবে? অবশ্য ঘরে বেশ কয়েকদিনের রসদ মজুত আছে। তাতে বেশকয়েক দিন বেশ ভালোভাবেই চলে যাবে। কিন্তু মনটা বড়ো আনচান করছে। এদিকে কোরোনার ভয়ও আছে। কিছু তো বলা যায় না।

পরের দিন পুরোটাই হারু চিন্তা করে কাটালো। দুপুরে বেরিয়েছিল একবার খেতে। কিন্তু খাবার মেলে নি। তার পরিবর্তে মিলল পুলিশের লাঠির ঘা। না না, দু-ঘা তে হারুর কিছু এসে যায় না। কিন্তু চিন্তা মাথায়,খিদে পেটে আচমকা দু-ঘা যেন সব মেখে দিল। কিছুক্ষনের জন্য হারুর মাথায় খিদে আর পেটে চিন্তা চলে এসেছিল। কিন্তু সামলে নিয়েছিল।

‘বলি, এত বোঝালেও বুঝবি না, না? সেই বেরোনো চাই!’

ভোলা মাস্টারের কথা মনে পড়ল হারুর। আগে লাঠি,পরে কথা।

‘না, মানে,খেতে বেরিয়েছিলাম।’ হারু গম্ভীরভাবে উত্তর দেয়।

‘দেশের এই চরম অবস্থা। কোনো বিবেচনা নেই তোর! ‘- পুলিশের গলার স্বর উঠতে থাকে।

‘আমি রোজ দুপুরে বাইরেই খাই।’-হারুও হারবে না।

বচসা কতদূর চলত জানা নেই।কিন্তু হঠাৎ এক বাইক আরোহী এসে পড়ায় পুলিশের কনসেনট্রেশন গিয়ে পড়ল সেখানে আর এক ঘা লাঠি আরো একবার খেয়ে বাড়ি যাবার অনুমতি পেল হারু।

রাত ন-টা। হারুর মাথা গরম। চোখ লাল।সারাদিন কোনো খাবার জোটে নি। আঘাত অপমানে জর্জরিত সে। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।

‘না। আর না। কক্ষনো না।’ – চিৎকার করে ওঠে সে।

হারু ঠিক করে ফেলে। আজ রাতে তাকে বেরোতেই হবে। না, অভাবের তাড়নায় না। তবে? এই ভাবে ঘরে বসে থাকা আর ভালো লাগে না যে।

কোনোমতে দুটো ফুটিয়ে, খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বেরোলো সে। পাড়াটা এমনি তেই নিঃঝুম। কিন্তু আজ যেন একটু অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধতা। গলিটা পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় এসে পড়ল সে। শুনশান রাস্তা। অন্যদিন যাও গোটাকয়েক গাড়ি চলাচল করে, আজ মারণ ভাইরাসের ভয়ে তাও বন্ধ।

একটা বিড়ি ধরায় হারু। টান দিতে দিতে আপন মনে যাচ্ছিল। না, নিজের এলাকার কাছাকাছি চুরি করতে নেই। এটা তাদের শাস্ত্রে মানা।

কিন্তু এ যে মহা মুশকিল। প্রতিটা বাড়িতেই আলো জ্বলছে। তাহলে কি অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছে সে? দূরে একটা পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেল।এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল হারু। কান পেতে শুনল। না, এদিকে আসছে না।আধঘন্টা মতো এদিক ওদিক ঘুরে মনের মতো বাড়ি পাওয়া গেল। দোতলা বাড়ি। অন্ধকার। নিস্তব্দ। অন্ধকার যেন নিজের মতো করে বাড়িটাকে গ্রাস করে নিয়েছে।

‘পারফেক্ট।’ – নিজের অজান্তেই বলে ফেলল হারু। আসলে তিন দিন পর কাজে নামছে। একটা উত্তেজনা তো থাকবেই। একবার বাড়িটা ভালো করে ঘুরে দেখে নিয়ে ঝটপট প্ল্যান টা ছকে ফেলল। প্রথমে পাঁচিল। তারপর পাইপ। মোটামুটি ১২-১৩ ফুট। হুঁ। হারুর কাছে নস্যি। আর তারপরেই দোতলার ব্যালকনি।

ব্যাস। যেমন ভাবা। পাঁচিল টপকে পাইপের দিকে এগোলো। বেশ মজবুত পাইপ। মনে মনে বাড়ির মালিকের প্রশংসা করল সে।

‘জয় মা।’- কপালে হাত জোড় করে দুহাতে পাইপ চেপে ধরল হারু। বেশ কিছুটা উঠেছে। কিন্তু এ কি! পুলিশের গাড়ি! এদিকেই আসছে! দেশটা দু-দিনে এত অ্যাডভান্স হয়ে গেল! বাড়িতে চোর পড়তে না পড়তেই পুলিশ! মাই,হিন্দি কেন, এতো ইংরেজী সিনেমাও ফেল।

গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামল। গটগট করে নেমে এল জনা চারেক উর্দিধারী। হারুর হাত ফস্কাচ্ছে। হাতের তলায় বিন্দু বিন্দু ঘামে পাইপ পিছলে যাচ্ছে। হারু কোনোরকমে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, সর্ব্বশক্তি প্রয়োগ করে পাইপটাকে জাপটে ধরে রাখার চেষ্টা করল।

‘ওই তো। ওই তো।’ – একজন পুলিশ চেচিয়ে উঠল।

‘যাহ। দেখে ফেললে নাকি!’-  হারুর পক্ষে পাইপ ধরে রাখা কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে পড়ছে। কিন্তু না। পুলিশটা তাকে দেখায় নি। হারু পুলিশের এখনোও উচিয়ে থাকা হাতটা অনুসরণ করে দেখল, ব্যালকনি থেকে একটা মুখ উঁকি মারছে। আর পুলিশটা তাকে লক্ষ্য করে এখনো লাফাচ্ছে। বাকি পুলিশ এদিকে দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে। এটা হচ্ছেটা কি, হারুর সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। শেষমেষ এ কার বাড়িতে চুরি করতে এল সে! মাফিয়া-টাফিয়া নাকি! এ কেমন ফ্যাসাদে পড়া গেল বাপু!

এদিকে পুলিশ সদর দরজা ভেঙে ফেলেছে। আওয়াজ এল, তারা উপরে ওঠার জন্য আরো একটা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।

‘আজ ব্যাটা নির্ঘাত মরবে।’- হারুর এবার বেশ মজা লাগে। ব্যাটাকে ধরে নিয়ে গেলেই হারুর মাঠ ফাঁকা। ব্যাস। আর কে পায় হারুকে।

কিন্তু ও কি! ব্যালকনি থেকে সেই উঁকি মারা মুখ এবার পাইপ ধরে নিচে নেমে আসছে যে। হারু চমকে ওঠে।

‘আরে ও মশাই। কি করছেন! আমি আছি যে।’ -হারু প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

‘হঠ যাও। আরে বেওয়াকুফ, হঠো।’- লোকটি দ্রুত নেমে আসছে।

পুলিশ প্রায় দু-নম্বর দরজা ভেঙে ফেলেছে।

‘আরে নামতে সময় লাগে তো নাকি! ও মশাই, আস্তে নামুন। পড়ে যাব তো!’

এরপর হারু যেন একটা সার্কাস দেখল। ঠিক তার থেকে কিছুটা দুরে লোকটা পাইপের ওপর পা দিয়ে প্রেশার করে শরীরটা কে শূণ্যে ভাসিয়ে দিল। তারপর হারুকে টপকে, হারুর পাশদিয়ে শূণ্যে ভাসতে ভাসতে, হারুকে একটা বাজেরকমের খিস্তি দিয়ে ঝপ করে মাটিতে পড়ল। তারপর পাঁচিল টপকে হাওয়া।

ঠিক সেই মুহুর্তে পুলিশের টর্চ এসে পড়ল ব্যালকনি তে। আর পরমুহুর্তেই আলো পড়ল হারুর উপর। হারুও উত্তেজিত।

‘ওই যে, ওদিক দিয়ে পালাল স্যার।’- হারু পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করল এবং তারপরেই সশব্দে পড়ল নীচে৷ আর ভেসে এল এক তীব্র আর্তনাদ।

‘বাবাগোওও!’

আসলে ডিরেকশন দেখাতে হারু হাত তুলেছিল। আর ঘেমো এক হাত পাইপ টা ধরে রাখতে পারেনি।যন্ত্রনায় কাতরে ওঠে হারু। উঠতে পারছে না। চোখটা বন্ধ হয়ে যাবার আগে সে দেখতে পেল, ঠিক যেন সিনেমার মতো, পুলিশ এসে তাকে ঘিরে ফেলল।

হারু এখন আইসোলেসন ওয়ার্ডে। আসলে ঘটনাটা খুবই বেদনাদায়ক।যে ব্যাক্তির বাড়িতে হারু চুরি করতে গেছিল সেই মহাশয় সেদিনই ফিরেছিলেন বিদেশ থেকে। এয়ারপোর্টের চেকিং তো কোনোরকমে এড়িয়ে যান কিন্তু বাদ সাধেন এক প্রতিবেশি। সেই প্রতিবেশিই পুলিশকে জানায় ব্যাপারটা। এবং পুলিশ সেই লোককে ধরতে এসে, হারুর দুর্ভাগ্যবশত, হারুকে সেই লোক ভেবে ধরে এনে ভরে আইসোলেসন ওয়ার্ডে। হারু জ্ঞান ফেরার পর অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কাজ দেয় নি।

হারু মনের দুঃখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। কোমরের ব্যাথাটাও চাড় দিয়ে উঠছে। এক তীব্র অভিমানে ভরে যায় তার মন। সেই লোকটা,পুলিশ,ডাক্তার,নার্স,সমাজ আর নিজের ভাগ্য সব্বাইকে দূষতে দূষতে চোখের জলে জানলার বাইরের দৃশ্যটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে ওঠে।

৷৷৷৷৷৷৷ সমাপ্ত ৷৷৷৷৷৷৷

~ হারুর বিপদ ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকাশীরামের কাশি
Next articleবায়ু – দূষণে আক্রান্ত জনজীবন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments