উদ্যত ছুরির ফলা অন্ধকারের বুক চিঁড়ে এগিয়ে আসছে। বাদশাহী ছোড়া। ক্রমশ এগিয়ে আসতে আসতে তা এপার ওপার করে দিল কারুর বুক। পাথুরে মাটি ভিজে গেল তাজা গরম রক্তে। একটা শরীর ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে গেল। সুবিশাল প্রাসাদের থাম, গম্বুজে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল তীব্র আর্তনাদ।
“ তুমি কি রোজই এই স্বপ্ন দেখো সুজন?”
— রোজ না তবে মাঝে মাঝে। যখন ঘুম বেশ গাঢ় হয়ে আসে। বিশেষ করে ভোরের দিকে।
— তুমি শিওর, ছুরিটা তোমার বুকেই এসে বিঁধছে। তুমি কি দেখেছ?
— না কিন্তু… আমি শিওর নয়। কিন্তু সেই সময় খুব ভয় করে। মনে হয় আমি হয়তো সত্যিই মরে যাবো।

সুজনের কথার মাঝেই ডুকরে উঠল সুজাতা। ডক্টর গাঙ্গুলি তাঁকে চোখের ইশারায় থামতে বলে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
— ঠিক কখন থেকে এই ঘটনাটা ঘটছে বলতে পারবে? মানে এটা তো বেশি দিনের ব্যাপার নয় বললে।
— না, দশ পনের দিন হবে। প্রথমে ভেবেছিলাম হরর মুভি দেখার জন্য এরকম মনে হচ্ছে। তাই মুভি দেখা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তার পরেও এই স্বপ্ন আসা বন্ধ হলো না।
— তখন কি মনে হয় তোমার?
— ভীষণ অসহায় লাগে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। যেন সত্যিই কিছু একটা অঘটন ঘটবে।

সুজন ও তার বাবা মা চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই ডক্টর গাঙ্গুলি তাকালেন চেম্বারের এক কোণে বসে থাকা লোকটার দিকে। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “ সব শুনলি?” লোকটি তার জায়গা থেকে উঠে এসে টেবিলের সামনের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, “ শুনলাম, বুঝলাম।”
— কি বুঝলি।
— ঘটনার সূত্রপাত কোথাও একটা হয়েছে। যেটা হয় এরা চেপে যাচ্ছে না হয় ভুলে যাচ্ছে।
— মানে তুই বলতে চাইছিস কোন অপদেবতা ভর করেছে সুজনের শরীরে।
ডক্টর গাঙ্গুলির কথায় একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ লক্ষ্য করেও তা এড়িয়ে গেলেন অসিত কুমার ঘোষ। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও, নেশায় ভূতান্বেষী। অসিত বাবু হালকা হেসে বললেন, “ তা বলতে পারিস। তবে কেসটা যদি এতোই সহজ হত তাহলে মনোবিদ ডক্টর প্রকাশ গাঙ্গুলি এই অধমকে ডেকে পাঠাতেন না।” ডক্টর গাঙ্গুলি এবার সামান্য হেসে বললেন, “ তা বলতে পারিস। একটা চোদ্দ পনের বছরের ছেলে, শরীরের সমস্ত পার্টস ওকে, মেন্টাল হেলথ ভাল, ক্লাসের ফার্স্ট বয়, স্পোর্টসে দুরন্ত। কেন রোজ রাতে এরকম স্বপ্ন দেখে! কেনই বা তারপর অস্বাভাবিক আচরন করে? আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না অসিত।”
— হতে পারে কিছু দেখেছে। ছোটবেলার স্মৃতি। হয়তো বা পূর্বজন্ম অথবা কোন অতৃপ্ত আত্মা ওর শরীরকে আশ্রয় করেছে।
— সাউন্ডস অকওয়ারড অসিত।
— কিছু করার নেই। আমার হেল্প নিলে এই যুক্তিগুলিকে হজম করতেই হবে। যাইহোক, ওদের নম্বরটা দে। কিছু ইনভেস্টিগেশন করতে হবে।

অসিত বাবু সেদিন সুজনের ঠিকানা ও ফোন নম্বর নিয়ে নিলেও যোগাযোগ করে পরের দিন। প্রকাশের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সুজন ক্লাস নাইনের ছাত্র। পড়াশোনা, খেলাধূলা সব কিছুতেই ভাল। কিন্তু দুসপ্তাহ ধরে মাঝ রাত্রির পর থেকেই সে অস্বাভাবিক আচরন করছে। ঘুম ভেঙে উঠে বসে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। প্রথম দিন ওর মা, সুজাতা, ওকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও সাড়া না পেয়ে পিঠে হাত দিয়ে ডাকতে যান। সুজন তাতে ভীষণ চটে গিয়ে মা’কে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারে। সুজাতা সেই ধাক্কায় ছিটকে পড়েন মাটিতে। তার কনুইতে চোট লাগে। সুজাতা প্রকাশকে বলেছে এরকম আসুরিক শক্তি সুজনের হতেই পারে না। তার পরের রাতে সুজন ঘুম থেকে উঠে পরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বলে তাকে কেউ বা কারা হত্যা করার চেষ্টা করছে। এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। রোজ রাতেই সুজন কিছু না কাণ্ড ঘটাতে শুরু করে। মা- ছেলের রাতের ঘুম উড়ে যায়। শরীর ভাঙতে থাকে উভয়েরই। সুজন দিনে দিনে পিছিয়ে পড়তে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে সুজাতা যোগাযোগ করেন মনোবিদ ডক্টর প্রকাশ গাঙ্গুলির সাথে। এপয়েন্টমেন্টের আগে রুগীর হিস্ট্রির জিস্ট বলে বুকিং করাটাই নিয়ম করেছেন ডক্টর গাঙ্গুলি। রাতের বেলায় সুজনের কেসে চোখ পড়তেই কি ভেবে বাল্য বন্ধু অসিতকে ফোন লাগান তিনি। অসিত পেশায় ব্যবসায়ী হলেও ভূত খোঁজাই তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। সেই নিয়ে অসিতকে বন্ধু মহলে ব্যঙ্গ শুনতে হলেও সে নির্বিকার ভাবে সেসব হেসে উড়িয়ে দেয়। প্রকাশও ছিলেন সেই দলে। কিন্তু আজ কেন যে অসিতের কথাই প্রথম মনে পড়ল তার। অসিতও কেস হিস্ট্রি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভেবে বললেন, ঠিক আছে যাবো। কিন্তু আমায় একটা আলাদা জায়গা দিতে হবে যেখান থেকে আমায় সহজে দেখা যাবে না। আমি ছেলেটিকে অবজার্ভ করতে চাই।
যথাসময়ে ওরা এলেন। সুজনের রোগা শরীর উপেক্ষা করে অসিতের চোখে পড়ল তার ঝকঝকে দুটি চোখ। ছেলেটি যে বেশ ব্রাইট তা বুঝতে বাকি রইল না অসিতের। চোখের তলায় জমে থাকা কালি ছেলেটির মনের চাপ সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করছে। তার থেকেও চাপে আছে সুজাতা, তা তার মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। সুজনের বাবা নেভিতে চাকুরিরত। বাড়িতে তাই সব কিছুই সুজাতাকে সামলাতে হয়। তদুপরি কিছুদিন আগেই দীর্ঘদিনের ছুটি কাটিয়ে রঞ্জন মানে সুজনের বাবা ফিরে গেছেন জাহাজে। সুজনের এই অবস্থার কথা তাই তাকে জানানো হয়নি। যত ঝক্কি পোহাচ্ছেন সুজাতা। সুজনকে এক রাতে উর্দুতেও কথা বলতে শোনা যায়। এ কথা শুনতেই অসিতের সন্দেহ গাঢ় হয়ে ওঠে। প্রকাশ জিজ্ঞেস করেন সে এর আগে কখনও উর্দু শিখেছে বা শুনেছে কি না। তার উত্তরে সুজন মাথা নেড়ে বলে, না, সে কখনওই উর্দু ভাষার সংস্পর্শে আসেনি। বরং সুজনের ওই স্বপ্ন টুকু বাদে তারপরের ঘটনাবলির কিছুই মনে থাকে না।

পরেরদিন অসিত হাজির হন সুজনদের বেহালার ফ্ল্যাটে। প্রকাশ গাঙ্গুলি আগেই সুজাতাকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিলেন বলে অসিতের ঘরে প্রবেশ করতে অসুবিধা হয়নি। কার্ড দেখাতেই ভেতরে আসতে বলেন সুজাতা। যদিও তার মুখ দেখে বোঝা যায় সে এই ভূতে ধরা ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। তবু সন্তানের খাতিরে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অসিতকে বসতে দিয়ে সুজনকে ডাকতে ভেতরে চলে যান সুজাতা। কিছুখনের মধ্যেই ফিরে আসে ওরা দুজন। সুজনকে পাশে বসিয়ে কোন ভনিতা না করেই অসিত বলে বসেন, “ চলো সুজন। আমরা একটু হাওয়া খেয়ে আসি।” হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজন এসে পৌঁছয় নিকটবর্তী একটি পার্কে। ততক্ষনে সুজনের অনেক খবরই করায়ত্ত করেছেন অসিত বাবু। কিন্তু সেসব মিলিয়েও কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পাজলটা ঠিক মিলছিল না। পার্কের বেঞ্চে বসে অসিত জিজ্ঞেস করলেন, “ তোমরা ঘুরতে যাও সুজন?” সুজন উচ্ছল হয়ে বলে উঠল, “ হ্যাঁ যাই তো। পাপা এলেই আমরা লং ট্যুরে যাই। এই যেমন পাপা ফিরে যাওয়ার আগেই আমরা বম্বে, পুণে, গোয়া ঘুরে এলাম। খুব মজা হয়েছিল।” অসিত হেসে সুজনের কাঁধ হাতে রেখে বলল, “ ঠিক আছে চলো ফেরা যাক।”
শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সুজনের কেসটা নিয়ে বেশ উদবিগ্ন ছিলেন অসিত। প্রকাশ ঘুমের ওষুধ দিলেও যে তা কাজ করবে না সে সম্বন্ধে উনি নিশ্চিত। কিন্তু কীভাবে যে ছেলেটিকে এই বিপদ থেকে বাঁচানো যায় সেই পথ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। হঠাৎ তার ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভার কানে দিতেই চমকে ওঠেন অসিত। সুজন কল করেছে। অসিত বললেন, “ হ্যাঁ সুজন বলো। কিছু বলবে? এতো রাতে কল করলে যে?” সুজন ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, “ স্যার আপনার কার্ড থেকে নম্বরটা পেলাম। মোবাইল ফোনটা সুইচ অফ বলে এতে করলাম। আসলে একটা কথা মনে পড়ল বলে কল করলাম।”
— কি কথা বলতো?
— আপনাকে বললাম না আমরা কিছুদিন আগে ঘুরতে গেছিলাম।
— হ্যাঁ, বলেছিলে।
— পুণেতে আমরা একটা ফোর্ট দেখতে যাই। শনিওয়ার ওয়াদা ফোর্ট। দুর্গের কিছু অংশ দর্শকদের জন্য খোলা থাকে। আর কিছু অংশ সারাইয়ের জন্য বন্ধ রাখা ছিল। গাইড আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখাচ্ছিল। ইতিহাস বলছিল। মা বাবার সাথেই ছিলাম আমি। হঠাৎ একটা মহলের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে গেলাম। মা বাবা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাও তাঁদের সঙ্গে যেতে পারলাম না। আমায় ওই মহলের থাম, গম্বুজ, মহলের প্রতিটা কোণ ভীষণ ভাবে টানছিল। ওরা যেন আমায় ডাকছিল। আমি সন্তর্পনে চলে এলাম ওই মহলের ভেতর। একটা খুব সুন্দর গান ভেসে আসছিল। এদিকে কাছাকাছি কোথাও কোন গান বাজনা হচ্ছিল না। সেই গান যেন আমার অনেকদিনের চেনা। আমার শরীরের ভেতর একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। গানের সুর ছাপিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম একটা কান্না, চিৎকার, আর্তনাদ। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। চারিদিক যেন অন্ধকারে মোড়া। আমায় ঘিরে ধরেছে কিছু অদৃশ্য শয়তান। তারা আমায় খুন করতে চায়। হঠাৎ একটা ঠান্ডা, ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া আমার শরীরের ভেতর প্রবেশ করল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করেই জ্ঞান হারালাম।
অসিত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ এটা কাউকে বলোনি কেন? আর তোমায় উদ্ধার করল কে?”
— আমি জানিনা। যখন চোখ খুললাম তখন বিছানায় শুয়ে ছিলাম। মা বাবা পাশে বসে ছিলেন। আমার জ্বর এসে গেছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন হয়তো জ্বরের জন্যই অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। আমিও আর বলতে পারিনি আসল ঘটনা। ভেবেছিলাম মনের ভুল। কিন্তু এই স্বপ্নটা বাড়ি ফেরার পর থেকেই আরম্ভ হল।
— আজ আমায় কেন বললে?
— আমি আপনার কার্ড দেখেছি।
অসিত মুচকি হেসে বললেন, “ বেশ ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল সকালে কথা হবে।”
কল কেটে দিয়ে অসিত কুমার ঘোষ তাঁর ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে বসলেন।

অসিতের গোটা দিনটা চলে গেল লাইব্রেরিতে। ইতিহাস সম্বন্ধিয় বই পড়ে, নোট নিয়ে অসিত একটা সিদ্ধান্তে এলেন। তিনি যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই ঘটেছে। এবার শুধু অপেক্ষা পূর্ণিমা রাত্রির। ততোদিন হয়তো সুজন আর ওর মা’কে কষ্ট ভোগ করতে হবে।
রাত দুটো নাগাদ ফোনটা বেজে উঠল অসিতের। আজ ইচ্ছে করেই ফোনটা খোলা রেখেছিলেন অসিত। হিসেব মতো ফোনটা বেজে উঠল। কিন্তু কল এলো প্রকাশের ফোন থেকে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ডক্টর গাঙ্গুলি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “ অসিত, অসিত, কাম ফাস্ট। হি ইজ গেটিং ফেরশাস! প্লিজ কাম। আমি পারবো না ওকে সামলাতে। তুই ঠিক ছিলি। এটা অলৌকিক কিছু। সামথিং আনন্যাচারাল।” অসিত ঘোষ ফোনটা কেটে দিয়ে তড়িঘড়ি গাড়ী নিয়ে ছুটলেন। আজ, এই মুহূর্তেই সব মিটিয়ে দিতে পারলে ছেলেটা বেঁচে যাবে হয়তো। আর যদি না হয় তাহলে…
গাড়ীটা ফ্ল্যাটের সামনে পার্ক করেই লিফ্টের অপেক্ষা না করেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন তিনতলায়। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকতেই সুজাতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, “ আমার ছেলেটাকে বাঁচান স্যার।” অসিত তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, “ আমি আমার সব কিছু দিয়ে আজ সুজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো। ভরসা রাখুন।” অসিত দেখলেন সুজনের ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে জিনিসপত্র ভাঙার শব্দ আসছে। ভেতর থেকে যেন কারুর গর্জনের শব্দ আসছে। সুজন ছাড়া তো কেউ নেই। যেন সুজনের ভেতর থেকে অন্য কেউ কথা বলছে। অসিত কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন কথা গুলি, নাহ্ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। অসিত ব্যালকনি থেকে পাইপের সাহায্য নিয়ে সুজনের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে কোনোমতে ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন। সুজনের শরীর মাটি থেকে একহাত উপরে ভাসছে। তার অপ্রকৃতস্থ চোখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। সে উন্মাদের মতো চিৎকার করে চলেছে। কোন এক অজ্ঞাত শত্রুর বিরুদ্ধে তার আস্ফালন। অসিত ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে দরজার লক খুলে দিতেই সুজন এক ঝটকায় তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলল। ঘরে ঢুকে এলেন সুজাতা আর প্রকাশ। সুজন আবার গর্জন করে উঠল। অসিতের হাতে চোট লেগেছে। তবুও সে উঠে দাঁড়িয়ে জোর হাতে বলে উঠল, “ পেশোয়া, আপনি শান্ত হন। শান্ত হন আপনি। আপনার রাগ, দুঃখের কারণ আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু স্বার্থপর শয়তানের জন্য কেন এই ছোট ছেলেটাকে কষ্ট দেবেন? ওও যে আপনার মতোই তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিমান। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ ওর মতো ছেলেদের হাতেই নির্ভরশীল।”
সুজন স্পষ্ট মারাঠি ভাষায় গর্জে উঠল, “ রঘুনাথ রাও! ওকে আমি ছাড়ব না।”
— সে মৃত মহারাজ। সে নিজের অপকর্মের সাজা পেয়েছে। জীবন, ইতিহাস কাউকে নিস্তার দেয় না মহারাজ। আপনি সুজনকে ছেড়ে দিন। ওকে ছেড়ে দিন আপনি।
সুজন আবার গর্জে উঠে অসিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আঁচড়ে, কামড়ে অসিতকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলল। অসিত নিরুপায় হয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। নিজেও চিত্কার করে উঠলেন। তারপর বললেন, “ যদি আপনি সত্যিই একজন যোগ্য রাজা হন। তাহলে আপনি সুজনকে ছেড়ে চলে যাবেন।”
— বদলা!
অসিত নিজের পকেট থেকে কিছু একটা বের করলেন। এর আগেও তিনি এটি ব্যবহার করেছেন একটি মেয়েকে বাঁচানোর জন্য। আজ সুজনকে বাঁচাতে আবার তার গুরুর দেওয়া এই অস্ত্র তাকে ব্যবহার করতে হলো। বজ্রের মতো দেখতে ছোট অস্ত্রটি সুজনের দিকে তাক করতেই তার মধ্যে থেকে একটি অলোক রশ্মি নির্গত হয়ে সুজনকে আছড়ে ফেলল মাটিতে। আর সঙ্গে সঙ্গে জানলার একটি কাঁচ ভেঙে গেল।

সুজন পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। প্রকাশ জিজ্ঞেস করলেন, “ অসিত ব্যাপারটা এক্স্প্লেন করতে পারবি?” অসিত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লেন, “ নিশ্চই। কিন্তু তার আগে একটা ইতিহাস জানতে হবে।”
— ইতিহাস? কীসের ইতিহাস? বললেন সুজাতা
— সুজাতা দেবী আপনারা কদিন আগে ঘুরতে গেছিলেন, পুণের একটা দুর্গ দেখতে গেছিলেন। মনে আছে?
— হ্যাঁ কিন্তু…
— সেখানে সুজন অসুস্থ হয়ে পড়ে।
— হ্যাঁ ওর জ্বর এসেছিল। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
— সুজন বলেছে। সেই ঘটনার পর থেকেই কিন্তু ও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এবার আসি ইতিহাসের ব্যাপারে,
বাজি রাও এর মৃত্যুর পর মারাঠার সিংহাসন দখল করেন বালাজি বাজি রাও বা নানা সাহেব। নানা সাহেবের তিন পুত্র ছিলেন – মাধব রাও, বিশ্বাস রাও ও নারায়ণ রাও। যুদ্ধে নানা সাহেব শহিদ হলে নিয়ম মতো পেশোয়া হন মাধব রাও। এদিকে বিশ্বাস রাওয়েরও যুদ্ধে মৃত্যু হয়। ভাইয়ের মৃত্যুর শোক বহন করতে না পেরে মাধব রাওয়েরও মৃত্যু হয়। এবার অবশিষ্ট থাকেন নারায়ণ রাও। তখনও তিনি পেশোয়া হওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন হননি। বয়স পনের কি ষোলো। কিন্তু প্রথামতো তাকেও সিংহাসনে আসীন হতে হলো। আর তার অভিভাবক হিসেবে রাখা হল নানা সাহেবের ভাই রঘুনাথ রাওকে। এই রঘুনাথ রাওয়ের বরাবরই লোভ ছিল সিংহাসনের ওপর কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না। এবার সেই সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল। তিনি ভাইপোর আড়ালে থেকে বিভিন্ন তঞ্চকতা করতে লাগলেন। এদিকে নারায়ণ রাও নাবালক হলেও, ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি কিন্তু কাকার মনোভাব বুঝে ফেললেন এবং একদিন তাকে হাতেনাতে ধরে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। এতে রঘুনাথ রাওয়ের স্ত্রী আনন্দি বাই সাংঘাতিক ক্ষেপে উঠলেন। তিনি সুযোগ খুঁজতে লাগলেন নারায়ণ রাওকে সিংহাসন চ্যুত করার। সুযোগ এসে গেল অনভিপ্রেত ভাবে। নারায়ণ রাওয়ের সাথে ওখানকার কিছু আদিবাসীদের একটি ব্যাপারে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। আদিবাসীরা রাজার ওপর প্রচণ্ড চটে ছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আনন্দি বাই রঘুনাথ রাওকে দিয়ে আদিবাসীদের সর্দারের উদ্দ্যেশে একটি চিঠি লেখান। কিন্তু তিনি সেই চিঠির একটি শব্দ এমনভাবে পাল্টে দিলেন যেন মনে হয় রঘুনাথ সর্দারকে আদেশ দিচ্ছেন নারায়ণকে মেরে ফেলার। আদিবাসীরাও এই আদেশে সোল্লাসে প্রাসাদে ঢুকে পড়ে। ঘুমন্ত নারায়ণ রাও এমন আচমকা আক্রমণে হকচকিয়ে পালাতে গেলেও তাঁকে দস্যুরা ধরে ফেলে। তাঁর শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ফেলে দেওয়া হয়। দুর্গে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন নারায়ণ রাওয়ের অতৃপ্ত আত্মা ওই মহলে আজও ঘুরে বেড়ান।
— কিন্তু সুজন কেন?
— এর সঠিক ব্যখ্যা আমার জানা নেই। তবে সুজন যে স্বপ্ন দেখত তা নারায়ণ রাওয়ের খুনের রাতের ঘটনা। সেদিন যে ঠান্ডা হাওয়া সুজনের ভিতর প্রবেশ করেছিল তাও নারায়ণ রাওয়ের আত্মা। আজ পুর্ণিমার রাত্রিতে সেই আত্মা একটিভ হয়ে উঠেছিল। প্রতিহিংসা পরায়ণ। সে সুজনের শরীরকে আশ্রয় করে নিজের কাজ হাসিল করার চেষ্টা করেছিল। তবে আরেকটা সম্ভাবনাও আমি একেবারে খারিজ করতে পারিনা।
— কি? সমস্বরে বলে উঠলেন সুজাতা ও প্রকাশ।
— হতে পারে সুজন পূর্বজন্মে ছিল নারায়ণ রাও স্বয়ং।
সুজাতা শুকনো মুখে সুজনের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার হৃদপিন্ডের শব্দটুকুও কর্ণগোচর হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকন্যা থেকে নারী
Next articleকে ?
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments