কলকাতার এক শীতের সন্ধ্যে, বাড়ীর সামনে শুনশান রাস্তা দেখে মনে হয় বুঝি কার্ফিউ লেগেছে । সোয়েটার, মাফলার, মাঙ্কি টুপী, আলোয়ানে আবৃত পঞ্চাশউর্ধ ছোটোখাটো হারুদা, সাধারণতঃ রাত ১১ অবধি দোকান খুলে রাখেন, আজ সাত তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধে ব্যাস্ত। কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, “বিনোদন বাজারে লিখেছে আজ রেকর্ড ঠান্ডা পড়বে, স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা নীচে, ১০ও ছুঁতে পারে। দেখছ না রাস্তা ঘাট কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে ?”
হারুদা আমাদের পাড়ার বাসিন্দা না হলেও পুরোনো দোকানদার হিসেবে পাড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ক্রিকেট ও ফুটবল ম্যাচের পরে ওনার দোকানের সামনে রীতিমতো ক্রীড়া বিশারদদের আলোচনা সভা চলে দু তিন দিন। আলোচনায় অংশগ্রহক সকলেই পাড়ার গলি টুর্নামেন্ট জমিয়ে খেলেছেন একসময়। প্রতি বছর লক্ষী পুজো থেকে কালী পুজোর সময়টা সপরিবারে হারুদা বার্ষিক ভ্রমণে বেড়োন। হিমালয়ের অনেক আনাচে কানাচে ঘুরেছেন।
একটু খোঁচা দিয়ে বললাম -“আপনারাই তো হাজার হাজার টাকা খরচ করে পাহাড়ে যান শুধু বরফ দেখতে। আবার হিমালয়ের ঠান্ডার উপযোগী সোয়েটার, জ্যাকেট, কম্বল কিনে ফেরেন। সেটা আর একটা পাহাড় যাত্রার প্রস্তুতি না পরের বছরের শীতের অপেক্ষা?”
আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে হারুদা বললেন, “ওটার আলাদা আনন্দ আছে, তুমি বুঝবে না।”
আনন্দ বুজতে না পারলেও ১০ ডিগ্ৰী শব্দটা ততক্ষনে মস্তিস্কে শীতাতঙ্কে পরিণত, বাড়ীর উষ্ণ আশ্রয়ে শীঘ্র পৌঁছনো সেই মুহুর্ত্তে অগ্রগণ্য মনে হল ।
উল্টো পারে দেখলাম ৫-৬ জন বিহারী রিকশাওয়ালা কাগজ, পিজবোর্ড জ্বালিয়ে আগুনের চারপাশে জবুথবু হয়ে বসে তাপ সেঁকছে। শীতে বিহার-ঝাড়খন্ডের স্টেশনের বাইরে যেমনটা দেখl যায় ।
চীন সীমান্তের কাছে ধুনছে রোসুয়া জেলার এক জনপদ, উচ্চতা প্রায় ২০৩০ মিটার। পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাজার দুই মানুষের বাস, সরকারি অপিসও আছে। নেপালের থাকতে কাজে প্রায় ধুনছে যেতে হত। সীমান্ত জনপদ সাপ্রোব্যাসি থেকে তখন জোরকদমে সড়ক নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে । যারা নেপাল হিমালয়ের সঙ্গে পরিচিত, ট্রেকিং করেন, তারা জানেন ধুনছে থেকে গোঁসাইকুন্ড, লাংটাং অভয়রণ্য ও গনেশ হিমালয়ের পথ শুরু।
এক জানুয়ারীর সকালে কাঠমান্ড থেকে রওনা হয়ে কাঁচা পাহাড়ী বিপজ্জনক রাস্তায় বাসে লাফাতে লাফাতে বিকেলে ধুনছে পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ। আগেরদিন প্রচন্ড বরফপাতের সঙ্গে রাতে পড়েছে তাল তাল ওলা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দুটো জীপের ভাঙা উইন্ডস্ক্রীন তার সাক্ষী । জানুয়ারির শেষে এমনটা অনুমেয় নয়। এবড়োখেবড়ো পথে পাথরের ওপরে জমে আছে বরফের স্তুপ । পাহাড়ী জনপদ ধুনছেতে কয়েকটা মাত্র হোটেল। হোটেল না বলে ওগুলোকে সরাইখানাই বলা চলে। তারই মধ্যে মন্দের ভালো ‘লাংটাং ভিউতে’ সেদিন অনেক বিদেশী পর্যটক। নিত্য যাতায়াত, তাই একটা কামরা কোনোরকমে পাওয়া গেলো ।
সন্ধ্যায় সড়ক নির্মাণের প্রজেক্ট অপিসে কাজ সেরে হোটেলের পথে, পিচ্ছিল বরফের রাস্তায়, হাঁটা দিলাম। চারিদিক নিঃস্তব্ধ, অন্ধকার, জনশূন্য। পাহাড়ের ধাপে ধাপে বাড়িগুলোর টিম টিমে আলোয় রাস্তা আলোকিত না হলেও, জমা বরফের স্তুপ থেকে এক শুভ্র আভা খানিকটা পথ দেখতে সাহায্য করছে। উত্তরের হাড়হিম করা কনকনে হাওয়া জ্যাকেট ভেদ করে শরীরে বিঁধছে। চারহাতি পশমের মাফলারটাকে মাথা, কান, গলা ঢাকতে যতটা পারা যায় পেঁচিয়েছি তবুও কোন অজানা ছিদ্র দিয়ে হিমেল হাওয়া ঢুকে হুল ফোটাচ্ছে জানি না। সাত-আট মিনিটের হাঁটাপথ বরফে পিছলাবার ভয়ে, পা টিপে হাঁটাতে লেগে গেল প্রায় পনেরো মিনিট।
হোটেলের কোনো ঘরেই হিটার বা ফায়ারপ্লেসের নেই। ডাইনিং হলে একমাত্র ফায়ারপ্লেস, শীতের রাতে তাই সমস্ত হোটেলের বোর্ডাররা সন্ধ্যের পর থেকে যতক্ষণ পারেন ডাইনিং হলেই কাটান । শোয়া মানে তো সেই স্যাতস্যাতে ঘরে বরফের মতো ঠান্ডা গদী আর ভারী তুলোর লেপের মাঝে নিজেকে স্যান্ডউইচ করতে হবে ।
ডাইনিং হলে লোকে লোকারণ্য। একমাত্র খালি কোণের ছোট্ট টেবিলটার দখল নিয়ে উষ্ণ জলের সঙ্গে খানিকটা ব্র্যান্ডি দিতে বল্লাম। এখানে বলে রাখি নেপালে এমন জায়গা আছে সামান্য প্যারাসিটামল কিনতে ৫ মাইল পাহাড়ী চড়াই ভাঙতে হয় কিন্তু রুক্সি (মদ) ৫ মিনিট হেঁটে অনায়াশে পাওয়া যায় । আমার ব্র্যান্ডি নিয়ে আসা কাঞ্ছার থেকে জানলাম ৩/৪টি করে টেবিল জুড়ে যে দুটো মস্ত টেবিল বানানো হয়েছে আসলে তাতে দুটো ভিন্ন বিদেশী দল । একদল গোঁসাইকুন্ড থেকে সবে ফিরেছে অন্য দলটি পরেরদিন লাংটাং যাবে । দুটো দলই মূলত তরুণ-তরুণী সমৃদ্ধ। বিয়ার ও রামের ফোয়ারার সঙ্গে প্রচুর হৈচৈ। নির্জন পাহাড়ে হার কাঁপানো ঠান্ডায় আজ উষ্ণতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ হৈহট্টগোল মন্দ লাগছে না, ওদের কান্ড দেখে আমারও বেশ সময় কেটে যাচ্ছে।
মনে পরে গেলো গঙ্গা বক্ষে, লেকের এক সাঁতার ক্লাবের, লঞ্চ পিকনিকের কথা। দুপুর বেলা মাঝগঙ্গায় লঞ্চ, সকলে জমিয়ে ভুড়িভোজে ব্যস্ত হটাৎ প্রচন্ড হৈচৈ, কান্নার আওয়াজ । শুনে মনে হলো বুঝি মারামারি লেগেছে ডেকের ওপর প্রান্তে। কি ব্যাপার দেখতে ভীড় কাটিয়ে খানিকটা নিকটে গিয়ে বুঝলাম সুরার প্রভাবে মত্ত এক মেম্বারের ইচ্ছে হয়েছে এইমুহূর্তে গঙ্গাস্নান করবেন। তিনি জামাকাপড় খুলে শুধু মাত্র আন্ডারওয়্যার পরে ডেকের রেলিং টপকে জলে ঝাঁপ দিতে চাইছেন । তিনচারজন ক্লাবের মেম্বার তাকে ধরে বেঁধে কোনরকমে আটকাচ্ছে আর ওনার স্ত্রী ও কন্যা চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। এক্কেবারে পিকনিকের দুধে চোনা।
“আমি কি এই টেবিলে বসতে পারি?” মিষ্টি নারী কণ্ঠের ইংরিজিতে সম্বিৎ ফিরলো।
এমনিতেই আমরা মুখের ওপরে না বলতে পারি না তাই আবার সামনে দাঁড়ানো হাসিমুখে বিদেশিনী সুন্দরী। একটু অবাকও হলাম বিদেশিদের টেবিল ছেড়ে আমার টেবিলে কেন ? মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে, সামনের একমাত্র খালি চেয়ারটা টেনে বসলেন। একঝলক তাকিয়ে দেখলাম খোলা কোঁকড়ানো সোনালী চুল লুটিয়ে পড়েছে কালো পশমের সোয়েটারের পীঠ পর্যন্ত । বয়স আন্দাজ ২৮-৩০, আকর্ষনীয় গড়ন । কালো ফ্রেমের চশমায় যেমন আত্মবিশ্বাসী লাগছে, মুখমণ্ডলীতে এক শান্ত অনাবিল আনন্দের ঝলক । কয়েক মিনিট দুজন মুখোমুখি চুপ করে বসে, এক অজানা অস্বস্থি, ভাবছি কোথা থেকে শুরু করবো ? এও ভাবি যদি উনি বাক্কালাপে অনিচ্ছুক হন ।
“ডু ইউ স্পিক ইংলিশ?” উনিই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করাতে খানিকটা হাঁপ ছাড়লাম ।
“চেষ্টা করি, কতটা পারি জানি না।”
“আমি সারা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?” হাসিমুখে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
তুলোর মত নরম হাতটা ধরে বললাম, “আগামীকাল কাঠমান্ড ।”
“ওহ আপনার ভ্রমণ শেষ। পথ সম্পর্কে যদি একটু বলেন। একা হিমালয়ে, তাই নার্ভাস।”
“আমি তো ভেবেছিলাম আপনি ওই দু দলের একজন l”
দুটো টেবিলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে সারা মাথা নাড়লেন, “আই এম ট্রাভেলিং অ্যালোন।”
একা শুনে অবাক লাগলেও জিজ্ঞেস করলাম, “গোসাইকুন্ড?”
“হ্যাঁ, গোসাইকুন্ড, লৌরীবিনায়ক, চিসোপানি, সুন্দরীজল হয়ে কাঠমান্ড।”
“এতো অনেক হাঁটা?” বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না। ভেবেছিলাম একা যখন পাহাড়ে উঠবেন আর নাববেন।
“হ্যাঁ দশ দিনের মত।”
“এক্কেবারে একা হাঁটবেন?”
“সঙ্গে গাইড আছে এখানে জায়গা না হওয়াতে সে পাশের হোটেলে।”
“আমি আজই এসেছি, এখানের কাজ শেষ কাল কাঠমান্ড ফিরব,”
“আপনি নিশ্চই আগে গোসাইকুন্ড গেছেন? যদি একটু বলেন।”
“যখন কলকাতার উষ্ণ সমতলে থাকতাম প্রতিবছর পাহাড়ে যাবার এক অদম্য আকর্ষণ অনুভব করতাম। হিমালয়ে বেড়ালে মনে হত তার শীতল আবহাওয়া, নৈসর্গিক দৃশ্যে শরীর মন চাঙ্গা হয়। এখন পাহাড়েই বাস, অনেক দুর্গম স্থানে এমনিতেই ঘুরতে হয়, পাহাড়ের অকারণে হাঁটার আকর্ষণ এখন ম্রিয়মান। পাহাড় ভ্রমণ নিয়ে বই লেখা বা তার ছবি দেখিয়ে বাহবা পাবার কোনো তাগিতও নেই, সুতরাং অহেতুক চড়াই ভেঙে শরীরকে কষ্ট দেবার দরকার কি? প্রতি দুমাসে এখানে আসি, কিন্তু দুদিন হেঁটে একটা তাল দেখার অপরিহার্যতা একবারও অনুভব করি না ।”
“একই তাল দেখতে আমি এসেছি সাত হাজার মাইল পেরিয়ে।” সারার উত্তরে দুজনেই হেঁসে উঠি।
স্থান ও কালের সাথে আবেগ ও দৃষ্টিকোনের আমল পরিবর্তন হয় । অনস্বীকার্য প্রকৃতির এই নিয়ম ।
কিছুক্ষন কেটে গেলো ভারতে ও নেপাল ভ্রমণের টুকরো টুকরো ঘটনার বর্ণনায়। কলেজস্ট্রিটের বইপাড়া, কফি হাউস, কলকাতার মিষ্টি, হাওড়ার ফুলের বাজার, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী সারা । সাধ্যমত এগুলোর বর্ণনাও করলাম।
“আমেরিকা, কানাডায় তো অনেক সুন্দর লেক আছে, ট্রেকিং পথেরও অভাব নেই তাহলে এত দূরে কেন?”
আমার প্রশ্নে কিছুটা হতচকিত হয়ে মাথা নত করে চুপ করে গেলেন সারা । ভাবছিলাম এই প্রশ্নটা না করলেই ভালো হত, অজান্তে কোথায় আঘাত দিয়ে ফেললাম? নিস্তব্ধে কেটে গেল কয়েক মূহুর্ত্ত । কথায় বলে নীরবতা নাকি মধুর, ওই সময় আমার মনে হচ্ছিলো নীরবতা অসহ্য। অবশেষে সারা মুখ তুললেন, চোখ ছলোছলো, “শুনবেন কেন এসেছি এতো দূরে?”
চলবে ……..