মৃত্যুর গর্জন এখন শোনা যায় পাশে,
তবুও কেন হে সবে উদাসীন এত !
বিষবাষ্প প্রতি পলে আকাশে বাতাসে
প্রবেশি ধরণী পরে তরঙ্গের মত।
লক্ষ বক্ষে ঝরে পড়ে তীব্র কলরব,
ইতি উতি পড়ে আছে অগণিত শব,
পরস্পর সাথে যেন করে আলিঙ্গন,
তথাপি কি বিচলিত নহে তনুমন !
সাবধান সাবধান – কহে কাণ্ডারী,
কিন্তু সে বাক্যে কারো নাহি কর্ণপাত,
বিক্ষুব্ধ তটিনী মাঝে দিতে হবে পাড়ি,
জলরাশি দিবানিশি করে সংঘাত।
যেতে হবে পথ চিরে তটিনীর তটে,
জীবন প্রতিষ্ঠা করো ধীর স্থির পটে,
যাত্রা করো এই ক্ষণে–কহে কর্ণধার,
চল সবে মৃত্যুরে করি সংহার।
প্রেয়সী দাঁড়ায়ে কাঁদে–কাঁদেন জননী,
বিচ্ছেদের হাহাকার–সে কি মর্মভেদী,
ধরণীর কোণে কোণে মৃত্যুর ধ্বনি,
তবু হেরি নির্লিপ্ত–রহ চক্ষু মুদি।
মৃত্যু যেন হেথা খেলে শুধু লুকোচুরি,
তবু হায় তোমাদের কেন এই দেরী !
জীবনকে যে মৃত্যু করে সদা বিদ্রুপ,
তার ভয়ে রবে কিনা দীন, নিশ্চুপ !
মৃত্যুর স্বরূপ হেরি ভীত বুঝি আজি !
যে মৃত্যুর আঘাতে ধরা চূর্ণবিচূর্ণ,
সেই মৃত্যু ত’ তোমাদেরই পাপ আবাহনে,
মিথ্যার করাল গ্রাসে সত্য যেথা দীর্ণ।
মানুষের ছায়া যবে হয় দীর্ঘকায়,
নীতিহীন ভ্রষ্টাচারে মত্ত সবে হায়,
তখনই ত’ ঘূর্ণি আসি’ করে ধরাশায়ী,
এত ধ্বংস তার জন্য তোমরাই দায়ী।
তাইতো কাণ্ডারী কহে-“হও হুঁশিয়ার,
ইতি হোক নিখিলের মৃত্যু হাহাকার,
নির্ভীক হৃদয়ে কহ–নাহি মৃত্যুভয় !
জীবনই আসল সত্য–তারই হবে জয়।”
নতুন ঊষশী করো জাগরুক এবে,
গহীন রাত্রি শেষে আসবে সুদিন,
পান করো স্বর্গসুধা অমৃত উৎসবে,
শোধ কর বসুন্ধরা সনে যত ঋণ।
আজ তাই সেনানীর কঠোর আদেশ,
অসুখের সাথে যুদ্ধে সুখ করো জয়,
মৃত্যুর অন্তরে সবে কর হে প্রবেশ,
অহং–এর নাশ হোক আপন লজ্জায়।
মায়ের অশ্রুপাত–হৃদয়ের যাতনা,
সবই ত’ জীবনবোধে অনন্ত দ্যোতনা,
ব্যর্থ যেন নাহি হয় ধরণীর বুকে,
আপন সীমার মাঝে রহ এবে সুখে।
হে অবোধ–হে লোভী–হে রিক্তজন,
পৃথিবীর যত দু:খ পাপ অমঙ্গল
সব কর এইক্ষণে শিরেতে ধারণ,
পান কর হিংসা দ্বেষ যত হলাহল।
আপনারে ভেবেছিলে শক্তির আধার,
তাই ত’ জীবনে আজ এই কুজ্ঝটিকা,
বঞ্চিতের মর্মদাহে আনন্দ অপার,
পরেছ ললাটে সেই লালসার টীকা।
দেবতার অসম্মান কর কি সাহসে !
সীমাহীন ঔদ্ধত্য প্রতিটি প্রকাশে,
তারই পরিণাম এই মৃত্যু মিছিল,
কৃষ্ণবর্ণ মেঘে ঢাকা সমগ্র নীল।
কিন্তু কি ভেবেছ কভু এই রক্তধারা,
দিতে কি হৃদয়ে পারে অনন্ত সুখ !
রাত্রির তপস্যা আনে দিবসের জরা,
আগ্রাসী মৃত্যু যেথা সদা উন্মুখ।
এখনো সময় আছে করো অবধান,
মিথ্যার দুর্বিপাকে হয়োনাকো ম্লান,
সত্যের সন্ধানে সবে হও এবে ব্রতী,
ন্যায়দণ্ড হাতে যেথা অপেক্ষক দূতী।
এই অসহ্য দু:খরাতি হোক নি:শেষ,
অভিযান করো বন্ধু সত্যনিষ্ঠ পথে,
ত্যাগ করো এক্ষণে কপটতা বেশ,
উড়াও আপন ধ্বজা সততার রথে।
কাণ্ডারী আদেশ কেহ কোরো না অবজ্ঞা,
ঔদাসীন্য দূর হোক স্থিত হোক প্রজ্ঞা,
তবেই ত’ খুঁজে পাবে সুবর্ণ দিশা,
অমারাতি অবসানে নবোদিত ঊষা।
মৃত্যুর হাত হতে পেতে পরিত্রাণ,
অমরাবতীর পানে দাও এবে দৃষ্টি,
নিদারুণ দুর্দশার হোক অবসান,
নরকের বক্ষে কর স্বর্গের সৃষ্টি।