সাদা কালো-ষষ্ঠ পর্ব : click here
।৭।
সেই ঘটনার পর দু বছর কেটে গেছে। এই ধরনের ঘটনা মানুষ চট করে ভুলতে পারে না, তবে সময়ের সাথে সাথে তা খানিকটা ফিকে হয়ে যায়। পদারও তাই হয়েছে। মাঝেমাঝে তার মনের গভীর থেকে প্রশ্ন আসে “আশার পাখিটাকে কেন মারলে অনীক? বেশ তো ছিলো!” সে নিজেকে নিজেই উত্তর দেয় “বেশ কোথায় ছিল? যে প্রায় মৃত তাকে বেশী দিন বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ?” কিন্তু সে জানে যে উত্তরটার মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে।
পদা এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স অনার্সের এর ছাত্র। বাবার খুব ইচ্ছা ছিলো যে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পরে। তবে পদাকে ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিশটা খুব একটা আকর্ষন করে না। বড্ড কাঠখোট্টা লাগে তার। নরেন্দ্রপুরে পড়াকালিন পদার পদার্থ বিগ্যানের প্রতি একটা টান জন্মায়। মূলত সত্যেন্দ্রনাথ বসু সম্পর্কে জেনে। তখনও পদা কুয়ান্টাম ফিজিক্স বিষয়ে বিশেষ কিছুই বোঝে না বা জানে না। কেবল স্কুলের লাইব্রেরিতে ফিজিক্সের বই ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে তার হঠাত একদিন নজরে পরে এই ভদ্রলোকের নাম। তার নামের সাথে যুক্ত বিশ্ববিখ্যাত বৈগ্যানিক আল্বার্ট আইন্সটাইন এর নাম। শুধু তাই নয়, দুজনের নাম দিয়ে নামকরন হয়েছে পদার্থ বিগ্যানের একটি মুখ্য প্রনালী—বোস-আইন্সটাইন স্ট্যাটিস্টিক্স। তার নামেই সৃষ্টি হয়েছে বোসোণ শব্দটি। সমস্ত তথ্য জানার পর পদার মনে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগে। কলকাতারই ছেলে। উত্তর কলকাতায় পদারই বাড়ির কাছে থাকতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করেছেন। অথচ সমস্ত বিশ্বের লোক এক বাক্যে তার নাম জানে। মানুষটিকে কোনদিন চেনেনি, জানেনি, কিন্তু গর্বে ভরে গেল পদার বুক। এরপরই সে মনস্থির করে নেয় যে পদার্থ বিগ্যানেই তার স্থান। প্রথম প্রথম পদার ইঞ্জিনিয়ারিংএ আপত্তি ছিল না। বিশেষত বাবা যখন চায়। মহারাজের সাথে কথা বলে জেনেছিল যে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করলেও পরবর্তী কালে পদার্থ বিগ্যান জড়িত গবেষনার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে দুর্গাপুজোর সেই ঘটনার পর পদার আর মানষিক বল ছিল না যে ছ’মাসের মধ্যে জয়েন্ট এন্ট্রেন্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে সেই পরীক্ষায় ভাল ফল করবে। অতএব সেই পরিকল্পনাকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিকে পদার ফল ভালোই হয়েছিল। ততদিনে সে একটু সামলে উঠেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্সের এন্ট্র্যান্স পরীক্ষাতেও ভালো ফল করেছিল। পরে জেনেছিল যে সে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। অতএব ফিজিক্স অনার্সে আডমিশন পেতে তাকে বেগ পেতে হয়নি।
প্রেসিডেন্সি কলেজ পদার খুব ভাল লাগছে। নরেন্দ্রপুরের থেকেও বেশী। এই কলেজের প্রতিটা ইঁট পাথরের মধ্যে একটা ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। মাঝেমাঝে কুয়ান্টাম ফিজিক্স ক্লাসে পদা অন্যমনষ্ক হয়ে পরে। প্রফেসর আর সত্যেন্দ্রনাথের মুখটা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সত্যেন্দ্রনাথের সে মোটে দু একটা ছবি দেখেছে বইয়ের পাতায়। তা সত্তেও। প্রেসিডেন্সিতে ঢোকার পর মুশকিল তবে একটা হয়েছে। পদাকে এখন আবার বাড়িতে থাকতে হয়। সেটা পদার ভাল লাগে না। যে পাড়ায় ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে সেই পাড়াতে থাকাটা এখন একটা ভীতিতে পরিনত হয়েছে। যদি আবার সোনালির মুখোমুখি হয়ে পরে? একদিন হয়েও ছিল। পদা মুখ নিচু করে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল। এখন তার আত্মসম্মান বোধ খুব প্রখর। আবার পরে গেলে আর যে উঠতে পারবে না সে তা জানে।
কলেজে পদার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। সে দেখতে সুন্দর বলে অনেক মেয়েই তার বন্ধু হতে চায়। পদা সেটা বোঝে। তাদেরই মধ্যে একজনের নাম নন্দিতা। নন্দিতা পদার থেকে একেবারেই আলাদা। বড়লোক পরিবারের মেয়ে। সল্টলেকে বিরাট বাড়ি। বারো বছর বয়েস অবধি বড় হয়েছে আমেরিকায়। তার চলনবলন কথাবার্তা সবই খুব সাবলীল, খুব স্মার্ট। তার মত মেয়ে সচারাচর উত্তর কলকাতার বাঙ্গালিয়ানার মধ্যে মানুষ হওয়া বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পরা কোন ছেলের ধারে কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু নন্দিতা অন্যরকম। সে আমেরিকা থেকে সে দেশের ভাল কিছু শিক্ষা সঙ্গে করে বয়ে এনেছে। কাউকে ভাল করে না জেনে না বুঝে পক্ষপাতিত্য দেখানো বা সেই মানুষটাকে বিচার করা সে একদম পছন্দ করে না। নন্দিতা ইকনমিক্স এর ছাত্রী। পদার সাথে তার আলাপ হয় ঘটনাচক্রে। একদিন প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিতে পদা কলেজ থেকে সবে বেরিয়েছে। বেরোনো মাত্র ঝড়ের ঝাপ্টায় তার ছাতা গেছে উল্টে। পদা যখন ছাতা সামলাতে ব্যাস্ত, তখন একটা সাদা টয়োটা গাড়ি থামল তার সামনে। জানালা নামলো। জানালার ওপাশ থেকে একটি মেয়ে জোড়ালো কন্ঠে বলল “তুমি ফিজিক্স অনার্স না? কোথায় থাকো তুমি?” “গড়পার” উত্তর দিল পদা। “গড়পার? সেটা কোথায়?” প্রতিপ্রশ্ন এলো গাড়ির ভেতর থেকে। “মানিকতলার কাছে”। “ও আচ্ছা। আমি তো মানিকতলা ফুলবাগান হয়েই যাব। তুমি চাও তো ছেড়ে দিতে পারি”। পদা একটু ইতস্তত করলো। মেয়েটাকে সে চেনে না। তবে আন্দাজ করা শক্ত নয় যে প্রেসিডেন্সিতেই পড়ে। গাড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো যে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। “ঠিক আছে,” বলে সামনের দরজা খুলে উঠতে যাচ্ছিল। “ওখানে নয়। পেছনে চলে এ্স। পদা পেছনে ঊঠলো। উঠে কোনরকমে ছাতাটাকে গুটিয়ে বলল “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সরি! আমার জামাটা একেবারে ভেজা। আপনার সিটে জল পরছে”। “আরে, বৃষ্টিতে তো জল পরবেই। ওতে কিছু এসে যায়না। বাই দা ওয়ে, বলতে ভুলে গেছি, আমার নাম নন্দিতা। আমি ইকো অনার্স”। পদা কোন উত্তর দিল না। কেবল একটা ধন্যবাদের হাসি। লক্ষ্য করলো যে মেয়েটার গায়ের রঙটা একটু চাপা, কিন্তু মুখটায় প্রচন্ড বুদ্ধির ছাপ। আর হাসলে অস্বাভাবিক সুন্দর একটা টোল পরে গালে। “তুমি প্লিস একটু ওকে বুঝিয়ে দাও তোমার বাড়িটা কোথায়”। পদার খুব আশ্চর্জ লাগছে যে মেয়েটা বিনা দ্বীধায় ওকে প্রথম থেকেই তুমি বলে সম্বোধন করছে, অথচ ও আপনি থেকে বেরতে পারছে না।
সেই প্রথম দেখা। সময়ের সাথে সাথে পদা নন্দিতার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। নন্দিতা মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারে। পদাকে সেটাই আকৃষ্ট করে। তার অনেক বন্ধু। পদা তাদের মধ্যেই একজন। তাদের বন্ধুত্বে কোন স্ত্রী-পুরূষের ভেদাভেদ নেই, নেই কোন ঘনিষ্টতা। শুধু আছে একে অপরের ওপর অগাধ বিশ্বাস। নন্দিতাকে পদা সব মনের কথাই বলতে পারে। একটা কথা বাদ দিয়ে।
একদিন কলেজের পর পদা, নন্দিতা, আর পদার নরেন্দ্রপুরের বন্ধু রাজু মিলে ঠিক করলো যে ধর্মতলা এলাকায় গিয়ে একটা সিনেমা দেখবে। হয়ত সিনেমা দেখার পর একটা রেস্তোঁরায় ঢুঁ দেবে। রাজুও ফিজিক্স অনার্স। ঘটনাচক্রে জানা গেছে যে নন্দিতা আর রাজু নাকি দুঃসম্পর্কের ভাই বোন। পদার এখনো মনে আছে রাজু কথাটা পেড়ে ঠাট্টা করে নন্দিতাকে বলেছিল “কি মাইরি! ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে প্রেম করব! আবার নতুন করে মেয়ে পটাতে হবে!” সবাই এই কথায় খুব প্রান খুলে হেসেছিল। পদার নিজেকে সেদিন খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছিল; এরকম কয়েকজন বন্ধু পাওয়াতে। কলেজ থেকে বেরিয়ে ওরা তিনজন হাঁটতে শুরু করল। জানুয়ারি মাসের হাল্কা শীত। হেঁটে বেশ আড়ামই লাগে। হাঁটতে হাঁটতে ডালহৌসি ছাড়িয়ে গেছে যখন ওরা, তখন রাজু বলল “কি সিনেমা দেখছি আমরা?” “এ পাড়ায় এসেছি যখন একটা হলিউডের সিনেমাই দেখা উচিত” মন্তব্য করলো পদা। সে হলিউড সিনেমা দেখতে ভালবাসে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার কৌতুহল তার ইদানিং খুব বেড়েছে। এই সমস্ত সিনেমা দেখলে সেই কৌতুহল খানিকটা তৃপ্ত হয়। “কি কি চলছে?” নন্দিতার প্রশ্ন। “নিউ এম্পায়ারএ টাওয়ারিং ইনফারনো, লাইটহাউসে কি চলছে জানি না, আর গ্লোবে গন উইথ দ্যা উইন্ড” উত্তর দিল রাজু। “সবই আমার দেখা,” নন্দিতা বলল “তবে গন উইথ দ্যা উইন্ড আমি হাজার বার দেখতে পারি”। “ঠিক হ্যায়, তাহলে গ্লোবেই চলো সবাই” রাজু বলল। পদা হঠাত দাঁড়িয়ে পরলো। “টাওয়ারিং ইনফারনো দেখলে হয় না? অন্যটা আমার দেখা”। ঠিক হোলো যে যেহেতু রাজু আর নন্দিতার দুটোই দেখা, আর পদার টাওয়ারিং ইনফারনো দেখা নয়, ওটাতেই যাওয়া হবে। কিন্তু নিউ এম্পায়ারে পৌঁছে দেখা গেল যে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। পরের শো অনেক দেরীতে। উপায় নেই দেখে সবাই গ্লোবের দিকে এগোতে যাবে, হঠাত পদা বেঁকে বসলো। “আমি যাব না। তোরা যা”। “কেন?” প্রশ্ন করলো নন্দিতা। “বললাম তো, আমার দেখা”। “তাতে কি হয়েছে? আমার তো বহুবার দেখা। আমি তো তাও যাচ্ছি”। “আমার ভাল লাগছে না। তোরা যা”। “কেন তোর কি হয়েছে?” নন্দিতা নাছোড়বান্দা। “আমি যাব না, তোরা যা”। “তুই আগে বল তোর কি হয়েছে”। পদা হঠাত রেগে গেল। নন্দিতার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো। “আমার কিচ্ছু হয়নি। বললাম তো যাব না। আমাকে একা ছেড়ে দে”। পদার গলা উঁচুতে ওঠার দরুণ আসেপাশের লোকজন এখন ওদের দেখছে। নন্দিতা আর কথা বাড়ালো না। রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল “চল”। বলে পদাকে ছেড়ে এগিয়ে গেল। পদা খানিক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়াটা দেখলো। তারপর আস্তে আস্তে রাস্তায় পা রেখে ফুটপাথের কিনারায় উবু হয়ে বসে পরলো। চোখ বুজে মুখ ঢাকলো নিজের হাতের পাতায়।
To be continued…