গভীর রাত্রি তাল তমালে ঘেরা জমিদার বাড়ির বাগানে এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার তদকালীন চব্বিশ পরগণার রাজপুর এলাকারপ্রবল প্রতাপী জমিদার দুর্গাচরণ কর চৌধুরী তাঁর ঘরে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তদকালীন বলছি কারণ ঘটনাটি ঘটেছিল একশতাব্দীরও বেশী আগে।  হঠাৎ তাঁর ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছে ! দুর্গাচরণের ঘুমটাভেঙে গেল।  তিনি দেখলেন অপরূপ রূপে সজ্জিতা এক নারীমূর্তি তাঁর সম্মুখে আবির্ভুতা। সেই নারী মূর্তিই তাঁকে ডাকছেন।ওঠ দুর্গা ওঠ, আমাকে এবার তোর কাছে নিয়ে আয় ! আর যে গঙ্গার স্রোতের সাথে ভেসে চলতে পারি না রে।

দুর্গা জিজ্ঞাসা করলেন-“ কে মা তুমি !“

আমায় চিনতে পারছিস না, দুর্গা। সন্তান হয়ে তুই মা কে চিনলি না ! ওরে আমি মা মহামায়া। আর কতদিন আমি এই গঙ্গায়ভেসে ভেসে বেড়াব, বল তো ! গঙ্গা তার স্রোত বদল করে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে আর আমাকেও সেই সাথে ভাসিয়ে নিয়েচলেছে। শোন্ তোর বাড়ির কাছ দিয়ে এখনো গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে।ঐ গঙ্গার পূর্ব পাড়ে আমার জন্য তুই একটা মন্দির গড়ে দিয়েসেখানে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবি। এই বলে মা হাত দিয়ে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে একটি জায়গা জমিদার দুর্গা কর চৌধুরীকে দেখিয়েবললেন, বেহুলা ঘাটের কাছে একটি বড় নিম কাঠের গুঁড়ি পাবি, তা দিয়েই যেন আমার মূর্তি গড়া হয়। আমি মা মহামায়া,  জগতের মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই আমার আবির্ভাব। আমি যদি গঙ্গার মাঝে আবদ্ধ থাকি তাহলে তোদের মুক্তি হবে কেমনকরে ! যা বললাম, সেই অনুযায়ী কাজ করলে তোর কল্যান হবে।এই বলে মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

দুর্গার দু চোখে জল তিনি চিৎকার করে উঠলেন– “ তাই হবে মা, তোমার এই সন্তান চিরকাল তোমার সেবা করে যাবে।এদিকেতাঁর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে তাঁর বোন ছুটে এলেন। সেই সময় দুর্গার স্ত্রী কদিনের জন্য পিতৃগৃহে গিয়েছিলেন। দুর্গাবললেন-“ ওরে নিভা, মা আসছেন আমাদের কাছে।নিভা বললেন-“ কি বলছ দাদা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।তুমিবোধহয় কোন স্বপ্ন দেখেছ।জমিদার বললেন-“ স্বপ্ন নয় রে, এক অদ্ভুত সত্য। তুই এক কাজ কর, এখুনি কারোকে দিয়ে খবরপাঠা। অনন্ত আর জীবন যেন অবিলম্বে আমার সাথে দেখা করে।  যা দেরী করিস না।নিভা কিছু বুঝতে না পারলেও দাদাকেঅমান্য করার সাহস তার ছিল না। সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অনন্ত আর জীবনকে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।

অনন্ত আর জীবন ছিল জমিদার দুর্গা কর চৌধুরীর বিশ্বস্ত দুই অনুক্ষণের সহচর। জমিদার বাড়ির প্রধান ফটক সংলগ্ন যে দেউড়ি,তার একেবারে দুপাশের দুটি ঘরে তারা থাকতো। অত্যন্ত ক্ষিপ্র এবং সুনিপুণ দুই লাঠিয়াল। খবর পাওয়া মাত্র তারাদুর্গাচরণের কক্ষে হাজির।

হুঁজুর, হুকুম করুন।”-অনন্ত সেলাম জানাল তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জমিদারকে।

যা, তোরা অবিলম্বে দেওয়ানকাকাকে  নিয়ে মন্ত্রণাকক্ষে চলে আয়।”-

কোন বাকব্যয় না করে অনন্ত আর জীবন ঘোড়ায় চেপে মুহুর্তের মধ্যে দেওয়ানের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। দেওয়ানসূর্যশেখর থাকতেন জমিদার বাড়ী থেকে আধক্রোশ দূরে। খবর পেয়ে তিনি দুই লাঠিয়ালের সাথে অনতিবিলম্বে বড়বাড়িরমন্ত্রণাকক্ষে এসে উপস্থিত হলেন। তিনজনের মনেই অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু জমিদারের আদেশ সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করা ছিলনিতান্তই রীতিবিরুদ্ধ।

জমিদার দুর্গাচরণ মন্ত্রণা কক্ষে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছিলেন। দরজার আওয়াজ পেয়ে তিনি দেখলেন সকলে হাজির।অনন্ত আর জীবন অভ্যাসগতভাবেই দরজার বাইরে চলে যাচ্ছিল। দুর্গাচরণ ইশারায় তাদের থামতে বললেন। তারা কিছুটাঅবাক হয়ে গেল। এরকম কখনও হয় না।

এত রাত্রে সকলকে ডেকে পাঠানোর জন্য আমি দু:খিত। কিন্তু আমি যে নিরুপায়। স্বয়ং মা মহামায়া আমায় আদেশদিয়েছেন।”-দুর্গাচরণের কণ্ঠে যেন আকুতি ঝরে পড়ল। এই বলে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা তিনজনের কাছে খুলে বললেন।অনন্ত আর জীবন খুব আশ্চর্য হল।  সুর্যশেখর ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক , ঈশ্বরবিশ্বাসী। অশ্রুবিগলিত ধারায় তিনি বললেন– “মা নিজে আসতে চেয়েছেন তোমার কাছে। পরম সৌভাগ্য। বাবা দুর্গাচরণ , আমাদের দেরী করা কখনই উচিত নয়।দেওয়ান সূর্যশেখর দুর্গাচরণের বাবার আমল থেকেই দেওয়ানী পদে বহাল। বর্তমান জমিদার দুর্গাচরণ তাঁর থেকে বয়সেঅনেক ছোট। তিনি  তাঁর দেওয়ান কাকাকে গভীর শ্রদ্ধা করেন।

অতএব চারজনের মধ্যে গভীর শলাপরামর্শ হল। পরদিন ভোরের আলো দেখা দিতেই লোকজন নিয়ে যথাস্থানে বেহুলা ঘাটেরকাছে উপস্থিত হলেন দুর্গা। হতবাক হয়ে সকলে দেখলো যে গঙ্গার জলের স্রোতে একটি নিম গাছের বেশ মোটা গুঁড়ি ভেসেআসছে। সবার মুখেমা মাধ্বনি। ঢাক ঢোল কাঁসর বাদ্যিতে চারিদিক মুখর হয়ে উঠল। জমিদার আদেশ দিলেন গুঁড়িটিকে তীরেএনে তুলতে। তারপর মোটা গুঁড়িটি গঙ্গার পূর্ব পাড়ে স্বপ্নাদিষ্ট মন্দির নির্মাণের স্থানে নিয়ে এসে রাখা হল। একইসঙ্গে জঙ্গল কেটেমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেল। সমতল ছাদের গর্ভমন্দিরের উপর আটচালা অবলম্বনে নির্মিত হল চূড়া। মন্দিরদেওয়ালের রং টকটকে লাল। সবই মায়ের নির্দেশে। কিন্তু একটি কাঠের গুঁড়িতে মায়ের মূর্তি কিভাবে নির্মিত হবে আর কেমনই বাহবে সেই মূর্তি আর কে বা নির্মাণ করবে ! দুর্গা মায়ের আরাধনায় বসলেন। বললেনমা, তুমিই বলে দাও, কি রূপে তুমিবিরাজিতা হবে ! “

রাত্রে মা আবার দুর্গাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন-“চিন্তা করিস না। আমার মূর্তির রঙ হবে কাঁচা হলুদের মত। মাথার চুল পিঠছাড়িয়ে যাবে মাথায় থাকবে সোনার মুকুট, হাতে গলায় সোনার অলংকারও যেন শোভা পায়।এ ছাড়া দু হাতে থাকবে সুন্দরকারুকার্য করা শাঁখা। এক মনোহরা রঙিন শাড়ি পরিয়ে আমাকে একটি লাল রঙের বেদির উপর অধিষ্ঠিত করবি। আর মন্দিরেরদেওয়ালের রঙও হবে লাল। আমি মা মহামায়া তোর গৃহে দশভুজা নয়, দ্বিভুজা হয়ে তোদের কন্যারূপে পূজা পেতে চাই। তোদেরকোন মেয়ে নেই আমি তোদের সেই সাধ পূরণ করবো। কিন্তু সাবধান, হাত দুটিতে যেন কোনো অস্ত্র না থাকে আর আমারকোনো বাহনেরও প্রয়োজন নেই। আমি যে তোর গৃহস্ত ঘরের এক  সধবা মেয়ে রে।মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দুর্গার দুচোখের জলযেন বাঁধ মানে না। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে তাঁর স্ত্রী পিতৃগৃহ থেকে রাজপুরে ফিরে এসেছেন। তিনিও সেই রাত্রে স্বপ্নের মধ্যে মাকেদর্শন করলেন।

চতুর্দিকে ঢ্যাঁড়া পেটান হল। অনেক কারিগর হাজির হলো। কিন্তু মায়ের এই রূপ গড়তে হবে শুনে সবাই পিছিয়ে গেল।অর্থের প্রলোভন থেকে ভয় দেখানো কিছুই বাদ গেল না। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। কেউ রাজী হলো না। তাহলে কি হবে ! কিভাবে মায়ের মূর্তি গড়া হবে ! কিন্তু জমিদার দুর্গাচরণ একেবারেই নিশ্চিত

ছিলেন যে যখন তিনি মায়ের আদেশ লাভ করছেন , তখন সব বাধাই অতিক্রান্ত হবে এবং খুব শীঘ্রই।

হঠাৎ একদিন এক বলিষ্ঠ চেহারার তরুণ এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলো। দেখলেই বোঝা যায় সে বাংলার মানুষ নয়। তারকথায় উত্তর ভারতের টান।

সে ভাঙা বাংলায় দুর্গাচরণকে বললো -“ঠাকুর সাহেব(উত্তর ভারতের লোকেরা জমিদারকে ঠাকুর সম্বোধন করে) আমারবাড়ী বারাণসী। সমাচার মিলল যে এখানে মা দুর্গার মূর্তি তৈয়ার করতে হবে। আমি করবো লেকিন কুছ শর্ত্ আছে।

জমিদার বললেন-“কি শর্ত ! “

হুঁজুর , আমি মন্দিরের ভিতর মূর্তি গড়বো এক মাহিনা পুরা লাগবে। মন্দিরের দরওয়াজা এই এক মাহিনা বন্ধ থাকবে।চাবি ভি হামার কাছে থাকবে। আর হামাকে কুছু শুধানো ভি চোলবে না। আমি কারো সাথে দেখা ভি কোরবো না, কোথা ভিবোলবো না। আর হামাকে কাম শুরু হোনে কা পহেলে আগাম সাতঠো সোনাকা রূপাইয়া দিতে হোবে। যদি রাজী থাকেন বোলেন।মন্দিরের পাশে হামার থাকবার ভি বন্দোবস্ত কোরে দিতে হবে। আমি নিরামিষ আহার করি। আপনা হাত সে রান্নাভি করি। সব কুছু ব্যবস্থা আপনাকে কোরে দিতে হোবে। আর এক মাহিনা বাদ আগলা মাঘী পূর্ণিমা কা দিন মায়ের পূজাশুরু হোবে।কিন্তু কোন শর্ত ভঙ্গ্ হোলে কাম অধুরা রেখে চলে যাবো।

তরুণটির কথায় দুর্গাচরণ এবং তাঁর দেওয়ান সূর্যশেখর প্রথমে কিছুটা পিছিয়ে গেলেও পরে রাজী হয়ে গেলেন। কারণ আরউপায় নেই। মাকে মনে মনে স্মরণ করে আর অনন্ত জীবনের ওপর সংগোপনে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখারনির্দেশ দিয়ে জমিদার দুর্গাচরণ তরুণটির সমস্ত শর্ত মেনে তার হাতে মায়ের মূর্তি গড়ার ভার অর্পণ করলেন

সব বন্দোবস্ত করে মায়ের মূর্তি নির্মাণের কাজ শুরু হতে আরো দুদিন দেরী হলো। জমিদার দুর্গাচরণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষাকরতে লাগলেন মাঝে মাঝে অনন্ত আর জীবনের কাছে তিনি খোঁজ নেন, কিন্তু তাদের কথায় কোন আশার আলো চোখেপড়ে না। তারা বলে যে কারিগরটি নাকি সারাদিন মন্দিরে ভিতর ঢোকেই না। তবে ! সে কি রাত্রে কাজ করে ! কে জানে ! অনেক কষ্টে জমিদার এবং জমিদার গিন্নী তাঁদের কৌতুহল দমন করে রাখলেন।

এইভাবে প্রায় একমাস অতিক্রান্ত। আর দুদিন পরেই মাঘী পূর্ণিমা জমিদার দুর্গাচরণের যেন আর তর সয় না। সেদিনসন্ধ্যায়ই সেই তরুণটি জমিদারের সঙ্গে দেখা করতে এল।

ঠাকুর সাহেব, মায়ের মূর্তি তৈয়ার হয়ে গেছে। তবে পরশু সকালের আগে মন্দির কা দোরওয়াজা খুলবেন না।আভি পূজাকাবন্দোবস্ত করেন।এই বলে সে চলে গেল।

দেখতে দেখতে রবিবার মাঘী পূর্ণিমা তিথি এসে গেল।সস্ত্রীক জমিদার সদলবলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে মন্দিরের সামনে এসেহাজির হলেন। সর্বাগ্রে তাঁর কুলপুরোহিতের  উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ। তরুণ সেই ভিনদেশী কারিগরটি মন্দিরের দরজারচাবিটি দুর্গাচরণের হাতে তুলে দিল।

ধীরে ধীরে মন্দিরের দরজাটি খুলে গেল। মনে হল যেন আপনা আপনি দরজাটি উন্মুক্ত হচ্ছে সবাই কেমন হতচকিত।এবার মায়ের অনিন্দ্যবরণা মূর্তি দেখে সকলে আপ্লুত। কিন্তু একি ! মায়ের মাথায় সোনার মুকুট, মায়ের গায়ে এত গহনাসব কোথা থেকে এল ! জমিদার দুর্গাচরণ চারিদিকে তাকিয়ে সেই তরুণ কারিগরটিকে আর খুঁজে পেলেন না। সঙ্গে সঙ্গেতিনি বিভিন্ন দিকে লোক পাঠালেন, কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। যেন সে ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে।দুর্গাচরণ বুঝতে পারলেন সবই মায়ের কৃপা। মা অলক্ষ্যে থেকে তাঁর সমস্ত কাজ করিয়ে নিয়েছেন। তবে সেই তরুণকারিগরটি কে ছিলেন ! তিনি কি স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। হয়ত তাই হবে। দুর্গাচরণের কপোল বুঝি অশ্রুতে বাণভাসি।ধুমধাম করে মায়ের পূজা শুরু হয়ে গেল।

দিন যায় , মাস যায়, বছরও ঘুরে যায়। দুর্গাচরণের জমিদারী তথা আর্থিক স্থিতির উন্নতি ক্রমবর্ধমান।

বহু দূর দূর থেকে ভক্তরা এসে মায়ের কাছে তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য মন্দিরের গায়ে লাল সুতো বেঁধে মানত করতে থাকে।তাদের মনস্কামনা পূরণও হয়। চতুর্দিকে মায়ের মহিমাও প্রচার হতে থাকে।

অগণিত কিংবদন্তী কাহিনী মা মহামায়ার এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে। আজও সে সব কাহিনী শুনলে যেন সারাশরীরে শিহরণ জাগে। মায়ের এমনই মাহাত্ম্যের এক কাহিনী আজকের আধুনিক যুগের মানুষ শুনলে হয়ত থমকে যাবেন।

আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগের কথা। তখন এই মন্দিরের চারদিকে ছিল কেবল চাষের জমি। এই অঞ্চলের মানুষেরএকমাত্র জীবিকাও ছিল চাষবাস। একদিন ভোরে চাষের খেতে গিয়ে এক চাষী দেখে এক মহিলা কারোকে কিছু না বলে চাষেরক্ষেত থেকে মটর কলাই শাক তুলছে। তার পরণে রঙিন শাড়ী , গায়ে গহনা , ঘোমটার মধ্যে দিয়ে সেই মহিলার কপালে বিরাটসিঁদুরেরটিপটিও দেখা যাচ্ছিল।সে যে একজন সধবা রমণী তা বুঝতে চাষীটির কোন অসুবিধা হলো না।সে জিজ্ঞাসা করলো-“কেমা তুমি ! এত ভোরে চাষের ক্ষেত থেকে মটর শাক তুলছো ! আমার ঘর তো কাছেই মা। আমাকে বললে কি আমি তোমায় দিতামনা ! “  কিন্তু সেই নারী তার কথার উত্তর না দিয়ে একদৌড়ে মায়ের মন্দিরে গিয়ে ঢুকে পড়লো।

চাষীটি খুব অবাক হয়ে গেলো। সে আর কালবিলম্ব না করে মন্দিরের সেবায়েতের বাড়ি গিয়ে সমস্ত কথা খুলে বললো। কিন্তু বৃদ্ধসেবায়েত চাষীর কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না। তিনি যে গত রাতেও পুজো করে যথারীতি মন্দিরের দরজায় তালা দিয়েএসেছেন। তাহলে কি করে এটা সম্ভব ! তিনি চাষীটিকে বললেন– “হয় ঘুমের ঘোরে, নয় নেশার ঘোরে তুই এসব অদ্ভুত দৃশ্যদেখেছিস কিন্তু চাষী তা মানতে রাজী নয়। অবশেষে চাষীর জোরাজুরিতে মন্দিরের সেবায়েত আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়েমন্দিরে গেলেন। মন্দিরের দরজার তালা দেওয়া। তিনি বললেন-“ দেখলে সবাই মন্দিরের দরজা তালাবন্ধ। কেমন করে বন্ধদরজার ভিতর দিয়ে কেউ মন্দিরে ঢুকতে পারে ! “ কিন্তু চাষীও দমবার পাত্র নয়। তার জোরাজুরিতে এবার সেবাইত রাগে গজরাতেগজরাতে দরজার তালা খুলে দিলেন। কিন্তু মন্দিরের ভিতরের দৃশ্য দেখে তাঁর বাকরুদ্ধকর অবস্থা। অন্যদের দশাও তথৈবচ।সবাই দেখলেন মায়ের বেদির উপরে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক গোছা মটর শাক।সকলেই বুঝতে পারলেন মা মহামায়া এবারঅন্নগ্রহণের অভিলাষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মটর শাক খেতে ইচ্ছে হয়েছে। তাই তিনি নিজেই চাষীর ক্ষেত থেকে মটর শাকতুলছিলেন। চাষীটি আর অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না।তার ক্ষেতে মায়ের চরণচিহ্ণ পড়েছে। যে ! এদিকে সেবাইত এসে চাষীরকাছে বারবার ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। এতদিন দুবেলা মায়ের সেবা করে তিনি যা সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন নি, এইচাষীটি আজ সেই পুণ্য দর্শন করেছে। চাষী তাঁর থেকে অনেক পুণ্যবান আর সৌভাগ্যবান বটেই তাঁর আক্ষেপ যেন আরশেষ হয় না।

চারিদিকে নিমেষেই সেই খবর রটে গেল। স্বয়ং জমিদার এসে চাষীকে আলিঙ্গন করলেন আর সেই থেকে মায়ের দুই বেলা ভোগদেওয়া শুরু হল। চাষীরাও তাদের প্রথম ফসল মাকে দিয়ে তারপর বাজারে গিয়ে বাকী আনাজ বিক্রয় করত। পরবর্তীকালেভক্তরা গর্ভগৃহের পাশেই বেশ বড় নাটমন্দির এবং ডান পাশে ভোগ রান্না করার ঘর নির্মাণ করে দেন। আজও সেগুলি বর্তমান।

আজ আর সেই জমিদারী প্রথা নেই। কালের বিবর্তনে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে মন্দির প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকে আজঅবধি মায়ের সেবার কোন ত্রুটি ঘটেনি। আজও মন্দিরের উৎসবকে কেন্দ্র করে বিরাট মেলা বসে এখানে। হাজার হাজারদর্শনার্থী সেসময় মন্দিরে এসে ভক্তিভরে মায়ের আরাধনা করেন।

অনেককাল আগে এই মন্দিরের পাশ দিয়ে মা গঙ্গার ধারা বয়ে যেত। এই পবিত্র ধারার তীর ধরে শ্রীচৈতন্যদেব কয়েকজন সঙ্গীনিয়ে কৃষ্ণ নামে উত্তাল হয়ে তাঁর হরিনাম বিলোতে বিলোতে রাজপুর, বারুইপুর, মথুরাপুর হয়ে শ্রীক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন। মাগঙ্গা এখন আর নেই বটে তবে জায়গায় জায়গায় রেখে গেছেন তাঁর অতীত চিহ্ন। সেগুলিই বর্তমানে আদি গঙ্গা নামে অভিহিত।গঙ্গার এরকম একটি চিহ্ন রয়েছে যেটিমহামায়ার ঘাটনামে স্থানীয় মানুষের কাছে আজ পরিচিত। সেই আদি গঙ্গার পূর্ব দিকেইমা মহামায়ার মন্দির অবস্থিত।

মন্দির অঙ্গনের মাঝখানে একটি বিশাল শিলা আছে। বলা হয়ে থাকে যারা তুলতে পারেন এই শিলাটি তাঁরা নাকি খুবইভাগ্যবান। অনেকে তুলতেও পারেন। আর যাঁরা তুলতে পারেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সৌভাগ্যবান। মায়ের মন্দিরের আগেই একটিপ্রাচীন শিবমন্দির দেখা যায় যদিও কিভাবে এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল সে বিষয়ে ইতিহাস নীরব। কিন্তু মা মহামায়ার দেউলযেখানেই অবস্থিত, তার আশেপাশে দেবাদিদেবের মন্দির থাকবেই আর এখানেও তার অন্যথা হয় নি। আজ মন্দিরের পাশদিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত না হলেও এই জায়গাটিইমহামায়ার ঘাটনামে পরিচিত। অতীতে হয়ত এই ঘাটই ছিলবেহুলার ঘাটযারদিকে স্বয়ং মা অঙ্গুলী নির্দেশ করেছিলেন।অনুমান করা যেতে পারে যে, প্রাচীনকালে বেহুলা লখিন্দরের ভেলা হয়তো এখানদিয়েই গিয়েছিল। কারণ গঙ্গা তখন মন্দিরের পাশ দিয়েই বহমান ছিল। যদিও বর্তমানে এখানে গঙ্গার কোন চিহ্ন পর্যন্ত দেখতেপাওয়া যায় না। একসময় সেই পুণ্য জলাধারের পাশে ছিল শ্মশান। আজ এখানে তারও কোন অস্তিত্ব নেই। কেবল রয়ে গেছেনমা মহামায়া তাঁর স্বমহিমায় যদিও দুর্গাচরণের নির্মিত মন্দির আজ ভগ্নদশাপ্রাপ্ত।

মন্দিরবাদেবালয়বলতে বোঝায়দেবতার গৃহযেখানে দেবদেবীর চরণকমলে মানুষ নিজেকে ভক্তিভরে সমর্পণ করে। মন্দিরএমন একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র যেখানে মায়ার জগৎ থেকে মানুষ তীর্থযাত্রী বা পূণ্যার্থীর বেশে জ্ঞান সত্যের জগতের সন্ধানেআসেন।মা মহামায়ার মন্দির সেরকমই একটি পবিত্র তীর্থস্থান। বহু বহু বছর ধরে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ জীবনদর্শনের সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে। আধ্যাত্মিক জীবনের বাইরে সামাজিক রীতিনীতি দৈনিক জীবনের ক্ষেত্রেও মামহামায়ার আশীর্বাদ আজ সর্বাঙ্গীন ভাবে প্রসারিত হয়ে এই পুণ্য ধর্মস্থানকে এক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ধন্য মা।তোমার করুণা আর কৃপাশীষে মানুষের জীবন হোক সতত মঙ্গলময়, চিরসুন্দর, সর্বসঙ্কটমুক্ত।

জয় ঁ মা মহামায়া

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleনরকযন্ত্রণা।
Next articleঅলস দুপুরের নির্জনতা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments