অন্য জীবন : প্রথম পর্ব : click here

অন্য জীবন – দ্বিতীয় পর্ব : click here

সেদিন ওরা দুজনেই গড়ের মাঠে বসেছিল। জাহ্নবীর সব কথা সেদিনই দুর্নিবার প্রথম শোনে। ও বলে ওর বয়স যখন পাঁচ বছর তখনই  দুদিনের জ্বরে ওর মা মারা যায়। বাবা অনেক দিন বিয়ে করেননি। ওর বাবার একটা মুদির দোকান ছিল। ঘর ও দোকান সামলাতে খুব কষ্ট হত বাবার। ও যখন ক্লাস ফোরে পড়ে বাবা তার এক পিসিকে নিয়ে এলেন বাড়িতে কাজ কর্মের জন্যে। সেই পিসি আসার পড়ে বাবার কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলেন

-“ও হারু আমার একটা কথা শোন বাবা। তুই একটা বিয়ে কর। ”

বাবা বলেন

-“না পিসি, সৎ মা আমার মেয়েকে নিজের মতো দেখবে না। তার চেয়ে এই ভালো । একটু বড় হলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে।” সেই পিসি দিদাই বলেন -“সব মেয়ে বুঝি খারাপ হয়? আমার নজরে একটা মেয়ে আছে। তার আগেও বিয়ে হয়েছিল। সোয়ামীটা ছিল বড় বজ্জাত। তাকে ছেড়ে অন্য আরেকটামেয়ে ছেলের সাথে থাকে। বিয়ের ছ’মাস পরেই মেয়েটার এই অবস্থা। তা মেয়েটা এখন যায় কোথায়? মা বাবার ঘাড়ে এসে পড়ে আছে। মেয়েটা কাজকর্মও ভালো জানে, নাম অনিতা। তা ওর বাবা সেদিন বলল, দিদি আমার মেয়েটার জন্য যদি কিছু করতে পারেন।”
জাহ্নবীর বাবা বলেন,
-“তুমি যখন ভালো বলছো মেয়েটাকে দেখলেই হল।”
বুড়ি তো খুব খুশি । ব্যাস একটু নারায়ণ পুজো করেই বিয়েটা হয়েছিল। ও বলে যে -“আমার খুব আনন্দ হয়েছিল । নুতন মা এসেছে, নিজের মায়ের কথা তো বিশেষ মনে নেই। ভালই চলছিল প্রথম প্রথম।”  দুর্নিবার ওর কথা শুনতে শুনতেই পপ্‌কর্নওয়ালাকে ডাকে। আর পপ্‌কর্নের একটা বড় প্যাকেট কেনে। ওর দিকে বাড়িয়ে দেয় প্যাকেটটা। দুর্নিবার জিজ্ঞেস করে
– তারপর?”
ও বলে – “তারপর আর কি ? পরের বছর আমার বোনের জন্ম হতেই সৎ মায়ের অত্যাচার শুরু হয়। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে বাড়িতে কাজ করাতো । ঠিকমত খেতেও দিত না। একদিন ভাবলাম বাবাকে সব বলে দিবো। মুখ দেখে মা আমাকে সন্দেহ করলেন আমি বাবাকে বলে দিতে পারি । আমাকে ভয় দেখালেন। বললেন, ‘তোর বাবাকে বিষ খায়িয়ে মেরে ফেলব।’

আমি ভয়ে চুপ করে থাকতাম। বোনটা সবে হাঁটতে শিখেছে । একদিন হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়। তারপর কি কান্না! ব্যাস আর যায় কোথায়?  সব মার পড়ল আমার পিঠে। বাবাকে বলা হল আমি বোনকে হিংসে করে ফেলে দেই, মারি। বাবাও যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের সব কথাই বিশ্বাস করতেন। আমার খুব কান্না পেত। বাবা আমাকে আগের মতো ভালোও বাসেন না আর কাছে ও ডাকেন না। অভিমানে আমিও বাবার কাছে অতো যেতাম না। এদিকে না খেয়ে খেয়ে অসুখে পড়লাম । কাজকর্মও ঠিক করে করতে পারছিলাম না তাই মায়ের যুক্তিতে বাবা এই কানাই মামার কাছেই রেখে গেলেন। মামা মামির সংসারে এসে পড়লাম। মামা-মামী নিঃসন্তান হলেও আমাকে খুব ভালো বাসতেন। স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । ইংরেজি আর অঙ্ক শিখতে যেতাম একজন টিচারের বাড়িতে। আমার মতো কিছু গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরাও ওখানে পড়তে আসতো সেখানে। বাকি সাবজেক্টগুলো নিজেই পড়তাম বাড়িতে। রেজাল্ট ভালই হচ্ছিল। মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, মামা-মা্মীই আমার মা-বাবা। পড়াশোনা করে চাকরি করব, মামা মামির সব দায়িত্ব নেব । নিজের বাবা তো খোঁজ নিতেই আসতেন না।”
– “কেন?”
-“বাঃ রে আমি যদি ছেলে হতাম তবে খোঁজ নিত। মা ভাবলেন নিজের একটা মেয়ে হয়েছে বিয়ে দিতে হবে তাই আমি  ওদের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। আমি না থাকলে বিয়ের খরচটাও বেঁচে যাবে। আমিও আর ও মুখো হইনি।”  কথা বলতে বলতে দুঃখে ওর চোখে জল এসে যায়। জাহ্নবী আঁচল দিয়ে জল মুছে।  দুর্নিবার বলে,” বিয়ের পর আমি তোমাকে পড়াবো। যত খুশি পড়ো।”
-“এত বয়সে পড়াশুনা করতে লজ্জা করেনা বুঝি?” জাহ্নবির প্রশ্নের উত্তরে ও বলেছিল,
-“না জুনি। পড়াশোনার কোন বয়স হয়না। যেকোনো বয়সেই শুরু করা যায়, ইচ্ছে থাকলেই হল।” তারপর বলল,
“তোমাকে আর বেশিদিন কাজ করতে দেবনা। আমি শীঘ্রই আমি একটা চাকরি করব।”
ওর বিশ্বাস ছিল পাশ করে বেরলেই বেশি দিন বসে থাকতে হবে না। ও জাহ্নবীকে অনেক গুলো বই কিনে দিয়েছিল এবং বলেছিল  -“সময় করে অবশই পড়বে। ” এখনো মনে আছে যেদিন ও প্রথম পাশ করে বেরোল, জাহ্নবী সেদিন ফ্রি তে লুচি, হালুয়া আর চা খায়িয়েছিল ওর সব বন্ধুদের । ওর কাছে ভদ্র ঘরের মানুষের মতো সব আদব কায়েদাও শিখে নিয়েছিল। দুর্নিবার অনেকবার জাহ্নবিকে  একটা মোবাইল দিতে চেয়েছিল।ও আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, “আর কত নেব বলতো? তাছাড়াও অত দামি জিনিস আমি সামলাতে পারব না ,  কখন হারিয়ে যাবে । তার চেয়ে বরং নিতাইএর দোকানের ফোনই ভালো। আমার কোন অসুবিধা হয়না। ওরা ডেকে দেয়।”  এরপর ওই দোকানের ফোনেই কথা হত। কানাইলাল এদিকে পঙ্গু হয়ে বিছানা নিল। দুর্নিবারের সাথে ওই ফোনে যোগাযোগই ভরসা। তাও বিকেল ছাড়া ফোনটা ধরা সম্ভব হত না সেই সকাল বেলা সেদ্ধ ভাত খেয়ে মামাকে খাইয়ে ঔষধ পত্র গুছিয়ে ওকে বেরোতে হত। ওই বস্তিরই একটা বাচ্চা মেয়ে “পুঁটি” , জাহ্নবী ওকে কিছু টাকা পয়সা দিত আর বলত আমি না আসা পর্যন্ত মামাকে একটু দেখবি। মেয়েটাকে কখনো ক্লিপ, চুড়ি, টিপ এইসবও ঘুষ বাবদ দিতে হত। ওর ফিরতে ফিরতে তিনটে সাড়ে তিনটে বেজে যেত। দুর্গাপুজোর সময় শপিং মলে গিয়ে ওকে দুটো শাড়ীও কিনে দিয়েছিল দুর্নিবার।  তারই একটা পরে ও দুর্নিবারের বাইকে চড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিল ও। অনেক রাত অবধি সেদিন ওরা ঠাকুর দেখেছিল। জাহ্নবিকে দেখতে  এত সুন্দর লাগছিল যে অনেকে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখছিল। ওকে কেউ বেশিক্ষণ দেখলেই দুর্নিবারের মুখটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল। কখনো বলে এইদিকে চল, কখনো বলে ওইদিকে চলো।
“কেন?” প্রশ্ন করে জাহ্নবী।
ও বলে, “তুমি শুধু আমার। আমি ছাড়া তোমাকে ওইভাবে কেউ দেখলে রাগ হয়।”
জাহ্নবী হেসে ফেলে। বলে,
-“যদি অন্য কোথাও বিয়ে হয়?”
দুর্নিবার বলে , “আমি তোমাকে আর সেই ছেলেটাকে দুজনকেই গুলি করে মেরে ফেলব।
জাহ্নবী দুর্নিবারের কিনে দেওয়া বইগুলি সময় পেলেই পড়ত আর বইগুলি যত্ন করে গুছিয়ে রাখতো। কিন্তু তার ভাগ্যের কথা সে কি আর জানতো?

 

ক্রমশঃ……

 

 

~ অন্য জীবন – তৃতীয় পর্ব ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleঅনুযোগ
Next articleBhasha Divas: because we love Bengal and its Language
Rina Acharya
একজন গৃহবধূ। শখ বিভিন্ন ধরনের কবিতা লেখা এবং গান শোনা।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments