বছর দুই আগেকার ঘটনা।কিন্তু ভাবলে আজও সারা শরীরে শিহরণ জেগে ওঠে। ছোট বেলার মধুর স্মৃতিও যে এইরূপ ভয়াল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তা আমার কল্পনাতীত।
আমি সাত্যকী।কলকাতার নামী প্রাইভেট কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত বছর পঁয়ত্রিশের একটি গুটিপকা।দিন যায় ,রাত যায়,দৈনন্দিন সমস্যা বারে..। কাজের চাপ ও ফাইলের ভারে প্রতিনিয়ত নিজের খোলসের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছি।শেষপর্যন্ত দমবন্ধ দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে অফিসে দিন পনেরো ছুটির দরখাস্ত দিয়েই ফেললাম।ছুটি মঞ্জুর হতেই বেরিয়ে পড়লাম।আগেই ঠিক করেছিলাম ছুটি পেলে আসাম যাবো।তাই বেরিয়ে পড়লাম দূরসম্পর্কের এক পিসির বাড়ির উদ্দেশ্যে,জোরহাট…।
হপ্তাখানেক আগে একটা চিঠি পেয়েছিলাম।তাতে লেখা ছিল পিসি আমাকে যত শীঘ্র সম্ভব ডেকে পাঠিয়েছে।চিঠি দেখে অবাকই হয়েছিলাম ,যে আজকালকার যুগেও কেউ চিঠি পাঠায়।পরে কাজের চাপে মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে এসবকিছু….।
ছোটবেলা থেকেই এই পিসির বাড়ির প্রতি ছিল আমার অমোঘ আকর্ষণ,আর তার একমাত্র কারণ মধুকর…পিসির বিশ্বস্ত চার দশক পুরোনো ভৃত্য।আসলে পিসির বাড়িটাকে বাড়ি না বলে, বাগান বাড়ি বললেই ভালো হয়, ওটা ছিল পাহাড়ের কোলে আমাদের ছুটি কাটানোর জায়গা। কারণ পিসেমশাই এর কাজের সূত্রে পিসিরা সপরিবারে থাকতো গুয়াহাটিতে । পিসির একটিমাত্র ছেলে,বুম্বাদা,বয়েসে আমার থেকে বছর চারেক বড়।দুই ভাই মিলে সারাবাড়ি মাথায় করে রাখতাম।আমি পিসির কাছে তার নিজের ছেলের থেকে কিছু কম ছিলামনা।

বছরে অন্তত দুবার আমরা ছুটি কাটানোর সময় সকলে হাজির হতাম এই বাগানবাড়িতে।ওটাই ছিল পিসোর আদিবাড়ি।শহরের শেষ সীমানায় একধারে পাহাড়ের মাথায় কাঠের তৈরি ছোট্ট বাড়ি।শেষপ্রান্তে বাড়ি হওয়ায় আশেপাশে জনবসতি নেই বললেই চলে।বাড়ির সামনে একচিলতে রেলিং ঘেরা বারান্দা।সেখান থেকে প্রধান ফটক পর্যন্ত নুড়ি বিছানো রাস্তা।বাড়ির সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত ঘেরা বাগান।পিছন বাগানের শেষে খাড়া পাহাড়ি খাত।এককথায় স্বপ্নপুরী।
মধুকাকাই হলো এই স্বপ্নপুরীর কেয়ারটেকার।ওর তত্ত্বাবধানে শীতকালে বাড়ির বাগানে বসত ফুলের মেলা ….সূর্যমুখী,লিলি,অর্কিড,রোডোডেনড্রোন ,আরো কত কিছু। ফুলগুলি পাহাড়ের কোল থেকে বয়ে আসা বাতাসে যেন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাদের ডাকত।ওদের দেখে আমার মন একপ্রকার অনাবিল আনন্দে ভরে যেত।
ছেলেবেলায় যখন ওখানে যেতাম মধুকরের বয়স তখন চল্লিশ।লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা,শ্যমবর্ণ, একমাথা কোঁকড়া চুল,আর গালে একটি দৃশ্যায়মান অতিকায় জরুল।তার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ানোই ছিল আমার প্রধান কাজ।সকালে ওর সাথে বাজারে যাওয়া, দুপুরে তার সাথেই রাঁধুনি হওয়া, খাওয়ার পর গল্প শোনা,আবার বিকেলে ফুলের বাগানে মালির কাজ…..সবেতেই আমি তার প্রধান সহকারী।

যেবার পিসো মারা গেল ,তারপর থেকে পিসি একলা গিয়েই ওখানে থাকতে শুরু করলো।বুম্বাদা চাকরি সূত্রে চলে গেল আফ্রিকা।বছরে একটিবার ছুটি পায়। হয়তো তখনই একবার আসে।

এদিকে উচ্চমাধ্যমিক এর পর থেকে আমার ঘোরাফেরা একপ্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।সংসারের চাপে দুই পরিবারের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন।তাও আমার মাঝে মধ্যে পিসির সাথে ফোনালাপ চলতেই থাকত।কিন্ত শেষ 1 বছর ধরে কোনো খবর পাইনি।আজ দীর্ঘ কুড়ি বছর পর আবার বেড়িয়েছি পিসির বাড়ির উদ্দেশ্যে।পিসিকে সারপ্রাইজ দেব বলে কিছু জানালামনা। প্লেনের টিকিট না পেয়ে অতঃপর বুধবার চিৎপুর থেকে রাত সাড়ে নয়টায় কলকাতা-ডিব্রুগর ট্রেনে জোরহাট উদ্দেশ্য
রওনা দিলাম, শীতকাল, আশা করি বিশেষ অসুবিধা হবেনা। ট্রেন ছাড়তেই সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে জানলার ধারে সাইড বার্থে বসে, দুপা ছড়িয়ে একটি সিগারেট জ্বেলে নিলাম।ব্যান্ডেল আসতেই ক্ষিদের জ্বালা অনুভব করে খানিক পেটপুজো করে, ট্রেনে উঠে আবার যথাস্থানে শুয়ে পড়লাম।পরদিন সকালে চোখ খুলতে দেখলাম ট্রেন জলপাইগুড়ি দাঁড়িয়ে।প্রয়োজনীয় সব কাজ সেরে ,নিজের বার্থে ফিরে এসে হাতঘড়িতে দেখি 10টা বাজে। ট্রেন তখনও কোচবিহার ঢোকেনি, গাড়ি এক ঘন্টা লেট এ চলছে।
এখনো পৌঁছাতে কম করে বারো ঘন্টা লাগবে। অগত্যা কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগলাম।হাজারো এলোমেল চিন্তা, এতদিন বাদে পুরোনো জায়গায় ফিরে যাওয়ার উৎকণ্ঠা সব মিলিয়ে পুরো দিনটা কোথা থেকে পার হয়ে গেল।অবশেষে যখন মরিয়ানী জংশনে পৌছালাম, তখন রাত সাড়ে এগারোটা। এখন থেকে জোরহাটের জন্য আবার ট্রেন ধরতে হবে।স্টেশনে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্বিতীয় ট্রেনের খোঁজ করতে যেই পা বাড়িয়েছি,রীতিমতো আশ্চর্য হওয়ার পালা, কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে যেন আবির্ভাব হলো মধু কাকার।শরীরে বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট, মুখে বলিরেখা, কপালে ভাঁজ, মাথায় টাক ,পরনে আধময়লা ধুতি পাঞ্জাবি কিন্তু গালের জরুলটা সেই আগের মতোই।
আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন “সতু,এত দেরি করে এলি বাবা।সেই কবে চিঠি দিয়েছি…..।আজ এখানে পরের ট্রেন আসতে অনেক দেরী হবে,তাই আমিই নিতে চলে এলাম”।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে ,আর কিছুই জিজ্ঞেস না করে আমি কাকার সাথে সোজা স্টেশনের বাইরে চলে আসলাম।একবারও মাথায় এলোনা যে আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে এসেছি। এসে দেখি কাকা আগের থেকেই পুরোনো ভগ্নদশা প্রায় একটি আম্বাসেডর নিয়ে হাজির করে রেখেছে।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকা,তুমিও শেষ পর্যন্ত গাড়ি চালানো শিখে নিলে !”
কাকা ম্লান হেসে বলল “ওই আর কি। মা ঠকুরুনের শরীরটা তো বিশেষ ভালো থাকেনা, তাই রাতবিরেতে দরকার পড়লে কাকে পাবো। সেইজন্যই শেখা আর কি।”
কাকাকে চিঠির কথা জিজ্ঞেস করতে বললো, বাড়ির ল্যান্ডলাইন টা খারাপ হয়ে আছে তাই চিঠি পাঠাতে হলো।আমার আসার কথা জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই কাকা বলে উঠলো ,”তোমার মা আগেই খবর পাঠিয়েছে, তুমি এখানে আসছ”।
বাক্যব্যায় না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম।আমাদের গাড়ি আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো।বুঝলাম কাকার নতুন হাত, তাই সাবধানে চালাচ্ছে।নিশুতি রাতে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে মন্থর গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে।দুধারে সারি সারি গাছ, তার মাঝে দুএকটা বাড়ি।এদিকটায় এরকম ধরনেরই বাড়িই বেশি।সন্ধ্যে নামলেই সবাই যে যার ঘরে।রাস্তাঘাট শুনশান।
বাড়ি পৌঁছাতে ঘন্টা খানেক সময় লাগবে।কিন্তু যে গতিতে গাড়ি চলছে তাতে দুই ঘন্টা লাগাও কিছু আশ্চর্যজনক নয়।অবশেষে কাকাকে বলে ,গাড়ি থামিয়ে আমিই চালাতে শুরু করলাম।
মিনিট কুড়ি চলার পর গাড়িটা হটাৎ ধাতব যান্ত্রিক শব্দ করতে করতে একসময় বন্ধ হয়ে গেল। এতো মহাবিপদ, এখনো সাত আট কিলোমিটার পথ বাকি।পিছনে কোনো গাড়ি আসছে কিনা লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখতে যাবো, এমন সময় পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ব্যাক সিটে কেউ বসে, আলো আধারীতেও বুঝতে পারলাম কোনো পুরুষ ! সর্বাঙ্গ কালো ছায়ার মতো, চোখ দুটো ধিকি ধিকি জ্বলছে।চকিতে পিছন ফিরে দেখলাম, কিন্তু কেউ নেই। পাশে কাকার দিকে তাকাতে দেখলাম, তিনি অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। তিনি বললেন “কিরে গাড়ি থামালি কেন ?”
আমি বললাম ” শুনলেনা , ইঞ্জিনে আওয়াজ হলো। তাই থেমে গেলো”।
কাকা বললো ” কই না তো ! ”
ইঞ্জিনে আবার স্টার্ট দিতেই , গাড়িটিও আর কোনো দিরুক্তি না করে আগের মতোই চলতে লাগলো।ভারী অদ্ভুত তো। যাই হোক আর ত্রিশ মিনিট পর আমরা বাড়ি পৌছালাম।

প্রধান ফটকের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামতে,কাকা গাড়ি নিয়ে পিছন দিকে রাখতে চলে গেল।কিন্তু বাড়ি আসতেই গা শিউরে উঠলো।একি অবস্থা হয়েছে বাড়ির। না আছে সেই বাগান, না আছে সেই বাড়ি।চারিদিকে জরাজীর্ণ বেড়া, যেখানে সেখানে ভেঙে পড়েছে। বাগানের পরিবর্তে চারদিকে খালি আগাছা আর লম্বা শুকনো ঘাস। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধুমাত্র ঘর থেকে টিম টিমে হলুদ আলো বেরিয়ে আসছে। সেই আলোতেই পুনরায় নজরে গেল এক ছায়াকৃতির দিকে ,বারান্দায় রেলিং ধরে এদিকেই যেন চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দূর থেকেই পিসি বলে ডাক দিলাম। আমার আওয়াজে মধুকাকা ছুটে এলো। বললো ” কাকে ডাকছ ?”
আমি বললাম ” কেন, পিসিকে” ।
মধু কাকা বললো ” সেকিগো, মা ঠাকুরুন তো খুবই অসুস্হ, দিন দশেক ধরে প্রচন্ড সর্দি কাশিতে ভুগছে।এখন ঘরে ,বিছানায় শুয়ে আছে।”
আমিও বাড়ির দিকে মুখ ফেরাতেই দেখলাম আর কেউ নেই সেখানে। জিজ্ঞেস করলাম “পিসির এত শরীর খারাপ, বুম্বাদা এলো না ?”
কাকা উদাস দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “দাদাবাবু আর আগের মতো নেই গো সতুবাবু। বড়বাবু মারা যাওয়ার পর সেই যে গেল বিদেশে, আবার এলো সেই বছর খানেক আগে।” বলতে বলতে কাকার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
অবস্থা বুঝে আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, চলো ঘরে গিয়ে পিসিকে আগে দেখি।
আমার কথা শুনে মধু কাকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল ” আগে ঘরে গিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে ফেল দেখি। মা ঠাকুরুন ঘুমাচ্ছে এখন।কাল সকালে দেখা কোরো। এখন না হয় , দুটি কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়। বড় রাত হয়েছে। তোমার ঘর তৈরি আছে, চলো আমার সাথে।”
কাকার পিছু পিছু করিডোর ধরে এগিয়ে চললাম।চারদিকে যত্নের অভাব স্পষ্ট।জায়গায় জায়গায় কাঠের তক্তা খুলে এসেছে…কোথাও ফাটল ধরেছে।মনে মনে ভাবলাম একা মানুষ আর কত করবে।তবে একটা জিনিস দেখে বড় আশ্চর্য হলাম যে , এখনো পর্যন্ত বাড়ির যত অংশ দেখলাম, সব জায়গায় সিসিটিভি বসানো।কাকা খানিক আমার মনের ভাব ধরে নিয়ে বললো “বড়বাবু মারা যাওয়ার আগের বছরই সব লাগিয়ে গিয়েছিলেন।এদিকটা বড় নির্জন কিনা,যদি কোনো দিন কিছু বিপদ হয়”।
অবশেষে আমরা গিয়ে পৌছালাম পশ্চিম দিকের শেষের ঘরটায়।মাঝারি সাইজের ঘর।ঘরের একপাশে পুরোনো আমলের একটা পালঙ্ক, পাশে একটি টেবিল। আর ঘরের অন্যদিকে বড় একটি জানলা, জানলার পাশে সূক্ষ কারুকার্য করা কাঠের বড় আলমারি।কাকা লাগেজ ব্যাগটা টেবিলে রেখে খাবার আনতে চলে গেলেন।আমি ঘরে ঢুকে সবার আগে পশ্চিমের জানলাটা খুলে দিলাম। জানলার ওপারেই ছোট বাগানটা পেরিয়ে পাহাড়ের কিনারা।বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার, একটা জোনাকির আলো পর্যন্ত নেই।আমার সেই স্বপ্নপুরী যেন মৃত্যুপুরীর মতো লাগছে।হটাৎ পিছনে শব্দ পেতে চিন্তায় ছেদ পড়লো। কাকা খাবার রেখে গেছে। খাবার খেয়ে শুতে গিয়ে দেখি রাত 2 টো বাজে।সারাদিনের ক্লান্তির পর বিছানায় শুতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।আচমকা জানলার কাছে খুটখাট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল।চোখ খুলতে দেখলাম একটা আবছায়া সরে গেল।খানিক অবাক হলেও মনের ভুল ভেবে আবার শুয়ে পড়লাম।কিন্তু আবার সেই শব্দ….ঠক ঠক। তৎক্ষনাৎ বিছানায় উঠে বসলাম।পাশের আলমারি থেকে আসছে।মৃদু কিন্তু সুস্পষ্ট…যেন আলমারির ভিতর থেকে খুব সাবধানে কেউ টোকা মারছে।ঘাড়ের লোম পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেল।খানিক বাদে টোকা মারার শব্দ বন্ধ হয়ে দেওয়াল আঁচড়ানো শব্দ শুরু হলো।মনে হচ্ছে কেউ আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভিতর থেকে বেরোনোর।কাঠ হয়ে এক জায়গায় বসে রইলাম।সহসা দরজার বাইরে প্রচন্ড করাঘাত শুরু হলো।মনে অদম্য ইচ্ছা,অথচ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতে সাহস হলোনা।প্রবল উৎকন্ঠায় দাঁতে দাঁত চেপে বসে একই জায়গায় বসে রইলাম।খানিক বাদে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।মনে সাহস জাগতে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে।যথারীতি দরজা খুলে কারো দেখাই পেলামনা। দরজা বন্ধ করে পিছন ফিরতেই হৃদপিন্ড একলাফে গলার কাছে চলে আসলো।আলমারির পাশে আলোআধারীতে দাঁড়িয়ে সেই ছায়ামূর্তি, যাকে গাড়িতে দেখেছিলাম। পার্থক্য একটাই, এবারে তার দৃষ্টি আরো উগ্র।আমার প্রতি তার জিঘাংসা স্পষ্ট…অযাচিত অতিথি তার যে নিতান্তই অপছন্দের।নিজের অজান্তেই দুপা পিছিয়ে গেলাম।ছায়ামূর্তি কাঠের আলমারির গায়ে নখের তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে ঝড়ের বেগে ধেয়ে এলো……আমিও সেই মুহূর্তে সর্ব শক্তি দিয়ে প্রানপনে চিৎকার করে উঠলাম… “মধুকাকা”
আমার পিছনের দরজা সশব্দে খুলে আর এক আবছায়া প্রবেশ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো আগের অবয়বের উপর।কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রবল আতঙ্কে জ্ঞান হারালাম।
পরদিন সকালে জ্ঞান আসতে দেখলাম পরে আছি জরাজীর্ণ আধভাঙ্গা বাড়িতে। চারদিকে মাকড়সার জাল।মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ।মেঝে থেকে কোনোরকমে উঠে টাল খেতে খেতে এগিয়ে চললাম পিসির ঘরের দিকে।
কিন্তু পিসির ঘরে দরজার কাছে এসেই পা আটকে গেলো।শীতের সকালেও অঝোরে ঘামতে শুরু করলাম। স্বর আটকে গেলো,গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছে।আতঙ্কে কেবল আ…আ..আ করে অস্পষ্ট শব্দ বেরোলো……..আমারই চোখের সামনে পিসির বিছানায় শুয়ে আছে চাদর ঢাকা দেওয়া একটা কঙ্কাল আর তার পা দুটি ধরে মেঝেতে বসে দ্বিতীয়টি।
খানিক্ষণ বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে, সম্বিৎ ফিরে পেতে ফোন করলাম পুলিশে।কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ চলে এলো।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিতে, আমি একটি স্থানীয় হোটেলে এসে উঠলাম।সুস্থ স্বাভাবিক হতে আর কিছু সময় লাগলো।
এদিকে পুলিশ পুরো বাড়ি সার্চ করে যাবতীয় প্রমান জোগাড়ের চেষ্টায় লেগে গেলো।  সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার তারা বাড়ির স্টোররুম থেকে যখন কিছু পুরোনো কম্পিউটারের ইউনিট খুঁজে পেল তখনও তাতে থাকা সিসিটিভির হার্ডডিস্ক সম্পূর্ণ অক্ষত । ক্যামেরা গুলি প্রায় বছরখানেক আগে অচল হলেও, ফরেনসিক টিমের সাহায্যে পুলিশ সিসিটিভির সমস্ত ফুটেজ সংগ্রহ করে নিলো।
কিন্তু এতকিছু হওয়ার পরেও আমার সকল ধারণের উর্দ্ধে যে আরও এক ভয়ংকর সংবাদ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তা ছিল আমার কল্পনাতীত, যা বাড়ি সার্চ করতেই বেরিয়ে এলো।কাঠের আলমারিতে পাওয়া গেলো তৃতীয় একটি কঙ্কাল। রিকভারি করা ডিস্ক থেকে পাওয়া , সিসিটিভির পুরোনো সব ভিডিও দেখার পর এবং পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়ে এলো আরও এক অতি ঘৃণ্য তথ্য, যা বর্তমান সমাজের এক ঘৃণ্য দিককে  পুনশ্চ সকলের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে।পুলিশ জানালো প্রায় বছর খানেক আগে বুম্বাদা বিদেশ থেকে এখানে আসে।কিন্তু তার উদ্দেশ্য সঠিক ছিলোনা। পিসির সব সম্পত্তি নিজের নামে করিয়ে নিতে কাগজে সই করানোর জন্য এক গভীর রাতে পিসির ঘরে প্রবেশ করে সে।প্রচন্ড বচসার পর অসুস্থ পিসি যখন জানিয়ে দেয় তিনি কোনো ভাবেই এতে সম্মত নন, তখন দাদা পিসির মুখে বালিশ চেপে ধরে।সেই সময় ঘরে আসে মধুকাকা, প্রানপনে চেষ্টা করে তাকে আটকানোর। কিন্তু এক বৃদ্ধ কিভাবে যুবকের বিরুদ্ধে পেরে উঠবে…অতথচ মা ঠাকুরুনকে বাঁচানোর আর কোনো পথ না পেয়ে , পাশে টেবিলে রাখা ফুলদানি দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন তার মাথায়।বুম্বাদা তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বৃদ্ধ তার জ্ঞান ফেরার ভয়ে তাকে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের আলমারিতে আটকে দিলেন। এদিকে বৃদ্ধ তার মা ঠাকুরুনের কাছে এসে দেখলেন তিনি আর নেই।চরম শোকে দুঃখে বিধস্ত সেই বৃদ্ধ বাড়িতে রাখা কীটনাশক খেয়ে সেখানেই আত্মহত্যা করলেন।অপরদিকে আলমারিতে থাকা লোকটি তখনও মারা যায়নি।বিধাতা তার অদৃষ্টে তার পাপের শাস্তি লিখে রেখেছিল।তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে সেখানেই মারা গেল সে।মুত্যুর আগে পর্যন্ত প্রানপনে চেষ্টা করেছে মুক্তি পাওয়ার।আলমারির ভিতরের দেওয়ালে তার নখের দাগ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

সব কিছু জানার পর সাত্যকী মনে একটাই প্রশ্ন আসে।তবে তাকে চিঠি দিয়েছিল কে ? হোটেলে বসে বিছানার উপর রাখা ব্যাগ খুলে,এলোপাথাড়ি হাতড়াতে থাকে সে। স্পষ্ট মনে আছে তার, ডানদিকের সাইড পকেটেই রাখছিল চিঠিটা….এখন জায়গাটা খালি।একটাই প্রশ্ন সাত্যকীর মাথায় বারংবার ঘুরতে থাকে….”তবে কে ?”

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleজন্মাজন্ম
Next articleসূবর্নরেখার সুরে
moumita acharyya
আমি মৌমিতা, b.tech কম্পিউটার সায়েন্স এর একজন প্রাক্তন ছাত্রী। বর্তমানে লেখালিখি করি, ছোট বড় মোট 20টি রচনা অনলাইনে প্রকাশ করেছি। গল্পের শ্রেণী মূলত হরর জঁ।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments