রাত্রি মধ্যযাম। কনৌজ রাজ্যের প্রান্ত থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি সুসজ্জিত শিবির । বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় বুঝি কোনরাজশিবির। কিন্তু এমনই একটি শূন্য প্রান্তরে এহেন একটি শিবির কি প্রয়োজনে ! সহসা সেই শিবির হতে বেরিয়ে এলেন একদীর্ঘকায় রাজপুরুষ। পোশাক, অভিজ্ঞান এবং ঊষ্ণীষে তমসাঘন রাত্রের আধো অন্ধকারে তাঁকে থানেশ্বর অধিপতি রাজ্যবর্ধনবলেই বোধ হল। ধীরে ধীরে এসে তিনি শিবিরের পাশে রাখা শ্বেত অশ্বটির পৃষ্ঠে হাত রাখলেন। প্রথমে অশ্বটি কিছুটা চন্চলহলেও মহারাজের সোহাগ পরশে সে কিন্তু অচিরেই শান্ত হয়ে গেল।এবার মহারাজ তাঁর শিবিরের রক্ষীদ্বয়কে মৃদু কণ্ঠস্বরে কিছুবললেন। রক্ষী দুজন তাঁকে প্রণাম করে অশ্বে আরোহণ করে দূরে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল । মহারাজও কিছুক্ষণ সেই দিকেতাকিয়ে রইলেন। অবশেষে তিনিও সেই শ্বেতবর্ণের অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে ঐ সৈনিক দুজন যেদিকে গেল তার বিপরীতে অশ্বটিকেচালনা করলেন। তাঁর মুখমণ্ডলে যেন একটি বিষণ্ণতার রেখা। কিন্তু তিনি কি সত্যই মহারাজ রাজ্যবর্ধন ছিলেন ! রক্ষীরানি:সন্দেহ হলেও মশালের স্তিমিত আলোকরেখার মধ্যেও কাহিনীকারের সাবধানী দৃষ্টিকে তিনি ফাঁকি দিতে পারেন নি।তবে কি ঐঅশ্বপৃষ্ঠে আরোহনকারী রাজপুরুষটি অন্য কেহ ! তাঁর মুখমণ্ডলে কেন ওই বিষণ্ণতার স্পর্শ ! আর তিনি যদি রাজ্যবর্ধনই হবেনতবে কেন তিনি এই তমসাঘন রাত্রে তাঁর রক্ষী দুজনের গন্তব্যের বিপরীত পথে অগ্রসর হলেন ! তবে তিনি কে ! এই প্রশ্নের উত্তরজানতে হলে আমাদেরকে অতীতের ভেলায় কয়েক পল ভেসে বেড়াতে হবে,খুঁজতে হবে ইতিহাসের ফেলে আসা কয়েকটি পৃষ্ঠাকে।
মহারাজ শশাংক। গৌড় বাংলার প্রথম সার্বভৌম অধীশ্বর।কিন্তু ইতিহাস তাঁর ক্ষেত্রে অনেকাংশেই নীরব। তবে ইতিহাস যেখানেনীরব সেখানে কল্পনার গতিকে আশ্রয় করে তাঁকে চিত্রিত করা যেতেই পারে। খানিকটা ইতিহাস আর খানিকটা কল্পনারমেলবন্ধনে হে সুধী পাঠকবৃন্দ, আসুন তাঁকে আমরা নবরূপে চিত্রিত করি , আবিষ্কার করি, উপস্থাপন করি।
খ্রীষ্টের জন্মের পর প্রায় ছয়শত বৎসর অতিক্রান্ত।আমাদের এই কাহিনীর যবে সূত্রপাত তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত ভিন্ন ভিন্নশাসকবর্গের অধীনস্থ ছিল। গৌড় অধীপতি শশাঙ্কের রাজত্বকাল ছিল আনুমানিক ছয়শত থেকে ছয়শত পঁচিশ খ্রীষ্টাব্দ।মতান্তরে ছয়শত ছয় থেকে ছয়শত সাঁইত্রিশ খৃষ্টাব্দ অবধি ।গৌড় অর্থে বর্তমান মধ্য ও উত্তরবঙ্গ। কিন্তু গৌড় অধীশ্বর রূপে স্বীকৃতহলেও মহারাজ শশাঙ্ক স্বীয় ক্ষমতা,শোর্য্য,বীর্য্য তথা সাহসিকতার বলে ক্রমশ প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশকেই তাঁর শাসনাধীন করেন।কেবল তাই নয়, বর্তমান পাটনা,গয়া এবং আশেপাশের বিহার,ঝাড়খণ্ড ও বাংলার কিছু অন্চল নিয়ে গঠিত সেকালের মগধেরবেশ কিছু অংশও শশাঙ্ক আপন ক্ষমতাবলে স্বীয় অধিকারে নিয়ে আসেন।সেইসাথে বর্তমান ভুবনেশ্বর থেকে গন্জাম অবধিতৎকালীন কলিঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাও তাঁর শাসনভুক্ত ছিল।এমনকি কিছুদিনের জন্য উত্তর ভারতের সুদূর বারাণসীতেও নিজেরবিজয় পতাকা উড্ডীনে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রভূত ক্ষমতার কাছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেশীয় নৃপতিরা বারেবারেনতিস্বীকারে বাধ্য হয়েছিলেন। দক্ষিণে চালুক্য রাজবংশ, উত্তরে থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশ এবং কান্যকুব্জ বা কনৌজের মৌখরীবংশের শাসকবৃন্দ তথা কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ মহারাজ শশাংককে দমনের জন্য যথেষ্ট প্রয়াসী হওয়া সত্বেও তাঁরজীবৎকালে সেই ক্ষমতাকে কোনভাবেই খর্ব করতে পারেন নি।
উপরন্তু মালবের অধিপতি দেবগুপ্তের সাথে শশাংকের মিত্রতা এটাই প্রমাণ করে যে মহারাজ শশাংক রাজনীতিক হিসাবেও যথেষ্টবুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলেন।শশাংকের রাজধানী ছিল তদকালীন কর্ণসুবর্ণ বা কানাসোনায়। এই শহরটি অধুনা মুর্শিদাবাদজেলার অন্তর্গত একটি ছোট জনপদ । নিকটস্থ রাঙামাটিতে ছিল তাঁর রাজপ্রাসাদ।জন্মাবধি শিব উপাসক সম্রাট শশাঙ্ক ছিলেনএকজন সত্যকারের শক্তিমান পুরুষ। একজন মহাসামন্ত থেকে একজন সার্বভৌম অধীশ্বর হবার সর্বপ্রকার চারিত্রিক দৃঢ়তা এবংগুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
এবার আমাদের মূল কাহিনীতে ফেরা যাক। ঘটনার ঘনঘটা আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে। শিবরাত্রির মহা উৎসবের আরমাত্র দুপক্ষকাল দেরী। কর্ণসুবর্ণ আসন্ন উৎসবের প্রস্তুতিতে আনন্দঘন। মহারাজ শশাংক মাত্র কিছুদিন হল বারাণসী জয় করেরাজ্যশাসনের দায়িত্ব তাঁর পুত্র মানবদেবের হস্তে অর্পণ করে রাজধানীতে ফিরে এসেছেন। সেদিন প্রভাতে তিনি তখন রাজসভায়আসীন এমনই সময় তাঁর এক প্রতিহারী রাজসভায় এসে উপস্থিত।
সে যেন অত্যন্ত ব্যগ্র।
“মহারাজ, আপনার পরম মিত্র মালবরাজ দেবগুপ্তের এক বিশেষ দূত এইক্ষণে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। সে বলছে যে বিষয়টিনাকি অত্যন্ত জরুরী।”
শশাঙ্ক প্রতিহারীর বাক্যে বিশেষ উদ্বেগ বোধ করলেন। মিত্র দেবগুপ্ত কি কোন বিপদের মুখোমুখি ! তিনি অবিলম্বে মালবরাজেরসেই বিশেষ দূতকে রাজসভায় আনীত করার আদেশ দিলেন। “যাও, এই মুহূর্তে সেই বিশেষ দূতকে এখানে নিয়ে এস।”
দূতটি রাজসভায় এসে মহারাজ শশাঙ্কের হাতে মালবরাজের অভিজ্ঞান সম্বলিত একটি পত্র দিল। পত্রটি পাঠ করে মহারাজশশাংক ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর প্রধানামাত্যের হাতে তিনি পত্রটি অর্পণ করলেন। কি লেখা ছিল সেই পত্রে যা এইআনন্দের আবহেও মহারাজ শশাঙ্কের মানসিক স্থিতিকে নষ্ট করে দিল !
তবে চলুন। সেই পত্রের কিছুটা অংশ আমরা পাঠ করি।
পরম মিত্র রাজাধিরাজ শশাঙ্ক,
মৌখরীরাজ কনৌজাধিপতি গ্রহবর্মার সৈনিকের দল মালবের প্রত্যন্ত অন্চলে বেশ কিছুদিন ধরে প্রত্যহ যথেচ্ছ লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ তথা নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে আমি মৌখরীরাজ্য আক্রমণ করার মনস্থকরেছি। আপনার রাজ্যের যে দশ সহস্র সেনা আমার রাজ্যে মোতায়েন আছে তাদেরকে আক্রমণে সামিল করার জন্য আমিআপনার অনুমতি চাইছি। সেই সাথে মালবরাজ্যে আপনার প্রত্যক্ষ উপস্থিতিও একান্তভাবে কামনা করি।
ইতি,
আপনার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেবগুপ্ত।
চিঠিটি পড়ে অসহনীয় রোষে ক্ষুব্ধ শশাঙ্কের একটিই প্রতিক্রিয়া ছিল। ‘হায়, শিবশম্ভু , এই অত্যাচারী,অনাচারী কনৌজিরা কিআমাকে একদিনও শান্তি দেবে না ! এদের চরম দণ্ড বান্ছনীয়। ‘
প্রকৃতপক্ষে মালব রাজ্যের উপর কনৌজের লোভ বহুদিনের।কিন্তু দেবগুপ্ত এবং শশাঙ্কের যৌথশক্তির কাছে তারা বারবারপরাভূত হচ্ছিল। বারাণসী বিজয় এবং তদপরবর্তী শিবরাত্রির উৎসবে মহারাজ শশাঙ্কের আনন্দোৎসবে ব্যস্ত থাকার সুযোগেদেবগুপ্তকে পরাস্ত করে মালব অধিকার করা যাবে–এমনই একটি ধারণা কনৌজাধিপতি গ্রহবর্মার মধ্য সন্চারিত হয়েছিল। তাইতিনি মালবরাজ্যে অনৈতিক ভাবে যথেচ্ছ লুণ্ঠন, অত্যাচার ইত্যাদি চালাচ্ছিলেন যাতে দেবগুপ্ত তাঁকে আক্রমণ করেন। আরতাহলেই গ্রহবর্মার কার্যসিদ্ধি। কিন্তু তিনি বোধ করি জানতেন না যে মালবরাজ্যে মহারাজ শশাঙ্কের অধীনস্থ দশ সহস্র সৈনিকপ্রহরারত ছিল।
ফলে দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণে তাঁর সৈন্যবাহিনীর সাথে শশাংকের ঐ দশ সহস্র সৈন্যবাহিনীর যোগদানের জন্য শশাঙ্কেরআগাম অনুমতি চেয়ে জরুরী পত্রটি দূতের মারফত কর্ণসুর্বণে পাঠিয়েছিলেন। আর বলা বাহুল্যই গৌড়াধিপতির দেবগুপ্তকে সেইঅনুমতি দিতে এক মুহূর্তেরও বেশী বিলম্ব হয়নি। কেবল তাই নয় তিনি নিজেও তাঁর রাজ্যকে সুরক্ষিত রেখে এক বিশালসৈন্যবাহিনীর সাথে দেবগুপ্তের সহায়তার উদ্দেশে কনৌজ অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পিছনদিক থেকে গ্রহবর্মণবা গ্রহবর্মাকে আক্রমণ করা যাতে দ্বিমুখী আক্রমণে তাঁকে বিধ্বস্ত করা যায়।
ইতিমধ্যেই দেবগুপ্ত এবং গ্রহবর্মার ভিতর প্রবল সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে তখন দেবগুপ্তের জয় অবশ্যম্ভাবী। তাঁরউদ্দেশ্য ছিল গ্রহবর্মাকে কারারুদ্ধ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: যুদ্ধক্ষেত্রেই কনৌজাধিপতির মৃত্যু ঘটল। কনৌজ দখল করলেনদেবগুপ্ত।কিন্তু তাঁর প্রতিহিংসার আগুনে আপামর কনৌজবাসীকেও দগ্ধ হতে হল।এমনকি গ্রহবর্মার পত্নী থানেশ্বররাজকন্যাঅসহায়া রাজ্যশ্রীকেও দেবগুপ্ত রেহাই দিলেন না। তিনি রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করলেন। কিন্তু এসব খবর মহারাজ শশাঙ্কের কানেএসে পৌঁছলনা। কারণ তিনি তখন কনৌজের পথে রওয়ানা দিয়েছেন। আর সেই পথ ছিল যথেষ্ট দুর্গম এবং বিপদসঙ্কুল। তবেপাঠকবৃন্দের অবগতির জন্য জানাই যে মহারাজ শশাংক কখনোই বন্ধু দেবগুপ্তের কোনরূপ হীনকর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না।