আজ এই মহালয়ার  শুভক্ষণে মাতৃবন্দনার  শুরুর মধ্য দিয়েই বাঙালির উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়ল।বিশ্বে বেজে উঠল আলোর বেণু। আজ প্রভাতে সেই সুর শুনে বাঙালি-মেতে উঠেছে দুর্গাপুজোর আনন্দে। মেতে উঠেছে ভুবন।মহালয়া মানেই মা আসছেন ঘরে এরকম একটা অনুভূতি । তাই  প্রস্তুতি আজ  তুঙ্গে উঠেছে। শিউলির গন্ধ মাখা ভোরের শিশির সে কথা আগেই জানান দিয়েছিল সেই আগমনী বার্তার। কাশবনে দোলা লাগিয়ে এবার মর্ত্যে আবির্ভূতা হবেন চিন্ময়ী দেবী।স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে ভক্তদের দর্শন দিতে আসেন দশভূজা দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা। মহালয়ার  পূর্বাহ্নে দেবীর ঘট প্রতিস্থাপন ও পূজোর মধ্যদিয়ে শুরু হবে দেবী আগমনের মুহূর্ত গণনা। শারদীয় দুর্গাপূজো  শুরুর প্রাক্কালে  চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হবে দেবী দুর্গাকে।  শুরু হয় দেবীপক্ষের। মহালয়া উদযাপনের মাধ্যমে দেবীর আরাধনা সূচিত হয়।  সারাবছর যে বাঙালি বেলা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমোয়, তারও  চৈতন্যদ্বয়  ঘটে মহালয়ার দিন। হবে নাই বা  কেন? এ যে বাঙালির বিশেষ শ্রেষ্ঠ উৎসব – শারদোৎসবের সূচনায় পিতৃপক্ষের শেষ ও দেবীপক্ষের সূচনার সন্ধিক্ষণকে বলা হয় মহালয়া।  মহালয়ার সাত দিন পর ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।  ‘-দেবী প্রসীদ পরিপালয়ে নো হরি ভীতে: নিত্যং যথাসুরবধদিধনৈব সদ্য: পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উৎপাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গানা’   মহালয়া এলেই বাংলার প্রকৃতি, মাঠ ঘাট -নদী-আকাশ মাতৃপূজার শুভ লগ্নকে বরণ করতে যেন প্রস্তুত হয়। মহালয়ার দিন দেবী বন্দনার সুর আপামর বাংলার মানুষের হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। দূর থেকে কানে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। বুকে জাগে তীব্র  আনন্দ । কারণ মা আসছেন যে। 

ছোটবেলায় মহালয়া দিয়ে আমাদের দুর্গাপুজোর আনন্দপর্ব শুরু হত ,সমাপ্তি হতো দেবী বিসর্জনে । আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম শিশির ভেজা ঘাসে প্রভাত-আলোর বিচ্ছুরণ, শিউলিতলায় ঝরে পড়া শিউলিরা, নীল আকাশের শুভ্র মেঘের দল যেন মায়ের আসার আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে।মহালয়ার আগের রাতে মনে থাকত দারুন উত্তেজনা। ভোর রাতে রেডিওতে প্রচারিত হবে মহালয়া, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরি, ধরণীর বহিরাকাশি অন্তর্হিত মেঘমালা।” মনে তুমুল আনন্দ  নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। রাত তিনটে বাজতেই ঘুম ভেঙ্গে যেত, মা-বাবার সাথে সাথে ভাইবোনেরা অপেক্ষা করতাম কখন ভেসে আসবে সেই সুর  ‘আকাশবাণী কলকাতা’ থেকে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ  কন্ঠে দেবী বন্দনা। দেড় থেকে দুই ঘন্টাব্যাপী প্রচারিত মহালয়ার সুরেলা মোহনায়  আটকে যেত মন। আশেপাশের প্রতিটি বাড়ী থেকে ভেসে আসতো মহালয়ার অপূর্ব সব সঙ্গীত, সাথে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কম্পিত কন্ঠে

“ ইয়া দেবী সর্বভুতেষু, মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে’ আজ ও কানে বাজছে। মহালয়ার পুণ্য লগ্নে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চণ্ডীপাঠ হল এক অনবদ্য সৃষ্টি। আজও মনে পড়ে ঘুম ঘুম চোখে মা বলতেন, “ওঠ। মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।”খানিকক্ষণ বিছানায় গায়ে চাদর মুড়ি নিয়ে শুনতাম এক হৃদয়স্পর্শী  গলার অসাধারণ বর্ণনায় দেবীর আহ্বান । রেডিও থেকে ভেসে আসতে থাকে তাঁর স্বর্গীয় কণ্ঠধ্বনি। সমগ্র বাঙালি সমাজকে সূর্যোদয়ের মধ্যে দিয়ে জাগিয়ে তুলে তিনি পাঠ আরম্ভ করেন।মাঝে মাঝে গান হত। সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ বড় বড় সব শিল্পীর গান ।ছোটবেলায় সব মিলিয়ে কিছুই বুঝতাম না তেমন  , সেরকম বোঝার মতো মানসিতা তৈরী হয়নি তখনও কিন্তু মহালয়ার  আনন্দে মেতে ওঠার উৎসাহ ছিল ঢের । কেমন যেন একটা জাদু থাকতো ঐ চণ্ডীপাঠ আর গানের মধ্যে। গীতিকাব্য শুনতে শুনতে সকালে সূর্যোদয় দেখতাম, আর ক’দিন পরেই দুর্গা পূজা। পূজার আগাম বার্তা।। আর নতুন জামার গন্ধ।  বাঙালির মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম। তার দরাজ কণ্ঠে চিন্ময়ীকে আহবান না শুনলে আমাদের মহালয়া শুরু হয় না এখনো। এমনকি শুধু বাংলায় নয় সুদূর আমেরিকা কানাডা ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন দেশে সারা বিশ্বে যত বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রত্যেকেই মহালয়া বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে গান শুনে মহালয়া শুরু করে। । অনেক আগে ডিডি বাংলা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোন চ্যানেল ছিলনা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকম টিভি চ্যানেলে মহালয়া দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই সময় মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গতিনাশিনী বিভিন্ন অনুষ্ঠান পর্বের আয়োজন থাকতো টেলিভিশনে।  তবে ডিডি বাংলার সেই মহালয়া আজও ভোলার নয়। এক সময় ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটি শুরু হলেই আমার ছোট্টমনে অনাবিল শান্তির ছোঁয়া লাগত। ঐ মুহূর্ত থেকেই আনন্দ যেন ছুঁয়ে যেত আমার চারধারের পৃথিবী। এভাবেই বড় হয়েছি, সংসারী হয়েছি, জীবনের প্রতিটি দিনে নানা রকম পরিবর্তন এসেছে। ছোটবেলার অনুভূতির সাথে বড়বেলার অনুভূতিতেও পরিবর্তন এসেছে। রাস্তায় রাস্তায় না হেঁটে বিছানায় বসেই মহালয়ার দেবী বন্দনা শুনেছি। জীবনের পরবর্তি ধাপগুলো পেরিয়ে আরও পরিনতির দিকে এগিয়েছি,, জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি দিয়েছি। 

           আমেরিকায় মহালয়ার  দিনে  আমেরিকার  প্রধান মন্দিরগুলোতে দুর্গাপূজার আমেজ শুরু হতে দেখা যায়। দেশে মন্দিরে মন্দিরে এমন মহাউৎসাহে মহালয়া হতে দেখা যায় না। মহালয়াতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হয়।  সংগীত  আর আবৃত্তির নান্দনিক উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয় উপস্থিত শ্রোতা-দর্শক। প্রবাসে থাকা এসব বাঙালী মানুষ দেশ এবং তাঁদের প্রিয়জন থেকে অনেক দূরে থাকেন। তাই তাঁরা প্রার্থনা করেন দেশের মানুষের সুখ ও শান্তির জন্য। বিদেশে পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকার কষ্ট কিছুটা দূর করতে এখানকার বাঙালিরা একে অন্যজনকে আপন করে নেন।  মা দূর্গা দূর্গতিনাশিনী সন্তানদের নিয়ে রওনা দিয়েছেন কৈলাস থেকে মর্ত্যলোক, তাঁর বাপের বাড়িতে। আর মোটে সাত দিন পরেই দুর্গা পুজো!!! কত অপেক্ষা, কত আশা আর প্রস্তুতির পর, কত দিন ধরে দিন গোনার শেষে অবশেষে পুজো আসছে!!! এতদিনে দুর্গা মণ্ডপে মা দুর্গার প্রতিমায় রঙ দেওয়া হয়ে গেছে বলো?? লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, আর অসুর সবাই সেজে গুজে তৈরী , সিংহ রাজ, হাঁস, ময়ূর, প্যাঁচা, আর ইঁদুর সব্বাই তৈরী। কি মজা!!! নতুন জামা গুলো আরেকটি বার পরে দেখি কেমন মানিয়েছে আমাকে!!………অবশেষে পুজো আসতো, আলোয় আলোয় সেজে উঠতো চতুর্দিক।এরকমটাই ছিল দেশে থাকাকালীন ছোটবেলার মহালয়া।

মহালয়া মানেই  দেবীর আগমন।মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত আমাদের সাহাবাড়ির দুর্গাপূজোর প্রস্তুতি পর্ব। আমাদের এই সাহা বাড়ির দুর্গাপুজো হল পারিবারিক পুজো। নিজেদের বাড়িতেই আমাদের এই পুজোর আয়োজন হয় । এখনো সেই পুজোর আরম্ভর চলে আসছে সেই পুরনো রীতি অনুযায়ী। রাত পোহালেই মহালয়া। পরেরদিন  ভোর থেকে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হবে মহালয়া। মূলত মহালয়ার দিন থেকেই সূচনা হয় শারদ উৎসব। মহালয়ার ভোর হতেই সাজোসাজো রব ওঠে বাড়ির অন্দরে। মহালয়ার দিন বাড়ির সকলে মিলে গঙ্গা স্নানে যাওয়া হতো। কাটোয়ার গঙ্গার দেবরাজ ঘাটে সাধারণত আমরা যেতাম। ছোটবেলা কেটেছে এই শহরেই।  সেদিন আমাদের শহর এবং পাশাপাশি গ্রাম গঞ্জ থেকে বহু মানুষ আসতো গঙ্গাস্নানে। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে দেখতাম অনেকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে গঙ্গাজল হাতে নিয়ে তর্পণ করছে। কেউ আবার গঙ্গার জল সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদন পূর্বক প্রণাম করে উচ্চারণ করছে  “ওম জবাকুসুম সঙ্কাশং” । অনেকে পিতলের কলসি তে গঙ্গাজল ভরে নিয়ে বাড়ি যায় সেই দিন। মহালয়ার দিন গঙ্গা স্নান এর মাধ্যমে সবাই নিজেকে শুদ্ধ করে ঘরে ফিরে আসে। আমাদের সাহা পরিবারের সকলে গঙ্গা স্নান সেরে বাড়ি ফিরে শুরু করে দেয় মা দুর্গার আহ্বানের প্রস্তুতিপর্ব।তারপর ঘুগনি লুচি দিয়ে জলখাবার এবং মধ্যাহ্নভোজন পর্ব শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির বাচ্চারা (মানে আমরা) সবাই বিভিন্ন রকম বাজি পোড়াতে ব্যস্ত থাকতাম। বিভিন্ন রকম শব্দ বাজি রং মশাল তুব্রি আরও বিভিন্ন রকম রকমারি আলোয় ঝলমল হয়ে ভোরে উঠতো চারিদিক। শুধু যে আমরা বাজি পড়াতাম তা নয় পাড়ার সকলেই মেতে উঠতো এই মহালয়ার বাজি পোড়ানো উৎসবে। এরমধ্যে পুজোর পত্রিকা বিভিন্ন রকম গল্পের বই কবিতার বই আর ভালো ভালো সিনেমা এগুলো তো আছেই। তাছাড়া মেয়েদের মধ্যে কার কি জামাকাপড় কার কি শাড়ি গয়না এগুলোর আলোচনা সে কি আর বলবো। কত কিনা কানে আসতো, এক এক জনার দিনে দুটো করে নতুন জামা পরার অবসর থাকতো। কারো কারো শুনেছি মহালয়ার দিন থেকেই নাকি নতুন জামা পড়া শুরু হয়ে যেত। আবার অনেক বাচ্ছারা  মহালয়া দিন থেকে নতুন জামাকাপড় পরা শুরু করে দিত। দেখা যেত পুজোর সময় আর তাদের নতুন জামা কাপড় পড়ার কিছু নেই, সব তাদের পড়া হয়ে গেছে এরকম বিভিন্ন মজার ব্যাপার ঘটতো সেই সময়। শেষ মুহূর্তে তুঙ্গে উঠতো  উৎসবের কেনাকাটা। চূড়ান্ত ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে   পরিবারের সকলের মধ্যে । 

বোধনের ঢাকে কাঠি পড়তে বাকি মাত্র ৭ দিন। ইতিমধ্যে কুমোরটুলিতে মা দুর্গার প্রতিমা তৈরি প্রায় শেষ হতে চলেছে। প্রতিমার চক্ষুদান হয় আজই।  মায়ের চক্ষুদান পর্ব শেষে বস্ত্র এবং অলংকারের সুসজ্জিত করে তৈরি হয়ে যাবে মা।মায়ের আগমনের সাথে প্রকৃতি যেন মিলে মিশে যায়। আবার কেউ কেউ বা মেতে ওঠে পিকনিকে। এখন পরিবারের বেশির ভাগ মানুষই থাকে বিভিন্ন জায়গায়। সবাই যে সব সময় পুজোর সময় আসতে পারে তা নয়। তবে সেই সব দিনের চিত্র আজও স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে আছে। এ গেল তখনকার দিনের মহালয়া। এইবার এখনকার দিনের মহালয়ার কথায় আসি। বিশেষ করে এই বছর ২০২০ সালে বিশ্বের এক ভয়াবহ পরিস্থিতি, করোনা ভাইরাস নামক সংক্রামক এর কারণে বেশিরভাগ মানুষই এখন অন্তর্মুখী। গৃহে বসেই এখন বহির্বিশ্বকে অনুভব করতে হয়। শরতের খোলা আকাশের মেঘ, কাশ ফুলের শোভা, শিউলি ফুলের সুবাস এসব যেন হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এবছরের মহালয়া সম্পূর্ণ অন্যরকম।  বাড়িতে বসে নিশ্চয়ই মহালায়া উপভোগ করবে সবাই কিন্তু বাইরে বেরিয়ে বন্ধুদের  রিইউনিয়ন আত্মীয়দের গেট টুগেদার সে সবই আজকে বাতিলের খাতায়। এবছর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে কোন কিছুই করা সম্ভব নয় ।

  যখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম আমাদের শান্তিনিকেতনে মহালয়ার  দিন ‘আনন্দবাজার’ নামে একটি অনুষ্ঠান  হতো । সব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন রকম খাবারের স্টল করত একটি খোলা মাঠে। বিভাগের শিক্ষক শিক্ষিকা রা সেই কাজে হাত লাগাতে কিন্তু মূলত অনুষ্ঠানটা ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচালনায়। আমার মুখ খুব মনে পরে বিভাগে থাকাকালীন আমরা একটি খুব সুন্দর খাবারের স্টল দিয়েছিলাম। সেই স্টলগুলোয় আমরা করেছিলাম শাহী টুকরা, ঘুগনি, আলুর চপ, ভেজিটেবল কাটলেট, ব্রেড পাকোড়া ইত্যাদি। অন্যান্য অনেক বিভাগের আরো অনেক খাবারের পদ ছিল। বিশ্বভারতীতে থাকাকালীন সত্যই মহালয়ার  দিনগুলো ছিল আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অন্যরকম। চারিদিকে ব্রহ্মবাদের ছোঁয়া, রবীন্দ্র অনুরাগীগন মূর্তি পুজায় বিশ্বাসী না হওয়ায় দুর্গাপূজার সেরকম আরম্ভর ছিল না আশ্রম প্রাঙ্গণে। আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালির কাছে মহালয়ার দিন থেকে প্রায় দুর্গাপুজো শুরু হয়ে যায়। কিন্তু শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রাঙ্গণে মহালয়ার দিন অন্যভাবে উদযাপন করা হতো।  সেখানে কোন দেবী আরাধনার ঘনঘটা নয়, সমস্ত মানুষের একাত্মতা, মানুষের আত্মার আরাম এটাই ছিল উৎসবের মূল বিষয়। এই নিয়ম নীতি অনুসরণেই মহালয়ার দিন এখানে ‘আনন্দবাজার’ বা ‘আনন্দমেলা’ উৎসব পালন করা হয়। সেদিনের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল বিভাগীয় পত্রিকা প্রকাশ। সেই পত্রিকায় ছাত্র ছাত্রী এবং অধ্যাপক অধ্যাপিকা দের বিভিন্ন লেখালেখি ছাপা হতো। মহালয়ার দিনটিতে সকালে উঠেই কাচঘর গৃহে ব্রহ্ম আরাধনা এবং বিভিন্ন সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ এর মাধ্যমে দিনটি শুরু হতো। তারপরই কোন একটি অধ্যাপকের বাড়িতে তোড়জোড়  শুরু হত আনন্দমেলার বিভিন্ন  রান্নার ব্যবস্থার জন্য। সেখানেই সারা হত সেদিনের জলখাবার। সারাদিন সবাই হাতে হাতে কাজ করে  তৈরী করতাম আনন্দমেলার আয়োজন সাথে থাকত সেই গান “জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী।

অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো।

জাগো, তুমি জাগো।”  তারপর সারাদিন হইহই করে কাটার পর সন্ধ্যাবেলার মধ্যেই সকলে শান্তিনিকেতনী সাজে সেজে উঠতো। আমাদের হোস্টেলের সামনে যে মাঠ সেই মাঠেই হত আনন্দ মেলা উৎসব। সেজন্য আমাদের বেশি দূরে কোথাও যেতে হতো না। সারা সন্ধ্যেটা আনন্দ মেলার বিভিন্ন খাবারের স্টলে ঘুরে ঘুরে অবশেষে আমাদের নিজস্ব বিভাগীয় স্টলে এসে আড্ডা বসতো বন্ধু এবং অধ্যাপক অধ্যাপিকা দের সঙ্গে। খাবারের স্টলে যেরকম বিক্রি বাবদ হত সেসব লাভ মূল্য সবটাই বিভাগের অন্য কোনো অনুষ্ঠান বা পরের বার আনন্দমেলার ফান্ডে রাখা হতো। সারা সন্ধ্যাটা খাবারের স্টলে বিভিন্ন সাহিত্য বিষয়ক পর্যালোচনা এবং রবীন্দ্র সংগীত গানের আড্ডার  মধ্যে কেটে যেত সুন্দর সময় গুলো।  কখন যে সময় বেরিয়েছে তো টেরই  পেতাম না অবশেষে রাত্রিবেলা হলে আমরা সমস্ত খাবারের স্টলের কাজ শেষ করে আমরা নিজে নিজে হোস্টেলে ফেরত আসতাম। নিজেদের মুঠোফোনে বাজিয়ে দিতাম  মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বন্দনা ‘তব অচিন্ত রুপ চরিত মহিমা, নব শোভা নব ধ্যান রুপায়িত প্রতিমা…বিকশিল জ্যোতি প্রীতি মঙ্গলা বরণে’। বন্ধুরা মিলে সবাই নাচতে ভালোবাসতাম তাই আনন্দমেলা থেকে ফিরেই শুরু করে দিতাম ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু,মাতলো যে ভুবন’ গানের সাথে রবীন্দ্রনৃত্য। সেই দিন রাতে আমাদের সকলেরই মন ভীষণ খারাপ থাকতো কারণ ঠিক পরের দিন থেকেই আমাদের ইউনিভার্সিটির ছুটি পড়ে যায় দুর্গাপূজার জন্য প্রায় এক মাসের ছুটি। আমাদের ইউনিভার্সিটি তে এটা একটি সম্পূর্ণ অন্যরকম বিষয় যা অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা। আমরা যেহেতু হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতাম সেহেতু আমরা সকলেই  বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকতাম বছরের বেশিরভাগ সময়টা। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশকিছু জন ছিল যারা দার্জিলিং জলপাইগুড়ি ত্রিপুরা কাশ্মীর লাদাখ এমনকি অন্য অনেক দেশের থেকেও বহিরাগত ছিল। সেজন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকত এই মহালয়ার দিনটার জন্য কারণ আমরা জানি মহালয়া দিন অনেক আনন্দ করার পর পরের দিন থেকেই ছুটি পড়ে যায় এক মাসের জন্য।আপনাদের হোস্টেলের সব বন্ধুদের অনেক মন খারাপ হতো তার পরে অন্যদিকে আনন্দ হতো যে আমরা এক মাসের ছুটি পাচ্ছি কিন্তু আবার অন্যদিকে মনটা খারাপ লাগত বন্ধুদের থেকে আমরা কিছুদিনের জন্য হলেও বিচ্ছিন্ন থাকবো কারণ হোস্টেলের জীবনটাও ছিল অনেক আনন্দপূর্ণ। যাইহোক এইভাবে শান্তিনিকেতনের মহালায়া কেটেছে আমাদের। 

আশ্বিন মাসে কৃষ্ণ পক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত করি সেই দিনটি পিতৃ পূজা ও মাতৃ পূজার সন্ধিক্ষণ।অসুর শক্তির বিনাশে অনুভূত হওয়া এক মহাশক্তির নাম দেবী দুর্গা। দেবীর আরাধনা সূচিত হয় মহালয়ার মাধ্যমে। মহালয়ার ষষ্ঠদিন ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হয়  ৫ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের। মহালয়াকে কেন্দ্র উৎসবমুখর পরিবেশে চণ্ডীপাঠ, উলুধ্বনি, ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনসহ নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে মহালয়ার আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। গতবার এমন সময় আমেরিকায় পুজো প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। মণ্ডপ সজ্জার প্রস্তুতিও প্রায় শেষ পর্বে।  কয়েক ঘণ্টা পরেই সাউন্ড-বক্সে বেজে উঠবে দরাজ কণ্ঠে  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ত্রোস্ত পাঠ। এখন পথে বেশ  কিছু কাশফুল নজরে এসেছে।অফিস যাওয়া আসার পথে কাশ ফুল চোখে পড়লে দেশের শরৎকালের কথা খুব মনে হয়।  এখানে সন্ধের পর থেকেই বয়ে যায়  হিমেল হাওয়া। মনে পড়ে যায় কিছু পুরনো কথা। ফিরে আসে স্মৃতির ঝুলিটা । মনে হয় কেউ যেন স্মৃতির মনিকোঠায় দরজাটা খুলে দিয়েছে। এই ভাবেই প্রবাসে বসে দেশের মহালয়ার কিছু স্মৃতিচারণ আর বিদেশের মহালয়ার কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম।

“প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি।

অসীম চাঁদে বেজে ওঠে রুপ লোক ও রস লোক এ আনে নব ভাবমাধুরী সঞ্জীবন,

তাই আনন্দিত শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ী কে মৃন্ময়ী তে আবাহন।”

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআমি তমসা
Next articleশিবপুত্র শশাংক ( দ্বিতীয় পর্ব )
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments