লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল বাইরের গেটের সামনে । রবীন বাবু বাজার থেকে ফেরার সময় দেখতে পেলেন । অনেকটা দূর থেকেই । কাছে এসে স্কুটারের ইঞ্জিনটা বন্ধ করে বললেন , কী ব্যাপার , উঁকি ঝুঁকি মারছ কেন ? স্কুটারের শব্দেই সতর্ক হয়ে গেছিল লোকটা । এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল ,বাগান পরিষ্কার করাবেন ? সুন্দর করে পরিষ্কার করে দেব ।
রবীনবাবুর সখের বাগান । পাঁচিলের চার পাশে নারকোল আর সুপারি গাছের সারি । মাঝখানে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ । অফিসের কাজে বাইরে গেছিলেন । ফিরেছেন দিন তিনেক আগে । চোখে পড়েছে বাগানে আগাছার বাড় -বাড়ন্ত । সামনে দূর্গা পুজো । বাগানটা পরিষ্কার না করলেই নয় । কিন্তু একটা লোক পাচ্ছিলেন না । ভালোই হলো এ কে দিয়ে জঞ্জাল সাফ করানো যাবে ।
বললেন , তুমি দাড়াও । আমি আসছি ।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে স্ত্রী কে বললেন , সুলোচনা , একটা লোক পেয়েছি । ভাবছি বাগানটা পরিষ্কার করিয়ে নিই ।
কোথায় পেলে ?
বাইরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল ।
চোর-টোর না তো ?
না না , পুজোর আগে এরা তো কাজের জন্য আসে ।
হলেই ভালো । আমি কিন্তু চা রুটি দিতে পারবো না । দশটায় আমার পার্লারে যাওয়া আছে । মালবিকা বলে দিয়েছে যে এরপরে খুব রাশ হবে । দীপকে তুমি স্নান করিয়ে দিও । আজকে আবার মালতির মা আসে নি ।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়েই রবীনবাবু বাইরে এলেন ।
কী নাম তোমার ?
আজ্ঞে , তারক মন্ডল ।
বাড়ি কোথায় ?
গোবরডাঙ্গায় ।
গোবরডাঙ্গা থেকে এতদূরে এসেছ ?
কী করবো বাবু , গরিব মানুষ । বউটার ক’দিন ধরে জ্বর । কিছুতেই কমতিছে না । শুধু ডাক্তার দেকালি কি হপে ? বিস্তর ওষুধ পত্তর কেনা নাগবে । কে দেবে বাবু ?
কত নেবে ?
সে আপনি যি টা ন্যায্য মনে করবেন সিটা দিবেন ।
সে বললে হয় ? কাজ করবে তুমি । অত দূর থেকে এসেছ । বলো , কত দেব ? একশো দিলে হবে ?
বড্ড কম হয়ে গেল না ?
ঠিক আছে , দেড়শো ।
পুরোপুরি করি দ্যান বাবু ।
শোনো , খুব সাবধানে কাজ করবে । চুরি-টুরি করবে না । যাও , শুরু করে দাও ।
পার্লারে যাওয়ার জন্য সুলোচনা প্রস্তুত । ঘড়ি পড়তে গিয়ে দেখে ঘড়ি নেই । কোথায় গেল ? ভালো করে মনে করে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘড়ি থাকে । পরশু দিন দেখেছে । কালকে দেখেছে কি না মনে নেই । ছেলে রত্নদীপ পাশের ঘরে বাবার সাথে খেলা করছে । সুলোচনা জিজ্ঞেস করলো , আমার ঘড়ি দেখেছ ?
রবীনবাবু বললেন , আমিতো জানি না । কেন , ড্রেসিং টেবিলে নেই ?
মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো সুলোচনা , থাকলে কী আর জিজ্ঞেস করি ? একটা জিনিস যদি জায়গা মত থাকে । সবার সব কিছুতে হাত দেওয়া । পই পই করে বলেছি যে আমার জিনিসে কেউ হাত দেবে না । কে শোনে কার কথা । জিজ্ঞেস করলেই সব ন্যাকা সাজে । আকাশ থেকে পড়ে । তারপর রবীনবাবুর দিকে তাকিয়ে রূঢ় ভাবে বলল , বলি , এখানে সঙের মত বসে থাকবে না খুঁজে দেখবে কোথায় গেল আমার জাপানি ঘড়িটা ? অত দামি ঘড়ি । দাদা এনে দিয়েছিল জাপান থেকে । এখনো এক বছরও হয় নি । যদি না পাই আমি কাউকে ছাড়বো না । থানায় গিয়ে রিপোর্ট করবো ।
রবীনবাবু বুঝতে পারছেন যে সমস্ত কথাই তার উদ্দেশ্যে বলা । সুলোচনার যখনই কিছু হারায় তার জন্য রবীনবাবুকেই দায়ী করে । আশ্চর্য , পরে যখন খুঁজে পায় তখন আর নিজের দোষ স্বীকার করে না । সারা বাড়ি তন্য তন্য করে খুঁজেও পাওয়া গেল না ঘড়ি । ও দিকে পার্লার থেকে সমানে ফোন করছে মালবিকা । আর মাত্র দু দিন বাদে পুজো । এরপর ভিড় বেড়ে যাবে । কান্না পাচ্ছে সুলোচনার । চিৎকার করে বলতে লাগলো , ঘড়ির কি পাখা গজিয়েছে ? ডানা মেলে উড়ে গেল ?
ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার কথা শুনে রত্নদীপ বলল , কালকে ব্যাট দিয়ে বল মারছিল । বলটা উড়ে গিয়ে গোলাপ বাগানে পড়েছে ।
রবীনবাবু বললেন , তার মানে দীপ তোমার ঘড়িটাকে বল বানিয়ে মেরেছে ।
কী করেছিস তুই ? চিৎকার করে উঠলেন সুলোচনা । আমার ঘড়ি যদি না পাই তাহলে তোর পিঠে এই লাঠি ভাঙ্গবো ।
ভয়ের চোটে দীপ গিয়ে তার বাবার পেছনে লুকালো । রবীনবাবু ছুটলেন বাগানে । তারক একমনে জঞ্জাল সাফ করে চলেছে ।
রবীনবাবু বললেন , তারক , এখানে একটা ঘড়ি পেয়েছ ?
তারক বলল , ঘড়ি ! কই না তো । আমি তো এখানে কোনো ঘড়ি দেখি নি ।
সুলোচনা বাগানে এসে হাজির । ধমক দিয়ে তারক কে বলল , দেখি নি বললেই হলো । এখানেই কালকে আমার ছেলে ঘড়িটা ফেলেছে । তুমি ছাড়া কেউ আসে নি এখানে । তাহলে গেল কোথায় ?
রবীনবাবু মিউ মিউ করে বললেন , ওতো বলছে দেখে নি । দেখতে পেলে নিশ্চয়ই বলতো ।
তুমি চুপ কর । এদের আমি খুব ভালো ভাবেই চিনি । শোনো , ভালোয় ভালোয় যদি না বের কর তাহলে থানায় খবর দেব । তুমি আমাকে চেন না ।
একটু ভয় পেয়ে গেল তারক । সত্যি সত্যি যদি থানায় খবর দেয় তাহলে ? পরে ভাবলো যে তাকে ভয় দেখাবার জন্য ওসব বলছে ।
মরিয়া হয়ে বলল , সত্যি বলছি মা , আমি কোনো ঘড়ি দেখি নি । দেখলে তো বাবুকে ডেকে দিয়ে দিতাম ।
সুলোচনা বলল , সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না । দাঁড়া ,দেখাচ্ছি মজা ।
ইতিমধ্যে আবার ফোন । মালবিকা জানতে চায় সে কী করবে । অন্য কাস্টমার তাড়া লাগাচ্ছে । সুলোচনা জানিয়ে দিল যে সে যাবে না । এখন ব্যস্ত আছে । পরে ফোন করবে । তারপর ফোন করলো লোকাল থানায় । রবীনবাবু থানা -পুলিশ না করতে বলেছিলেন । কিন্তু কে শোনে কার কথা ? সখের জাপানি ঘড়ি চুরি গেছে । সুলোচনার এখন মাথার ঠিক নেই । থানার অফিসারকে বলল , এখনি আসুন । চুরির কেস । চোর ধরে রেখেছি ।
এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল তারক । পুলিশ যদি তাকে ধরে তাহলে মারের চোটে আধমরা করে ছাড়বে । বিশ্বাসই করবে না তার কথা । পুলিশের গাড়িটা এসে থামলো গেটের সামনে । পুলিশ অফিসারের সাথে দুজন কনস্টেবল । পুলিশ দেখে এগিয়ে এল সুলোচনা ।
বলল , আসুন স্যার । এই সেই ঘড়ি চোর । আমার ঘড়িটা ওর কাছেই আছে ।
দুজন কনস্টেবল গিয়ে ধরলো তারক কে । ঠিক আছে , আমরা ওকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি । দুটো লাঠির বাড়ি পিঠে পড়লেই সুর সুর করে ঘড়ি বেরিয়ে পড়বে ।
তারককে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গজগজ করতে করতে সুলোচনা চলে গেল তার ঘরে । দীপকে স্নান করাতে হবে । রবীনবাবু বাগানে তখন একা । ভাবলেন একবার ভালো করে বাগানটা খুঁজে দেখলে হয় । যদি পাওয়া যায় । সত্যি পাওয়া গেল । একটা গোলাপ গাছ তলায় শুকনো পাতার আড়ালে পরে আছে ঘড়িটা । মনটা খারাপ হয়ে গেল । লোকটা শুধু শুধু মার খাবে । চুরি না করেও চোরের অপবাদ পেল লোকটা । কাজটা ভালো হলো না । ঘড়িটা নিয়ে রবীনবাবু সোজা গেলেন সুলোচনার কাছে । বাথরুমে সে তখন দীপকে স্নান করাচ্ছে ।
রবীনবাবু বললেন , ঘড়িটা পাওয়া গেছে ।
চিৎকার করে উঠলো সুলোচনা , কোথায় ? থানা থেকে ফোন করেছিল ? তোমাকে বললাম না , এরা এক একটা পাকা চোর ।
না ।
কি না ?
তারক মানে ওই লোকটা চুরি করে নি । গোলাপ গাছ তলায় পরে ছিল শুকনো পাতার আড়ালে । ব্যাচারা শুধু শুধু মার খেল । আমি এখনই থানায় গিয়ে লোকটাকে ছাড়িয়ে আনছি । থানায় গিয়ে রবীনবাবু জানালেন যে ঘড়িটা বাগানেই পাওয়া গেছে । হঠাৎ গরাদের দিকে নজর যেতেই আঁতকে উঠলেন । মারের চোটে অর্ধ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে লোকটা । অফিসার বললেন , ভয় নেই , বেঁচে আছে । হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব । নিয়ম মেনে কয়েকটা সই -সাবুদ সেরে বেরিয়ে এলেন রবীনবাবু । মনটা খারাপ হয়ে গেল । ব্যাচারা কাজের টাকাটাও পেল না উল্টে চোর বদনামে মার খেল । বলছিল বউটা অসুস্থ । একটু টাকা পেলে বউয়ের চিকিৎসা করাতে পারে । কাল সকালে একবার হাসপাতালে যাবেন বলে ঠিক করলেন । তারক কে চুপি চুপি বেশ কিছু টাকা দিয়ে দেবেন যাতে বৌয়ের চিকিৎসা ভালোভাবে করাতে পারে ।
হাসপাতালের ডাক্তার সমাদ্দার রবীনবাবুর পরিচিত । তারকের বর্ণনা দিতেই বললেন , সে তো কাল রাত্রেই মারা গেছে । ডেডবডি পুলিশ পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েছে । লোকটা নাকি চুরি করে পালাচ্ছিল , পাড়ার ছেলেরা ধরে এমন মার মেরেছে যে রাতেই মুখে রক্ত উঠে মারা যায় । অবাক বিস্ময়ে ডাক্তার সমাদ্দারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রবীনবাবু ।