দিদার কোলে সেদিন রাতে বসেছিলেম যবে,
বাবা এলেন ঘরের মাঝে – গুরুগম্ভীর রবে
শুধান আমায়– “কি খোকন,পরীক্ষায় কি হবে !
এমন করে চললে তুমি রসগোল্লাই পাবে।
সারাদিনই উড়ছো খালি–কেবল গল্প, খেলা,
আর ঘুমে দুচোখ ঢুলঢুলু ঠিক পড়ার বেলা।
লেখাপড়ার নামটি নেই–সব জলান্জলী,
ঠাকুরমার কোলে বসে ঠাকুরদাদার ঝুলি।”
“আমার কাছে এসে এখন ছয়ের নামতা পড়ো-“
“ছয় এক্কে ছয় আর ছয় দুগুণে বারো–
তিন ছয় তিন ছয়”-যেই না গেছি আটকে,
বাবা অমনি চেয়ার থেকে উঠেই পড়েন ছিটকে।
কান দুটোকে পাকিয়ে বুঝি ঘাড়টা দেবেন মটকে,
“ছয়ের নামতা ভুলে গেছ–মনে আছে কি শটকে !”
“তোমার জন্যে ছেলেটার এমনতরো হাল,
দিদার দিকে তাকিয়ে থাকেন–রেগেই বুঝি লাল।”
শব্দ পেয়ে ওঘর থেকে ছুটে আসেন দাদু,
“কি হল কি–চেঁচামেচি করছ কেন যাদু !
আমার দাদুর গায়ে তুমি হাত তুলেছ আজ !”
সারা বাড়ি রটলো খবর–বিনা মেঘেই বাজ।
বলেন দাদু – “সত্যি যাদু তোমার সাহস দেখে,
আশ্চর্য হচ্ছি আমি কেবল থেকে থেকে ।”
দিদা বলেন – “ঠিক বলেছ–এর বিচার চাই,
পড়াশুনা করবে না আজ আমার দাদুভাই।”
জেঠু আসেন, জেঠী আসেন, আসেন সাথে কাকী,
জেঠু আমার আদালতের বিচারপতি নাকি।
বলেন – “যাদু,ভঙ্গ তুমি করলে চারশ কুড়ি,
এ ব্যাপারে দেশের আইন–বড্ড কড়াকড়ি।”
কাকা আবার পুলিশ কর্তা–এলেন লাঠি হাতে.
ভাবটা এমন বাবাকে বুঝি জেলেই দেবেন রাতে।
জেঠু বকেন, জেঠী বকেন, বকেন কাকী, কাকা,
বাবার তখন করুণ দশা–দেওয়ালে পিঠ ঠেকা।
ভাই বোনেরা তুতো যত ঘরের মধ্যে সব,
সারা বাড়ী সরগরম–কি হৈ চৈ রব।
“ঘাট হয়েছে আর কোনদিন আসব না এই ঘরে,
কত ধানে কত চাল বুঝবে ব্যাটা পরে।”
দাদু বলেন – ঠিক বলেছ–তুমি কুলাঙ্গার,
ঐটুকু ঐ রোগা ছেলের হাড় কখানা সার।
মা মরা ঐ শিশুর জন্য হয় না তোমার মায়া !”
বাবার দুচোখ জলে ভরা–বিষাদসিন্ধু ছায়া।
জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিলেন ওষ্ঠ,
কত দিনের কথা তবু আজও মনে স্পষ্ট।
মায়ের সঙ্গে দেখা আমার হয়নি জন্ম থেকে,
মা নাকি মোর থাকেন দূরে নীল আকাশের বুকে।
দাদু দিদা জেঠু জেঠী কাকা কাকীর স্নেহ,
বুঝতে আমায় দেন নি কভু মায়ের অভাব কেহ ।
বাবা ছিলেন রাশভারী–চিকিৎসক এক নামী,
ভয়ে পেতেম তাঁকে খুবই–যেতেম কাছে কম–ই।
কিন্তু তাঁর স্নেহ ছিল ফল্গুনদীর ধারা,
তিনিও যবে চলে গেলেন–আমি পাগল পারা।
“আমিও যখন যাব ওই দূর আকাশের বুকে,”
বলেছিলেম – “ভগবান, নেবই তোমায় দেখে।”
বয়স তখন আমার কত–হয়ত বারো মোটে,
সে রাতের স্মৃতি আজও উজল মনের পটে।
বাবার তখন অসুখ ভারী–ভর্তি হাসপাতালে,
আমার থেকে লুকিয়ে সবাই চোখের জল ফেলে।
ঘুমিয়ে ছিলেম দিদার খাটে–পাশেই তিনি বসে,
হঠাৎ দাদু জড়িয়ে নিলেন চোখের জলে ভেসে।
জেঠু,জেঠী,কাকু,কাকী ভাইবোনেদের ভীড়ে,
এক নিমেষে বুঝে গেলেম সেদিন কেমন করে,
বাবাও আমার হয়ে গেছেন নীল আকাশের তারা,
মায়ের সাথে এবার তাঁর নিত্য ঘোরাফেরা।
আজ ত’ তাঁরা কেউই নেই–সবাই অস্তাচলে,
আছি কেবল ক’ ভাই বোন স্মৃতির উজান তুলে।
ভাগ্যে আমি জন্মেছিলেম যৌথ পরিবারে,
দাদু,দিদা,জেঠু, জেঠী, কাকা, কাকীর ঘরে,
পেয়েছিলেম আমি তাঁদের অপার ভালবাসা,
বাবার মত তাই আমারও ডাক্তারীটাই পেশা।
মিলিয়ে গেছে হারিয়ে গেছে যৌথ পরিবার,
সিন্ধু থেকে বিন্দু হয়ে খুঁজে পাওয়াই ভার।
একান্ন নেই শতকিয়ায়–পৃথক পৃথক অন্ন,
বৃদ্ধাশ্রম এখন কেবল দাদু দিদার জন্য।
আজকে শিশুর জীবনধারায় বুঝি অনেক খাদ,
পেল না কেউ এমনতরো ভালবাসার স্বাদ।
কোথায় এহেন খুশী,মজা,আনন্দ সিঞ্চন !
বিন্দু বিন্দু পরিবারে প্রীতির আকিঞ্চন ।
রাতের বেলায় যখন তাকাই নীল আকাশের পানে,
তখন বুঝি অনেক তারা আমায় ফেলে চিনে।
হাতছানিটি দিয়ে যেন তারা আমায় ডাকে,
হয়তো তাঁরা লুকিয়ে আছেন সেসব তারার বাঁকে।
তারার দল মিটমিটিয়ে যখন দেখি হাসে ,
তাঁদের সেই মুখগুলি সব আমার চোখে ভাসে।
আমিও যেদিন দূর আকাশে মেলেই দেব পাখা,
সেদিন হবে মায়ের সাথে আমার প্রথম দেখা ।
সেই দিনটির তরেই আমার যতেক অপেক্ষা,
বলবো তাঁরে – “তোমার কাছেই মাগো আমার দীক্ষা।
গর্ব করার শিক্ষা দিলে আমায় গর্ভে ধরে,
কেমন করে চলতে হয় যৌথ পরিবারে।”
যে পরিবার হারিয়ে গেছে অসীম অন্তরালে,
যেথা দাদু দিদা জেঠু জেঠী ছিলেন সদলবলে।
আজ ঐকতানের বেসুর গানে বিভেদ রাগের সৃষ্টি,
মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেছে–স্বার্থান্ধের দৃষ্টি,
পরিবারের সংজ্ঞাটাই বদলে গেছে বুঝি,
সবার মাঝেই লক্ষ্মণের গণ্ডী সোজাসুজি।
——————————————————————
স্বপন চক্রবর্তী।