এখন বসন্ত। লাল আবেগে নিজেকে ভরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল গাছটা।গাছের উপর দুটো পাখি সবেমাত্র এসে বসেছে।বাতাস তার সমস্ত ব্যস্ততা থামিয়ে গাছটির পাতাতেই আশ্ৰয় নিয়েছে। সূর্যের আলো উপর থেকে মেঘ এর আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। প্রকৃতিও প্রেম ছড়িয়ে দিয়েছে এই গাছের চারপাশে। সবাই দুজনের প্রেমালাপের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত।

মাধবী এইমাত্র এসে বসেছে গাছের চারপাশে মাটির বেদি তে।উল্টাদিকে মুখ করে সাইকেলের চেইন ঠিক করতে ব্যাস্ত অতুল। যেন সে ভুলেই গেছে যে সে মাধবী কে আস্তে বলেছে। মাধবী কিছুক্ষণ রুমাল দিয়ে মুখের স্বল্প ঘাম পরিস্কার করে ধৈর্য রাখতে না পেরে অতুল কে বললো-‘কি রে আমায় কি জন্য আসতে বলেছিলি? আমায় বসিয়ে রেখে ধ্বজা একটা সাইকেলের চেইন সরব বলে? নাকি আমায় দিয়ে সাইকেল সারানোর মতলব। বলতেই পারতিস তাহলে আমি না এসে হারুদা কেই পাঠাতাম।’ অতুল থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে  মাধবীর দিকে ঘুরে বললো-‘এমা ছিঃ ছিঃ.…না না,আমি খেয়াল করিনি তুই চলে এসেছিস। আসার সময় চারবার চেইন পড়েছে, তুই ঠিকই বলেছিস যে এটা আর চলবে না, কিন্তু আর উপায়ও তো নেই।

‘অতুল মাথা নামিয়ে ডান হাতে মাথা চুলকাতে শুরু করলো আনমনে। মাধবী বললো-‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। শোন,চুল কালো করবার ইচ্ছা হলে টাকা দিয়ে গারনিয়ার করিয়ে নে, সাইকেলের চেইন এর অয়েল লাগিয়ে কি লাভ বল, স্নান করলেই তো উঠে যাবে। ‘অতুল সঙ্গে সঙ্গে হাত টা নিচে নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাধবী বললো-‘বল কি জন্য ডেকেছিস? মা কে বলে এসেছি যে শ্বেতার বাড়ি যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। ‘অতুল ডান হাতের গুটানো জামাটায় মুখের ঘাম মুছতে মুছতে মাধবীর থেকে এক হাত পশে বসলো। মাধবী ওর দিকে  তাকিয়ে আছে। ও জানে কি জন্য আজ ডেকেছে অতুল,কি বলবে। এই দিনটার জন্যই তো অপেক্ষায় এতদিন কাটিয়েছে। কিন্তু ওর মুখে নতুন প্রেমিকা হবার আনন্দ,উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে না। এটাই তো মেয়েদের গুন। সব বুঝেও অবুঝ, সব জেনেও বোকা সেজে থাকা। ভালোবাসা ঠোঁটের কাছে এসে শত লাফালাফি করলেও তাকে এক ঢোকে গিলে ফেলার ক্ষমতা তারা রাখে।

অতুল জামার একটা কোন গোটাতে গোটাতে  বললো-তুই রাগ করবি না তো?

-হা করবো। তাহলে বুঝি বলবি না?

-না না বলছি। আসলে…

-তার মানে আমি রাগ করি, সেটাই চাস। ওকে বল তাহলে। এমনিই লেট হচ্ছে।

-না,সেরকম কিছু মিন করতে চাইনি। প্লিজ রাগ করিস না।

-ওকে। করবো না বল।

-মাধবী,তোকে আমার খুব ভালো লাগে। মানে জানিনা কেন, কিভাবে, কবে যে……তোকে যখন ই দেখি সবকিছু কিরকম এলোমেলো হয়ে যায়। আর যখন না দেখি তখন ও তোর উপস্থিতি অনুভব করি। যখন কলেজে ভিজে চুলে আসিস, যখন টিফিন এ সব ছেলের মাঝে এসে আমায় টিফিন দিয়ে যাস, কলেজ ছুটির পর তোর বান্ধবীদের চলে যেতে বলে আমার জন্য অপেক্ষা করিস, রবিবার বিকালে যখন মাঠে খেলি আর তুই সাইকেল চালিয়ে পেরিয়ে যাস ঠাকুর প্রনাম করতে, যখন তোদের বাড়ির পাস দিয়ে রেশন আনতে যাই আর উপরের বারান্দায় তোর ওই লাল চুড়িদারটা শুকানোর জন্য মেলা থাকে, যখন  আমার তেষ্টায় তুই জল দিয়ে ধমক দিস জলের বোতল না আনার জন্য… তখন আমি কোথায় যে হারিয়ে যাই জানিনা। এসব নিয়ে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি তখন ওদিকের আমি টা বলে যে এটা নাকি ভালোবাসা।

হ্যাঁ মাধবী আমি তোকে ভালোবাসি।

মাধবী দাঁড়িয়ে উঠে মুখ বেজার করে বললো-‘ছিঃ…এটা প্রপোজ? হে ভগবান, আগে কেউ এরকম প্রপোজ করেনি। ‘অতুল একটু হলেও ভেঙে গেল। নিরাশ মুখে বললো -এর আগেও মানে এর আগেও অনেকে প্রপোজ…মাধবী পুরো কথা শোনার আগেই বললো-হ্যাঁ। কেন তুই জানতিস না? যাই হোক, করবে নাই বা কেন? বড়লোকের মেয়ে আমি, দেখতে সুন্দরী, মডার্ন, পড়াশনাতেও ভালো, নাচ ও করি। এটা নিয়ে তাও গোটা তিরিশ তো হবেই। ‘অতুল একটা আফশোস এর নিশ্বাস ছেড়ে -হুম, আমি ভেবেছিলাম যে…বলে মাথা নামিয়ে নিলো। মাধবী ভিতর ভিতর ভীষণ জোরে হেসে মুখ সিরিয়াস করে বললো ‘আরে এতে মাথা নামানোর মতো কি হলো। এটা তো বাস্তব। কেউ যদি প্রপোজ করে তা হলে আমি কি করে আটকাই বল। আচ্ছা অনেকে তো অনেককিছু বলেছে। এবার শুনি তুই কি বলিস। আমায় কতটা ভালোবাসিস?

‘অতুল মাথা উঠিয়ে বললো- জানিনা ঠিক।

-আচ্ছা। আমায় কতটা কেয়ার করতে পারবি?

-হ্যাঁ। নিজের থেকে বেশী।

-আমি যদি ভালো না বাসি, তাহলেও কি ভালবাসবি? নাকি আবার অন্য ডালে চড়বি?

-কি বলছিস এসব। আমি ভালোবাসি তোকে। আজীবন বাসবো।

-যদি সম্পর্ক টা শুরুও করি, তারপর কি আমার ডিসিশান এ সবসময় ফাইনাল হবে তো?

-সরি, সেটা নির্ভর করছে কি সিদ্ধান্ত নিবি। সেটাতে যদি তোর ক্ষতি হয় তাহলে বোঝাবো তোকে।

-আমি যদি রাগ দেখায় তাহলে কি করবি, উল্টে রাগ দেখাবি?

-রাগের কারণ জেনে তোকে মানাবো, আর আমার যতই রাগ আসুক সেটা ভালোবাসা হয়েই বেরোবে সবসময়।

-আমায় স্বাধীনভাবে চলতে দিবি নাকি বাধা ডিবি তোর সাথে কম্পিয়ার করে?

-ভালোবাসা বন্দি রাখা যায় না।

-দেখ, আমার বাবা খুব বড়লোক। সে নিশ্চয় খুব ভালো ছেলের সাথেই বিয়ে দেবে একমাত্র মেয়েকে। এখন আমি যদি তোকে মেনেও নি, বাবা মানবে কেন? তুই পারবি মানাতে?

-হ্যাঁ।

-কি করে? আর যদি না মানে?

-আমি অনেক ভালোবাসবো। অনেক বড়ো … জানি না। তবে একা একা কাটিয়ে দেব সারাজীবন এভাবেই।

-জানিস, আমার মাসির মেয়ে খুকি দি কেও ঠিক তোর মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ওই ছেলেটা। এক বছর যেতে না যেতেই সব উল্টো হয়ে যায়। অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে। বাড়িতে সব জানত। মেসো ঠিক ও করেছিল ওই ছেলের সাথেই দিদির বিয়ে দেবে। কিন্তু… বুঝতে পেরেছিস আশা করি।

মাধবী অতুলের দিকে চোখ রেখে বললো- তুই যে এরকম টা করবি না তার কি গ্যারান্টি। আর বাবা মানবেও না। তুই যতটা এগিয়েছিস, এটা থেকে বেরোনো কঠিন জানি। কিন্তু শুরুতেই যদি আমায় একবার বলতিস তাহলে আজ খারাপ লাগতো না।স্বপ্ন দেখিস না আর। এই স্বপ্নে সূর্য নেই, চাঁদ নেই। আছে শুধু কালো মেঘের গর্জন। ভুলে যা। শোন, কাল থেকে আর এরকম কিছু মনে আনবি না। যা বা এরই যা। আমিও যাই। অনেক লেট হয়ে গেছে।

মাধবী হেঁটে বাড়ির রাস্তার দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখলো অতুল মাথা নামিয়ে দুটো কনুই হাঁটুর উপর রেখে চোখদুটো ধরে আছে। হাতের বাঁধ ভেঙে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। মাধবী যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই অতুলের কান্না বাড়ছে। মাধবী মনে মনে ভাবছে’ না এ কি করলাম। আমি ঠিক করিনি। কেন মজা নেবার নেশায় মিথ্যা কথা বলে ওকে কষ্ট দিলাম। বেচারা সত্যি আমায় খুব ভালোবাসে, আর আমিও তো ওর জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। বলে দিব নাকি… না, কোনো কিন্তু না। এখন ই বলতে হবে আমায়। ভাবতে ভাবতে মাধবী ঘুরে অতুলের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। অতুল অঝোরে কাঁদছে আর বলছে-কেন বলতে গেলাম ওকে। কেন স্বপ্ন দেখলাম…

মাধবী অতুলের হাতদুটো ধরে উঠালো। গালে কান্নার ধারাদুটো আঙ্গুল দিয়ে মুছে জড়িয়ে ধরলো অতুল কে। মাধবীর চোখ থেকে জল নেমে এলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো- পাগল। আই লাভ ইউ টু। খেপা আমার।

দুজনা দুজনকে ছেড়ে মুখের দিকে তাকিয়ে। অতুলের বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে মাধবী বললো- হ্যাঁ,আই লাভ ইউ বোকা।কিছুই বোঝে না। অতুল হাসলো। কি যেন জিতেছে ও। হ্যাঁ ও ভালোবাসা জিতেছে। মাধবীকে জড়িয়ে ধরলো। বাতাস শিমুল গাছের উপর জোরে জোরে নৃত্য করতে শুরু করেছে। শিমুল ফুল ভালোবাসা হয়ে ঝরে পড়ছে ওদের উপর। সূর্য নিজেকে লুকিয়ে অন্ধকার করছে। পাখি দুটো বোধহয় আনন্দে বা লজ্জায় উড়ে গেল এইমাত্র।

 

~ প্রেম নিবেদন ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleফিট্‌বিট্‌ (পঞ্চম পর্ব)
Next articleস্বপনের সংসার
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments