“যদিও তুমি আমার স্থির জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা ভাবছো একাগ্রমনে; তাই কি বন্ধু?”

উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, ঢাক এবং কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ এর মধ্যে, মনে হচ্ছে আমার কানে যেন কেউ ফিসফিস করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কেউ বোধহয় সত্যি বলেছেন, শ্রুতিবোধ মনকে অনুসরণ করে। বারাসাতে  যেখানে আমার শৈশব কেটেছে আমার দাদুভাই আর ঠাম্মার স্নেহের ছত্রছায়ায় এবং যে পুকুরে আমি শিশুবয়সে সাঁতার শিখেছি, স্নান করেছি; কালের ঘূর্ণিচক্রে  আমার এবং পুকুরের মধ্যে কি একটা মানসিক ব্যবধান  তৈরী হয়ে গেছে? যেটাকে আমি মন থেকে কি মানতে পারছি না। আমার মন কি ভারাকান্ত, কিন্তু কিসের জন্য?

আমরা অনেকদিন পরে আমাদের বারাসাতের বাড়িতে দূর্গাপুজোর সময় যাই, আমরা এখন কাজের সূত্রে আবুধাবিতে থাকি। বারাসাতের বাড়ি যেটা আমার দাদুভাই বানিয়েছিলেন পুকুর এবং পুজোমণ্ডপসহ, এবং দূর্গা পূজা শুরু করেছিলেন এই পূজামণ্ডপে দূর্গামায়ের স্বপ্নাদেশে ১৯৫৪ সালে যে সালে আমার বাবা এবং মায়ের বিয়ে হয় এবং আমার মায়ের প্রবেশ ঘটে আমাদের বংশের প্রথম বধূরূপে। আমি পুকুরপাড়ের ঘাটে একা একা বসে একমনে জলের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম একদল ছোট ছোট  ঈষৎ লাল রঙের রুই কাতলা মাছের চারাপোনাগুলো ঘাটের সিঁড়িতে সাঁতার কাটছে দলবেঁধে আর একটা শোলমাছ তাদের ঘিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন ওদের পাহারা দিচ্ছে প্রহরী হিসেবে।

অজান্তে যেন আমি পুকুরের সাথেই বিড়বিড় করে কথা বলছি, “আমি ভাবছিলাম আমার ছেলেবেলার দিনগুলো; তোমার জলে আমি সাঁতার কেটে এপার ওপার করছি, আমার বন্ধুদের সাথে গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরার চেষ্টা করছি, ঐপাড়ে দেখতে পাচ্ছি আমি আর দাদুভাই একসাথে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরছি, অথবা দুপরে গরমের মধ্যে মাদুর পেতে শুয়ে আছি নারকেলগাছের অথবা নীমগাছের তলায়। কত সুন্দর আমার শৈশব কেটেছে তোমাকে এবং দাদুভাইকে নিয়ে। আমার মনে আছে তোমার জল তখন কত পরিষ্কার ছিল একদম  স্বচ্ছ কাঁচের মতো টলটল করতো।”

মনে হলো যেন আমার কানে একটা সুকণ্ঠ আওয়াজ রিনরিন করে আবার বেজে উঠলো, “তুমি ঠিক বলেছো বন্ধু, আমার জন্মের সময় আমার জল সত্যি পরিষ্কার এবং মিষ্ঠ ছিল। তোমার ঠাম্মা, পাড়াপড়শির বধূরা আমার ঘাটে বসে গল্প করতে করতে পিতলের কলসিতে রান্না করার, খাওয়ার জল ভরে নিয়ে যেত; তখন বোধহয় অনেকের বাড়িতেই  হাত টেপা কল ছিল না। আমার মনে পরে সেইসময় কিছু অল্পবয়েসী বধূ এবং যুবতীরা জল নেয়ার সময় একটা গান গুনগুন করে গাইতো, আমার মন ভরে যেত যখন ওরা কলসি কাঁখে নিয়ে গাইতো —-”

‘ললিতা গো

ওকে আজ চলে যেতে বলনা

ও ঘাটে জল আনিতে যাবোনা যাবোনা

ও সখি অন্য ঘাটে চলনা

ললিতা  ওকে আজ  চলে যেতে বলনা’

“এই গানটা তখন খুব নাম করেছিল, মান্না দের গাওয়া।” আমি বলি, “আমি মানছি, এখন আমরা আমাদের কর্মব্যস্ততায় এমন ভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি – তোমার জলের নিয়মমতো পরিশোধন করার এবং পরিষ্কার রাখার দরকার  সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। আমার মনে আছে দাদুভাই একবছর অন্তর তোমার জল পরিষ্কার করাতেন লাইমস্টোন দিয়ে; মাঝে মাঝে লোক দিয়ে আগাছা, কচুরিপানা, শ্যাওলা পরিষ্কার করাতেন। কাউকে সাবান দিয়ে কাপড় কাচতে দিতেন না, তোমার জল অনেকেই পানীয় জল হিসেবে ব্যাবহার করতো সেই কারণে।”

“এখন আমার কোনো অভিযোগ নেই, বন্ধু। মনে হয় আর প্রয়োজন হবে না আমাকে পরিষ্কার রাখতে।”

“কেন বন্ধু একথা কেন বলছো, দুঃখে?” আমার প্রশ্ন।

“কিছুদিন আগে আমার ঘাটে দাঁড়িয়ে কিছুলোক  বলাবলি করছিলো তোমার কাকুদের সাথে, খুব শীঘ্র তোমরা আমার ঘাট ভেঙে একটা রাস্তা বানাবে। শুনলাম তোমরা তোমার দাদুভাইএর বানানো বড়োবাড়িটা ভেঙে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি  বানাবে, তারসাথে আমার উত্তর পারে যে  ছোট ফ্লাটবাড়িটা আছে সেটাও ভেঙে একটা বড়োফ্ল্যাটবাড়ি  বানাবে; তার জন্য একটা চওড়া রাস্তা দরকার। এবং কিছুদিন পরে আমাকে বুজে দেবে মাটি এবং বাড়ি ভাঙার ধংসাবশেষ দিয়ে।”

বুঝতে পারি আমার বন্ধুর বেদনা, এটা হয়তো প্রথমে ঠিক হয়েছিল এবং সেটা শুনে ও মর্মাহত হয়ে পড়েছে। কাকুমনির থেকে যেটা আমি জানতে পারি, পুকুর বোজার কোনো পরিকল্পনা এখন নেই। ভুল ভাঙাটা খুব জরুরী।

আমি বলি, “তুমি যেটা শুনেছ, সেটা আংশিক সত্যি। হয়তো আগে এরকম পরিকল্পনা ছিল। এখন তোমাকে বোজার কোনো  পরিকল্পনা নেই, তবে ঘাট ভাঙতে হবে একটা চওড়া রাস্তার জন্য। আমি কাকুদের সাথে কথা বলবো যাতে তোমার জল নিয়মমতো পরিষ্কার করা হয়।”

“তুমি কি জানো, আমার পিতা কে?” আমি অবাক হয়ে যাই হঠাৎ ওর এরকম প্রশ্নে।

ও বলতে থাকে, “তোমার দাদুভাই আমার পিতা, উনি আমাকে সৃষ্টি করেছিলেন ১৯৪৯ সালে তোমার জন্মের অনেক অনেক আগে। উনি আমার মাটি দিয়ে পুরো জমিটা উঁচু করেন বাড়ি বানানোর জন্য যে বাড়িতে তুমি ওনার সাথে শৈশবের দিনগুলো কাটিয়েছো। উনি যখন পূর্ববাংলা থেকে এখানে আসেন বসবাস করার জন্য, তখন উনি উপলব্ধি করেন একটা পুকুরের প্রয়োজনীয়তা। তখন পূর্ববাংলা থেকে অনেকে এখানে আসেন বসবাস করার জন্য এবং জলের অভাব ছিল। তোমার নিশ্চয় মনে আছে, পাড়াপড়শি থেকে প্রায় প্রত্যেকে আমার পুকুরে আসতো স্নান করার জন্য এবং পানীয় জলের জন্য। তখন সকল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কতলোক আসতো আমার জলে স্নান করতে, কতরকম গল্প শুনতাম, আমার মন ভরে যেত।”

আমি অনুভব করতে পারি, দাদুভাই তার সৃষ্টি পুকুরকে একজন পরিবারের সদস্য বলেই মনে করতেন।

আমি শুনতে পাই আমার কানে তখনও একটা সুমধুর আওয়াজ বেজে চলেছে, “আমি প্রচন্ড গর্ব অনুভব করতাম যখন আমার পিতা বুকজলে দাঁড়িয়ে তর্পন করতেন প্রত্যেক মহালয়ার সকালে।”

“হাঁ, আমার মনে আছে। যখন আমি দাদুভাই কে জিজ্ঞাসা করি তর্পন কি, উনি আমাকে বোঝান – মহালয়ার দিন প্রাতঃসকালে হিন্দুরা গঙ্গাতে পূর্বপুরুষদের কাছে তর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান তাদের উত্তরসূরীদের আশীর্বাদ করার জন্য, এবং দাদুভাইয়ের কাছে আমাদের পুকুরই ছিল যেন গঙ্গা।”

পরে আমি জানতে পারি, দেবীপক্ষ শুরু হয় মহালয়ার দিন। মহালয়ার প্রাতঃসকালে তর্পনের মাধ্যমে দেবিপক্ষকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আমাদের শুভদিনের জন্য। দেবী দূর্গামা ওনার যাত্রা কৈলাশ থেকে শুরু করেন মহালয়ার দিন ওনার পরিবারকে নিয়ে পিতৃগৃহ পৃথিবীর উদ্দেশে।

আমার বন্ধু তখনও গুনগুনিয়ে চলেছে আমার কানে, “দশমীর দিন সকালে তোমরা সবাই তোমার দিদি ভাই পিসতুতো বোন আর ভাইদের নিয়ে আমাকে ঘিরে মাছধরা দেখতে, এটা তোমাদের কাছে একটা বিরাট উৎসব ছিল। আমারও খুব ভালো লাগতো তোমাদের উৎসুক মুখগুলো দেখে। প্রথমে আমি একটু কষ্ট পেতাম আমার জল থেকে মাছগুলো ধরার জন্য, কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি মাছ তোমাদের একটা সুখাদ্য – যেমন আমার দরকার সূর্যকিরণ, বৃষ্টি, বাতাস আমার বেঁচে থাকার জন্য, এটা প্রকৃতির নিয়ম। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম, যখন তোমার কাকারা এবং পাড়ার দাদারা মিলে আমার জলে মাদুর বিছিয়ে – যে কুলগাছটা আমার জলের উপর একদম নুয়ে আছে সেটাকে ঝাঁকা দিত আর পাকা কুলগুলো টপটপ করে মাদুরের উপর পড়তো। তুমি আমার পাড়ে দাঁড়িয়ে লাফাতে আর বলতে, আমাকে কুলভরা ঝুড়িটা দেবে কিন্তু। তুমি তখনও সাঁতার শেখোনি, তাই পুকুরে নামা  বারণ ছিল।”

“তোমারতো সব মনে আছে দেখছি। আমি এরপরে দিদির থেকে খুব তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখি।”

“কিন্তু আমার প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিল যখন তোমার এক দুষ্টু পাড়ার দাদা জোড়া কালবোস মাছের একটা ধরে নেয়। তোমার ঠাম্মা রোজ দুপুরে ভাত খেয়ে ঘাটে এসে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকতেন, ঠিক তখনি এই জোড়া কালবোস তোমার ঠাম্মার পায়ের কাছে এসে ঘুরে বেড়াতো আর ঠাম্মার থেকে ভাত খেত। ওনার পোষা ছিল। একটা জলঢোড়া সাপও ছিল, সেও এসে ভাত খেত ঠাম্মার হাত থেকে। আমার তখন কি আনন্দ হতো, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। ঠাম্মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন কালবোস মাছের একটাকে না দেখে।”

“আমি জানি, আমিও ঘাটে দাঁড়িয়ে এই অপূর্ব দৃশ্যটা দেখতাম। আমি অবাক হতাম, মাছগুলো টের পেতো কীকরে, আমি ঘাটের জলে দাঁড়িয়ে অনেকদিন চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনোদিন মাছের জোড়া অথবা সাপ আসতো না।”

“আমার মনে হয় তোমার ঠাম্মার গলার আওয়াজে অথবা গায়ের সুগন্ধ পেয়ে। ওরা ঠাম্মাকে খুব ভালোবাসতো। তোমার ঠাম্মা একপাল হাঁসকে রোজ সকালে পুকুরে নিয়ে এসে ছেড়ে দিতেন, সারাদিন ওরা ‘কোয়াক, কোয়াক’ আওয়াজ করে আমার জলে ভেসে বেড়াতো। যখন সন্ধ্যাবেলায় ঠাম্মা এসে পাড়ে দাঁড়াতেন, ওরা সাথে সাথে জল থেকে উঠে ওদের ঘরের দিকে ফিরে যেত এক লাইন ধরে। আমি আজ প্রচন্ড ভাবে এইগুলো হারাই।”

“আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট বন্ধু। আজকে দাদুভাই, ঠাম্মা, হাঁস, কুলগাছ, জোড়া কালবোস, বাচ্চাদের দাপাদাপি তোমার বুকে  – কিছুই নেই। সব একেএকে হারিয়ে গেছে। তোমার জল থেকে কলমি শাক তুলে ঠাম্মা একটা খুব সুন্দর ভাজা বানাতেন রসুন দিয়ে, আমার এখনো জিভে স্বাদ লেগে আছে। তোমার নিশ্চয় মনে আছে তোমার জলে পদ্মফুল হতো, আমরা তুলে অষ্টমী পুজোতে দিতাম। পদ্মফুলকে শুভ এবং পবিত্র মানা হয়, সুন্দরের প্রতীক।”

“এখন আমার জলে আর পদ্মফুল হয় না কেন?”

“আমি যতটা জানি দাদুভাই তোমার জলে একবার কিছু পদ্ম কান্ড লাগিয়েছিলেন, একবার পদ্ম কান্ড লাগালে কিছুবছর পর্যন্ত পদ্মফুল হয়। তারপর আবার লাগাতে হয়।”

“আমার পিতা সত্যি একজন মহান মানুষ ছিলেন, আমি ওনার জন্যে গর্বিত অনুভব করি। উনি আমার চার দিকে কত গাছ লাগিয়েছিলেন – নারকেল, সুপারি, নীম, কুল, জামরুল, কাঁঠাল, পেয়ারা, শিউলি, টগর, আরও কত কি – এখনো সূর্যের কিরণ থেকে শুরে করে ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ের উপর দিয়ে বয়ে যায়। কিন্তু একবার ঘাট ভেঙে দিলে আমার জলে আর কেউ স্নান করতে আসবে না,  আমার ঘাটে বসে আর কেউ কথা বলবে না তোমার মতো।” অনুভব করতে পারছি যেন একটা ফোঁপানো কান্নার আওয়াজ।

“আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি, বন্ধু। কিন্তু আমার মনে হয় এটা কিছুদিনের জন্য, আবার একটা ঘাট নিশ্চয় বানানো হবে। তোমার জলে এখন আমাদের দূর্গা প্রতিমার বিসর্জন হয়, ঘাট তো লাগবেই।”

হঠাৎ রূপালীর ডাকে আমি থতমত খেয়ে চমকে উঠি। আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাহলে কার সাথে এতক্ষন কথা বলছিলাম। “তুমি দেখছি ঘুমিয়ে পড়েছো ঘাটে বোসে। কিছু চিন্তা করছিলে নাকি? অষ্টমী পূজা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি এসো, অঞ্জলি দিতে হবে।”

“আমি আসছি, রূপালী।”

আমার বন্ধুর উদ্যেশে ফিসফিস করে জানাই, “আমাকে এখন যেতে হবে, বন্ধু। কিন্তু আমি যখনি তোমার পাশ দিয়ে যাবো, তোমার পাড়ে বসে আবার আমাদের কথোপকথন হবে।”

পূজামণ্ডপের দিকে যেতে যেতে, নিজের মনে গুনগুনিয়ে উঠলাম নিজের অজান্তে,

‘আমি কি আরও ভাল কিছু অনুভব করতে পারি,

এমন দিন নিয়ে যখন ও কাঁদবে না?
যাই হোক না কেন, সময় বলার অপেক্ষা রাখে না
বিদায়, আমার ভালবাসা, বিদায়।’

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleঅমানিশা
Next articleস্মৃতি
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments