(ঝিনাইদহ ,আগষ্ট ২০২০)
ধর্ম ভাবনা, বিশ্বাস কিংবা অনুশীলন পৃথিবীর প্রায় সকল আস্তিক মানুষের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য ও বিশেষ গুরুতর বিষয়। যারা নাস্তিক তাদের কাছে ধর্ম আরও বেশি ভাবনার বিষয়, কারণ তারা ধর্মে, ঈশ্বরে তাদের যত অবিশ্বাস আর সন্দেহ তার পেছনে যৌক্তিকতা দাড় করাবার জন্য তাদেরকে বেশি বেশি ধর্ম বিষয়ে মাথা খাটাতে হয়। সিধাপথে কেউ কেউ চটকদার ধার্মিক মানুষ। এদের কথায় ধর্ম বেশি থাকে কিন্তু তাদের কর্ম নিশ্চিতরুপে প্রায় ধর্ম শূণ্য। এরা ধর্মের ভাল প্রচারক কিন্তু ভাল অনুশীলনকারী নয়। অধর্মের অনেক সংঘাতিক কার্য এদের দ্বারা অনায়াসে সংগঠিত হয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে তা অন্যান্য মানুষের কাছে ধরা পড়ে গেলে কোরান-হাদিসের মার প্যাঁচে ফেলে তা জায়েজ করে নেওয়ার মত বিদ্যাও এদের জানা জানা থাকে। এক কথায়, এরা হলো অতিমাত্রায় চালাক, ধর্মের জোচ্চর। এদের ঠিক বিপরীত স্বভাবের বিশাল শ্রেণীটি হলো অচেতন, অগা ধাচের ধার্মিক। ধর্মের জ্ঞান এদের প্রায় শুন্য । কিন্তু ধর্মের ভয় খুব বেশি।
আলী আশরাফ গ্রামের মানুষ। মুসলিম। ধর্মের মীমাংসায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। অর্থাাৎ, ধর্মীয় জ্ঞানে তিনি আস্ত নবডঙ্গা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়িতে, মাঠে সমানে গতর খাটানো আর শুধু বৈষয়িক বিষয়ে ভাবনা করা ছাড়া সারা দুনিয়ায় আর দ্বিতীয় কোন বিষয়ে তার কোন গরজও নেই, কোন জ্ঞানও নেই।
একবার শীতের বিকালে আলী আশরাফের নিজ গ্রামের মধ্যে বড় স্কুল মাঠে আনন্দ-উল্লাসে এলাকা ব্যাপী আয়োজিত ফুটবল প্রতিযোগীতার ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। হুটুরে-পুটুরে, বুড়া-গুড়ো সব প্রকার কাজ-কর্ম ফেলে সবাই যখন শ’য়ে শ’য়ে বিপুল উৎসাহে দুপুরের ভাত খেয়েই মাঠে হাজির হয়ে ফুটবল খেলার বাধ ভাঙা আমোদে মেতেছে, সে সময় ভীষণ অশ্চর্য হয়ে দেখা গেল যে, সদা ব্যস্ত আলী আশরাফ ডান হাতে একটা বড় লাঙলা নড়ি আর বাম হাতের কব্জিতে বোঝা খানেক গরুর দড়ি-খুটো ঝুলায়ে এগারটা গরু-বাছুর নিয়ে উত্তেজনা শুন্য হয়ে স্থির মেজাজে স্কুল মাঠের রাস্তা ধরে ক্রিড়ামোদী শত শত মানুষের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণের বিলের দিকে পশুচারণে চলেছে । খেলার মাঠের এত হর্ষধ্বনি আর উত্তেজনার মধ্যেও আলী আশরাফ এতটাই অনাসক্ত, অগ্রাহ্য আর নির্বিকার ভঙ্গিতে গরু চরাতে চলে গেলেন যেন এত বড় মাঠ, মাঠের মধ্যে লাল-নীল-হলুদ সার্জি পরে যুদ্ধরত ২২ জন খেলোয়াড়, মাঠের চারপাশে অত্র এলাকা থেকে আগত কয়েক’শ মানুষ- এসবের কোন কিছু তার চোখেই পড়লো না। তার ভাবখানা এমন যে, এসব খেলাধুলার কোন মানে হয় না।
ঈদের দিনও এই আলী আশরাফের কাজ ফুরায় না। সারা বছরের তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে এই একটা বিশেষ আনন্দের দিনটাকে তার কাছে স্বাভাবিক একটা দিনের বেশি কিছু মনে হয় না। খুশিপূর্ণ, চেনা-অচনো মানুষে ভরা, রঙিন কাগজে-পতাকায় আর বর্নিল সামিয়ানায় শুশোভিত ঈদগা মাঠে গিয়ে যথা সময়ে নামাজ ধরার ব্যাপারেও তার মধ্যে অতিরিক্ত কোন গরজই লক্ষ্য করা যায় না। বলতে গেলে সারাক্ষণ দুনিয়াদারী করে মরে যে কাজ প্রেমিক আলী আশরাফ, তার বিবেচনায় গোসল করে, সেজেগুজে ঈদের মাঠে গিয়ে নামাজ পড়ে, কোলাকুলি করে, মানুষের সাথে গল্প-গুজব আর কুশল বিনিময় করে, মিষ্টির দোকানে ঘুরে ঘুরে আর ঠেলাঠেলি করে জিলাপী- পিয়াজু কিনে সকাল-দুপুর প্রায় পুরোটা নষ্ট করে বাড়ি ফিরে আসা মহামূল্যবান সময়ের একান্তই নির্দয় অপচয় ছাড়া কিছুই না। তুবও সে চরম অনিচ্ছা নিয়ে ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে যায় শুধুমাত্র সমাজকে দেখাতে। কিন্তু সে কোন খেয়ালেই বুঝতে পারে না যে, মানব জীবনের নানান উল্লেখযোগ্য, হাসি-খুশির আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তার যে খাপছাড়া রকমের বৈরাগ্য তা তার সমাজ খুব ভাল করেই দেখে আর হাসাহাসি করে। এভাবে বিনোদন বিরাগী আলী আশরাফ অন্য সকলের রঙ্গ-তামাশার বিষয় হয়ে থাকে সব সময়।
ঈদের মাঠে ভরা জামাতে সবচেয়ে শেষে যে ব্যক্তিটি অচঞ্চল, অগরজে, ঢিমে তালে পা ফেলতে ফেলতে এসে হাজির হয় সে হলো গ্রামের ঐ একজন মাত্র বিরল মানব, আলী আশরাফ। তাই ঈদের মাঠে আলী আশরাফের এসে যাওয়া মানেই নামাজ শুরু করা যায়। এতে অবশ্য গ্রাম বাসীর একটা বিশেষ উপকার হয়- আলী আশরাফ এসে গেল, তো নিশ্চতরুপে বলা যায় যে, ঈদের মাঠে গ্রামের কোন বান্দা আসতে আর অবশিষ্ট নেই; ফলে কারো নামাজ মিস করে আফসোস করার আর কোনই সম্ভাবনা থাকলো না।
একবার গ্রামের কয়েকজন যুবক ছেলে স্কুল মাঠে এক জায়গায় গোল হয়ে অলস বসে গল্পগুজবে মজে আছে। যুবক কালের গল্পে মজা বেশি। কে কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, কার প্রেমিকা কাকে ছেকা দিয়ে চলে গেছে, কে প্রেমের কথা তার স্বপ্নের নায়িকাকে বলে দেওয়ার সাহসের অভাবে ভুগছে, কার প্রেমিকার হঠাৎ অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে- ইত্যাদি স্বপ্ন-রঙিন আর বিয়োগান্তক সব বেগ-আবেগের গল্পে যুবক বয়সের মানুষেরা একবার ডুবে গেলে দুনিয়ার অন্য কোন খেয়াল তাদেরকে সহজে টেনে তুলতে পারে না।
কিন্তু সেদিন আলী অশরাফকে মাঠের সামনের রাস্তা দিয়ে গরু-বাছুর নিয়ে আপনমনে মাঠের দিকে যেতে দেখে যুবকদের একজন হঠাৎ অতি উৎসাহ নিয়ে ঐ গোল মিটিং এর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল-
“আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, আশরাফ চাচা আমাদের নবীর নাম কি তা বলতে পারবে না।”
অন্যরা এ কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বললো-
“ধুর! তাই আবার হয় নাকি? যতযাই হোক না কেন, তাই বলে নবীর নাম জানবে না! এ হয়?”
আলী আশরাফের সাধারণ জ্ঞান সম্বন্ধে বিভক্ত যুবকদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিতর্কের মীমাংসা করতে সর্বসম্মতিতে স্থির হলো যে, তারা আলী আশরাফ চাচাকে সারাসরি প্রশ্ন করে তার নিজ মুখ থেকে শুনে বিষয়টি যাচাই করে দেখবে। যুবকদের কোন বিষয়ে সামান্য কৌতুহল সৃষ্টি হলে তা একবারে ঘোড় দৌড়ে পরিণত হয়। সম্পূর্ণ মিটে না যাওয়া পর্যন্ত এ দৌড় কিছুতেই থামে না। তারা সকলে দারুণ উৎসাহ নিয়ে গোল মিটিং এ ক্ষণিকের স্থফা দিয়ে স্কুল মাঠ থেকে উঠে গিয়ে এক জোঠ হয়ে দ্রত হেটে পশুচারণে গমনরত আলী আশরাফ চাচাকে ডেকে থামালো আর জিজ্ঞাসা করলো-
“ হ্যাগো চাচা, এই যে এই শালারা সব বলতেছে যে, তুমি নাকি আমাদের নবীর নাম জানো না?”, যাদের বিশ্বাস ছিল যে উনি নবীর নাম জানে তারা বলল।
“হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস হয় না যে, তুমি নবীর নাম কতি পারবা। কও দেকি আমাদের নবীর নাম কি?”, যাদের সন্দেহ ছিল তারা বলল।
কঠিণ আসক্তি নিয়ে কাজের দিকে ছুটে চলা আলী আশরাফ ঐ কর্মহীন অলস ছেলেদের এমন প্রশ্নে ভীষণ রকমের বিরক্ত হলো। প্রশ্নটা কোন কাজেরই মনে হলো না তার কাছে। তার গরু বাছুরের দল হাটতে হাটতে তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। তার আর এক তিলও দাড়িয়ে থাকা চলে না। আবার গরুর দলে দু-একটা ফাজিল আঁড়ে আছে। এই ছেলেগুলোর মধ্যেও কেউ কেউ তার আঁড়েগুলোর মতই ফাজিল। প্রাণী কিংবা মানব, সকল সমাজেই কিছু কুলাংগার না থাকলে ভাল সদস্যদের প্রকৃতপক্ষে কোন দাম থাকতো না। যেমন অন্ধকার আছে বলেই, আলোর প্রয়োজনীয়তা বা এর মুল্য আমরা বুঝতে পারি। আলী আশরাফ ভাবলেন, পরে সুযোগ পেলেই এ বেয়াড়া, দুষ্টু আঁড়েগুলো দলছুট হয়ে অন্যের জমির ধানে-পাটে গিয়ে মুখ লাগাতে পারে। এ নিয়ে রুষ্ট, বদরাগী কোন ক্ষেত মালিকের সাথে তার অযথা ঝগড়া-গন্ডগোল বেধে যেতে পারে। তিনি গ্রামের কারো সাথে কোন বিষয়ে সামান্য ঝগড়া-মারামারিও কখনো করেনা। নবীর বিষয়ে প্রশ্ন করা গ্রামের ঐ ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে জরুরী ভাব আর কর্ম ব্যস্ততা দেখায়ে আলী অশরাফ বললেন-
“ওসব বাপু আমার কাছে শুনে না। আমি বাপু ওসবের মধ্যে থাকিনে। আমি গেলাম, গো। গরুবাছুর আবার কোনতে কোনে গেল দেখি।”
এই বলে আলী আশরাফ দৌড়াতে দৌড়াতে গরুর পালের পিছু ধরে নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে দক্ষিণ মাঠের পানে নিয়ে যেতে থাকলেন।
ছেলেগুলো আলী আশরাফের জবাব শুনে আবার স্কুল মাঠে ফিরে এসে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আর হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে একজনের গায়ের উপর আর একজন পড়তে লাগলো।তারা সকলেই আলী আশরাফের ব্যাপারে আশ্চর্যে মারা যেতে লাগলো। কেউ বলল-
“ এ কোন জাতের মানুষ। ওরে বাপরে বাপ, নবীর নাম কতি পাল্লো না। এ কি এট্টা কথা?”
আবার কেউ বলল-
“ওরে শোন। আশরাফ চাচা মানুষ খারাপ না। কিন্তু কাজ পাগল, এই যা । কাজের বাইরে অন্য বিষয়ে জানা বা মনে রাখা তার কাছে কোন উপকারে আসেনা । তাই এগুলো নিয়ে কোন মাথা ঘামায় না।”
এই কাজের ভূত আলী আশরাফের শুধু তিন ছেলে। কোন মেয়ে নেই। মেঝো এবং ছোট ছেলের প্রাইমারী স্কুলের পরে পড়াশোনা আর আগাইনি। আগাইনি কারণ ছেলে দুটোরও লেখাপড়ায় সিদ্ধিলাভে মনের জোর ছিলনা, আবার তাদের জাত কৃষক বাপেরও টাকা পয়সা খরচ করে লম্বা সময় ধরে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ায়ে ছেলেপুলেকে চাকরীজীবী বানানোর ইচ্ছোতেও অভাব ছিল। বাপের ইচ্ছের অভাবের ফল হলো তারা বাপের মত কৃষক হয়ে গেল। তাই তারা সানন্দে কৃষক বাপের সাথে পরোদস্তুর কৃষি কাজে কায়-মন-বাক্যে লেগে পড়েছিল। কৃষি কাজে জোয়ান মদ্দ দুই ছেলের চার হাত যোগ হওয়াতে আলী আশরাফের ভারী সুবিধে হচ্ছিল বটে। দৈনন্দিন কৃষিকাজ আর চাষাবাদ তার দারুন বেগবান হয়ে একেবারে উল্কা গতিতে ছুটতে লাগলো। তাই বড় বড় কৃষককে পেছনে ফেলে আলী আশরাফ প্রায় প্রতিবছর মাঠে উৎপাদিত ধান, পাট আর গোয়ালে পালিত গরু-বাছুর বিক্রি করে পাঁচ-দশ কাঠা আবাদী জমি কিনতেছিল। বছর বছর জমি কিনতে পারা কৃষিজীবীর জন্য লক্ষীর পরিচয় আর বড় সফলতার নজির।
অবশ্য আলী আশরাফের বড় ছেলে মারুফকে শত মেরে কেটেও অন্য দুই ছেলের মত অনায়াসে কৃষি কাজে নামাতে পারেনি। কৃষিকাজে বিমুখ মারুফ এস.এস.সি. পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পেরেছিল। সম্পূর্ণ নিজের মনের জোর ইচ্ছায় আর শত চেষ্টায়। প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুল শেষ করার পথে তার নিজের বাপের বেশ অসহযোগিতা আর বিরোধীতা ছিল।
মারুফ ছিল একটু আধুনিক ও সৌখিন ছেলে । প্রতিদিন বিকালে স্ত্রি করা ভাল শার্ট-প্যান্ট পরে গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘোরা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া তার খুব প্রিয় ছিল। অন্য দ্’ু ভায়ের মত ভূতের ন্যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে খেটে মরা একদম অপছন্দ ছিল তার।
মারুফ খুব ভাল ফুটবল খেলতে পারতো। দূর-দূরান্তের গ্রামে-গঞ্জে হায়ারে খেলতে যেত। এ জন্য তার বাপ আলী আশরাফ মাঝে মাঝে তার বাইরের গ্রামে হায়ারে খেলতে যাওয়ার ডাক পাওয়ার ব্যাপারে খোজ খবর করতো। ছেলে হায়ারে খেলতে যায় এজন্য তার অহংকারের শেষ নেই। আসলে ব্যপারটা এমন নয়। খেলাধুলার ব্যাপারে তার ন্যূনতম কোন আগ্রহ ছিলনা। বাপের যা অপছন্দ, ছেলে সেটা করলে বাপের তাতে অনুমোদন বা আদর-আহ্লাদ-আগ্রহও থাকার কথা নয়। ছেলে চারদিকে হায়ারে খেলতে যায়, তাতে তার কোন বিশেষ টাকা-পয়সা হাতে আসে কিনা সেই অর্থ লাভের সুখের খবরটা ইনিয়ে-বিনিয়ে বের করা বাপ আলী আশরাফের কাছে মূল আগ্রহের বিষয়। হায়ারে পরের হয়ে গতর খাটিয়ে খেলা করে তাদের খেলায় জিতিয়ে দিয়ে তার বিনিময়ে যদি কোন আয় রেজগার না হয়, তাহলে সে খেলা যেন বন্ধ করে দিয়ে সংসারের কাজে একটু হাত দেওয়া হয়, আর যদি কোন টাকা পয়সা খেলা থেকে হাতে আসে তাহলে তা যেন আজে বাজে কাজে ব্যয় না করে তার হতে তুলে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে দিয়ে আলী আশরাফ ছেলে মারুফ কে এসব কথা বলাতো।
মারুফের এসএসসি’র রেজাল্ট হয়ে যাওয়ার মাস খানেক পরের একটা পরমানন্দের ঘটনা। সেদিন জেলা শহরের সার্কিট হাউজ মাঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে জোয়ান নিয়োগ চলছিল। আলী আশরাফের বড় ছেলে মারুফ সেই মাঠে তার গ্রামের আর স্কুলের আরো কয়েকজন উচু-লম্বা বন্ধুর সাথে অনেক আগ্রহ আর আশা নিয়ে সৈনিক পদে দাঁড়িয়েছিল। তার বন্ধু করিমের বুকে সেনাবাহিনীর লোকেরা ধাপ করে প্রাথমিক সিলেকশন সিলের আঘাত মারলে, সে গায়ে যথেষ্ট শক্তির অভাবে লাইনের মধ্যে উল্টে পড়ে যায়।এ দৃশ্য দেখে সারা মাঠের সব মানুষ সে কি দারুন হাসাহাসি করেছিল। মাঠে উঠা উচ্চ হাসির রোল থামাতেই সেনাবাহিনীর লোকজনের পনের-বিশ মিনিট সময় লেগে গিয়েছিল। তবুও হাসি থামতে চায় না। অনেক কষ্ট করে বুক- মুখ চেপে ধরেও কেউ হাসি থামাতে পারছিল না। মেজর সাহেব করিমকে বলেছিল-
“সৈনিক হতে হলে গায়ের জোর, বুকের জোর থাকতে হয়, তোমার তো কোনটাই নেই, দেখছি , বাপ।”
গায়ে মুরগির বল নিয়ে লাইনে উল্টে পড়া করিম সেনাবাহিনীর নির্বাচন থেকে বাদ পড়ে যায়। তবে শরীরের মাফ-জোখ আর অন্যান্য সকল প্রকারের পরীক্ষা-নীরিক্ষায় অনায়াসে উত্তীর্ণ হয়ে সেদিন সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে আলী আশরাফের ছেলে মারুফের চাকরী জুটে যায়।
ভীষণ আমোদ, আনন্দ নিয়ে সৈনিকের চাকরীতে যোগদানের দু’ মাস পরে রোযার মাস এসে পড়লো। গো-মূর্খ, মাঠে খাটা আলী আশরাফের মত ডাহা কৃষকের বাড়িতে কেউ চাকরিজীবী হবে, লেখা পড়া শিখবে- এরকম সম্ভাবনার কথা আশেপাশের কেউ কোন দিন ভাবেনি। আলী আশরাফরা নিজেরাও কেউ কোন দিন বলতে পারতো না যে, তাদের বাড়িতে এ রকম কেউ চাকরী করবে । চাকরীটা যেন একবারে আল্লাহ নিজ হাতে ধরে আলী অশরাফের ঘরে উপহার দিয়ে দিল। তাই আল্লাহর খুশির জন্য ছেলে মারুফ তার বাবাকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মোবাইল করে তার গ্রামের বাড়িতে রোযাদারদের জন্য একটা ইফতার আর মিলাদের অনুষ্ঠান করতে বলে দিল। খরচের যত টাকা সে মারুফ নিজে বেতন থেকে সময়মত পাঠিয়ে দেবে। একথাও ব্যখ্যা করে বলে দিল।
ধম্ম কম্মে অনাসক্ত, উদাসীন আলী আশরাফের বাড়িতে ধর্ম ভক্তিতে ইফতার অনুষ্ঠানের মত কোন কার্যকলাপের কোন পূর্ব ইতিহাস আপাতত স্মরণকালের মধ্যে কারো জানা ছিল না । আলী আশরাফ নিজেই কোন দিন রোযা রাখে না। রোযা থাকলে নাকি সে ক্ষুধার জ্বালায় মরে যায় আর ক্ষেতে কাজ করতে পারে না। আর প্রয়োজন মত মাঠে পড়ে সারাদিন কষে গতর খাটাতে না পারলে তার বুক ফেটে যায়।
মারুফ জানে যে, তার বাবুগিরি, খেলার নেশা, বিদ্যাবাতিকে ত্যক্ত-বিরক্ত বাপ আলী আশরাফের কাছে তার কথা প্রসঙ্গের বহুত কদর হয়েছে। বেকার কালে তার কথার ফুটো পয়সা দাম ছিলো না তার বাপের কাছে। তবে তার কথায় তার বাপ তাদের বাড়িতে মানুষ দাওয়াত করে এনে ইফতার করাতে রাজি হলেও, নিজ পুঁজি থেকে এ উদ্দেশ্যে একটা পয়সাও যে খসাতে চাইবে না সে বিশুদ্ধ সাধারণ সত্য কথাটা মারুফ খুব ভালভাবেই জানতো। তাছাড়া সরকারী চাকরীজীবী ছেলে হয়ে ইফতারের মত ছোটখাট আয়োজনে কৃষক বাবার অর্থ খসানোও নিজের জন্য বেইজ্জতের আর নিন্দার বিষয়। তাই ইফতার অনুষ্ঠান উপলক্ষে ছেলে মারুফ বাড়িতে এক সপ্তাহ হাতে রেখেই তার চাকরী জীবনের তৃতীয় মাসের বেতন পাঠিয়ে দিল। চাকরীর বেতন পরিবারের জন্য বাড়িতে পাঠাতে, বাড়ির কাজে ব্যয় করতে যে কোন বিবেকবান, দ্বায়ীত্ববান ছেলেদের মনে, আবেগে ভয়ানক রকমের ভাল লাগে। মারুফের মত অবিবাহিত, যুবক চাকুরের সবচেয়ে বেশি খুশি ঠেকে। এতে আত্মতৃপ্তির মিঠে সাদ পাওয়া যায়। নিজ পরিবারে সকলের কাছে সমাদর ও মূল্যায়নের জায়গা তৈরী হয়। পবিরারে যে কোন বিশিষ্ট স্দ্ধিান্ত গ্রহণে নিজের উপার্জনের শক্তি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা যায়। নিজেকে পরিবারে অপরিহার্য মনে হয়।
ছেলের পাঠানো টাকা পৌছে গেল আলী আশরাফের হাতে। হাতে টাকা চলে আসলে গায়ে, পায়ে, মনে কাজে লেগে পড়া যায়।হাতে টাকার জোগাড় না থাকলে, শরীর-মন কোনটাই কোন কাজে সাড়া দিতে চায় না।
বাড়িতে মিলাদ উত্তর ইফতার অনুষ্ঠানের দিন ও ক্ষণ ধার্য হলো। শুক্রবার বাদ আসর। শুক্রবার জুম্মার দিন। বেনামাজীদের নামাজের দিন। যারা সপ্তাহের ছয়দিন নামাজের ধারে কাছেও যায় না শুক্রবার তাদের জন্য মসজিদে গিয়ে ভিড় বাদিয়ে দেয়ার দিন। ঠেলাঠেলি কারার প্রতিযোগীতার দিন। আলী আশরাফও শুক্রবারে মসজিদে জায়গা ধরার প্রতিযোগীতায় একজন নিয়মিত প্রতিযোগী।
দুই দিন হাতে রেখে বুধবার রাতে সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে আলী আশরাফ পাড়া-পড়শী আর সকল দায়-দায়েদীদের মিলাদ উত্তর ইফতার মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে আসলো। হাদিয়া দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না যে দাওয়াতে সে দাওয়াতে সবাই খুশি হয়। গরীব মানুষ বেশি খুশি হয় কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের হাদিয়া দিয়ে দাওয়াত খাওয়ার ক্ষমতা থাকে না।
আলী আশরাফের দীর্ঘকালের ধর্মানুষ্ঠান বঞ্চিত বাড়িতে হঠাৎ ইফতারের মত মহতি অনুষ্ঠানের সাদর নিমতন্নে সবাই যতটা না মনে মনে খুশি হলো তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তায় আশ্চর্য হলো। ধম্ম-কম্ম ভোলা আশরাফের মুখে আকস্মিক রোযা, ইফতার, মিলাদ এর কথা খুব বিষ্ময়কর মনে হলো সবার কাছে। সাচ্চা ধার্মিকের মুখে অধর্মের কথা কিংবা অধার্মিকের কাছে ধর্মের কথা শুনলে মানুষ এভাবেই আশ্চর্য হয়। তবে সকলেই অনুমান করতে লাগলো যে, তার ছেলে আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীতে চাকরী পেয়েছে, সেই আল্লাহর কাছে বিশেষ শুকরিয়া আদায়ের উপলক্ষে এই ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন। সবাই এটাও সমানে জোর অনুমান করতে লাগলো যে, মারুফের বেশ একটা জোরনে পড়ে আলী আশরাফ বাড়িতে মানুষ ডেকে ইফতার করাতে বাধ্য হয়েছে; তা না হলে কখনো সে নিজ থেকে সোয়াবের এতবড় কাম করার ধর্মানুরাগী কোন মানুষ না। কেউ কেউ তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসাও করেছিল, ঠিক কি উপলক্ষে তার বাড়িতে হঠাৎ এই ইফতার অনুষ্ঠান। জবাবে আলী আশরাফও সরলভাবে কারণ দর্শায়ে বলেছিল-
“ ঐ যে মনি চাকরী পায়েছে তো। মনি কোলো যে, আব্বা ইফতারী দিতি হবি। তাই দিচ্ছি।”
রোযাদারকে ইফতার কারানোর কতবড় ফজিলত আলী আশরাফের তার বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানে না। রোযা রাখার শরীয়তি- মারফতি ফায়দা কি তাও তার বোধের বহুত বাইরে। যে সৃষ্টিকর্তায় সে পৈতৃকসূত্রে বিশ্বাস করে, এই দুনিয়দারী তো তারই দেওয়া। তাই সৃষ্টিকর্তার দুনিয়ায় কর্মে ডুবে থেকে নিরন্তর সংসারের উন্নতি ঘটানোই তার ধ্যান ও ধর্ম। ফলে ধর্মের অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান তাকে তার কর্ম ডুব থেকে টেনে তুলতে পারে না। সে নিজেও সে গভীর ডুব থেকে আত্মচেষ্ট হয়ে উঠতে চায় না।
মিলাদ উত্তর ইফতার অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত নিয়ামতের শুক্রবার দিনটা এসে পড়লো। সকাল, দুপুর গড়ায়ে বেলা আসর হলো। এখনই সবার আসা আরম্ভ হওয়ার কথা। কথা থাকলেই তা ঘটবে এরকম চিরন্তন কোন নিয়ম প্রৃথিবীতে নাই। আলী আশরাফের স্ত্রীর সকাল থেকে সারাটা দিন পার হয়ে গেছে ইফতার আয়োজনের জন্য বাড়িতে নির্ধারিত নানান কাজ কম্ম করতে করতে। সময়মত গোসল, খাওয়া কিছুই হয়নি।
লিষ্টি করা ইফতার সামগ্রীর সমস্ত আয়োজন শেষ। গোয়ালপাড়া বাজারের বিখ্যাত অরুন ঘোষের মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে ওর্ডার দিয়ে বড় বড় জিলাপী তৈরী করে আনা হয়েছে। বউ বাড়িতে ডাল বেটে মোটা মোটা বড়া ভেজে রেখেছে। বাড়িতে গাম্বীর ধানের হাতে ভাজা মচ মচে মুড়ি, কড় কড়ে পিয়াজু, চাকা চাকা বেগুণি, বড় বড় গøাসভর্তি রুহ আফজার শরবত, গরম গরম আলুর চপ, এক নম্বর বিলাতী খেজুর, বিদেশী মিষ্টি জাতের আপেল, রসালো কমলা, লাল টকটকে পাকা তরমুচ সহ আরো অনেক কিছুর জোগাড় করে প্রস্তুত করা হয়েছে। ছেলে মারুফ খুব কড়া ভাষায় বাড়িতে সাধান করে দিয়ে বলেছে যে, ইফতারে কোন ত্রæটি যেন না হয়।
কিন্তু মিলাদের নির্ধারিত সময় বয়ে যেত লাগলো। বাইরে চারদিকে দৃষ্টি প্রেরণ করে দাওয়াত প্রাপ্ত কোন একটা বান্দাকে উৎসাহে কিংবা অনুৎসাহে আলী আশরাফের বাড়ির দিকে আসার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পরের মানুষ বাড়ি দাওয়াত করে এনে খাওয়ানোর কাজেও যদি দুঃচিন্তা করতে হয়, এটা যদি আপ্যায়নকারীর মানুসিক পীড়ন করে, তাহলে এর চেয়ে অনুশোচনার আর অক্ষেপের কোন কিছু হতে পারে না মানুষের জন্য।
এই অনিশ্চয়তা আর আশংকার মুহুর্তে আলী আশরাফ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাড়ির কাছের-দূরের কারোর দেখা না পেয়ে তিনি নিজেই খোজ নিতে বের হলেন – কেন কেউ এখনো আসলো না – কেন সকলের আসতে এত দেরী হচ্ছে?
পর মানুষ কেন আসছে না তা পরে খোজ নিলেও চলে। আপন মানুষ কেন বিলম্ব করছে তার কৈয়ফিয়তটা সবার আগে নিতে হবে।কারণ কোন প্রয়োজনের সময়, বিপদে-আপদের কালে আপন মানুষ পিছাইয়া গেলে তাতে পরের মানুষ আগাইয়া না আসবার শক্ত অযুহাত খুজে পাই।
তাই সর্ব প্রথমেই আপন ছোট চাচার বাড়ি গিয়ে হাজির হলো আলী আশরাফ। তার আপন ধলা চাচা। চাচাদের এক সময় রং ভাগে ভাগ করে ডাকাডাকি করা হতো। এই যেমন রাঙা চাচা, ধলা চাচা, কালা চাচা ইত্যাদি। তবে এসব নাম দেওয়া হতো চাচাদের শরীরের চামড়ার রং ভেদে। তাই মনের গভীরে কেউ একজন নিকোষ কালো কুঁচ কুঁচে হলেও শুধু বাইরের চর্ম রং এর বদৌলতে তার ধলা চাচা হয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। আজকাল অবশ্য চাচাদের এসব আদর আহ্লাদের কালা , ধলা, রাঙার রং-রকমারী আর চলে না। চাচারা সব এখন আংকেল। প্যাটার্নাল আংকেল, ম্যাটার্নাল আংকেল।
পেরেশানে মাথা পাগল আলী আশরাফ রক্তের সম্পর্কের অধিকারের জোর আর অভিমানের তেজ নিয়ে তার দরদী ধলা চাচার বাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখলো যে, তিনি সমস্ত মনোযোগের সাথে ঝাড় থেকে লম্বা এক বাঁশ কেটে, ফেঁড়ে তার থেকে চটা বের করে চেঁচে ছুলে মসৃন করছে। ভাস্তে আলী আশরাফের বাড়িতে যে তার আজ ইফতারের দাওয়াত এবং সেখানে যে তার সবার আগেই হাজির থাকা কর্তব্য তা সে কথা যেন তিনি ভুলেই বসে আছে। । যে কাজে যার সর্বাগ্রে থাকার কথা তার এমন অচেষ্টায় পেছনে পড়ার দৃশ্য দেখে আলী আশরাফ কিছুটা রেগে গিয়ে তার রাঙা চাচাকে বলল-
“কি গো ধলা চাচ, তুমি একোনো বসে এই চটা চাইচতেছো, হ্যাগো? এই কি তোমার এট্টা আক্কেল হলো? ওঠো, ওঠো, শিগগির ওঠো । আজকে না আমার বাড়ী ইফতারের দাওয়াত তোমার। এখন মিলাদ হবে। আর তোমার এখনো কোন খোজই নেই্ । তুমি কি ভুলে গেছ নাকি, হাগো?”
আলী আশরাফ এই কথাগুলো যতটা অস্থিরতা নিয়ে বলে চললো ঠিক কয়েকগুন স্থিরতা নিয়ে তার ধলা চাচা তা শুনে গেলেন এবং বললেন-
“ তোমার দাওয়াতের কথা তো আমি ভুলিনিরে, বাপু। কিন্তু তোমার বাড়িতে দাওয়াত খাতি যাওয়ার তো আমার কোন কায়দা নেই।”
ধলা চাচার কথা শুনে আলী আশরাফ যেন মাটিতে পুতে গেল। যার কাছ থেকে যে মারাত্মক বেদনার কথা শোনার কোন কল্পনা মানুষ জীবনেও করেত পারে না তার কাছ থেকে সেই কথা শুনতে হলে আশ্চর্যের আর কোন কূল কিনারা থাকে না। ধলা চাচার সাথে আলী আশরাফের জীবনে কোন দিন কোন কিছুতে লেগেছে, দুটি কটূ কথা হয়েছে এমন ইতিহাস কেউ বলতে পারবে না। বালু ঝড়ের কালে বালুর মধ্যে মুখ ডুবায়ে মরুভূমির প্রাণী উঠ যেমন স্থির পড়ে থাকে, আলী আশরাফও ঠিক তেমন আপন কর্মে চোখ-মুখ-মন ডুবায়ে পড়ে থাকা ঐ মরুভূমির প্রাণীর ন্যায়। আশে পাশে আরো দু’চারটে বিষয় আশয়ের যে অস্তিÍত্ব থাকতে পারে তার কোন খোজ রাখা তার একান্তই অকর্তব্য। এ রকম নিরীহ ও আত্মনিয়োজিত একজন মানুষের সাথে কারো কোন বিষয়ে দ্ব›দ্ব-বিগ্রহ থাকতে পারে সে কথা এ গ্রামের কারো বিশ্বাসের বিষয় নয়। কিন্তু তার বাড়িতে তার আপন চাচার দাওয়াত খেতে যাওয়ার ব্যাপারটা একবারে অসম্ভব করে দিয়েছে এমন কি স্বার্থের বিষয় ঘটে থাকতে পারে তা জানতে কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়ায়ে থেকে আলী আশরাফ চাচার কাছে কৈফিয়ত চাইলো-
“ ক্যান, ধলা চাচা? তুমি হঠাৎ এরকম কতা কচ্ছ যে? আমার বাড়ি তুমি দওয়াত খাতি যাতি পারবা না কি কারনে? আমি তোমার কাছে কি অন্যায় করচি চাচা?”
“ওরে বাপু, শোন। ইডা ন্যায়-অন্যায়ের বিষয় না। তোর তো বাপু দওয়াত দিয়া হয়নি। তুই তো বদর জদ্দারের দওয়াত দিস নি। তার ছাড়া তো আমি তোর বাড়ি দওয়াত খাতি গেলি আমার উপরে চাপ আসপেনে। বদর জদ্দারের সাথে আমাগের সাইড দল আছে। সে বাদ থকলি সমেস্যা আছে।”
ভালবাসার ধলা চাচা যে মনের মধ্যে এতবড় একটা কালা প্যাঁচ কষে আপন ভাস্তের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত এড়ায়ে চলার ফঁন্দি এটে দৃঢ় মনে বাড়ি বসে আছে সে কথা ভেবে আলী আশরাফ অত্যন্ত আহত হল। ইফতার মাহফিলেও কেমন করে মানুষ- তাও আবার আপন মানুষ- অসুস্থ্য রকমের সংকীর্ণ দলাদলির পঁচা হিসাব টেনে আনতে পারে সেই কথাটা কিছুতেই সে মানতে পারছিলনা। ইফতারের মধ্যে দলাদলির এই প্রসঙ্গটা আলী আশরাফের কাছে অত্যন্ত অসহ্য মনে হতে লাগলো-
“চাচা, বদর জদ্দারের বাড়ি তো অনেক দূরে। সেই গিরামের শেষ পাড়ায়। আশে পাশের সব বাড়িতি তো দওয়াত দিছি।আর আমার বাড়িতি তো ইফতারের দওয়াত। এর মধ্যে দলাদলি আসতেছে ক্যান, চাচা?”
ধলা চাচা খুব ন্যায্য কারণেই জানে ও বোঝে যে, এই জটিল জগতে এমন অনেক কিছুই আছে যা তার আত্মভোলা ভাস্তে আলী আশরাফের জন্য দরকার হয় না। তেমনি একটা অদরকারী বিষয় হলো সামাজিক দলাদলী। তার জন্য এটা একবারেই নিষ্প্রয়োজন। অচর্চার বিষয়। সে একলা চলা লোক। কিন্তু ধলা চাচাকে সমাজের আরো দশ জনের সাথে উঠতে, বসতে হয়। প্রতিনিয়ত কত কিসেমের ঝক্কি, ঝামেলা আর মার প্যাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয় তার ঠিক নেই। এখানে তাকে চাঁদে চাঁদে কাছে কিংবা দূরের অনেক সাধু, অনেক ভন্ডের সাথেই প্রয়োজনে দল গড়তে হয় আবার দল ভাঙতেও হয়। দলাদলীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বেদলের লোকজনকে মাইর বসাবার জন্য, আবার মার ঠেকাবার জন্যও প্রয়োজন। মারামারি করে টিকে থাকার এত বড় সামাজিক প্রয়োজনেই ধর্মীয় ইফতার অনুষ্ঠানেও দাওয়াত করার ক্ষেত্রে দলের লোকের অন্তর্ভুক্তি আর বেদলের মানুষকে বর্জন কারার একটা সুক্ষè হিসাব মাথায় রাখেতে হয়। কিন্তু আলী আশরাফ জীবনে কোন দিন এই হিসাবের অনুশীলন করে নাই। এজন্য ধলা চাচা ভাস্তেকে বাস্তবতা বোঝালেন এভাবে-
“শোন, বাপু, দলাদলি তোমার জন্নি আসে না। কিন্তু আমাগের জন্নি আসে। এখানে বহুত হিসাবপাতি আছে। তুমি তো কোন ঝামেলায় থাকনা , তাই কোন ঠেলা বোঝ না।”
কবে, কোন কালে, কেমন করে ধর্মের অনুষ্ঠানের সাথে দল-বেদলের সম্পর্ক স্থাপন হয়ে একেবারে জড়ায়ে প্যাঁচায়ে খিচুড়ি হয়ে গেছে তা কিছুতেই আলী আশরাফের মাথায় আসছিলো না । যে জঠিল কথা মাথায় ঢোকে না সে কথা নিশ্চয় ভারী কথা। ভাবলে শুধু বুদ্ধির অসাঁড়তাই ধরা পড়ে।
ধলা চাচার সাথে আর কোন কথা বাড়ালো না আলী আশরাফ কারণ তার সাধারণজ্ঞানে অনুমান হতে লাগলো যে, তর্ক করে তার কোন উপকার নেই। এতে সময় ব্যয় হয়ে যাবে কিন্তু পরে এত কষ্টের আয়োজনের বাড়ির প্রথম ইফতার অনুষ্ঠান মাঠে মারা যেতে পারে। অনুষ্ঠানটা পন্ড হয়ে গেলে তার নিজের মনেও খুব খারাপ লাগবে, ছেলেটাও চাকরী স্থলে বসে খুব দুঃখ পাবে।
ধলা চাচা যেভাবে তার ইফতার অনুষ্ঠানে আসার অপারগতা ও যেভাবে তার কার্য-কারণ ব্যখ্যা করে শোনায়ে দিলেন তাতে এত যতেœর ইফতার অনুষ্ঠান আলী আশরাফের নিকট ধর্মের সৌন্দর্য হারায়ে শীঘ্রই বিশ্রি পীড়াদায়ক এক উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ালো।
রাঙা চাচার উপদেশ মেনে তৎক্ষনাৎ আলী আশরাফ গ্রামের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাড়ায় বদর জদ্দারের বাড়ির দিকে দ্রæত পায়ে ছুটতে লাগলো। লম্বা ঢোলা এক সাদা পাঞ্জাবী গায়ে। পাঞ্জাবীটার বয়স তার বয়সের তিন ভাগের এক ভগের কম হবে না। এর ব্যবহার বছরে মাত্র দুই দিন। দুই ঈদ। ঘন্টা দুয়েকের অধিক এ পাঞ্জাবী তার গায়ে থাকে না। এর পরে ভাজে ভাজ মিলায়ে আবার তা ট্রাঙ্কে যত্ন করে তুলে রাখে। পাঞ্জাবীর সাথে সাথে মাথায় টুপি পরেছে। পরণে একটা ধোয়া কাচা ল্ঙুগী। সব মিলিয়ে আলী আশরাফের একটা নতুন ছবি প্রকাশিত হয়ে গ্রামের অপরাপর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। তার এভাবে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যাওয়া দেখে সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো এভাবে সে কোথায় চলেছে । কারো প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর করে, কারোটা আবার উপেক্ষা করে পড়ি মরি করে আলী আশরাফ বদর জোয়াদ্দারের বাড়িতে গিয়ে পৌছালো।
“চাচা আমার বাড়িতি এট্টু এখনি যাতি হয় যে। আজ আমার বাড়িতি মিলাদ আর ইফতার এর এট্টু আয়োজন করিছি।”
“কি উপলক্ষে মিলাদ দেচ্ছ গো, আশরাফ?”
“ঐ যে আমার বড় ছোয়াল ডা আর্মির চাকরী পাইছে তো। সেই জন্নি।”
“ও আইচ্ছা। তা কার কার দওয়াত দিয়েছো ,হ্যগো?”
আলী আশরাফের কাছ থেকে দাওয়াত প্রাপ্তদের নামের একটা মোটামুটি তালিকা শুনে বদর জদ্দার বললেন-
“ না গো। এ দাওয়াতে আমার যাওয়া সুম্ভাব না।”
“ক্যান চাচা? সুম্ভাব না ক্যান?”
“ তোমার ওকানে তো কদর মন্ডল যাব্যেনে। কদর মন্ডলের সাথে এক জাগায় বসে দওয়াত খাওয়া কোন ভাবিই সম্ভব না।”
“ক্যান চাচা?”
“তুমি জান না? সে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। আবার তাছাড়া শরা ব্যাপারীকে দওয়াত দিয়েছো দেকছি। ও তো আমাদের এন্টি গ্রæপ করে। আমরা করি এমপি’র গ্রæপ আর ও করে মেয়রের গ্রæপ। তাহলে তোমার এসপ লোকের সাথে কেম্মায় তোমার বাড়ি ইফতার খাতি যাব, বল? ”
আলী আশরাফ বদর জদ্দারের এসব কুটিল, ভাগ-বিভাজনের রাজনীতির কথা শুনে এবার মাজা পানির বিপদ থেকে যেন একবারে অঠাই পানিতে গিয়ে পড়লো। তার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। এখন সে কি করবে, কি বলবে, ভেবে যেন কোন কুল-কিানারা পাচ্ছিল না।
বদর জদ্দারকে অনেক অনুরোধ, অনুনয় করেও কোন উপকার হলনা। তিনি কিছুতেই আলী আশরাফের বাড়িতে আসতে রাজি হলো না।
আলী আশরাফ তবে বুঝতে পারলো যে, গ্রামের মানুষের রাজনীতির বিষয় আশয় এখন ধর্মের, কিতাবের অনেক উর্ধ্বে উঠে গেছে। ধর্মের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এখন কে দলে, আর কে বেদলে, কে আপনার আর কে পরের, কাকে পছন্দ, কাকে অপছন্দ,কে পক্ষে,কে বিপক্ষে ইত্যাদি’র প্রতিফলন ও প্রকাশ করবার বাহন হিসাবে ব্যবহার্য হচ্ছে ।
ধর্মের অনুষ্ঠানে মানুষের এত সব অর্ধেমর ছুতো অন্বেষণ করার কাজে সৃষ্টিকর্তার অনুমোদন আছে কি না তা ধর্ম বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু ধর্মের গজমূর্খ আলী আশরাফের মন তার আপন প্রাকৃতিক শক্তি দিয়ে ভেতরে ভেতরে গলা ফাটিয়ে বলছিল যে, কোন মতেই ইফতার অনুষ্ঠানের সাথে এ সমস্ত অধম বিচার-আচারের বিষয়ের কোন যোগ চলতে পারে না।
এ পাড়া ও পাড়া দৌড়া দৌড়ি করে ভীষন পেরেশান হয়ে, চরম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলো আলী আশরাফ। সন্ধ্যা লেগে আসলো। মাগরিবের আযান পড়ে গেল। ঘরের বারান্দায় পাতা সারি সারি ইফতারের থালাগুলো আরবী খেজুর, মিষ্টি, মুড়ি, আলু-বেগুনির চপ এবং আরো কত আল্লাহর নিয়ামত ধারণ করে রোযাদারের পানে চেয়ে রইলো কিন্তু সেগুলো উপভোগ করে, সৃষ্টিকর্তার অশেষ নেকি হাসিলের প্রয়োজনে আলী আশরাফের বাড়িতে সেদিন দাওয়াতপ্রাপ্ত কোন রোযাদারেরই দেখা মিলল না। আপন-পর কেউ না।
অত্যন্ত দুঃখ বেদনা নিয়ে ছেলের কাছে ফোন করে আলী আশরাফ কেঁদে কেঁদে বলে দিল-
“ ইফতার, মিলাদ এসব দিতি কল্যে ক্যান, বাপ? ধম্ম কম্ম এত জটিল হয়ে গেছে। আমি কি এত কিছু বুঝি?”