আমাদের মন যতই বলুক, সে কখনই আঘাত ছাড়া কাজ করে না। এ উপলব্ধি সুধু আমার নয়, দুনিয়ায় যত রক্ত মাংসে গড়া মানুষের ভেতর হৃদয় নামক বস্তুটি আছে, তাদের সবার মনেই এই এক সুর বাজে। কর্মতো শুধু নিমিত্ত মাত্র। মনের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ, লাঞ্ছনা, ভালোবাসা, হিংসা এ সবের দরুন আমরা কোনো কর্ম করতে বাধ্য হই। তাই একথা বলতে আজ আর বাধা নেই যে “মনের হদিস মনই জানে”।
পড়ন্ত বিকেল। একটি মেয়ে পিঠে ব্যাগ, হয়তো পড়তে যাছে। হয়তো খুব সুন্দরি নয়। কিন্তু ভগবানের সৃষ্টিকে সন্দেহ করলে পাপ হতে পারে। তাই হয়তো সুন্দরি ই বটে। প্রথম পর্বের ছাত্ররা বেরোলো, আর সেই শুভ পর্বের সূত্রপাত ঘটল। মেয়েটিকে দেখে এক ছেলের পাছন্দ হল। কিন্তু ছেলেটির সেই আশাতে জল ঢালতে শুরু করল মনের খেয়াল। ভাবলো হয়তো মেয়েটি তার থেকে বড়, স্যারের পরবর্তী পর্ব হয়তো অন্য শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য। ছেলেটি চলে গেল। কিন্তু তার চিন্তা গুলো যায়নি। সারা রাত কেটে গেল শুধু তার নিজের মনের সাথে লড়াই করতে করতে। সে অনেক স্বপ্ন দেখত, যে একদিন বাকি সবার মতো তার জীবনেও আসবে এক অচেনা সঙ্গি, যে আচমকাই এসে তার সব স্বপ্নকে ভেঙে বাস্তবতার রূপ দেবে।
ক্রমাগত দিন যায়। আর কাটতে থাকে নিদ্রাহীন রাত। অবশেষে এল পড়তে যাওয়ার দিন। আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে। কোনোমতে ছুটতে ছুটতে পৌঁছল। পড়ানো ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। ছেলেটি কোনোমতে একটি জায়গায় বসে খাতা বেড় করে লিখতে শুরু করল। তারপরই এল বজ্রাঘাত। প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস না করতে পেরে ছেলেটি বার বার চোখ কচলে দেখল যে, তার জেগে থাকা রাতগুলো তার দিকে তাকিয়ে প্রাণপণে হাসছে। মনের মায়া খেলায় একদিন তার চোখ অন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু মনের মাঝে কোথাও যেন বার বার এক আশার আলো উঁকি মারতো। তাইতো নিজের ঠিক সামনে বসে থাকা সেই মেয়েটিকে দেখে ছেলেটির আত্মবিস্মৃতি ঘটল। সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল এক অচেনা জগতে।
এরপর শুরু হল নিজের প্রতি করা মনের বিদ্রূপের প্রতিশোধ নেবার পালা। চলল মনের সাথে নিজের লড়াই। মন জানে কিকরে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে হয়, কিন্তু তাও নিজেকে জেতাতে সে গড়ে তুলল ভয় নামক আক প্রাচীর, যাতে কিছুতেই ছেলেটি সেটা পড়তে না পাড়ে। কিন্তু তার স্বপ্ন, তার আবেগ তাকে বাধ্য করাল মেয়েটির সাথে আলাপ করতে। ভয়ে ভয়ে কথা বলে দেখল, মিথ্যে ভয় তাকে শুধু কষ্ট দিছিল। মেয়েটি অত্যন্ত ভদ্র ও সুশীল। কিন্তু তার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলার মত সাহস ছেলেটির আসেনি। মনে মনে হয়ত ভালোবেসে ফেলেছিল ছেলেটি। কিন্তু আমরাতো মনের দাস, তাই ইচ্ছে থাকলেও মনের কথাটা বলতে মনই বাধা দিচ্ছিল বার বার।
এরপর একদিন ছেলেটির শহরে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা হয়। এটা যেন ছিল মনের প্রতি তার লড়াই-এ মনের দেওয়া মোক্ষম চাল। ছেলেটি আত্মহারা হয়ে মেয়েটির সাথে যগাযোগ করার চেষ্টা করল। কোনোমতে এক বন্ধুর কাছথেকে মেয়েটির ফোন নম্বর জগাড় করল। পড়তে যাওয়া বন্ধ, ফোন করে কাথা বলার সাহস নেই, তাই যাওয়ার প্রাক্মুহূর্তে একটি ম্যাসেজে লিখে পাঠাল, “আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। কিন্তু এতোদিন বলতে পারিনি। আজ আমি শহরে চলে যাচ্ছি। এক মাস পর আবার আসব তখন দেখা করব।“
দেখতে দেখতে ২০ দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা একটা ম্যাসেজ এল ছেলেটির ফোনে। লেখাছিল,”তুমি ফিরলে আমাকে জানিও”। শুধু এটুকু লেখা যেন তার মনে সব সুখ এনে দিয়েছিল। আবার এল তার সেই বিনিদ্র রাতের মায়া। ঘরে ফেরার অধির আগ্রহে সে ব্যাকূল হয়ে উঠেছিল।
অবশেষে এল বাড়ি ফেরার দিন। ট্রেন থেকে নেমে সোজা হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে। রাস্তার এক গোলি থেকে মৃত্যুপথযাত্রীর মঙ্গল কামনায় দেওয়া হরি ধ্বনি শুনে সে নিজেকে ধন্য মনে করল। মার কাছে সে শুনেছে যাত্রাপথে হরি ধ্বনি শুনলে যাত্রা শুভ হয়। বাড়ি ফিরেই আগে সে মেয়েটিকে ম্যাসেজ করল। কিন্তু কোনো উত্তর পেল না সাথে সাথে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তার মন ব্যাকূল হয়ে উঠল। সে তার নিজের এক বন্ধুর বাড়ি গেল মেয়েটির সাথে দেখা করার পরামর্শ নিতে। বন্ধুটির বাবা আর মেয়েটির বাবা ভালো বন্ধু। দরজা খুলে ছেলেটিকে দেখেই বন্ধুটির চোখে জল এল। ছেলেটি অবাক হয়ে বলল ,“আমাকে দেখে কাঁদার কি হল?” উত্তরে বন্ধুটি যা বলল তা আজও ছেলেটিকে তার নিজের মনের প্রতি ঘৃণা করতে বাধ্য করে।