চরিত্র

গল্প কথক,

গল্প কথকের স্ত্রী,

রমেন সেন,

সুধীর বিশ্বাস,

সোমেশ্বর ,

দেবযানী দেবী,

শর্বরী,

মানবী ,

পটলা ,

ভবানী ,

পটা,

সাদাৎ আলী

দৃশ্য

<গল্প কথক ও তার স্ত্রী সকাল বেলায় চায়ের সাথে খবরের কাগজ পড়ছেন>

গল্প কথকঃ  ও বাবা, কাগজে দেখছি, চিত্র বিচিত্রার নতুন নাটকের বিজ্ঞ্যাপন বেরিয়েছে। এরা যে এখনো নাটক করছে তাই জানতাম না । ভাবা যায়, সেই কোন প্রাচীন দল।

স্ত্রীঃ  চিত্রবিচিত্রা মানে সেই পেয়ারা পাড়ার, রমেন বাবুদের দলটা? ওদের নাটক নিয়ে, কি যেন একটা গণ্ডগোল বেধেছিল না ?

গল্প কথকঃ হ্যাঁ, তা বেধেছিল বৈকি, তবে ৪ বছর আগে। 

স্ত্রীঃ আমি শুনেছিলাম, উত্তরাধিকারসূত্রে  দলের মালিকানা পেয়েছিলেন রমেন সেন। একসময়ে তিনি তো দলের সবথেকে জনপ্রিয় হিরো ছিলেন, আর থিয়েটার ছিল তার প্রাণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

গল্প কথকঃ হুমঠিকই শুনেছ।তবে দলের ভেতরের খবর তোমার জানার কথা নয়।নেহাত ওই দলের

বহুদিনের অভিনেতা, সুধীর বিশ্বাস, আমার কলেজের সহপাঠী, তাই ওর থেকে পুরো গল্পটাই আমি জানতে পেরেছিলাম।

স্ত্রীঃ বাঃ, তাহলে একটু ভালো করে খুলে বল না গল্পটা, রোববার সকালে চায়ের সাথে এরকম গল্প শুনলে মনটা তাজা হয়ে যায়। 

গল্প কথকঃ তা নাহয় যায়, কিন্তু  আমার চায়ের কাপ তো খালি… 

স্ত্রীঃ চা নিয়ে ভাবনা কিসের, এই এক ফ্লাস্ক ভরতি তৈরি আছে। তুমি বলতে থাক, আমি কাপে ঢালতে থাকছি।    

গল্প কথকঃ বেশ। চায়ে চুমুক দিয়ে, গল্পটা শুরু থেকেই শুরু করি তাহলে, কি বল?    

স্ত্রীঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম গোরা থেকে।    

গল্প কথকঃ চিত্র বিচিত্রা নাট্য সমিতির, গোরা পত্তন হয়েছিল, স্বাধীনতারও  আগে,  সেই গোরাদের আমলে। সে সময়ে,  চিত্রভানু সরকার আর তার স্ত্রী বিচিত্রা দেবীর অভিনয় দেখতে, তখনকার বাংলার বড় লাট, ফিট ফাট  হয়ে আসতেন বলে শুনেছি। অবশ্য সেই যশ আর জৌলুশ, সবই প্রাচীন ইতিহাস।

স্ত্রীঃ  আহা! অতটা গোরা থেকেও নয়। মানে, রমেন বাবুদের সময় থেকে শুরু কর। ওই গণ্ডগোলের ব্যাপারটা বেশ জমিয়ে বল।     

গল্প কথকঃ  অ! আচ্ছা বেশ বেশ। রমেন বাবু থিয়েটার অন্ত প্রাণ হলেও, দুঃখের বিষয় নাটকের দল চালাবার মতন সামর্থ্য তার একেবারেই ছিলনা। মহাজন, কাবুলিওয়াওালাদের, কৃপায় দলটা কোনওরকমে টিকিয়ে রেখেছিলেন । অবশেষে, বিধাতা রমেনবাবুর প্রতি করুণা করে, তার ভাইপো সোমেশ্বরকে তৈরি করলেন কিঞ্চিত বাঁ দিক ঘেঁষে। বড়লোক বাপের সম্পত্তি পেয়ে, ছেলে পরেছিল বেশ বেকায়দায়। অতোগুলো টাকা পায়ে ঠেলে দিলে, দুর্বল বুকে থ্রম্বসিস হবার ভয় থাকে, আবার এদিকে সম্পত্তি ভোগ করতে গেলে বাঁ দিক থেকে টিটকিরি ও বুরজুয়ো বলে গঞ্জনা সইতে হয়। এমন দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকে রমেন বাবু তার বড়লোক ভাইপোকে উদ্ধার করলেন, নাটকদলের সদস্য ও পৃষ্ঠপোষক করে নিয়ে।

স্ত্রীঃ হুম! কম্যুনিস্টদের কাছে তো থিয়েটারের এমনিতেই একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে।

গল্প কথকঃ   তারওপর সোমেশ্বরের সুপ্ত লেখক সত্ত্বাটিও, বহিরপ্রকাশেরএকটা মঞ্চ পেয়ে গেল।আর তার ফলে চিত্রবিচিত্রার আর্থিক অবস্থাটাও আবার একটু স্বচ্ছল হয়ে উঠল।

স্ত্রীঃ বাঃ ! দারুণ ব্যাবস্থা।

গল্প কথকঃ কিন্তু যত দিন গেল, রমেনবাবু তার ভাইপোর সবজান্তা পাণ্ডিত্য, আর অবোধ্য সব রাজনৈতিক নাটকের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। নেহাত ছোকরার পূঁজির জোরেই, দল টিকে আছে, তাই সহ্য করে যাচ্ছিলেন সব। কিন্তু একের পড় এক ফ্লপ নাটক, আর রাজনৈতিক দলের শাসানি ও গোলযোগের পর, সেই সহ্যেরও বাধ ভাঙল। তাই শুরু হল তুমুল তর্ক


দৃশ্য

< চিত্র বিচিত্রার, ক্লাব ঘরে বসে সদস্যদের আলোচনা >

সোমেশ্বরঃ আচ্ছা তোমরা একটা সহজ ব্যাপার বুঝঝো না কেন হেজনগণকে সচেতন করাটা, থিয়েটার জগতের পরম্পরা

রমেন বাবুঃ  এবার, আবার তোমার সচেতন নাটক করলে, হাতে পরবে হাতকড়া।

গত মাসের কথাটা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে বুঝি ?

ওই সব রাজনৈতিক নাটক দেখিয়ে, বাধালে একটা হুলুস্থুল

দেবযানীঃ রমেন বাবু, Please ! Keep your cool.

রমেন বাবুঃ না , আর আমি ঠাণ্ডা থাকব না।

এইবারে সিম্পেল, নির্ভেজাল অরাজনৈতিক নাটক হবে।

সোমেশ্বরঃ তুমি এ দলের dictator হলে কবে ?

সুধীর বাবুঃ ওঃ ! নিজেদের মধ্যে বচসা করে কি লাভ ?

শর্বরীঃ সেই তো। This is a Cultural Hub.

এখানে আমরা শুধু সংস্কৃতিচর্চা করতে আসি।

রমেন বাবুঃ তা ওই সোমেশ্বরই তো গোল বাধালে, কি সব নাটক লিখেছে ,

দস্তভস্কি, লেনিন আর ক্ষুদিরামের ফাঁসি।

এসব নাটক চলে ?!

সোমেশ্বরঃ বাঃ বাঃ ! কি কথাটাই না বললে !

থিয়েটারতো আসলে একটা মারুতি গাড়ি ,

মনোরঞ্জনের জ্বালানিতে চলবে বোধ করি ?!

রমেনবাবুঃ অবশ্যই।

সোমেশ্বরঃ হুহঃ !  বাঙালের ঘাড়ে হ্রস্বয়ই।

বলি বিবেকের মাথা খেলেন নাকি ?

সংস্কৃতির সবই তো ভাসালেন,

থিয়েটারই বা থাকে কেন বাকি।

রমেন বাবুঃ শোন হে ছোঁড়া,

এঁড়েতক্ক কোর না।

সোমেশ্বরঃ আচ্ছা আপনি 43তে খুব অ্যাক্টিভ ছিলেন না ?

তা ভুলে গেলেন,  I. P. T. A. ?

রমেনবাবুঃ পিটিয়ে যখন পিঠের ছাল নেবে ছাড়িয়ে,

তখন আঁতলামোটা করবে কি নিয়ে ?

সোমেশ্বরঃ যত্তসব, বুরজুয়োর দল।

দেবযানীঃ ব্যাস ব্যাস ! এবারে আর No কোলাহল।

সোমেস্বরবাবু, এবারে নাহয় পলিটিক্সটা বাদই থাক,

অন্য কোন নাটকের কথা ভাবা যাক।

সুধীরঃ হ্যা , সেই ভালো।

অন্যরাঃ হ্যা হ্যা সেই ভালো।

পটলাঃ আমি বলছিলাম কি

এবারে একটু শান্তিপ্রিয়, ভক্তিমূলক নাটক করলে কেমন হয়?

মানবীঃ বাঃ ! পটলাদার আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়।

দেবযানীঃ শুধু আইডিয়া নয় , কিছু নামও suggest করলে ভালো হয়।   

সুধীরঃ  ইয়ে  এই যেমন ধর, শ্রী রামকৃষ্ণ কথাম্রিত, কিংবা মহিষাসুর মর্দিনী

রমেনঃ হ্যাঁ! এই নাটক তো আগে ভাবিনি।

শর্বরীঃ মহিষাসুর মর্দিনী, sounds very relevant.

সোমেশ্বরঃ Irrelevant! Belligerent! Inelegant!!

দেবযানীঃ ওঃ! সোমেশ্বর, Dont be so adamant.

রমেনঃ দেখ সোমেশ্বর,

এমনিতেই আমরা রাজনৈতিক প্যাঁচে জর্জরিত শহরবাসী,

ক্ষণেকের জন্যে হলেও, রাজনৈতিক ঝামেলা এড়িয়ে চলা ভালবাসি।    

আজকেরদিনে, সবচেয়ে ভালো publicity হয়, ভক্তিভরে।

কাজেই

পটলাঃ নাটকও জমবে ভক্তিতেই।।

সোমেশ্বরঃ চুপকর ! আহাম্মক !

দেবযানীঃ আঃ, সোমেশ্বর, তুমি না versatile লেখক?

তা একটা আধুনিক মহিষাসুরমর্দিনী পালা লেখ না,

এটা একটা নতুন challenge হিসেবে কেন দেখো না?

সোমেশ্বরঃ ঠিক আছে,  ঠিক আছে।

তোমরা যদি হতে চাও প্রাচীনপন্থী,

আমি কেন মিছে ঘাঁটব কাশুন্দি ?

গণতন্ত্রই শেষ কথা।

রমেন বাবুঃ যাক ! অবশেষে ছেলের খুলেছে মাথা।

তাহলে শুনে রাখো সবে

এবার চিত্রবিচিত্রায়, মহিষাসুরমর্দিনী পালা হবে।

অন্যান্যরাঃ বাঃ বাঃ, ভালো decesion, ভালো decesion.

সুধীরঃ তবে ইয়ে

এই অকালে অকালবোধন পালায়, জনতা রুষ্ট হবে না তো?

রমেন বাবুঃ ওঃ!  সুধীর বাবু, সবকিছু নিয়ে চিন্তা করা ছাড়ুনতো।


দৃশ্য

<মহিষাসুর মর্দিনীর রিহার্সাল >

গল্প কথকঃঅতএব, অনেক তর্ক বিতর্কের পর, সোমেশ্বর মহিষাসুরমর্দিনীর আধুনিক সংস্করণ লিখতে বসল।

তার কলমের জোরে, দুদিনেই পালা লেখা শেষ হলো। তবে নাটকের মূল বিষয়বস্তু, তার কম্যুনিস্ট মনে আঘাত করায়, নাটকের বাজেট সম্পর্কে সে একটু কুণ্ঠিত হয়ে পরল। রমেন বাবু, ভাবগতিক দেখে, বেশ একটু নরম হয়ে গেলেন। যদিও পৌরাণিক পালার আধুনিক ডায়লগ, তিনি মন থেকে মানতে পারছিলেন না, তবুও একমেবদ্বিতিয়ম পৃষ্ঠপোষককে হারানোর ভয়ে

স্ত্রীঃ নিজের মনকে মানিয়ে নিতে বললেন, তাইত ?

গল্প কথকঃ হ্যাঁ। যাইহোক, মহিষাসুর মর্দিনীর রিহার্সাল শুরু হলো পুরো উদ্যমের সাথে

(ইন্দ্র) রমেন বাবুঃ  হে মহর্ষি ব্রম্ভা,

বর দিলেন মহিষাসুরকে আপনি কি অনুপাতে?

কি ফাঁপরেই না পরলাম, আশ্বিনের এই শারদপ্রাতে।

(ব্রম্ভা) সুধীরঃ আঃ ! দেবরাজ ,

বৃথা হইবেন না নারাজ।

বিপদের এই ঘনছায়া দূর হবেই আজ।

রমেন বাবুঃ ফন্দি যত আপনার, সুপ্ত না রাখিয়া মনে,

বলে ফেলুন দেখি, এ অসুরকে হারাইব কেমনে?

সুধীরঃ ইয়ে মানেকেমন যেন শোনাচ্ছে,

দেবদেবীদের নিয়ে, ফাজলামি করাটা কি ঠিক হচ্ছে?

রমেন বাবুঃ আমিও তো তাই বলি,

এটা কি হচ্ছে কি ?

মহিষাসুরমর্দিনীর parody !?

সোমেশ্বরঃ দেখুন মশাই,

যা বোঝেন না,

তা নিয়ে কথা কইবেন না।

প্রাচীন নাটকের ধুলো ঝেড়ে,

আধুনিক ও যুগোপযোগী করে

দর্শকদের সামনে তুলে ধরাটাই আমার কাজ,

পছন্দ নাহলে, রাখুন আপনার পালা, আমি চললুম আজ   

শর্বরীঃ আঃ, এতো দেখছি দ্বন্দ মেলা ,

কথায় কথায় শুধু  ঝামেলা !?

রমেনবাবু, নাটক একটু contemporary হলে,  ক্ষতি নেই তাতে।

দেবযানীঃ হ্যাঁ, নতুন প্রজন্মের ভক্তি, বাড়বে বই কমবে না এতে । 

নিন, আবার শুরু করুন দেখি ,

এবার, আমার scene-টা হবে নাকি ?

অন্যান্যরাঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, রিহার্সাল আবার শুরু হোক , শুরু হোক।

(ব্রম্ভা) সুধীরঃ জাগো, জাগো হে দেবী ,

অসুরগনের সাথে যুদ্ধ লেগেছে হেবি।!

(দুর্গা)দেবযানীঃ জাগিয়াছি আমি, হে দেবগণ,

অসুর মস্তক এবার করিব খণ্ডন।

মহাদেবঅর্ধাঙ্গী,  আমি দশভুজা

এই আপতকালে, করহে মোর পূজা।

শর্বরীঃ এমা ! কি কয় ?!

আরেকটু তেজের সাথে বললে ভালো হয়।

তুমি, দেবী অসুরদলনী বলে কথা

এভাবে বললে তো পুরো পার্টটাই বৃথা।

দেবযানীঃ সর্দারি করিসনি শর্বরী।

নিজের পার্ট নিয়ে মাথা ঘামা ,

আমার পার্টে নাক গলানো থামা।

শর্বরীঃ দুটো সাজেশান দিলেই এতো চটছ কেন ?

ভাব দেখাচ্ছ এমন, প্রলয় বেধেছে যেন।

সুধীরঃ ইয়ে মানেআপনারা মহিলাবৃন্দ

মিছামিছি কেন বাধাচ্ছেন দ্বন্দ ?

নিন, আবার শুরু করুন দেখি ।

অন্যান্যরাঃ হ্যাঁ হ্যাঁশুরু করুন।

দেবযানীঃ হ্যাঁ যা বলছিলাম

দশহস্তে করিয়া অস্ত্র বোঝাই ,

প্রস্তুত হইয়াছি করিতে লড়াই।

হে অসুররাজ, এস হে রণে

বিঁধিব ত্রিশূল, তোমার ওই মহিষ বদনে

একি ? মহিষাসুর কই ? ওর এন্ট্রি তো এখানে ?

সোমেশ্বরঃ তাইত, পটলা , এই পটলা !

কোনে বসে ঢুলছিস, যে বড় ?

মহিষাসুর হয়েছ যখন,

একটু এনার্জি বহন কর।

যা শিগগিরি, স্টেজে এন্ট্রি নে … 

(মহিষাসুর)পটলাঃ   ( সবে মাত্র ঘুম ভেঙে, কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ) 

হ্যাঁ হ্যাঁ , এইতো এসে গেছি, মানে মহিষাসুর স্টেজে এসে গেছে,

ডায়লগটা কি ছিল যেনহ্যাঁ,  মনে পরেছে।

দেবী হে দেবী,

বন্দনা করি তোমারে,  দিয়া রক্ত করবী।

তোমারই শ্রীচরণে সঁপিলাম কলম আমার,

গদ্য, পদ্য, গ্রন্থ সব হইল একাকার।

সোমেশ্বরঃ এই হতভাগা ! এসব কি বলছিস?

স্টেজে বসে সাহিত্য চর্চা করছিস ?!

কাল, মডার্ন মহিষাসুর মর্দিনীর স্ক্রিপ্ট দিয়ে এসেছিলাম তোকে,

এখানে মডার্ন বাল্মীকিপ্রতিভার ডায়লগ এলো কোত্থেকে ?

পটলাঃ  Sorry Sorry, একটু গুলিয়ে গেছে।

আসলে তোমার হাতেরলেখা এতো বাজে সব শুদ্ধ,

নতুন স্ক্রিপ্ট, পুরনো স্ক্রিপ্ট, সবই দুর্বোধ্য।

সোমেশ্বরঃ চোপ! মহিষাসুর মর্দিনীর ডায়লগ বল দেখি !

পটলাঃ বলছি বলছি, দাড়াও, আগে একটু ঝালিয়েনি।

(স্ক্রিপ্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে )

হুম, ঠিকআছে রেডি।

হে দেবী, আসিয়াছ তুমি মোর সাথে লড়িতে,

মোর আসিম তেজ তুমি পারিবে কি সহিতে?

শর্বরীঃ হিঃ হিঃ , (ফিক করে খানিকটা হেসে)

অমন সিল্কের মতো পাতলা গলা,

যেন আধুনিক সংগীতের রেওয়াজ,

এক কে করবে, অসুর বলে তোয়াজ।

পটলাঃ Shut Up !!

সোমেশ্বরঃ হ্যাঁ, একদম চুপ।লক্ষ্মী হয়ে থাক।

মানবীঃ ( ফিস ফিস করে ) এই শর্বরী,

শুধু শুধু আর interrupt করিস না।

একে তো দিয়েছে লক্ষ্মী সরস্বতীর পার্ট ,

ঝামেলা করলে, এবার করে দেবেএকেবারে কাট।

অন্যান্যরাঃ রিহার্সাল continue হোক,  Continue হোক।

দেবযানীঃ তবে রে ! মহিষাসুর,

ব্যাটা অসুরের সর্দার

এবারে বুঝাইব মজা, তর এই আস্পরদার।

দেখ কেমন লাগে এই ত্রিশূলের খোঁচা

মহিষাসুরঃ এই এই !! সুড়সুড়ি লাগছে।ওরে কে আছিস বাঁচা।


দৃশ্য  

গল্প কথকঃএক প্রকার তাণ্ডবের মধ্যে দিয়েই রিহার্সাল চলল কয়েক হপ্তা। অবশেষে এলো নাটকের ওপেনিং শোএর দিন। সোমেশ্বরের লিমিটেড বাজেটে, এবারে চিত্র বিচিত্রার কপালে জুটল, একটা ঝর্ঝরে কমিউনিটি হল, যার ছেঁড়া পর্দা, রমেন বাবুকে, নিজের কিছু পুরনো লুঙ্গি কেটে তাপ্পি দিতে হয়েছিল;  ঝুলনের মেলায় কেনা, খেলনা দিয়ে বানানো প্রপ, আর সদ্য চোখে ছানি কাটিয়ে আসামেকআপ আর্টিস্ট, সাদাৎ আলী।

< গ্রিন রুমে, রমেন বাবুর আর সুধীরের মেক আপ চলছে >

সুধীরঃ এই হতচ্ছাড়া! এটা কি আঠা দিয়ে লাগালি আমার গোঁফ ?

বীভৎস গন্ধে পেটের ভাত উঠে এল, ওফঃ !!

সাদাৎঃ তোওবা , তোওবা ! আরে হুজু

হামার কি কসুর?

আপকাতো বাজেট হ্যাঁয় বহুত কম

তাই ময়দা জ্বাল দিয়ে, মুছ লাগায়া হাম।

রমেন বাবুঃ বাজেট কম বলে এই দিবি ?

এটা কি wig দিয়েছিস রে হতভাগা ,

ভেতরে ভরতি উকুন আর ছারপোকা।

সোমেশ্বরঃ এই যে ! আপনারা ব্যাক স্টেজে বসে এখনো করছেন কি?

দর্শকরা বসে বসে, ফাঁকা স্টেজ দেখবে নাকি ? !

রমেনবাবুঃ আরে যাচ্ছিরে বাবা, যাচ্ছি।

আসলে এই wig-টা যা জঘন্য দিয়েছে,

বুঝলে

সোমেশ্বরঃ নিকুচি করেছে Wig-এর।

যান শিগগিরি, ড্রপ উঠল বলে।

< সুধীর ও রমেনবাবুর প্রস্থান, গুটি গুটি পায়ে শর্বরীর প্রবেশ  >

শর্বরীঃ এই যে সোমেস্বরদা,

আবার বলছি, কাজটা ভালো করলে না,

দুর্গার পার্টটা আমায় দিলে হত না ?

সোমেশ্বরঃ আজ্ঞে না শর্বরী । যত্ত্যসব !

তোমায় আর তোমার যমজ বোনকে,

লক্ষ্মী স্বরস্বতি ছাড়া আর কিছু মানাত নাটকে?

শর্বরীঃ আঃ! মানবীর কথা ছাড় না,

ওর জ্বালায় দেখছি আমার কিছুই হলনা।

সোমেশ্বরঃ থাম থাম !!

যাকে যা পার্ট দেওয়ার, ভেবে চিন্তেই দিয়েছি,

নাটকের জন্যে যা ভালো হয়, তাই করেছি।

যা দেখি এবার,

আমায় এখন লাইটিং ঠিক করতে হবে।

শর্বরীঃ (চাপা গলায়) ঠিক আছে, যা করার মা লক্ষ্মীই করবে।

সোমেশ্বরঃ কিছু বললি ?

শর্বরীঃ না না কিছু না


দৃশ্য  

গল্প কথকঃ প্রথম কিছু দৃশ্য মোটামুটি নির্বিঘ্নেই কেটেছিল। মাঝে মাঝে কিছু ছোকরা দর্শকের টিটকিরি ও টিপ্পনী খানিকটা বিঘ্ন ঘটালেও, সেটা অভিনেতারা ভালোই ম্যানেজ করেছিল। তবে গোল বাধল ক্লাইম্যাক্স সিনে

দুর্গাঃ ওরে ওরে, পাপিষ্ঠ মহিষাসুর ,

আজই তোরে পাঠাইব নরকে

মহিষাসুরঃ হাঃ হাঃ,  হাঃ হাঃ ! !  হাসাইলে দেবী,

দেখ হাসে বাকি সব দর্শকে।

দর্শকঃ  হাঃ হাঃ,  হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ,  হাঃ হাঃ

দুর্গাঃ তবে রে !! এই দ্যাখ মজা

হানিলাম ত্রিশূল, সোজা

মহিষাসুরঃ উঃ উঃ !! আবার কোমরে কাতুকুতু দিচ্ছ ?!

সোমেশ্বরঃ (সাইড উইং থেকে, চাপা গলায় ) অ্যাই দেবযানীদি , কি কোচ্ছ ?   

< হঠাৎ শর্বরীর প্রবেশ  >

শর্বরীঃ মামাগো  ! লড়িতে দিব না তোমারে একা,

আয়রে মহিষাসুর, দেখি তোর কত তেজ দেখা

দেবযানীঃ (দাঁতে দাঁত চেপে ) এই শর্বরী কি করছিস কি, তুই এখানে ?

শর্বরীঃ হে মাতে ! তোমার ক্রন্দন ও অসুরের অট্টহাস্য রবে,

থাকিতে পারিলামনা বসিয়া, ভাবি বুঝি পরাজয় হবে ।    

সোমেশ্বরঃ আরে কি হচ্ছে কি শর্বরী?

স্টেজ থেকে নাম শিগগিরি।

মানবীঃ লক্ষ্মীরে

আমায় ছেড়ে তুই, আসিলি কেন একা?

এমা ! কি সস্তার প্রপ দিয়েছে দেখ, বীণাটা ব্যাকা।

সোমেশ্বরঃ এ হে হে হে !! স্টেজে এসব হচ্ছে কি ?

এটা কি মগের মুল্লুক নাকি ?

মানবীঃ লক্ষ্মীর সহিত স্বরস্বতির তেজেতে

অসুর ওরে, লুটিয়ে পরবি মেঝেতে।

শর্বরীঃ এস মা

দুর্গা, লক্ষ্মী, স্বরস্বতি মোরা তিনজনায়

মহিষাসুরমর্দন করি, সমবেত প্রচেষ্টায়

দেবযানীঃ  অ্যাঁইয়ে মানে… ! কি করা উচিত ঠিক বুঝতে পারছিনা,

বেশ, আয় তবে, এমনিতেও অসুর না মেরে তো আর যাচ্ছিনা 

পটলাঃ  এইরে, এতজন একসাথে !?

থাক থাক, কষ্ট করিয়া, বধিবে কেন মোরে,

হে দেবীগণ

এই দেখ, অস্ত্র ছাড়িয়া কলম ধরিলাম

এক্ষণ।

রক্ত নাহি, কালি দিয়া রচিব মহাকাব্য ,

মহিষাসুর নয়, কবিতাসুর নামই মোর প্রাপ্য।

সোমেশ্বরঃ ইস ! সব গুবলেট করলে

বাল্মীকি, মহিষাসুর সব মিশিয়ে ফেললে !!

ভবানীঃ সোমেস্বরদা

সোমেশ্বরঃ কে ? ভবানী ? তোর আবার কি চাই ?

ভবানীঃ বলছিলাম কি,

আজ মুখুজ্জে পাড়ায়, একটা খাওয়া দাওয়া পরেছে,

পটা আর আমার, দুজনেরই নেমন্তন্ন রয়েছে ।   

আর এখানেও, লক্ষ্মী স্বরস্বতির তো দেখছি

যুদ্ধংদেহি ভাব,

তা আমরাই বা বাদ থাকি কেন?

হোক না, গণেশ কার্ত্তিকেরও আবির্ভাব।

সোমেশ্বরঃ হ্যাঁ নিশ্চয়ই ! যা খুশি তাই করে যা ,

আমার বুকের উপর দিয়ে স্টেজে চলে যা

আমার বুকের উপর দিয়ে চলে যা

ভবানীঃ আয় রে পটা, ঝটপট ,

নাটক শেষ হলেই দেব চম্পট।

পটাঃ আসিতেছি, আসিতেছি ভাত্রিদ্বয় মোরা,

স্ক্রিপ্ট করিয়া বিদীর্ণ ,

  গণেশ ও কার্ত্তিক ছাড়া এ দৃশ্য

কেমনে হবে সম্পূর্ণ ?!

মহিষাসুরঃ ওরে বাবা !!  আরও?! আরও লোকে জুটেছে দেখছি।

আরে কাতুকুতু দেয় কে? কি জ্বালা, সমর্পণতো করেই ফেলেছি।

আমি হার মানছি, আমি হার মানছি

এবারে ছেড়েদে মা, কেঁদে বাঁচি।।

রমেন বাবুঃ দর্শকগণ, এমনি রূপে সাঙ্গ হল, মহিষাসুরপর্ব ,

কবিতাসুর জন্মিল তাই, প্রাচীন পন্থা করিয়া খর্ব।

সুধীরঃ হ্যাঁ, ইয়ে মানেসবশেষে এবার পরিচয় পর্ব।

প্রথমেই ডিরেক্টর ও লেখক, সোমেশ্বরকে ডাকি,

কই সে? ও বাবা ! মূর্ছা গেছে নাকি ?!

তা যাক গে

মা দুর্গার ভূমিকায়, শ্রীমতী দেবযানী দেবী,

লক্ষ্মী স্বরস্বতি করেছিল, শর্বরী ও মানবী।

গণেশ, কার্ত্তিক সেজে এলো, ভবানী ও পটা

মহিষাসুর থুড়ি কবিতাসুর হলেন আমাদের পটলা।

ইন্দ্রের ভূমিকায় ছিলেন রমেনবাবু,

আপাতত উনি, wig-এর উকুনে কাবু,

আর আমি শ্রী সুধীর বিশ্বাস, ব্রম্ভা সেজেছিলাম,

জ্ঞান বা ভক্তি নয়, আজ শুধু মোরা হাসাতেই এসেছিলাম ।

এরম নাটকও করতে হয়, রোজগারের স্বার্থে,

নইলে বাকি ভালো নাটক, করব কিসের অর্থে ?

নমস্কার।।

 ***       

গল্প কথকঃ সেবারের মহিষাসুর মর্দিনী নাটকের, অত্যাধুনিকতার খবর এতো ছড়িয়ে পরল, যে চিত্রবিচিত্রা রাতারাতি তাদের পুরনো খ্যাতি ফিরে পেয়েছিল।

স্ত্রীঃ, তাহলে ওই একটি নাটকের জোরেই, দলটা এখনো টিকে রয়েছে

কাগজে তো বলছে আরও দু সপ্তাহ ওদের নাটক হলে থাকবে।কিগো ? দেখতে যাবে নাকি ?    

************************************************************************************************************************

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleসেই জানালাটা
Next articleমাতৃভূমির জন্য
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments