” পরেশ-বাবু, আপনাকে আজ সন্ধে থেকেই দেখতে পাচ্ছি বেশ আনমনা। এরকম ব্যাজার মুখ আপনার দেখতে একদম ভালো লাগে না। বৌদির সাথে কী রাগারাগি হয়েছে ? ”

” না গড়াই। আজ সকালে বাড়ি ফিরে দেখি মেয়েটার খুব জ্বর। আসার সময়ও জ্বরটা পুরোপুরি কমেনি। এদিকে আকাশে সকাল থেকেই মেঘের আনাগোনা, মেঘের চাদরের তলায় জড়োসড়ো কলকাতা শহর, সাথে পিটপিট করে বৃষ্টি। টালিগঞ্জে আমরা নতুন এসেছি তুমি জানো সেটা। তোমার বৌদির সেরকম ভাবে পরিচয় পাড়াপড়শিদের সাথে হয়নি এখনোও। তাই মনটা একটু ভারাক্রান্ত চিন্তায়। ”

” ডাক্তার দেখিয়েছেন ? ”

” হ্যাঁ ডাক্তার দেখিয়েছি। বলেছেন চিন্তার কিছু নেই, এপ্রিল-মে মাসে সিজিন চেঞ্জের সময় এরকম হয় বাচ্চাদের। এপ্রিলের গরমের মধ্যে হঠাৎ করে বৃষ্টি এসে ঠান্ডা লেগে গেছে। ”

” আপনি এক কাজ করুন, পরেশ-বাবু। একটু পরেই লাস্ট বনগাঁ লোকাল ঢুকবে। তারপর ফার্স্ট লোকাল তিন ঘন্টা পর। জিপটা নিয়ে বাড়ি চলে যান। আবার সকাল পাঁচটা / সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ চলে আসবেন। ”

” কিন্তু আমার চিন্তা এই শরণার্থীদের নিয়ে। এরা রোজ রাতে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া কোরে কিছু না কিছু ঝামেলা পাকাবেই। ” পরেশ-বাবু বলেন।

” সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই স্বাধীনতা পাওয়া-টা  যেন একটা গোদের উপর বিষফোঁড়া। স্বাধীনতা আর দেশ ভাগের সাথে সাথে এই শরণার্থী-দেরও আমাদের উপর জোর কোরে যেন চাপিয়ে দেওয়া হল। সরকারের থেকে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই এদের পুনর্বাসন করানোর। এখন আবার শুনছি জোর করে এদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হবে। যারা চিরকাল ধান চাষ করে এসেছে, নদী-নালা ভরা দেশে থেকে এসেছে – তারা কী করে ওই জঙ্গলের মতো দেশে ভুট্টা-মকাই ফলাবে। হ্যাঁ যে কথাটা হচ্ছিলো – আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি আর রতন আজকে আর ঘুমাবো না, জেগে থেকে খেয়াল রাখবো যাতে কোনো ঝামেলা না হয়। ”

” আপনি যখন বলছেন, তাহলে আমি দু-তিন ঘন্টার জন্য বাড়ি ঘুরে আসি। লাস্ট লোকালটা আসতে আরোও মিনিট পনেরো বাকি আছে। ”

” পরেশ-বাবু, আপনার বোধহয় এই নাইট ডিউটি করতে ভালো লাগে না ! নতুন বিয়ে করেছেন, ছোট মেয়ে – কী করে ভালো লাগবে ! আমার কিন্তু বেশ লাগে। আপনাকে আই-বি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফালতু এই-ঝামেলার কাজে পোস্টিং করে দিয়েছে। তবে এক বছরের জন্য, তিন মাস কেটে গেছে – বাকিটা দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ”

” আমার প্রথমে একটু খারাপ লাগতো। কিন্তু আপনাকে পেয়ে আমার এখন বেশ ভালো লাগে। আপনার এই দিনের পর দিন নাইট ডিউটি করতে অসুবিধা হয় না ? ”

” না পরেশ-বাবু। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, আর কী চিন্তা ! এখানে দু-তিন ঘন্টা গড়িয়ে নিই। সকালে ফেরার সময় একবারে বাজারটা করে বাড়ি ফিরি। চান করে জলখাবার খেয়ে টানা ঘুম। দুপুরে খেয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোই। সন্ধেবেলায় চা টা খেয়ে টিফিন ক্যারেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সংসারের বাকি সব ঝামেলা বৌ সামলায়। সুখের জীবন ! ”

” তাহলে বৌয়ের সাথে ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলেন কখন ! ”

” আপনি নতুন বিয়ে করেছেন তাই এটা চিন্তা করছেন। যখন আমার মতন বয়স হবে, সংসারের নানা ঝামেলা সামলাতে সামলাতে হেঁজিয়ে যাবেন – তখন হয়তো ফিকির আর ফাঁকফোকর খুঁজবেন কী করে পালিয়ে থাকা যায় বৌয়ের থেকে। আপনাকে আমার অভিজ্ঞতার থেকে একটা উপদেশ দিই আজ , হয়তো ভালো লাগবে না আজ শুনতে আপনার। জীবন তার নিজের মতো বয়ে চলে। জীবনের নানা অজানা পাকদন্ডী, অচেনা গলিখুঁজিতে অপেক্ষা করে হরেক বিস্ময়, নতুন অভিজ্ঞতা। আর জীবন নামক প্রবাহের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র নারী। খুব কাছের নারীও তার আঁচলে লুকিয়ে রাখে কোনও না কোনও গোপন কৌটো। সেই কৌটোর হদিশ সবসময় করতে যাবেন না, তাহলে কিন্তু  নানা অশান্তি, লেগে যাবে কথা কাটাকাটি। ”

” গড়াই, আপনি মাঝে মাঝে এমন দার্শনিকের মতো কথা বলেন – আপনাকে আমি সবসময় ঠিক বুঝতে পারি না। ”

” আপনি মন খারাপ করে বসেছিলেন, তাই একটু নানা কথা বলে চাঙ্গা করে দিলাম। এই রতন, চল তোর সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে। বনগাঁ লোকাল ঢুকলো বলে। ”

কিন্তু পরেশ-বাবু তখন জানতেন না – আজ রাতে কেন, কাল দুপুর পর্যন্ত্য ওনার আর বাড়ি ফেরা হবে না।

*****

” আমার আটকে গেছে, কাকাবাবু। ”

উদয় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার তখন ওনার ডিসপেনসারি বন্ধ করার তোড়জোড় করছেন, প্রায় রাত নয়টা বাজে। কমপাউন্ডার কিরণবাবু চলে গেছেন। দেখেন বিন্দু দাঁড়িয়ে আছে, ঘাড়-গলা উঁচিয়ে।

” এটা আবার কীরকম ভাষা রে বিন্দু ? ”

” আমি অশিক্ষিত, কোনোরকমে আট ক্লাশ পাস করেছি। এর থেকে ভালো ভাষা আর কি আসবে আমার ! মা-বাপ্ সগ্গে যাওয়ার পর থেকে দাদা-বৌদির সংসারে গতর খাটিয়ে তবে দু’বেলা কিছু জোটে। এরপর এর থেকে ভালো ভাষা মুখে আসে না। ”

” কিন্তু এসব আমাকে জানাতে এসেছিস কেন ? রাত-বিরেতে তুই কী ফাজলামো মারতে এসেছিস আমার সাথে ? ”

” কেন, আটকে গেছে – এর মানে বোঝেন না ডাক্তার হয়ে ? একমাস পেরিয়ে গেছে আমার মাসিক বন্ধ। ”

” তাতে আমি কী করবো ? ”

” যখন আমার সাথে ঢলামো করছিলেন, তখন খেয়াল ছিল না ? এখন আমি বাড়িতে দাদা-বৌদিকে মুখ দেখাবো কী করে ? কী বলবো দাদা-বৌদিকে ? ”

” মুখ সামলে কথা বলবি বিন্দু ! তুই আমার এখানে এসে, তোর বৌদির নানারকম রোগের অজুহাত নিয়ে আমাকে বিরক্ত করিস ওষুধের জন্য। বৌদির নাকি বাচ্চা হচ্ছে না, পেটে গ্যাস অম্বল হয়েছে। যখন আমার ডিসপেনসারি খালি থাকে রাতের দিকে, তখন এইসব অজুহাত নিয়ে আমার গায়ের উপর প্রায় ঝুঁকে জিজ্ঞেস করিস – কেন বৌদির বাচ্চা হচ্ছে না, একটা ওষুধ দিতে। দাদার মুখের দিকে নাকি তাকাতে পারছিস না। কিরণবাবু সাক্ষী আছেন। এখন এসে ফালতু ঝামেলা পাকাচ্ছিস এই রাতে ! আমি তোর খবর রাখি না ভেবেছিস ! বিশুর সাথে কী কম ঢলামো করিস ? ”

” এখন আপনি সব ভুলে যাচ্ছেন কাকাবাবু। দুই মাস আগে কাকিমা যখন মেয়েকে নিয়ে ওনার বাপের বাড়ি যান, তখন কী হয়েছিল মনে নেই আপনার ? ”

উদয় ডাক্তার এবার একটু ফাঁপরে পরে যান, এটা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। কথা প্রায় জড়িয়ে যায়।

” তাতে কী প্রমাণ হয় ? মনে আছে তুই আমার বাড়ি এসেছিলি বেশ রাত করে। তোর নাকি গা ম্যাজ-ম্যাজ করছে, মুখে স্বাদ নেই। ওষুধ নিতে এসেছিলি। ”

” তারপর কী হয়েছিল, মনে আছে ! আপনার মনে না থাকলে আমি বলি। সেটা ফেব্রুয়ারী মাস, হঠাৎ করে বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছিল। আপনি আমার বুক-পিঠ যন্ত্রর দিয়ে দেখে বললেন, কিছু না – একটু ঠান্ডা লেগেছে। পরেরদিন ডাক্তারখানায় এসে ওষুধ নিয়ে যেতে বললেন। আমি বেরিয়ে আসছি, তখন হঠাৎ আপনি বললেন – বিন্দু, আমার কাছে একটু রাম আছে। তোর ঠান্ডা লেগেছে, একটু রাম খেয়ে নে – আরাম লাগবে। আপনার কথা শুনে আমি আর আপনি রাম খাই। ”

” মনে আছে সেটা। কিন্তু তারপর কী হলো, আমি আর কিছুতেই মনে করতে পারিনি পরে। বোধহয় একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম, তুই আমার গ্লাসে বেশি বেশি করে ঢালছিলি আমার খেয়াল আছে। তারপর বোধহয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেক রাতে চোখটা একটু খুললে দেখতে পাই – আমি বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। তুই চলে গেছিস। ”

” আপনার কী তখন আর হুঁশ আছে ! নেশার ঘোরে আমার সর্বনাশটা করে ছাড়লেন। এবার আমি কী করি ? ”

” ঠিক আছে। আমি তোকে ওষুধ দেব। সাতদিন খাবি, যেমন বলবো – সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

” আমার মাথা খারাপ নাকি ? তারপর ওষুধ খেয়ে আমি পটল তুলি আর আপনি ঝাড়া হাত-পা হয়ে বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ান। ”

উদয় ডাক্তার বেশ একটু ভয় পেয়ে বলেন, ” তাহলে কী করতে চাস ? ”

বিন্দু এবার বেশ জোর গলাতেই বলে, ” আপনার আর কী, পুরুষ মানুষদের এটাই তো সুবিধা ! সব ঝামেলা মেয়েদেরই পোহাতে হয়। খোঁজ নিয়েছি, রানাঘাটে গিয়ে খালাস করতে হাজার টাকা মতন লাগবে। যত তাড়াতাড়ি করা যায় ভালো, দেরি করলে ঝামেলা বাড়বে। ”

গ্রামটার নাম আরাম ডাঙ্গা। রাণাঘাট থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। একশো পরিবারের বসতি বোধহয় মেরে-কেটে। উদয় ডাক্তার একটু ঘাবড়ে যান। জানাজানি হতে বেশি সময় লাগবে না।

কেচ্ছার ভয়ে আমতা-আমতা করে বলেন, ” ঠিক আছে, আমিও খোঁজ নিচ্ছি। তবে টাকাটা জোগাড় করতে কিছু সময় তো লাগবে। হাজার টাকা কম নয়। আমাকে দু’দিন সময় দে, আমি দেখছি। ”

” যা করবেন, একটু তাড়াতাড়ি করবেন। ”

তিন-চার দিন  কেটে গেছে। উদয় ডাক্তার অনেক চেষ্টা-চরিত্তির ধার-দেনা করে পাঁচশো টাকা কোনোরকমে জোগাড় করে বিন্দুকে দিয়েছেন। বিন্দু হুমকি দিয়ে গেছে যদি এক-দু’দিনের মধ্যে বাকি টাকা জোগাড় না হয়, গ্রামে তুলকালাম বাধাবে।

উদয় ডাক্তার চিন্তাগ্রস্ত মনে বসে আছেন বাড়ির বারান্দায়, সেই রাতের পর থেকে ডাক্তার খানায় আর যান না। সবাইকে বলছেন, শরীরটা ঠিক ভালো নেই।

হঠাৎ দেখেন বিশু, পাড়ার উঠতি মাস্তান, হন্তদন্ত হয়ে আসছে ওনার বাড়ির দিকে।

বিশু বেশ ঘাবড়ানো মুখ নিয়ে বলে, ” ডাক্তার বাবু, আপনি বাঁচান আমাকে। আপনার নিশ্চয়ই কোনো ওষুধ জানা থাকবে যাতে বাচ্চা গর্ভেই নষ্ট করে দেয়া যেতে পারে। ”

উদয় ডাক্তার বিশুর কথা শুনে অবাক। বিশু আবার কি বলছে ! কার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলছে !

” কি হয়েছে বিশু মাথা ঠান্ডা করে সব বল। ”

” গত তিন-চার দিন ধরে বিন্দু আমাকে বিরক্ত করে খাচ্ছে। বলছে, ওর পেটে নাকি আমার বাচ্চা। আমি বললাম, উদয় ডাক্তারের থেকে গর্ভপাত করার ওষুধ নিয়ে খেলেই ঠিক হয়ে যাবে, বেশিদিন এখনো হয়নি। কিন্তু কে শোনে আমার কথা। ওষুধ খাবে না, তাহলে নাকি ও মরে যাবে। দেড় হাজার টাকা চাইছে, বলছে রাণাঘাটে ওর কোন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করেছে। ঐ বন্ধু নাকি কয়েকবার ওর জানাশোনা ডাক্তারের থেকে অপারেশন করিয়েছে। কাল থেকে শাসাচ্ছে, পরশুর মধ্যে টাকা না দিতে পারলে – সবাইকে বলে দেবে। ওকে মদ খাইয়ে ওর অগোচরে –  ওর সর্বনাশ নাকি আমি করেছি ! বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা ! গ্রামের লোক জানলে আমার পিঠের ছাল তুলে নেবে লাঠি পেটা করে। আপনি একটা উপায় বাৎলিয়ে দিন ডাক্তারবাবু। ”

উদয় ডাক্তার এবার বেশ ভাবনায় পরে গেলেন। বিন্দু কী ওদের দুজনের সাথে খেলছে টাকা হাতানোর জন্য। মনে হচ্ছে এটা বিশুর কান্ডকারখানা। আগ বাড়িয়ে পাঁচশো টাকাটা দেওয়া ভুল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে এখন।

” ঠিক আছে বিশু, চিন্তা করার কিছু নেই। তুই বিকেলের দিকে আমার সাথে দেখা কর। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি। ”

বিকেলে বিশু আসলে, ওকে উদয় ডাক্তার দুটো পুরিয়া দিয়ে বলেন, ” এটা এলোপ্যাথিক ওষুধ। দুটো পুরিয়া দিলাম। এক নম্বরটা আজ রাতে যেমন করে হোক ওকে ম্যানেজ করে কিছু একটার সাথে গুলে খাইয়ে দিবি। আর কালকে রাতে, দুই নম্বর পুরিয়া-টা। কিন্তু খেয়াল রাখবি, দু নম্বর পুরিয়া-টা বেশি ডোজের – এক নম্বর পুরিয়া খাওয়ার পর চব্বিশ ঘন্টা পেরোলে তবেই খাওয়াতে হবে। ”

বিশু টাকার লোভ দেখিয়ে রাতে বিন্দুকে ডেকে আনে ওর বাড়িতে। ওর হাতে হাজার টাকা গুঁজে দেয়। বলে বাকিটা কালকে দেবে।

বিন্দু টাকা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করতেই, বিশু বলে, ” বিন্দু, এবার তোর ঝামেলা মিটে গেলো। একটু বসে যা, ভালো মদ জোগাড় করেছি – আংরেজি। একটু চেখে দ্যাখ। ”

আংরেজি বোতল দেখে, বিন্দু লোভ সামলাতে পারে না। টাকা দুজনের থেকেই বাগানো গেছে, বাকিটাও পাওয়া যাবে মনে হচ্ছে। একটু চেখেই দেখা যাক।

যখন বিন্দুর বেশ টলোমলো অবস্থা, বিশু দুটো পুরিয়া-ই এক ফাঁকে বিন্দুর মদের গ্লাসে ঢেলে দেয়। ভাবে, কে আবার কালকের ঝামেলায় যাবে। কিছুক্ষণ পরে বিন্দুর কথা জড়িয়ে আসে, মাটিতেই শুয়ে পরে হাত-পা ছড়িয়ে।

বিশু এই সুযোগে ওর কোমরে গুঁজে রাখা হাজার টাকাটা বের করে ফেলে।

মদ খেতে খেতে বিশু কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেই জানে না।

*****

সকালে উদয় ডাক্তার প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে বারান্দায় চা নিয়ে বসেছেন, ভাবছেন আজ ডিসপেনসারি খুলবেন। হঠাৎ দেখেন বিশু দৌড়তে দৌড়তে আসছে, মুখটায় যেন কেউ আলকাতরা লেপে দিয়েছে।

” ডাক্তারবাবু, আপনাকে এখনই আমার আস্তানাতে আসতে হবে। বিন্দুর অবস্থা ভালো দেখছি না। অসার হয়ে শুয়ে আছে, মুখ বেঁকিয়ে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে। অবস্থা ভালো বুঝছি না। ”

উদয় ডাক্তার জামা প্যান্ট গলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বিশুর ঘরে আসেন, পালস দেখেই বুঝতে পারেন – বিন্দু আর বেঁচে নেই। কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়ে দেখেন – বিন্দুর শাড়ীতে কোনো রক্তের দাগ নেই বাইরে থেকে। গর্ভপাত হয়ে গেলে শাড়ীতে রক্তের দাগ থাকা উচিৎ। কিন্তু এখন আর এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। লাশটার এখনই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, বিশু দুটো পুরিয়া-ই কালকে মদের সাথে খাইয়ে দিয়েছে। বিশুর উপর চোটপাট করতে থাকেন, কিন্তু এখন আর কী করা যাবে।

দুজনে অনেক আলোচনা করে ঠিক করেন, একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে বিন্দুকে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে রেখে – বিশু ওর  বিশ্বস্ত দুই চেলার সাহায্যে রাতের ট্রেনে রাণাঘাট থেকে বনগাঁ নিয়ে যাবে। তারপর বনগাঁ থেকে শিয়ালদাহ অভিমুখী লাস্ট লোকালে চড়ে ওরা দমদমে নেমে পড়বে। আবার ভোরের রাণাঘাট লোকাল ধরে ফেরত চলে আসবে এখানে।

প্রথম এক-দু’দিন দাদা-বৌদি খোঁজ করে বিন্দুর। কিছুদিন পর বিন্দুর বৌদি প্রভা বলে ওর দাদাকে, ” ভালোই হয়েছে আপদ গেছে। নিশ্চয়ই কারুর সাথে পালিয়েছে। ”

লোকেও আস্তে আস্তে ভুলে যায় বিন্দুর কথা। দাদা-বৌদি পুলিশে কোনো রিপোর্ট করার প্রয়োজন মনে করে না।

*****

” পরেশ-বাবু, মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। বনগাঁ লোকাল খালি হয়ে যাওয়ার পর একটা বেওয়ারিশ ট্রাঙ্ক পাওয়া যায়। রতন খুলে দেখে, ভিতরে একটা মেয়ে – দয়ের মতন করে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে রাখা। মুখ পুরো বেঁকে গেছে। একটা বাজে পঁচা পঁচা গন্ধ বেরোচ্ছে। মনে হয় বেঁচে নেই। ”

এ আবার কী উটকো ঝামেলায় পড়া গেলো ! ট্রাঙ্কটা গড়াইকে অফিসে নিয়ে আসার অর্ডার দিয়ে, পরেশ-বাবু লালবাজারে ফোন করেন হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে।

সকাল পাঁচটায় রথীন-বাবু চলে আসেন দল-বল নিয়ে। পরেশ-বাবুর চেনা, ওনার অধীনে আগে কাজ করেছেন।

ফটো যদিও তোলা হলো, কিন্তু মুখটা এমন বিশ্রী ভাবে বেঁকে গেছে – ফটো দেখে কেউ চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ।

রথীন-বাবু বলেন, ” একমাত্র যদি শাড়ী দেখে কেউ চিনতে পারে। কারণ শাড়ীটাতে বেশ ফুল ফুল ছাপ আছে, বেশ জমকালো শাড়ী। এটাই একমাত্র ভরসা মনে হচ্ছে, পরেশ-বাবু। ”

লাশ পোস্ট মর্টেমে পাঠানো হয়। পেটে মদের রেশ পাওয়া যায়, তার সাথে মিফেপ্রেক্স জাতীয় ওষুধের কণা। এই ওষুধটা গর্ভপাত করানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মেয়েটা অন্তঃসত্তা ছিল না। তাহলে কেন এই ওষুধের কণা ওর পেটে পাওয়া যায়, এটাই রথীন-বাবুকে চিন্তিত করে ফেলেছে। কোনো ডাক্তার জড়িত থাকতে পারে বলেও রথীন-বাবুর মনে আসে। ওষুধটা মদের সাথে রিঅ্যাকশন করে এই বিপদটা ঘটিয়েছে বলে পোস্টমর্টেমের রায়, এবং ওষুধের ডোজ বেশ অনেকটাই ছিল প্রয়োজনের চেয়ে ।

রথীন-বাবু বনগাঁ অঞ্চলে পরেশ-বাবুর সাথে চষে বেড়ান, সব ধোপাখানাতে শাড়ীটা দেখান। অনেক স্থানীয় ডাক্তারের সাথে কথা বলেন, মেয়েটার ছবি দেখান – কিন্তু কোনো হদিশ পান না। এদিকে যুগান্তর, আনন্দবাজার সব পেপারে মেয়েটার ছবি, শাড়ীটার আলাদা করে ছবি দেওয়া হয়েছে।

কয়েকমাস কেটে গিয়েছে। আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। রথীন-বাবু, পরেশ-বাবু দুজনেই হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নিয়মিত কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন।

রাণাঘাটে বিষ্ণু ধোপা একদিন ইস্তিরি করা কিছু কাপড় ডেলিভারি করার জন্য একটা পেপারে মুড়তে গিয়ে হঠাৎ করে বিন্দু আর ওর পরিহিত ফুল ফুল ছাপ দেওয়া শাড়ীটা চোখে পড়ে। শাড়ীটা চেনা চেনা ঠেকে। আরে এটা তো প্রভা বৌদির শাড়ী ! বিষ্ণু ধোপা তো চিরকাল ওদের বাড়ির কাপড় কাঁচে, ইস্তিরি করে। প্রভা বৌদি যখন আরাম ডাঙ্গা থেকে ওনার বাপের বাড়ি রাণাঘাটে আসেন, বিষ্ণু তখন ওনার কাপড়ও কেচেছে। বিষ্ণু এবার নিশ্চিত এটা প্রভা বৌদির শাড়ী। শাড়ীটা দেখলেই চিনতে পারবে। শাড়ীর কোণাতে ‘বি’ ছাপ থাকবে কালো কালী দিয়ে। কিন্তু মেয়ের ছবিটা প্রভা বৌদির নয়। একবার সন্দেহ হয় – এটা ঐ শাড়ীটাই, আবার একবার ভাবে বোধহয় ভুল করছে। একইরকম দেখতে কত শাড়ীই তো হয়।

কিন্তু মন থেকে কিছুতেই সন্দেহটা সরাতে পারে না। পেপারে দিয়েছে, শাড়ী অথবা মেয়েটাকে সনাক্ত করলে হাজার টাকা দেবে।

শেষ পর্যন্ত্য বিষ্ণু ধোপা চলে যায় শেয়ালদহ স্টেশনে, দেখা করে পরেশ-বাবুর সাথে। শাড়ীটা দেখেই চিনতে পারে, ‘বি’ ছাপটাও দেখতে পায়।

পরেশ-বাবু সাথে সাথে রথীন-বাবুকে ফোন করেন। বিষ্ণুর সাথে কথা বলে, তখনি ওনারা বিষ্ণুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আরাম ডাঙ্গাতে যান। বিন্দুর দাদা-বৌদির সাথে কথা বলে জানতে পারেন, বিশুর সাথে বিন্দুর বেশ ভালোই মাখামাখি ছিল। বিশুকে একটু চাপ দিতেই সব কিছু উগলে দেয়। উদয় ডাক্তারের  নামও বেরিয়ে আসে তদন্তে। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। বিন্দুর উদ্দেশ্য ছিল উদয় ডাক্তার আর বিশুর উপর চাপ সৃষ্টি করে টাকা কামানোর, ওদের কিছু মুহূর্তের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।

কিন্তু অপরাধ অপরাধই।

উদয় ডাক্তার আর বিশু – দুজনেরই  বিরুদ্ধে প্রযোজ্য করা হয় –  ধারা ৩১৪ (গর্ভপাতের অভিপ্রায়ের কর্ম – মৃত্যুতে পরিণতি), ৩০৭ (মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা), ২০১ (মৃতদেহ বিলুপ্ত অথবা লুকোনোর চেষ্টা / সাহায্য করা)।

                                                                      *****

নোট : এই ঘটনাটা বাবার চাকরি জীবনে ঘটেছিলো ৬০ দশকের প্রথম দিকে, যখন আমার জন্ম হয়নি। দিদির কাছে শোনা, তার উপর একটু রঙ চড়িয়ে গল্পটা লেখা।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleইচ্ছে করে
Next articleলক্ষ্ণণের গণ্ডী।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments