প্রাচীন ভারতবর্ষের সংস্কৃতি কিংবা সনাতন ধর্মের বেড়াজালে নাস্তিক্যবাদী বা জড়বাদি মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল যারা আমাদের মৃত্যুর পর আত্মার যে অস্তিত্ব আছে সে কথা অস্বীকার করতেন,তাদের মূলত বলা হতো চার্বাক।
ওল্ড টেস্টামেন্টে সলমন বলেছেন, “যা মন চায় তাই করো। স্ফূর্তি করে খাও দাও,আনন্দ কর।স্ত্রী পুত্র নিয়ে সুখে ঘর করো।যা করতে পারো সকল শক্তি দিয়ে করো; কারণ,শেষ অবধি তো যেতেই হবে সেই কবরে।কাজ বলে – কৌশল বলে – জ্ঞান বলে কোনো জিনিস পরলোকে থাকেনা।”
Emili du chatelet এর শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে বিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ ধ্রুবক।শক্তি অবিনশ্বর,একে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায়না।এক রূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তরিত হয় মাত্র।যেমন ফটোগ্রাফিক প্লেটে আলো এসে পড়লে তা আলোক শক্তি থেকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর ঘটে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ এর সময়কালে প্রাচীন দার্শনিকদের ধারণা ছিল যে কিছু অন্তর্নিহিত পদার্থ সংরক্ষণ করে সবকিছু তৈরি হয়েছে।এম পেডোকেলস এর মতে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড মূলত চারটি উপাদানে তৈরি – পৃথিবী,বায়ু,জল, অগ্নী।
শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত আমাদের সকল কাজকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যে একটি শক্তি বা কয়েকটি শক্তির সমন্বয় পরিচালিত করে – তাতে কি বিতর্ক দানা বাঁধতে পারে?
তাহলে মৃত্যুর পরের অবস্থা কি?নাস্তিক রূপে যদি কল্পনা করা যায় যে সেটি বিলীন হয়ে যায় ঠিক তখনই বিজ্ঞানের নিত্যতা সূত্রটি প্রবল ভাবে ধাক্কা দেয়- শক্তির বিলিনতা তো প্রামাণ্য নয়।
কাব্যধর্মি উপনিষদগুলির মধ্যে কঠোপনিষদ অন্যতম। ” দি সিক্রেট অফ্ ডেথ” নাম দিয়ে স্যার এডউইন আর্নল্ড এর ই অনুবাদ করেছিলেন। গ্রন্থটি আরম্ভ হয়েছিল অনেক টা এই রকম প্রশ্ন দিয়ে – কেউ কেউ বলেন,মানুষ মরলে চিরকালের মতো লুপ্ত হয়ে যায়,আর কেউ কেউ বলেন ,মরণের পরেও মানুষ বেঁচে থাকে । এই কথা দুটির কোনটি সত্য এই প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে।
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে মরণের পর আত্মা বলে যদিও কিছু থেকে থাকে সে কি তার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে ?”
ভদ্রলোক কে প্রশ্নটা হঠাৎ ই আমার মাসতুতো ভাই করে বসলো।নাম আনন্দ শঙ্কর দাস,প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এক মেধাবী ছাত্র,বাড়ী পশ্চিম মেদিনীপুর ,এখন কসমোলজি নিয়ে এস এন বোসে ডক্টরেট করছে।ক্লান্তিটা তখনো তেমন কাটেনি বিকেলে, আমরা তখন মুকুটমনিপুর ড্যাম এর একদম বিপরীত পাশে পুরুলিয়ার একটি ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম দোলাডাঙায়।
সেই ভোর সকালে খড়গপুর থেকে রুপসিবাংলা ধরে বাঁকুড়া স্টেশনে নেমে সবে চায়ে চুমুক দিয়ে মানবাজার যাওয়ার বাসে তখন।দুই ভাইএর একসঙ্গে এই প্রথম কোথাও বেড়াতে যাওয়া।দুপুর তখন প্রায় একটা, মানবাজারে ভবঘুরের মত হাঁটছি – দোলাডাঙা যাওয়ার কোনো যানবাহন নেই।চারদিকে পুরনো আমলের বাড়ী ঘর ,পুরনো দিনের বাজারের ঐতিহ্য অনেকটাই এখানে বেশ স্পষ্ট।
ছোটনাগপুর মালভূমির এই অংশের উল্লেখ জৈন ভগবতিসুত্র থেকে মেলে,মনে করা হতো সড়শ জনপদের এটি একটি।প্রাচীন ভারতে বজ্র ভূমি দের রাজত্ব ছিল এখানে।এই অঞ্চলের সব থেকে বড় বাজার এটি।মানবাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পথ গেছে মাত্র ১৫ টা ঘরের বাস এই ছোট্ট সনাঝুরুর জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী গ্রাম।
মিনিট কুড়ি পরে একটি মেশিন রিকশা তে দরদাম করে উঠলাম। উঁচু উঁচু টিলা,পাথুরে জমির মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি,পর্ণমচি বৃক্ষের এলোচুলে না বলা কথা,আর ওই ছোট্ট ছোট্ট মাটির বাড়ী রাস্তার ক্লান্তি দূর করবে নিমেষে। দু একদিনের জন্য চলে আসতে পারেন আমিত্বের ডাকে।হাতে গোনা কটি দোকান নিয়ে গ্রামের ছোট্ট বাজার,দুপুর হয়েছে তাই সব বন্ধ, রিকশা আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। প্রায় মিনিট পনেরো হেঁটে জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছলাম আমাদের হোটেলে,যদিও হোটেল বলা ভুল হবে – ছিল কতগুলো তাঁবু আর চারটে মাড হাউস।ডাবের জল দিয়ে অ্যাপায়ান শুরু হলো।দূরে কংসাবতী র জল তখন আমাদের অপেক্ষায়। চটজলদি স্নান সেরে মনোনিবেশ করলাম দুই ভাই দুপুরের আহারে। ড্যাম এর জলের কাল্পংসি মাছের ঝোল,আলুপস্ত,আর ডাল ভাতে মনটা সে যাত্রায় তৃপ্তি লাভ করেছিল।
” দেখে তো তোমরা আমার ছেলে বয়সি হবে, তা পরিচয় জানতে পারি?”
গুরুগম্ভীর গলায় কিঞ্চিৎ দূরে খেতে বসা এক ভদ্রলোকের জিজ্ঞাসায় আমরা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিলাম। পরিচয় পর্বের পর ,আহার শেষে আমাদের হোটেলে আমরা ব্যতীত একমাত্র দ্বিতীয় অতিথি মানুষটির সঙ্গে আমরা ভাব জমিয়েছিলাম কংসাবতী র পাড়ে। ভদ্রলোকটির মুখে এতক্ষণ আত্মা সম্পর্কে গল্পঃ আমাদের বেশ মন কেড়ে ছিল। ওপারে মুকুটমনিপুর,লেকের জলের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েক টি পাহাড় ,চারিদিকে সবুজের সমারোহ – এক গ্রাম্য সংস্কৃতি সঙ্গে বোকাসোকা গ্রামের মানুষের ভালোবাসার মাঝে আত্মার খোজ পাওয়া যায় নাকি সে নিয়ে তর্ক চলতে পারে কিন্তু আমার আমি কে খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয় বৈকি।
ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি,হালকা রঙের খাদির পাঞ্জাবি পরনে ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোক কে বেশ মজাদার মনে হয়ে ছিল আমাদের দুজনের ই।স্ত্রী এখন বিদেশে মেয়ের কাছে, তাই অবসর জিবনে ছুটি কাটাতে তিনি একাই এসেছেন,থাকেন পুরুলিয়া শহরে। সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন ” আত্মার অস্তিত্বের কথা বেদান্ত দর্শন স্বীকার করে। ভগবৎ গীতায় আছে ‘ মানুষের আত্মা অবিনাশী, অস্ত্রের দ্বারা একে ছেদন করা যায় না,আগুনে একে পড়ানো যায় না,বাতাস একে শুকিয়ে ফেলতে পারেনা আর জলেও একে ভেজানো যায় না ‘।
হিন্দুদের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার মন্ত্রগুলো তে চোখ রাখলে দেখা যায় মৃত ব্যাক্তির আত্মীয় গন তার নামে পার্থনা ও সৎকাজ করেন মৃতের সদগতি লাভের জন্য কারণ তারা বিশ্বাস করেন মৃতের উদ্দেশে পার্থনা ও সৎকর্ম বিদেহীদের পরলোকে সাহায্য করে।”
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের মতে চিন্তা হলো একটি মস্তিষ্কপ্রসূত ফল অর্থাৎ মস্তিষ্কের কাজ ফুরিয়ে গেলে মনের কাজ ও শেষ হয়ে যায়,আত্মা বলে সতন্ত্র কেউ নেই – আনন্দর কথাটা আমাদের আড্ডা টাকে আরও জমিয়ে দিয়েছিল।সূর্যাস্ত হতে কিছু দেরি আমরা তখন কংসাবতী র বুকে বোটিং করার পরিকল্পনা নিচ্ছি,
” কখনো নিজেকে প্রশ্ন করেছো – আমি কে?”
খুব হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম,হোটেলের দাদাটা তখন নৌকো নিয়ে দাড়িয়ে।
“আমার আমিকে খুঁজে যদি কোনোদিন পাও সেদিন আত্মার পরিচয় মিলবে বৈকি”
নৌকার হাল তখন কল কল শব্দে আমাদের জলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,ভদ্রলোক তীরে বসে নিজের আবেগে কথা গুলো বলছিলেন।
এখানে যদি বেড়াতে আসেন নৌকবিহার অবশ্যই করবেন দিগন্তরেখা র অপরূপ স্পর্শ মনের গ্লানি দুর করার জন্য যথেষ্ঠ।
বোটিং শেষে করে সন্ধের চায়ের আড্ডা টা সবে শুরু হবে সঙ্গে এলো আলুর চপ আর মুড়ি।সূর্য তখন অস্তাচলে প্রায়।
” হিন্দুদের প্রাচীনতম মহাকাব্য মহাভারতে একটি চমৎকার প্রশ্ন পাওয়া যায়, যার উত্তর যুধিষ্ঠির খুব যথাযথ ভাবে দিয়েছিলেন ‘ নিত্য দিন ই মানুষ ও জীবজন্তু মারা যাচ্ছে,কিন্তু তবু মানুষ মৃত্যুর বিষয়ে ভাবেনা,তার ধারণা – তার কখনো মরণ হবেনা। এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে।”
গরম চপে কামড় বসিয়ে ভদ্রলোকের আড্ডা দেওয়া শুরু হলো।বোধ হলো বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চর্চা করেন।
আত্মা কে অনুভব করার প্রথম শর্ত ই হলো আমার আমিকে জানা।আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে দুভাবে ভাগ করা যেতে পারে – একটি চেতন মন বা কনসিয়াস মাইন্ড অপরটি হলো অবচেতন মন বা সাবকন্সিয়াস মাইন্ড। যুক্তি,ইচ্ছে,পরিকল্পনা,স্বপ্ন,কিংবা ক্রিয়েটিভিটি এগুলি হল আমাদের চেতন মনের ক্রিয়াকলাপ যা মস্তিষ্কের ৫ শতাংশ,প্রসেসিং স্পীড ৪০ বিটস পার সেকেন্ড।
অপর দিকে অবচেতন মনের মধ্যে পড়ে আচার অভ্যাস,বিশ্বাস,স্মৃতি,অনুভূতি ইত্যাদি যা মস্তিষ্কের ক্ষমতার ৯৫ শতাংশ,প্রসেসিং স্পিড ৪০ মিলিয়ন পার সেকেন্ড।আমাদের অবচেতন মন এতটাই শক্তিশালী বিনা বাধায় চব্বিশ ঘন্টা প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন কোষ কে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।যাকে এক কথায় বলা যেতে পারে অসীম বা অনন্ত। বিশ্বের বহু স্থানে চিকিৎসক কিংবা বিজ্ঞানীদের “প্লেসিবো এফেক্ট ( Placebo effect ) ” রোগীদের ওপর প্রয়োগ করতে দেখা যায়।যেখানে রোগীর অবচেতন মনে ঢোকানো হয় যে তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে আদতে ওটা হয়ত একটি সুগারের বড়ি।রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে যাচ্ছে – অবচেতন মনের শক্তি এতটাই।
পাশে তখন দুটো আদিবাসী দাদা আমাদের জন্য “বন ফায়ার” এর তোর ঝোর শুরু করেছে।এখানে এলে বন মুরগি খেতে কখনো ভুলবেন না।সন সন করে হাওয়ায় গোটা পরিবেশ স্তব্ধ।ওরা তিনজন এখানে আজ ,পালা করে গ্রামের লোক এই হোটেল দেখা শোনা করে।
বেশ আমুদে ভদ্রলোক চুরুট ধরাতে ধরাতে বললেন “কখনো NDE ( near death experience) এর কথা শুনেছ?”
যদিও ইন্টারনেট এ কিছু পড়েছি তবু্ও মাথা নাড়লাম দুজনেই।
” এটি হলো ,যাকে বলে মেডিক্যালী ডেথ পরে বেঁচে ফিরে এসেছে অথবা কোমায় থাকা মানুষজন যারা মৃত্যুর পরের অবস্থা প্রত্যক্ষ বা অনুভব করেছেন।এরকম অনেক কেস ই ইন্টারনেট ঘাটলে পাওয়া যায় যারা সেই দুনিয়া কে নিজের শরীর থেকে পৃথক হয়ে নিজের চেতনা,নিজের আমিত্ব,নিজের চৈতন্যকে অনুভব করতে পেরেছে।
কিন্তু মানুষের চৈতন্য ময় আত্মা যখন দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যায় যাকে বিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে দেখলে একটি এনার্জী র নির্গমন বলা যেতে পারে তার আলোকচিত্র নেওয়া যায়।মরনের পর দেহ কে ওজন করে দেখা গেছে নির্গত কিছুর ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ।”
মনটা কিছু সময়ের জন্য অন্য জগতে যেনো চলে গেছিলো সত্যিই তো যার সঙ্গে আমরা প্রতিমুহূর্ত রাগ ,অভিমান ,ইচ্ছে ভাগ করে নি – সেই আমার আমি আজ তার অস্তিত্ব নিয়ে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
বন ফায়ারের আগুনটা নিভু নিভু প্রায়, ঘাড় ঘুরিয়ে একটু আড়ষ্ঠতা ভাঙছি, দেখি পেছনে কেউ দূরে বসে আমাদের আড্ডা একমনে শুনছে।নির্লিপ্ত কিন্তু অবাক চোখ গুলো এতক্ষণ আমাদের কথপোকথনের সাক্ষী। জলসানো মুরগির দেহ আমরা সবাই ভাগ করে নিলাম।রাত অনেক বেড়েছে,ভদ্রলোক তখন হেঁটে ওই দূরে জঙ্গল্টার পাশে দাড়িয়ে -জলের দিকে তাকিয়ে।রাতে রুটি,আলুকষা খেয়ে, শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমোতে গেলাম।
ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা,মাটির বাড়িতে ঘুমনোর বিলাসিতা কাটিয়ে ব্রাশ করে বেরিয়ে পড়েছি গ্রামটা ঘুরে দেখবো বলে – ঘুম চোখে গরুগুলোর দাড়িয়ে থাকা,মোরগের পৌরুষ ভরা গলায় “কোকোর কো” ডাক, বাসী বাসন নিয়ে পুকুরে যাওয়া রমণীর ব্যস্ততা ,শিশির ভেজা শাপলা ফুলের ক্যানভাস আর গ্রামের মেঠো পথের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অনাবিল অনুভূতি এক ব্যাতিক্রমী সকালের ছবি এঁকে গেছিলো মনপুরানের কাব্যে।
নিমাইদা এই গ্রামের ছেলে, কাল পরিচয়,আজ উনাদের বাড়ী যাচ্ছি খেজুর রসের আস্বাদন নিতে।এই গ্রাম্য মানুষ গুলোর আন্তরিকতা, ভালোবাসার গুণগত মান আমাদের শহুরে মানুষদের থেকে শতযোজন বেশি।
” ভদ্রলোক কে চেনেন আপনি?”
-“চিনি বাবু, উ বাবু ত মাঝে মধ্যেই আসেন এখানে,বাবুর ছেলে আজ থেকে কয়েক বছর আগে মুকুটমনিপুরে, ও পাড়ে, আমাদের এই ড্যাম এ জলে ডুবিয়া মইরে গ্যাসে গা”
কথাটা শুনে দুই ভাই একটু হকচকিয়ে যাই। এত আলাপচারিতা হলো অথচ এই ব্যাপারটা গোপন করে গেছেন, হয়তো কষ্টের কথা বলতে চান না।
” বাবু এখানে আসেন মাঝে মাঝে, স্ত্রী কেও নিয়ে আসেন,সেবার ত বাবুর মেয়ে জামাই আইছিল। বাবু খুব ভালোমানুষ গ,আমাদের ট্যাকা দ্যায়, খুউব ভাল পায় “।
সারা গ্রামে নিমাইদার দাদার একমাত্র বাইক।কিছু টাকার বিনিময়ে আজ সারাদিন আমরা বাইক নিয়ে ঘুরবো।
গাড়ির আওয়াজে এখনও এখানে বাড়ী থেকে লোক বেরিয়ে আসে, বড়ো বড়ো চোখ করে যখন আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে,নিজেকে সেলিব্রিটি হওয়ার অনুভূতি থেকে বঞ্চিত করতে – চাইলেও পারবেন না।
ভারী বর্ষা হলে কংসাবতীর জল হোটেলের সিমানায় প্রবেশ করে,চারটে মাড হাউস আর তিনটে তাঁবু ব্যাতিত প্রকৃতি এখানে খুব কাছাকাছি।
লুচি,আলুর দম আর চা খেয়ে বেরিয়ে পড়া দুই ভাইয়ের।আমরা যাচ্ছি হরিণ উদ্যানে। শাল পলাশের ভেতর বাইক চালানোর তৃপ্তানুভূতির কথা না হয় গোপন ই থাক। হরিনদের সঙ্গে কিছুক্ষন শুভদৃষ্টির পর আমাদের পরের গন্তব্য মুকুটমনীপুর কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের যেতে হবে নৌকো পেরিয়ে ও-পাড়ে।ঘাম ঝরিয়ে বাইক কে নৌকার ওপরে তুলে পৌঁছলাম অনেকটা স্বদেশ সিনেমার খান স্যার এর নৌক যাত্রার স্টাইলে।
কংসাবতীর ডাইকের ওপর গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা জীবনের আরেক অমূল্য সম্পদ আর সাথে যদি আপনার প্রিয়জন থাকে তো কথাই নেই।
দেখা হলো কংসাবতী র পরিজনদের সাথে,সবুজের অন্তহীন আলাপ বসলো কিছুক্ষন পাহাড়ের বুকে,কুমারী মিশেছে এখানে।পাশে ই ঝাড়খণ্ডের সীমানা।ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বড়ো “আর্থ ড্যাম” এটি।দুপুর গড়িয়েছে ,হোটেলে ফিরে দুপুরের আহার শেষে একটু দেহটাকে এলানোর পরিকল্পনা নিচ্ছি-
” ভদ্রলোককে আজ সকাল থেকে দেখছিনা, মানুষটার চোখের নিচে কালি কষ্টের পরিসিষ্ঠাংসের পরিচয় দেয়,আমরা উনার ছেলের মত বলে হয়ত উনি উপযাজকের মত আমাদের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলেন। ”
আনন্দর আমাকে বলা কথাটা মস্তিষ্কে টোকা দিয়েছিল।
বিকেলে চা খেয়ে কংসাবতী র পাড়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখছি,
– ” মুকুট মনিপুর কেমন লাগলো? আমার তো আবার এই জায়গাটা বেশ পছন্দের।সন্ধ্যেতে এসো গল্পঃ করা যাবে, কাল চলে যাচ্ছি”
ভদ্রলোক দুর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কংসাবতী র পাড় ধরে এগিয়ে এসে আমাদের বললেন।
” নিশ্চই ,আমরাও কাল চলে যাচ্ছি,সন্ধের আড্ডাটা অবশ্যই হবে”
আনন্দর শ্রদ্ধা ভরা প্রত্যুত্তরে, ভদ্রলোক বোধ হলো খুশি হয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলেন।
ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাতটা,চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নীমাইদা একমনে রান্না করছে ওই দূরের তাঁবুতে।
” প্রাচীন মিশরীয় দের দেহ সংরক্ষণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ ছিল ,তারা বিশ্বাস করতো আমাদের দ্বিতীয় সত্ত্বার কথা,তাদের মতে এই জড় দেহের সঙ্গে সূক্ষ্ম শরীর বা আত্মার দৃঢ় সংযোগ আছে ,তাই জড় দেহের সংরক্ষণ করা জরুরি।যদিও এই দ্বিতীয় সত্ত্বার কথা কমবেশি সব ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়।
স্বামী অভেদানন্দের “লাইফ বিয়ন্ড ডেথ” গ্রন্থ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মৃত্যুর পর মানুষের অবস্থা কিংবা ভিন্ন আত্মার সঙ্গে মানুষের আলাপচারিতার কথা।প্রেততত্ত্ববাদে, একটি মিডিয়ামের সাহায্যে কিভাবে একটি আত্মার সঙ্গে পরিচিতি ঘটানো যায় তার বর্ণনা পাওয়া যায়।”
ভদ্রলোক থামলেন কিছুক্ষন,নতুন সিগারেটে সদ্য টানটা দিতে দিতে বললেন আমরা ব্যতীত এখানে আরো কিছু জন আছেন।
মুহূর্তের মধ্যে আমরা দুভাই থ্রি সিক্সটি কোনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমরা তিনজন ছাড়া এখানে তো আর কেউ নেই!শরীরটা ছম ছম করে উঠলো।
বেশ রাগান্বিত হয়ে আনন্দ বলে উঠলো ” যদি আত্মা বলে কেউ কিছু থেকে থাকে আমরা দেখতে পাইনা কেনো?”
ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন ” বিজ্ঞান কে তো বিশ্বাস করো নিশ্চই?
আচ্ছা?পদার্থবিদ্যা ভালো লাগে?”
আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দের বিষয় ছিল এটি তাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম।
ততক্ষনে নিমাই দা আমাদের জন্য চা আর পাকোড়া নিয়ে এসেছে।
” আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি তা ছাড়াও আমাদের আরও কতগুলো দুনিয়া আছে,বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ডাইমেনশন।শুরুর দিকে বিজ্ঞানের ধারণা ছিল আমাদের মাত্র তিনটে ডাইমেনশন আছে কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করে এই তিনটের বাইরেও কিছু হায়ার ডাইমেনশন এক্সিস্ট করে।
এখন প্রশ্ন হলো আমরা তাদের দেখতে পাইনা কেনো?
পঞ্চোয়েন্দ্রিয়ের বেড়াজালে বাঁধা এই পার্থিব শরীর শুধুমাত্র দেখা, শোনা,গন্ধ,স্বাদ,অনুভব করতে পারে।কিন্তু আমাদের চালিকা শক্তি বা অপর অর্থে দ্বিতীয় সত্তা – সূক্ষ্ম শরীর এসবের বাধা মানেনা কারণ সেটি একটি শক্তি বা তার সমন্বয় ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের চৈতন্য ময় আত্মা বা এনার্জী যে কিনা অবিনশ্বর তাদের আমরা দেখতে পাই না কারণ তারা অন্য ডাইমেনশনে থাকে।ধরা যাক, টু ডাইমেনশনে কোনো ব্যাক্তি আছে, সে কখনোই থ্রি ডাইমেনশনে থাকা কাউকে দেখতে পাবেনা কিন্তু উচ্চ ডাইমেনশনে থাকা ব্যাক্তি চাইলে নিচের ডাইমেনশনে থাকা ব্যাক্তির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে পারে। ঠিক তেমন ভাবেই আমাদের চারপাশে কারুর দাড়িয়ে থাকা অথবা আমাদেরকে এই মুহূর্তে কারুর উচ্চ ডাইমেনশন থেকে দেখাটা কি খুব কাল্পনিক?আমরা তো সেই তিনটে ডাইমেনশনে পড়ে আছি।
তুমি তো পদার্থ বিদ্যায় ডক্টরেট করছো,তোমাদের কোয়ান্টাম ফিজিক্স কি বলে?”
ভদ্রলোক থামলেন।রাতের ওষুধ খাওয়ার তাড়নায় বোধহয় রুমে গেলেন।
কোয়ান্টাম ফিজিক্স হলো পদার্থবিদ্যার সেই অংশ যাতে ইলেকট্রন,প্রোটন,নিউট্রন এর মত সব অ্যাটমিক পার্টিকেল বা কণা কে বর্ণনা করা হয়, এদের থেকেও যে আরো সূক্ষ্ম কণা (quark) থাকতে পারে প্রথম এখানে প্রমাণ করা হয়।এটিকে বিংশ শতাব্দীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলা যেতে পারে।যাকে Quantum mechanics and Quantum field theory বলা হয়।
১৯০০ সালে বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এর প্রথম সূচনা করেন।উনি ব্লাক হোলের বা কৃষ্ণবস্তু র ওপর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, আলোক বা অন্য তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ শক্তির স্বতন্ত্র প্রবাহ না হয়ে শক্তির ছোট ছোট প্যাকেট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর জন্য প্ল্যাঙ্ক কে নোবেল পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয়েছিল।তার এই হাইপোথিসিস বিজ্ঞান জগতে সেইসময় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, এই হাইপোথিসিস ব্যাবহার করেই আইনস্টাইন আলোক – বিদ্যুৎ প্রবাহ বর্ণনা করেছিলেন।আজকের কম্পিউটার কিংবা মোবাইল থেকে gps সবই এই কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর অবদান।
” আমার মৃত পরিজনদের আত্মা যদি এখন এই মুহূর্তে ওয়েভ বা তরঙ্গের আকারে আমার পাশে বসে থাকে ,সেটি খুব অস্বাভাবিক?”
আমাদের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে ভদ্রলোক রুটি তে কামড় বসালেন।
কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলে, যখন কোনো বস্তু কে কেউ দেখেনা অথবা কোনো জিনিসের যখন কোনো অবজার্ভার থাকেনা তখন সেটি ওয়েভ ফর্ম ( wave form) এ থাকে কিন্তু যখন কোনো বস্তুকে আমরা দেখি সেটি পার্টিকেল বা কণা রূপে এসে যায়।প্রথমে ওয়েভ তারপর সেমি ওয়েভ তারপর হয় সেমি পার্টিকল থেকে আমাদের নিউরনে আসে। এই অংশের মতে এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের সঙ্গে ওয়েভ আকারে জুড়ে থাকি অনেকটা গণিতের পারমুটেশন ও কম্বিনেশন এর নীয়ম মেনে।একটা পার্টিকেল বা কণার প্রভাব অন্যটির ওপর পড়ে যদি সেটি অন্য গ্রহেও থাকে,তবুও। আইনস্টাইন ও এই বিষয়টিকে প্রথমে সহজভাবে নেননি।যাকে ফিজিক্সের ভাষায় বলে “quantum entanglement” ।
আনন্দ কিছুটা সম্মতির সুরে বলল “আমাদের কোয়ান্টম ফিজিক্স ও দ্বৈত সত্তার কথা ব্যাখ্যা করে ,এই ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই কণা(perticle) এবং তরঙ্গ(wave) রূপে থাকে, অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই একই সময় দুটো অস্তিত্বে বিরাজ করে।আরো সহজভাবে বলতে গেলে কিছু গুন কণার থাকে আর কিছু গুন তরঙ্গের।যাকে dual nature বলে।”
আনন্দর কথাটা শেষ হতে না হতে ই ভদ্রলোক বলে উঠলেন “ঠিক এই জায়গায় আমাদের আত্মার ধারণা মিল খায় , কখনো স্লিপ প্যারালাইসিসের অনুভূতি পেয়েছো? যেখানে শরীর ঘুমিয়ে কিন্তু মস্তিষ্ক জেগে থাকে।”
আমাদের রাতের খাবার দিয়ে নিমাইদা অনেক্ষন হলো চলে গেছে,জঙ্গলে তখন ঝিঁঝি পোকার ডাক।আমরা তিনজন।কেনো জানিনা মনে হচ্ছিল সত্যিই আমরা একা নোই।ভদ্রলোক আমাদের শুভরাত্রি জানিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিলেন।
সেদিন রাতে আমরা কেউ ঘুমাইনি।ভদ্রলোক কোথায় গেলেন এত রাতে?
পরেরদিন খুব সকালে আমরা ব্যাগ গুছিয়ে বাইকে রওনা দিলাম মানবাজারের উদ্দেশ্যে,সঙ্গে নিমাই দা।
” কাল ভদ্রলোক কোথায় গেছিলেন এত রাতে?”
নিমাইদা মুখটা নীচু করে বলল ” বাবু প্রতি অমাবস্যার রাতে কংসাবতির পাড়ে বসে সারারাত কথা বলেন,আমরা বহুবার বাধা দিয়েছি,বাবু শোনেনা, উত্তরে বলে ছেলের সঙ্গে কথা বলি। কাল বাবু সারারাত ওখানে ছিল।”
কিছু প্রশ্ন,কিছু না পাওয়া উত্তেরের আফসোস নিয়ে আমরা নিমাইদা কে সে যাত্রায় বিদায় জানিয়েছিলাম,কথা দিয়েছি আবার আসবো।
ভেতরের আমি, কিছুতেই বিজ্ঞান – আধ্যাত্মিকতার দন্দ মানতে চাইছিল না,শুধু বলছিল একদিন বিজ্ঞানের হাত ধরেই হয়তো আধ্যাত্মিকতা তার পুরনো গরিমা ফিরে পাবে,আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে নতুন কোন দিক,নতুন কোনো দুনিয়া।যেখানে নাস্তিক আস্তিকের বিরোধ থাকবেনা,কুসংস্কার মাথা তোলার সাহস পাবেনা।
ভদ্রলোক তার ছেলেকে পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই কিন্তু আমরা সেদিন সারারাত ঘুমনোর ভান করে নিজের আমিত্বের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কোয়ান্টাম ফিজিক্স খুব সুন্দর একটা কথা বলে “solidity is an illusion”। এই মায়ার জগতের উর্ধে আমাদের যেতে হবে।
( সমাপ্ত)