আলো আঁধারি একটা জায়গার মধ্যে দিয়ে দুটো লোক প্রাণপনে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছে। চারিদিকে স্তূপীকৃত রাবিশ । পেছনে কেউ যেন তাড়া করছে তাদের। একটা কোকেন ভর্তি ব্যাগ। হঠাৎ তিনটে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। একটা ব্যাগ ছিটকে মাটিতে পড়ে তার থেকে নোট গুলো বেরিয়ে ছড়িয়ে গেল মেঝেতে। একটা রূপোর ব্রেসলেট বাঁধা হাত তাতে একটা ত্রিশূলের মতো পেন্ডেন্ট ঝুলছে। হাতে একটা পিস্তল। ক্রমশ এগিয়ে আসছে। লোকটার মুখটা ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মেয়ে, ভারী মিষ্টি দেখতে। পরনে সুন্দর সাদা একটা স্কার্ট। সে বাপি এসেছে , বাপি এসেছে বলে দৌড়ে আসছে। পিস্তল থেকে একটা ফায়ার হলো আর সঙ্গে সঙ্গে সজোরে বাজ পড়ার আওয়াজ হলো। ঘুম ভেঙে ধড়পড় করে উঠে বসলো লোকটা।
******
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। একটা গাড়ি ছুটে চলেছে জাতীয় সড়ক ধরে। উইন্ডো গুলো বন্ধ তবুও ফাঁক ফোকর দিয়ে বৃষ্টির জল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে ভেতরে ঢুকে টুপ্ টাপ করে পড়ছে। সামনে ড্রাইভার আর তার পাশে একটা লোক। পেছনে একটা লোক বসে আছে। তার হাতে হ্যান্ডকাপ । লোকটা এতক্ষন একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখছিলো। একটা বাজ পড়ার আওয়াজে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর সে বোঝার চেষ্টা করছিলো সে কোথায় আছে। মাথাটা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেমন একটা ঝিম ধরা ভাব। লোকটা জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো ” আমি কোথায় ? ”
সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন ইন্সপেক্টর আর তার এসিস্টেন্ট। কনস্টবল, এসিস্টেন্ট দুজনেই অবশ্য সিভিল ড্রেসে আছেন। এসিস্টেন্ট গাড়ি চালাচ্ছে।
ইন্সপেক্টর, মুখ ঘুরিয়ে বললেন ” কি মানিক চাঁদ ঘুম ভাঙলো ?”
পেছনের লোকটা সামনের দিকে দুবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
ইন্সপেক্টর দাঁত বের করে হেসে বললেন ” তাহলে আর কি? এইতো এসে পড়লাম বলে তারপর আপনার খাতির যত্ন করা হবে খন। ” – দাঁত গুলো পান খেয়ে কালো হয়ে গেছে।
লোকটা আবার জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো ” কোথায় যাচ্ছি আমরা ?”
এবার এসিস্টেন্ট হো হো করে হেসে বললো ” কেন? আপনার মামার বাড়ি ! মামার বাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই। এটাও বলে দিতে হবে ? আপনার কি হলো বলুন তো মানিক ? নাকি কি বলবো পাউডার মানিক? নাকি খোকা মানিক ?”
লোকটা হঠাৎ হুড়মুড় করে হ্যান্ডকাপ সমেত হাত দিয়ে গাড়ির দরজা গুলো ঠেলে খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। দু তিনবার পা দিয়ে লাথি মারলো। ইন্সপেক্টর আস্তে করে রিভলবারটা বের করে মানিকের দিকে দেখিয়ে বললো ” না না ওসব কাজ করতে যাস না। কাল সারা রাত অনেক ছুটিয়েছিস, আর না। এই ঝড় জলের মধ্যে তোর পেছনে আর ছুটতে পারবো না। সোজা খুলি উড়িয়ে দেবো। তারপর স্যার কি বলবে না বলবে সে দেখা যাবে। তাই বলছি ভালো ভাবে থাক বেশি চালাকি করার চেষ্টা করিস না। তাতে তোরও ভালো আর আমাদেরও শান্তি। ”
লোকটা একবার খুনি দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালো তারপর মাথা নিচু করে ফোঁস ফোঁস করে ফুঁসতে লাগলো ।
ইন্সপেক্টর আবার সামনের দিকে ঘুরে বসলো। রিভলবারটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বললো ” বাপরে বাপ কি বৃষ্টি। কলকাতা তো ভেসে যাবে এই বৃষ্টিতে।”
এসিস্টেন্ট বললো ” যা বলেছেন স্যার । কর্পোরেশনের সেবায় কলকাতায় এখন বন্যা। আর কাল রাত থেকে দৌড়ে মরছি। বডি আর টানছে না । স্যার একটু আছে চলবে নাকি ? ”
ইন্সপেক্টর একটা হাই তুলে বললো “ডিউটি তে খাব?
এসিস্টেন্ট হেসে বললো ” কি ডিউটি স্যার। এখানে আর কে দেখছে ?”
বলে বোতলটা ইন্সপেক্টরের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
ইন্সপেক্টর এক ঢোক গিলে মুখে আআ করে একটা আওয়াজ করে মানিকের দিকে একবার তাকিয়ে বললো “তোকে লালবাজারে তুলে দিয়ে বাড়ি গিয়ে টানা ঘুম দেব। আর শোন ওখানে যা জিজ্ঞেস করবো ভালোয় ভালোয় উত্তর দিয়ে দিবি। বেশি ঘাটাবিনা বলে দিলাম। নইলে তো জানিস কপালে অনেক দুঃখ আছে।”
মানিক ফোঁস করে একটা নিঃস্বাস ছেড়ে বললো ” আমি কিছু জানিনা। আমি কিছু করিনি।”
এসিস্টেন্ট মুখ ভেঙ্গিয়ে বললো ” নাঃ , তুমি কিছু করনি। কিছুই যেন না। তাহলে কাল সারারাত কি আমাদের সঙ্গে চু কিত্ কিত্ খেলছিলে ? সোম স্যারের হুড়কো তো খাসনি কোনোদিন। পেছনে যখন পড়বে তখন সব অজানা জানা হয়ে যাবে।”
ইন্সপেক্টর সোম তাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন ” আচ্ছা, ওই মাল গুলো আজ কোথায় পাচার হওয়ার কথা ছিল বলতো ? গুজরাট নাকি নেপাল ?”
লোকটা আবার চেঁচিয়ে বললো ” বললাম তো আমি কিছু জানি না। আমার কিছু মনে নেই। ” হাতকড়াটা একবার ঠুং ঠাং আওয়াজ করে উঠলো।
ইন্সপেক্টর সোম স্যার হেসে বললো ” বেশ বেশ খুব ভালো। ও ঠিক আছে এখন জানতে হবে না। তবে আমার নামও ভার্গব সোম কার পেট থেকে কি করে কথা বের করতে হয় তার দাওয়াই আমার জানা আছে। ”
মানিক আবার একটু জোর গলায় বললো “বাজে কথা ছাড়ুন। আমার পরিবার কোথায়? আর আমার মেয়ে? আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করবো। ”
– “বাব্বা তোর মতো লোকের আবার পরিবার ! ভাবা যায়? তা তোকে আগে শ্রীঘরে তো ঢোকাই তারপর বৌ, মেয়ে, বাপ, মা, বেয়াই, বোনাই, জগাই, মাধাই যার সঙ্গে খুশি দেখা করিস। তা তারা এখন থাকে কোথায়?”
মানিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো ” জানি না। আমি কিছু জানি না। আপনারা ভুল করছেন। আমি কিছু জানি না। ”
ইন্সপেক্টর সোম এবার বিরক্ত হয়ে বললেন ” উঃ আবার সেই একই ভজন শুরু করল।” তারপর ড্রাইভারের দিকে ঘুরে বললেন ” শোন কথা, আদালতে যখন উঠবে জজসাহেব স্মাগলিং, খুন, জালিয়াতি কোন ধারায় ওকে শাস্তি দেবেন তা ভাবতেই পাগল হয়ে যাবেন আর উনি নাকি এখন কিছুই জানেন না। ”
– ” ছাড়ুন না স্যার, ও সময় এলে ঠিক বলবে। ”
ইন্সপেক্টর সোমের মোবাইল টা বেজে উঠলো। কানে নিয়ে বললেন ” হ্যালো। য়েস স্যার।” ওদিকের কথা কিছু শোনা গেল না। ” – হ্যাঁ স্যার বলুন। – না সব ঠিক আছে। – পারফেক্ট – সিওর- সিওর। – প্রচন্ড বৃষ্টি স্যার – রাস্তা ঘাট ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না। — তাও ধরুন ওই ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবো আশা করছি। ” বলে এসিস্টেন্টের দিকে তাকালেন। বলে এসিস্টেন্ট মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। – “অফকোর্স স্যার সে আর বলতে। আপনি যেমন বলেছেন তেমন ভাবেই হচ্ছে । ওকে ওকে স্যার – থ্যাংক ইউ। ” লাইনটা কেটে দিয়ে ইন্সপেক্টর মোবাইলটা আবার পকেটে রেখে দিলেন। ঘর ঘুরিয়ে বললেন ” ডি আই জি স্যার। ”
এসিস্টেন্ট ভুরু তুলে মাথা নাড়িয়ে বললো ” ও ”
বৃষ্টি যেন আরও মুষলধারে নেমে এলো। দুপাশে রাস্তার ধারে কিছুই ঠাওর করা যাচ্ছে না। বেশি জোরে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভবনা প্রচুর থাকে। কোনো রকমে কলকাতা পৌঁছতে পারলে তারা বাঁচে। অনেকক্ষণ সবাই নীরব। অবিরাম ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ আর তার মাঝে গাড়ির ওইপারের ছপাৎ ছপ্, ছপাৎ ছপ্ আওয়াজ একটা রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করছে। এসিস্টেন্ট বললো ” স্যার গান শুনবেন এফ এমএ ?”
ইন্সপেক্টর একটা ছোট্ট হাই তুলে বললেন ” চালাও শুনি। বসে বসে আর ভালো লাগছে না। ”
এসিস্টেন্ট রেডিওটা চালিয়ে দিলো। রেডিওতে তখন মোহাম্মদ রাফির একটা গান হচ্ছিলো – ” বার বার দেখো, হাজার বার দেখো, ইয়ে দেখনেকি চিজ হ্যায় —”
গানটা শুনতে শুনতে মানিকের মাথায় একটা তরঙ্গ বয়ে গেল। একটু যেন তন্দ্রা মতো এসে গেল মানিকের। কতকগুলো খন্ড খন্ড দৃশ্য মাথায় ভেসে উঠতে লাগলো। একটা ছোট্ট মেয়ে গিটার বাজাচ্ছে , মানিক তার সাথে গানটা গাইছে। এক মহিলার সঙ্গে মানিক গানটার সঙ্গে নাচছে। একটা স্কুল বাস। সেই ছোট্ট মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে বললো বাই বাপি। দূর্গা ঠাকুর বিসর্জনের ভিড়। দুটো বাচ্চা ছেলে ঢাকের তালে তালে নাচছে। হঠাৎ দেখলো দুটো শাঁখা পরা হাত। কে যেন ঠুকে ঠুকে শাঁখা গুলো ভেঙে দিচ্ছে। এরা কি তার নিজের কেউ? এদের কি সে আগে কোথাও দেখেছে? এসব কি দেখছে সে? এরা কারা? কাউকেই তো চিনতে পারছেনা সে! অথচ ভীষণ চেনা লাগছে। কেন এত চেনা লাগছে? এরকম অনেক প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরতে লাগলো। আবার তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। মাথাটা আবার ঝিম ঝিম করছে। মানিক হ্যান্ডকাপ সমেত হাতটা মাথায় চেপে ধরলো।
এসিস্টেন্ট খুব সাবধানে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে এক দুটো ট্রাক হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইন্সপেক্টর সোমের একটু ঝিমুনি লেগে গেছিলো। অনেক্ষন এইভাবে চলার পর এসিস্টেন্ট গাড়িটা এক জায়গায় এসে থামালো।
ইন্সপেক্টর সোমের ঝিমুনি কেটে গিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন ” কি হলো?”
— ” স্যার সামনে তো কিছুই দ্যাখা যাচ্ছে না, আমি নেমে একবার দেখে আসবো? মনে হচ্ছে একটা লেবেল ক্রসিং। গেট ফেলা আছে কি নেই কাছে না গেলে বুঝতে পারছি না। ”
ইন্সপেক্টর সোম এক মুহূর্ত ভাবলেন তারপর বললেন ” ওকে,যাও। গাড়ির চাবি আমাকে দিয়ে যাও। আর তাড়াতাড়ি ফের। ”
— ” হ্যাঁ স্যার আমি যাবো আর আসবো। ” বলে স্টার্ট বন্ধ করে সিটের নীচে থেকে একটা ছাতা বের করলো। তারপর আস্তে করে গাড়ির দরজা খুলে ছাতা ফুটিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।এগিয়ে গেল। এসিস্টেন্ট যেন একটা জলের প্রাচীরের মধ্যে ঢুকে হুশ করে উধাও হয়ে গেল।
ইন্সপেক্টর রিভলবারটা বের করে সিটের পাশে রাখলেন। দেখলেন লোকটা আবার মাথা নিচু করে বসে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। ইন্সপেক্টর একটা আড়মোড়া ভেঙে হাত দুটো উল্টো করে সামনের দিকে জড়ো করে মট মট করে আঙুল গুলো ফাটিয়ে বললেন ” বাপরে বাপ, পৃথিবী যেন ভেসে যাবে আজ। ”
হঠাৎ কানের কাছে একটা গরম বাতাস লাগলো তার ” স্যার বাইরে যাবো। ”
ইন্সপেক্টর ধড়পড় করে রিভলবারটা নিয়ে ঘুরে বসলেন। লোকটা জেগে উঠেছে। ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন ” কি হয়েছে কি ?”
মানিক আবার বললো ” স্যার বাইরে যাবো।”
– ” মানে? বাইরে কেন? ”
— ” স্যার এক নাম্বার। অনেকক্ষণ থেকে চেপে আছি আর পারছি না। ”
ইন্সপেক্টর সোম ঝাঁজিয়ে বললেন ” চালাকি পেয়েছিস? ওসব এখন হবে না। ”
মানিক মিনতি করে বললো “স্যার প্লিজ স্যার। সত্যি বলছি প্রচন্ড চাপ। আর পারছি না। ”
ইন্সপেক্টর সোম ধমক দিয়ে বললেন ” আচ্ছা মুশকিল তো। বললাম তো ওসব হবে না এখন। ”
— ” স্যার তাহলে আমার কিছু করার নেই আমি গাড়িতেই — ”
ইন্সপেক্টর সোম এবার রিভলবারটা তাক করে বললেন ” হই হই , ওসব একদম করতে যাসনা বলে দিলাম। নইলে শালা এক গুলিতে পেট ফুটো করে দেব। এক নম্বর দু নম্বর সব বেরিয়ে যাবে। ” কিছুক্ষন তাক করে রেখে তারপর একটু নরম হয়ে বললেন ” আচ্ছা দাঁড়া, অর্জুন ফিরে আসুক তারপর যাবি। ততক্ষণ চুপচাপ বসে থাক, একদম ঝামেলা করবি না।“
কিছুক্ষণ পর এসিস্টেন্ট অর্জুন ফিরে এলো।
সোম বললেন ” কি হলো কি? এতো দেরি করলে কেন ?”
অর্জুন বললো ” স্যার গেট পড়ে আছে। ট্রেন আসছে। দাঁড়াতে হবে। ”
সোম বিরক্ত হয়ে বললেন ” বোঝো। একে রামে রক্ষা নেই তায় সুগ্রীব দোসর। নাও এবার মানিক বাবু কে সামলাও। ” তারপর কড়ি আঙুল দেখিয়ে বললেন ” ওর নাকি খুব জোর পেয়ে গেছে। ”
অর্জুন বললো ” কিঃ ? না না ওসব এখন হবে না। ”
মানিক আবার পেছন থেকে বললো ” তাহলে আমি গাড়িতেই করে দিচ্ছি, কিছু করার নেই আর। ”
সোম বললেন ” ওই শুনলে তো। এবার সামলাও। শালা জ্বালিয়ে মারলো হারামিটা। ”
অর্জুন বললো ” মহা মুশকিল তো। এই বৃষ্টির মধ্যে তোকে আমি পেচ্ছাব করতে নিয়ে যাবো কি করে ? ” তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে বললো ” আচ্ছা ঠিক আছে স্যার আমি ডিক্কি থেকে দড়িটা নিয়ে আসছি ওটা ওর কোমরে বেঁধে নামাবো। ”
সোম বিরক্ত হয়ে বললেন ” ঠিক আছে যা পারো করো তাড়াতাড়ি। ঝামেলা গোটাও। ওদিকে দেরি হয়ে গেলে তখন মুশকিল। ”
অর্জুন তাড়াতাড়ি গাড়ির পেছনে চলে গেল। কিছুক্ষন পর ঢুক করে ডিক্কি বন্ধ করার একটা আওয়াজ হলো। অর্জুন সামনে এসে সোমকে বললো ” স্যার রিভলবারটা বের করুন। ” তার হাতে এক গাছি মোটা দড়ি।
সোম বললেন ” এই যে বের করাই আছে। ” বলে মানিকের দিকে সেটা তাক করে রাখলেন।
অর্জুন খুট করে ডান দিকের দরজাটা খুলে বললো ” হৈ চল ওই দরজার দিকে সরে যা। ” মানিক বাম দিকের দরজার দিকে একটু সরে গেল। অর্জুন আবার বললো ” এবার নিচের দিকে ঝোঁক ” লোকটা তাই করলো। অর্জুন এবার শক্ত করে কয়েক প্যাঁচ দিয়ে দড়িটা মানিকের কোমরে বাঁধলো। অর্জুনের দশাসই চেহারা। আর গায়েও অসুরের মতো জোর। সে নিজের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে ডান হাতে ধরলো আর অন্য হাতে দড়িটা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো। তারপর যে হাতে পিস্তল ধরা সেই হাত দিয়েই আস্তে করে বাম দিকের দরজাটা খুলে মানিককে বললো ” চল এবার নাম। ”
মানিক বললো ” স্যার হ্যান্ডকাপটা?”
অর্জুন পিস্তলটা তার কানের কাছে ঠেকিয়ে বললো ” শালা বসতে দিলে শুতে চায়। চল এগা। বেশি দূরে যাবি না এই সামনেই যা করার কর। ”
মানিক আস্তে করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো পেছন থেকে অর্জুন বললো ” না চল চল , তাড়াতাড়ি কর। ”
প্রচন্ড বৃষ্টি, মানিক ভিজতে লাগলো। সত্যি তার খুব জোরে পেয়ে গিয়েছিলো। সেই বিকেলে রাজগীর থেকে ছেড়েছে, রাস্তায় কোথাও আর দাঁড়ায়নি। গতকাল ভোর নাগাদ ধরা পড়ছিলো সে। গোটা দিনটা ওখানের থানার আর হেড কোয়াটারের ফর্মালিটিতে কেটেছে। সন্ধ্যের মুখে তারা ওখান থেকে ছাড়ে। অর্জুন মনে মনে ভাবছিলো এতটা রিস্ক সোম স্যার না নিলেই পারতেন।
মানিকের হয়ে গিয়েছিলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছিলো। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কোমরের কাছে দড়িটা শক্ত করে ধরে একটা হ্যাচকা টান দিলো। অর্জুন হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়লো মানিকের পায়ের কাছে। হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে গিয়ে অন্ধকারে কোথাও পড়ে গেল। অর্জুন চেঁচিয়ে উঠলো ” স্যার ?” ইন্সপেক্টর সোম সঙ্গে সঙ্গে দুটো ফায়ার করলেন। মানিক পেছন দিকে সরে গেল। আর গুলি দুটো গিয়ে সোজা লাগলো অর্জুনের মাথায়। ধপ করে কলাগাছের মতো পড়ে গড়িয়ে রাস্তার ধারে নয়নজলিতে পড়ে গেল অর্জুন। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটে গেল যে ইন্সপেক্টর সোম কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে মানিক ঝাঁপিয়ে পড়লো ইন্সপেক্টর সোমের ওপর। মানিক সজোরে ইন্সপেক্টর সোমকে মাটিতে চেপে ধরে রিভলবারটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। ইন্সপেক্টর সোমও গায়ে যত জোর আছে তাই দিয়ে মানিককে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিছুক্ষন সেই কাদার মধ্যে ধস্তা ধস্তি করার পর ধাম করে একটা আওয়াজ হলো। ইন্সপেক্টর সোম আঁক করে ছিটকে পড়ে গেলেন। গুলিটা কোমরের কাছে লেগেছে। মানিক এবার রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইন্সপেক্টর সোম চেঁচিয়ে উঠলেন ” না না। ”
মানিক ধাম ধাম করে দুটো গুলি করলো। ইন্সপেক্টর সোম লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। বৃষ্টির জলে লাল রক্ত মিশে ভেসে যেতে লাগলো। মানিক এগিয়ে গিয়ে পা দিয়ে একবার ঠেলে দেখলো সোমকে। নিথর দেহ। মানিক লাশের পকেট গুলো হাতড়াতে লাগলো। হাতড়াতে হাতড়াতে গাড়ির চাবিটা পেয়ে গেল। কিন্তু হাতকড়ার চাবিটা চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পেলো না। হঠাৎ রাস্তার ধারের নয়নজলি থেকে কাদা মাখা, রক্ত মাখা একটা বীভৎস মূর্তি টলতে টলতে উঠে এলো। মাথা থেকে মুখ বেয়ে গলগল করে বয়ে যাচ্ছে রক্ত। মূর্তিটা দুহাত দিয়ে পেছন থেকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরলো মানিক কে। চেপে ধরলো গাড়ির মধ্যে। তারপর মানিকের গলাটা গায়ের জোরে দুহাতে টিপে ধরলো। অতর্কিতে আক্রমণে কিছুটা বেসামাল হয়ে গেছিলো মানিক। মানিক দেখলো অর্জুন উঠে এসে তাকে চেপে ধরেছে। তার দশাসই চেহারা কাদা রক্তে মাখামাখি হয়ে বীভৎস অপদেবতার রূপ ধারণ করেছে। যদিও সমস্ত গায়ের জ্বরে দিয়ে অর্জুন মানিকের গলাটা চেপে ধরেছিলো তবু সে গায়ে তখন আর এত জোর ছিল না। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে তা ম্লান হয়ে গাছে। মানিক পা দুটো ভাঁজ করে জোড়া পায়ে অর্জুনকে একটা লাথি মারলো। অৰ্জুন আবার ছিটকে গিয়ে ছপাৎ করে কাদার মধ্যে পড়লো। আর এবার উঠতে পারলো না। একটু দূরেই একটা ট্রেন যাওয়ার শব্দ হচ্ছে। মানিক সাত তাড়াতাড়ি হাতকড়া পরা হাতেই কোনোরকমে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত গাড়িটা ঘোরাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভাগ্যদেবী মনেহয় সেদিন তার ওপর সদয় ছিলেননা। গাড়ির চাকাটা স্কিড্ করে বেসামাল হয়ে ধড়াম করে সামনের একটা খুঁটিতে ধাক্কা মারলো তারপর ডানদিকে একটা পাল্টি খেয়ে পড়ে গেল। মানিক জ্ঞান হারালো।
********
হাসপাতালের করিডোরে দ্রুত পায়চারি করছিলো লোকাল থানার ও সি মানস রায়। লোকটা ঘুমিয়ে পড়ার আগে বয়ান দিয়েছে যে তার নাম মানিক। প্রচন্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল মানিক। পাঁজরের একটা হাড় ভেঙেছে , ডান হাতে দুটো ফ্র্যাকচার। তাছাড়া মাথাতেও প্রচন্ড চোট পেয়েছে। ডাক্তার কড়া ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। প্রায় পুরো শরীরটাতেই ব্যাণ্ডেজ। মানস রায়ের চিন্তার অনেক গুলো কারণ আছে। এক লোকটা ঘুমিয়ে পড়ার আগে নিজের সম্মন্ধে যা বয়ান দিয়েছে তার সঙ্গে এক্সিডেন্ট স্পটে পাওয়া এভিডেন্সের কোনো মিল নেই। দুই একসিডেন্টের আওয়াজ পেয়ে যখন স্থানীয় লোকেরা দৌড়ে গিয়ে গাড়ির মধ্যে থেকে লোকটাকে বের করে নিয়ে আসে তখন তার হাতে হাতকড়া পরানো ছিলো। তিন লোকটা বারবার বৃষ্টির জলে গাড়ির চাকা পিছলে যাওয়ার কথা বলছিলো কিন্তু শুধু আজ কেন গত তিন চার দিন ছিটে ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি।
মানিক নামটাও যেন চেনা চেনা ঠেকছে মানসের। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। হঠাৎ কি মনে করে সে নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে কেউ ধরলো।
– ” হ্যালো লালবাজার? আমি বিজয়গড় থানার ও সি মানস রায় বলছি। একবার ডি সি অমর মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে পারি? হ্যাঁ, প্লিজ বলবেন একটা কেসের ব্যাপারে জরুরি কথা আছে। ”
কিছুক্ষণ চুপ। তারপর ওদিক থেকে কেউ বললো ” হ্যালো। ”
মানস বললো ” নমস্কার জ্যাঠাবাবু ভালো আছেন তো, আমি মানস বলছি চিনতে পারছেন ?”
ওদিক থেকে ডি সি মিত্র বললেন ” হ্যাঁ হ্যাঁ , মানস বলো। চিনতে পারবোনা কেন? আমি ভালোই আছি। কিন্তু কি ব্যাপার বলতো? রিসেপশন বললো কোনো কেসের ব্যাপার। কি হয়েছে ? তুমিতো এখন বিজয়গড়ে পোস্টেড্ নাকি? সব ঠিক তো ওখানে। ”
মানস বললো ” হ্যাঁ জ্যাঠাবাবু এখানে সবই ঠিক আছে। আসলে একটা ইনফরমেশন পাওয়ার জন্য আপনাকে ফোন করলাম। ”
ডি সি মিত্র বললেন ” হ্যাঁ বলো কি ইনফরমেশন। আমার জানা থাকলে নিশ্চই বলবো। ”
মানস বললো ” জ্যাঠাবাবু মানিক নামের কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে ? মানে ধরুন কাল বা আজ গ্রেফতার হয়েছে এমন। ”
ডি সি মিত্র অবাক হয়ে বললেন ” কেন বলো তো ? কি ব্যাপার?
মানস উত্তর দিলো ” আসলে আমাদের এখানে একজন হাসপাতালে ভর্তি আছে। সিরিয়াস এক্সিডেন্ট পেসেন্ট। সে বয়ান দিয়েছে তার নাম মানিক। মানিকচাঁদ দাস। উদ্ধার করার সময় হাতে হ্যান্ডকাপও পরানো ছিল। কিন্তু এক্সিডেন্ট স্পটে আমরা আর কাউকেই পাইনি। তাছাড়া ওই নামটা আমার খুব চেনা লাগছে। তাই আপনাকে ফোন করলাম। ”
ডি সি মিত্র উত্তেজিত হয়ে বললেন ” কি বললে? মানিকচাঁদ দাস? আর ইউ সিওর?”
— “হ্যাঁ জ্যাঠাবাবু আমি নিজে বয়ান নিয়েছি। ”
ডি সি মিত্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ” বাট হাউ ইট ইজ পসিবল ? ”
মানস বললো ” কেন জ্যাঠাবাবু?”
ডি সি মিত্র বললেন ” দ্যাখো মানস কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। মানিকচাঁদ দাস হলো কুখ্যাত পাউডার মানিক। চার বছর আগে একাউন্টারে সে মারা যায়। সে কিকরে তোমাকে বয়ান দিতে পারে? তুমি এক কাজ করো, তুমি আমার মোবাইল নম্বরটা নোট করে নাও ৪০২৩৫৬৮৯১৭। আমাকে লোকটার ছবি তুলে এক্ষুনি একটা হোয়াটস্যাপ করো। আমি দেখে তোমায় জানাচ্ছি। ”
মানস এবার বললো ” ঠিক ঠিক জ্যাঠাবাবু। পাউডার মানিক, এই জন্যেই নামটা এতো চেনা লাগছে। আমি এক্ষুনি আপনাকে হোয়াটস্যাপ করছি। আচ্ছা ছাড়ছি জ্যাঠাবাবু। ”
মানস কলটা কেটে তাড়াতাড়ি নম্বরটা সেভ করে নিলো। পেশেন্টের ঘরে গিয়ে মানিকের একটা ছবি তুললো তারপর ওই নম্বর এ হোয়াটস্যাপ মেসেজ করলো ছবিটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মানসের ফোনটা বেজে উঠলো। মানস কলটা ধরে বললো ” হ্যাঁ জ্যাঠাবাবু বলুন। ”
ওদিক থেকে ডি সি মিত্র বললেন ” আরে কি বলবো! তুমি যার ছবি পাঠিয়েছ সে আমাদের স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর ইন্সপেক্টর ভার্গব সোম। উনিই অপেরেশন পাউডার মানিকে লিড করেছিলেন, সঙ্গে ওনার ভাই ছিলেন ইন্সপেক্টর অর্জুন । কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত অর্জুন ওই অপেরেশনে মারা যান। আর তাছাড়া ইন্সপেক্টর ভার্গব তো এখন ছুটিতে আছেন। ”
মানসের মাথা বোঁ বোঁ করছিলো।
ডি সি মিত্র জিজ্ঞেস করলেন ” ওর সঙ্গে কোনো জিনিস পাওয়া গেছে? ”
মানস বললো ” হ্যাঁ, একটা মোবাইল, কিছু কাগজপত্র, পার্স, একটা ব্রেসলেট তাতে একটা ত্রিশুলের মতো পেন্ডেন্ট, একটা আই কার্ড আর একটা রিভলবার। ”
একজন কনস্টবল ছুটতে ছুটতে এসে একটা মোবাইল মানসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ” স্যার ফোনটা বাজছে। মনেহয় পেশেন্টের কেউ ফোন করেছে। ”
মানস এই ফোনে বললো ” জ্যাঠাবাবু আমি আপনাকে একটু পরে আবার কল ব্যাক করছি। ছাড়ছি এখন। ” বলে কনস্টেবলের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে দেখলো তার স্ক্রিনে মিতা নামটা দেখা যাচ্ছে। কলটা তাড়াতাড়ি ধরে বললো ” হ্যালো ”
ওদিক থেকে একটা মিষ্টি গলা ভেসে এলো ” হ্যালো। বাপি? তুমি কখন ফিরবে ? আমি খুব মিস করছি তোমাকে। ”
মানস বললো ” বাপিকে খুঁজছো। তোমার বাপির নাম কি ?”
ওদিক থেকে উত্তর এলো ” আমার বাপির নাম ভার্গব সোম। তুমি কে ?”
মানস হেসে বললো ” আমি? আমি একটা আঙ্কল। বাপি তো একটু কাজে ব্যস্ত আছে। তোমার মা ওখানে আছেন ? যদি থাকেন, ফোনটা একটু ওনাকে দেবে? ”
ওদিক থেকে বললো ” হ্যাঁ দিচ্ছি। ” কিছুক্ষণ পরে এক মহিলার গলা ভেসে এলো ওদিক থেকে ” হ্যালো কে বলছেন ?”
— ” মিসেস সোম ?”
— ” হ্যাঁ বলছি। আপনি? ”
— ” আমি বিজয়গড় থানার ও সি মানস রায় বলছি। দেখুন ইন্সপেক্টর সোমের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। উনি এখানেই স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ভয়ের তেমন কিছু নেই এখন। ডাক্তারের কথামতো উনি আউট অফ ডেঞ্জার। কিন্তু সমস্যা হলো কেন বুঝতে পারছিনা উনি নিজেকে মানিক বলে বয়ান দিচ্ছেন। ”
মিসেস সোম ভয়ার্ত গলায় বললেন ” ওহ মাই গড আরও একটা অ্য়াটাক। আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি ওখানে যাওয়ার জন্য। “