একদিন হল এক জব্বর কাণ্ড। সেদিন ছিল শুক্রবার। ডিসেম্বর মাসের কুড়ি তারিখ। সপ্তাহের শেষ দিন। সামনেই পঁচিশেডিসেম্বর। কেমন একটা ছুটি ছুটি ভাব চারিদিকে। পটকান বাবুর বাড়ীর লোকজন, তাঁর স্ত্রী , মেয়ে এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধবরাচড়ুইভাতি করতে সব দীঘা যাচ্ছেন দুদিনের জন্য। পটকানেরও যাবার কথা কিন্তু সকালে তাঁর গা হাত পা ব্যাথা করছিল। জ্বরজ্বর ভাব। তিনি গেলেন না। পটকান বাবুর স্ত্রীও গেলেন না। তবে বাড়ির আটখানা গাড়ী বোঝাই করে অন্যরা সবাই চলে গেল।পটকান বাবুই সব গাড়ীর চাবি দিয়ে দিলেন। তিনি কদিন দিনরাত শুয়ে থাকবেন। অতএব তাঁর গাড়ীর প্রয়োজন কিসের ! সবচালকেরা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

এদিকে হল কি , হঠাৎ দুপুর সাড়ে দশটা নাগাদ আয়কর দপ্তর থেকে একটা ফোন এলতাঁকে দুপুর বারটার মধ্যে আয়কর দপ্তরেরঅফিসে হাজির হতে হবে। তাঁর মাথায় হাত। তিনি বললেন যে তাঁর শরীরটা ভাল নয়, আর বাড়ীতে একটাও গাড়ী নেই তিনি বরং পরে কোনদিন গিয়ে দেখা করবেন।আজ তিনি তাঁর অ্যাটর্নীকে পাঠিয়ে দেবেন কিন্তু আয়কর দপ্তরের অফিসারভদ্রলোক তাঁর কথা শুনতে রাজী নন। তিনি হতবুদ্ধির সাথেই কথা বলতে চান। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর অফিসার দুপুরদুটো অবধি অপেক্ষা করতে রাজী হলেন। নয়তো পটকান বাবুকে সমস্যায় পড়তে হবে।

কি আর করেন পটকান ঢোল। তিনি এবার সত্যিই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। তাঁর গাড়ীও নেই,গাড়ীর চালকও নেই। আর অন্যকোন গাড়িতেই তাঁর বিশাল বপু ঢুকবে না। ভেবে ভেবে যখন কোন কুলকিনারা পাচ্ছেন না, তখন তাঁর স্ত্রী হলাদিনী তাঁকে পচারকথা মনে করিয়ে দিলেন। একমাত্র পশুপতিই নাকি তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। পচাকে তিনি আজ ছুটিদিয়েছিলেন। কিন্তু কোন উপায় নেই। অতএব তিনি পচাকে ফোন করে সব জানালেন। পচা ফোন পাওয়া মাত্র তার বুলেটচেপে মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে বারুইপুর থেকে পটকানের বাড়ী পৌঁছে গেল।

পচাকে দেখে পটকান বাবু হাতে চাঁদ পেলেন। পটকান বাবুর অবস্থা দেখে পচা মানে পশুপতির খুব খারাপ লাগল। শীতকাল, তাও পটকান বা হতবুদ্ধি ঘেমে চান করে গেছেন। সে বললে-“স্যার, আপনি একটু ঠাণ্ডা হোন, আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়।কিছুক্ষণ চিন্তা করে পচা যা বললে তাতে পটকান বাবুর চক্ষু স্থির। সে পটকানের কানে কানে বললে-“স্যার, একটিই উপায় আছে।আপনার একুশতম স্বর্গরথই একমাত্র আপনাকে বৈতরণী পার করাতে পারে। আপনি স্বর্গরথের পিছনের খাঁচায় শুয়ে পড়ুন।আমি সাদা শাল দিয়ে আপনাকে ঢেকে দিয়ে এসি চালিয়ে দিচ্ছি। আর আপনার আশীর্বাদে আমি ভালই গাড়ী চালাতে পারি।এমন ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে গাড়ী চালাবো যে চোখের নিমেষে বাম্বু ভিলায় আয়কর অফিসে পৌঁছে যাব।পটকানের শুনেভিরমি খাবার জোগাড়। তিনি বললেন-“সে কি পচা, জ্যান্ত মানুষ হয়ে মড়ার গাড়িতে চড়বো ! লোকে কি বলবে ! “ পচাবললে-“কিন্তু স্যার, ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আয়কর দপ্তরের আদেশ বলে কথা। আর এই গাড়ীতে আগে কোনমড়া চড়ে নি।পটকান বললেন-“কিন্তু আমি কোনদিন আয়কর ফাঁকি দিই নি।পচা বললে-“সে সব কথা বলে আর লাভকি ! কিন্তু আর দেরী করলে দুটো বেজে যাবে আমাদের এখুনি বেরুতে হবে।

পটকান দেখলেন যে সত্যিই আর কোন উপায় নেই। অতএব তিনি আর কথা না বাড়িয়ে স্বর্গরথে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। পচা তাঁরওপরে সাদা চাদর চাপা দিয়ে যাত্রা শুরু করলো। আশেপাশের লোকের চক্ষুস্থির। পটকান বাবুর বাড়িতে কি হল ! এই সকালবেলা সবাই হৈ হৈ করতে করতে কোথায় বেরিয়ে গেল। পটকানের বাড়ির আশেপাশে দুএকজন সাংবাদিক ঘোরাঘুরিকরতো। কোন মুখরোচক খবরের আশায়। তারা সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গরথের পিছু নিল। তখন দুটো বাজতে পনের মিনিট বাকী। গাড়ীবাম্বুভিলায় ঢুকে পড়লো।

এদিকে স্বর্গরথ বাম্বু ভিলায় ঢুকছে দেখে সেই সাংবাদিকরা থ। আর সেই সাথে আয়কর দপ্তরের লোকজনও থ।বড়কর্তা থেকেশুরু করে সকলেই সচকিত। সবাই ভাবলে যে নিশ্চয় কোন বড় কর্তার মৃত্যু হয়েছে। সবাই ছুটে এল। বাম্বু ভিলার সামনে লোকেলোকারণ্য।খবর পেয়ে অনেক সাংবাদিক, আলোকচিত্রীরাও এসে হাজির।সবাই গাড়ি ঘিরে ফেলল।

কিন্তু পচা মানে পশুপতি ঘাবড়ে গেল না। সে চালকের আসন থেকে নেমে এসে স্বর্গরথের পিছনের কামরার দরজা খুলে দিল।এবার সেই ঢোলের মত বিশাল বপু আর আবলুষ কাঠের রঙের জৌলুসসম্পন্ন পটকান ঢোল ওরফে হতবুদ্ধি পাঁজা সাদা চাদরসরিয়ে উঠে বসলেন। প্রথমে অনেকে ভূত ভূত বলে চিৎকার করে উঠলো। তখন পটকান বললে – “ভয় পাবেন না, স্যার।আমি হতবুদ্ধি পাঁজা।পাঁজা এনটারপ্রাইজেস লিমিটেডেরমালিক। ভূত নই। আপনারা আমায় দুপুর দুটোর মধ্যে আসতেবলেছিলেন। দেখছেন আমার চেহারা। যে গাড়ীগুলিতে আমি চড়ি তার একটাও আজ বাড়িতে নেই অন্য গাড়িতে চড়বো কিকরে ! তাই কথা রাখতে শেষে এই স্বর্গরথে চেপে চলে এলাম।

সবাই হতবাক। এদিকে আলোকচিত্রীরা তাঁর পটাপট ছবি তুলে নিল।আর সাংবাদিকরা কালবিলম্ব না করে সব খবর তাদেরযার যার দপ্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। এর মধ্যে খবর পেয়ে বড় বড় টিভি চ্যানেলগুলো বাম্বুভিলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরুকরে দিল। মানে একেবারে হৈ হৈ ব্যাপার, রৈ রৈ কাণ্ড।

খবর পেয়ে আয়কর দপ্তরের কলকাতাস্থিত সকল বড় কর্তারা বাম্বুভিলায় এসে হাজির।যিনি আঞ্চলিক প্রধান তিনি এসে একটাবিশাল মালা হতবুদ্ধি ওরফে পটকানকে পরিয়ে দিলেন। হতবুদ্ধি বললেন-“স্যার , স্বর্গরথেই আমায় মালা পরিয়ে দিলেন।প্রধানবাবু জিভ কেটে বললেন-“লজ্জা দেবেন না, আপনিই স্যার। আমি স্যার নই। আয়কর দপ্তরের আদেশ মান্য করার জন্য, আজ আপনি যা করলেন তা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল সারা দেশের কাছে। আর আপনার মত একজন সৎ আয়করদাতাকেএইভাবে যখন তখন আয়কর দপ্তরে আসার আদেশ দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। আমাদের যে অফিসার এই অন্যায় কর্মটিকরেছেন, তাঁর প্রতি সংশ্লিষ্ট বিভাগ যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।আপনাকে আর কোনদিন আমাদের অফিসে আসতে হবে না।খুব প্রয়োজন হলে আমরাই যাব আপনার কাছে। আপনি যতই আয় করুন না কেন, কখনোই আয়করে ফাঁকি দেন না বা কোনকিছু গোপন করেন না। তাই আজ থেকে আমরা আপনাকে এক নতুন উপাধিতে ভূষিত করলাম।আয়না।আপনার মধ্যে দিয়েসমগ্র দেশ একজন সৎ মানুষের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে।চারিদিকে হাততালির হুল্লোড় বয়ে গেল। এবার প্রধান কর্তা কোথা থেকেএক বিশাল গাড়ী জোগাড় করে নিজে পটকান বাবুকে বাড়ী পৌঁছে দিলেন।তারপর বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে পটকান মানেহতবুদ্ধির সাক্ষাৎকার নেওয়া হল। তবে তিনি সব কথাতেই তাঁর সহকারী পচা মানে পশুপতি চাকলাদারের নাম করতে একটুওকুণ্ঠা বোধ করলেন না.  পরের দিন প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে পটকান এবং পচার বিশাল ছবি সহ সেই সব সাক্ষাৎকার প্রকাশিতহল। হতবুদ্ধি একজন বড় ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এবার আয়কর অফিসে তিনি যে কাণ্ডটা ঘটালেন, তার ফলে তিনিরাতারাতি ভারতবিখ্যাত হয়ে গেলেন, পচারও নামডাক কম হল না।শুনলাম হতবুদ্ধিকে নাকি পদ্মভূষণ দেওয়া হতে পারেআগামী বছরে।

     ।দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleIt is One Religion!!
Next articleশিশুর কষ্ট
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments