কুনালের বয়স যখন চোদ্দ বছর তার বাবা হৃদরোগে মারা যান । বাবা কাজ করতেন জুট মিলে । তখনকার দিনে মিলের অবস্থা রমরমা । খাটুনি ছিল কিন্তু সংসারে অভাব ছিল না । নিজেদের বসত বাড়ি । বাড়ির সামনে অনেকটা জমি । জমির একদম পেছন দিকে বানিয়ে ছিলেন দুই কামরার ঘর , রান্নাঘর ,বাথরুম , পায়খানা সবই । ইচ্ছা ছিল পরবর্তীকালে হাতে টাকা এলে সামনের জমিতে বেশ সুন্দর করে একটা দোতালা বাড়ি বানানোর । ইচ্ছাটা পূরণ হওয়ার আগেই মারা গেলেন ।
কুনালের বড়ভাই কুশল অনেকটাই বড় কুনালের চেয়ে । ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে সে আর পড়ে নি । বাবার সুপারিশে ঢুকে গেছিল মিলে । করিৎকর্মা ছেলে । ডান হাত বা হাত দু হাতই সমান তালে চলে । তার সাথে সমান তালে চলে বুদ্ধি । ইউনিয়নের তখন প্রচুর ক্ষমতা । চাকরিতে থাকা না থাকার হর্তা ,কর্তা ,বিধাতা । যোগ দিল ইউনিয়নে । বয়সে সবার ছোট । কিন্তু কাজে এক নম্বর । ফাই ফরমাস খাটার জন্য সব সময় উদগ্রীব । এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখতো ঠোঁটের কোনায় । যে যা বলতো মুখ বুঝে তাই করে দিত । অতি অল্প সময়ে সবার প্রিয় পাত্র হয়ে গেল কুশল । কুশল বোকা , কুশল বেগার খাটছে ,যদি ঘুনাক্ষরেও কারো মনে এই প্রশ্ন জেগেছে তাহলে সে নিশ্চিৎ মূর্খের স্বর্গে বাস করছে ।
আগেই বলেছি কুশল অসম্ভব বুদ্ধিমান । সে ভেবে দেখেছে চাকরি টিকিয়ে রাখতে গেলে ইউনিয়নের নেক নজরে থাকতে হবে । তাদের খুশি করতে পারলেই চাকরির ভিত একদম মজবুত । দ্বিতীয়ত , ফাই ফরমাস খাটলে বিনা পয়সায় এটা সেটা খাওয়া যেমন জুটে যায় , তেমনি দু -পয়সা পকেটেও আসে । পয়সা ফেরৎ দেওয়ার সময় এমন একটা ভান করে যে পয়সার প্রতি ওর কোনো লোভই নেই । যখনই কেউ কিছু কিনে আনতে বলবে সঙ্গে সঙ্গে কুশল বলে বসবে , তুমি কিন্তু টাকা ফেরৎ দেওয়ার সময় না বলবে না । তোমরা যখনই কেউ কিছু আনতে দাও , ফেরৎ টাকা কিছুতেই নিতে চাও না । আমার খুব খারাপ লাগে । আমার ভালো লাগে বলে তোমাদের জন্য কাজ করি । তোমরা আমায় ভালোবাসো, এটাই তো অনেক পাওয়া । এর মধ্যে টাকার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে ? তোমরা কিছু ভাবো না কিন্তু অনেকের তো ভালো নাও লাগতে পারে ।
এর পরে উত্তর যে টা আসবে সেটাও কুশলের জানা । বেশি পাকামি না করে এখন যাও যে টা আনতে বলা হয়েছে সে টা নিয়ে এস । আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দৌড় লাগায় কুশল ।
বাবা যখন মারা যায় কুনাল তখন ক্লাস এইটে পড়ে । এখনকার মত তখনকার দিনে বিনা পয়সায় স্কুলে পড়া যেত না । মাসে মাসে মাইনে দিতে হত । এর ওপর ছিল অন্যান্য ফিস । এছাড়াও ছিল বই খাতার খরচ আর প্রাইভেট মাস্টারের টাকা । কুশল যে টাকা মাইনে পেত সংসার চালিয়ে ভাইয়ের পড়ার খরচ চালানো দুরূহ ব্যাপার । বাধ্য হয়ে পড়া ছাড়তে হলো কুণালকে । খুব কেঁদে ছিল কুনাল । পড়তে সে খুব ভালোবাসতো । নতুন বইয়ের গন্ধ ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় । নিজের হাতে যত্ন করে মলাট দিত । সাদা কাগজ কেটে লেবেল বানিয়ে সে টা পূরণ করে সেটে দিত মলাটের ওপরে । কুনাল ছিল বই পাগল । বই পেলে সে আর কিছু চায় না । বাবার সাথে যখন বুকস্টলে যেত সে শুধু উল্টে পাল্টে দেখতো এক একটা বই । নাকের কাছে এনে গন্ধ শুকত । আর মনে মনে ভাবতো তার যদি এরকম একটা বইয়ের দোকান থাকতো তাহলে বেশ হত । কত রকমের কত বই । সে শুধু বই পড়তো ।
স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পরে কুনালের অফুরন্ত সময় । কিন্তু খেলতে তার ভালো লাগে না । বাড়িতে বসে থাকতো । পাতা উল্টে দেখতো পুরনো বই গুলো । কুশল একদিন মিল থেকে ফিরে বলল , ভাই , এই ভাবে ঘরে বসে সময় নষ্ট না করে একটা কাজ কর । মা বলল , এত টুকু ছেলে ও কী কাজ করবে ? কুশল বলল , মা , আমি সুজিতদার সাথে কথা বলেছি । বছরের এই সময়টা বইয়ের দোকানে কাজের খুব চাপ থাকে । সুজিতদা একটা ছেলে খুঁজছে । আমি ভাইয়ের কথা বলায় সুজিতদা একেবারেই রাজি হয়ে গেল । বলল , ভাইকে পাঠিয়ে দিস । কাজ ও শিখবে আবার কিছু টাকা মাইনেও পাবে । লাফিয়ে উঠলো কুনাল । বলল , দাদাভাই , খুব ভালো কাজ । আমি করবো । কাল থেকেই কাজে যোগ দেব । টাকা পয়সা তুই বুঝে নিবি । আমি শুধু কাজ করবো বুকস্টলে ।
কুনালও খুব শান্ত শিষ্ট । শেখার আগ্রহ আছে । ভুল করলে স্বীকার করে আর বকা খেলে চুপ করে মাথা নিচু করে থাকে । বুক স্টলের মালিক সুজিত নিয়োগীর খুব আস্থা ভাজন হয়ে উঠলো কুনাল । কাজে ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতাই নেই । কানাইদা বলে আর একজন মধ্যবয়সী কর্মচারী আছেন । ভীষণ কামচোর । কাস্টমার কিছু চাইলে আগেই বলে দেবে নেই । ফুরিয়ে গেছে । সামনের সপ্তাহে আসার কথা আছে । একবার খোঁজ নিও । বিল বানাতে আর পেমেন্ট রিসিভ করতেই ঘাম ছুটে যায় মালিকের । সব সময় নজর দিতে পারে না কানাইদার কথায় । ভাবে সত্যি বুঝি স্টকে বইটা নেই । কিংবা অমুক জিনিসটা ফুরিয়ে গেছে । মনে মনে গালি দেয় সাপ্লায়ার ছেলেটাকে । পরের সপ্তাহে বিল নিয়ে আসলে ধরবে ব্যাটাকে । রিকুইজিশন দেওয়া সত্বেও মাল দিতে এত দেরি কেন , জবাব দিহি করতে হবে । পরের সপ্তাহে ছেলেটাকে ধরতেই বলল । কেন দাদা , আমি তো গত সপ্তাহে রিকুইজিশন মিলিয়ে সব মাল দিয়ে গেছি । এই দেখুন কানাইদার সই করা ভাউচার । এই কথা কানাইদাকে বলতেই বলবে , ও তাইতো , আমি একদম ভুলে গেছিলাম । কুনাল আসার পর থেকেই মহা বিপদে পড়েছেন কানাইদা । কাস্টমারকে যেই বলে বইটা নেই , ফুরিয়ে গেছে কিংবা সামনের সপ্তাহে একবার খোঁজ নিও , সঙ্গে সঙ্গে কুনাল বলে বসবে , আছে তো । আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি । ঠিক কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মুহূর্তের মধ্যে বইটা নিয়ে নেমে আসবে । এর ফলে বই বিক্রি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে । আগে যেমন অনেক কাস্টমার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে চলে যেত , এখন সেটা হয় না । কুনালের সব মুখস্ত । কোন বই কোথায় আছে ? কত তার দাম ? মুখে মুখে সব বলে দেবে । একদম ডিসকাউন্ট করে । কুনালের কাজে সুজিতদা যত খুশি , কানাইদা ততই ক্ষুব্দ । করার কিছু নেই । অনিচ্ছা সত্বেও মেনে নিতে হয় ।
দেখতে দেখতে দিন যায় । মাস যায় । ঘুরে আসে বছর । ইউনিয়নের দাদাদের বদান্যতায় মিলে চাকরি পার্মানেন্ট হয় কুশলের । মিলে নিজের কাজ করেও দাদাদের তাবেদারী করা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছিল কুশলের । কাজেই বাড়ি ফিরতে দেরি হত । কুশলের মা একদিন বললেন , বাবা কুশল , বয়স হচ্ছে । শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না । তুই বাবা একটা বিয়ে কর । বৌমার হাতে সংসার দিয়ে আমি একটু নিশ্চিন্ত হই । কুশল বলল , এখনই না , মা । সবে পার্মানেন্ট হয়েছি । মিলের ব্যাপার কখন কী হয় কেউ জানে না । হাতে একটু পয়সা করি জমিয়ে নিই ,তারপর তোমার পছন্দসই মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো । এখন বরঞ্চ তোমাকে সাহায্য করার জন্য একজন কাজের লোক রেখে দিই । মা মেনে নিল কুশলের কথা । আরো পাঁচটা বছর কেটে গেল । এখন বিয়ে করতে কুশলের আর কোনো আপত্তি নেই । কুনালও যথেষ্ট বড় হয়েছে । ইউনিয়নের দাদাদের বলে রেখেছে । ভাইকে মিলে ঢোকাতে হবে । সামনের ইলেকশনে যদি এই পার্টি জিতে যায় তাহলে ভাইয়ের চাকরি একদম পাকা । কিন্তু ঝামেলা করছে আর একটা ইউনিয়ন । ভেতরে ভেতরে ওরাও খুব শক্তিশালী । দুই একবার সাবধান করে দিয়েছে কুশলকে । কুশল অবশ্য এ সব গায়ে মাখে না ।
খুব সুন্দর ভাবেই মিটে গেল বিয়ের অনুষ্ঠান । একটা অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই আর একটা অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল । এক বছরের মাথায় জন্ম হল ছেলের । সবাই দারুন খুশি । ছেলের যখন আট মাস বয়স তখন ঘটলো অঘটন । ইলেকশনের দিন ঠিক হয়ে গেছে । তৎপরতা বেড়ে গেছে ইউনিয়নের দাদাদের । পার্টির নেতারা মাঝে মাঝেই আসছে । আলোচনা চলছে । গেটের বাইরে মিটিং । বিশাল জমায়েত । বিরোধী পক্ষ বসে নেই । তারাও মরিয়া হয়ে উঠেছে । তাদের পার্টির নেতারাও আসছে । কেউ কাউকে একচুল জমি ছাড়বে না । সমানে সমানে টক্কর । কুশলের কাজও বেড়ে গেছে অনেক । ছুটির পরে অনেকক্ষন সে থেকে যায় । নানা রকম কাজ থাকে । শিফট চেঞ্জ হলে সন্ধ্যের সময় আবার মিলে চলে আসে ইউনিয়নের কাজে । দিন যত এগিয়ে আসছে উত্তেজনার পারদ উঠছে তত চড়চড় করে । মাঝে মধ্যে মিলের গেটের বাইরে বোম পড়ছে । সবাই সতর্ক । খবর আছে বিরোধীপক্ষ বাইরে থেকে ভাড়া করা গুন্ডা নিয়ে এসেছে । ভোটার দিন একটা ঝামেলা পাকাবে । ঝামেলা তার সাত দিন আগেই হল । রাত্রি দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরছিল কুশল । কারখানার গেট পার হয়ে মেন রোড । কিছুটা যাওয়ার পর রেলের গুদাম । গুদামের পাশ দিয়ে রেলের লাইন । মালগাড়িগুলো শুধু এদিক দিয়ে যায় ।শর্ট কাট মারার জন্য রেল লাইন ধরেই হাঁটতে শুরু করলো কুশল । এদিকে জন বসতি নেই বললেই চলে । অনেকটা যাওয়ার পর কুলি বস্তি । বস্তির পর আবার রাস্তা বাজারের দিক দিয়ে পুরোনো পাড়ার দিকে ঘুরেছে । ওদিকেই কুশলদের বাড়ি । মেন রোড ছেড়ে রেল লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করতেই কতকগুলো ছেলে অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো । কোনো কিছু বোঝার আগেই একটা ধাতব বস্তু সজোরে ঢুকে গেল তলপেটের ভেতর । গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত । চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কুশল । অন্ধকারে মিশে গেল ছেলেগুলো ।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার । বস্তিতে বজরংবলীর পুজো । ভিড় জমিয়েছে বস্তির লোকজন । প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে । শাল পাতায় । খিচুড়ি আর পায়েস । বস্তির বাইরের কিছু মানুষ এসেছিল প্রসাদ খেতে । প্রসাদ খেয়ে দল বেঁধে চলল বড় রাস্তার দিকে রেল লাইন ধরে । একজনের পায়ে কী যেন ঠেকলো । ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠেছে । ভেবেছে ট্রেনে বোধ হয় কুকুর কাটা পড়েছে । তাড়াতাড়ি করে মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে দেখে একটা মানুষ পড়ে আছে । ভালো করে দেখে বুঝলো একটা ছেলে খুন হয়েছে । রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা । ভালো করে ঝুঁকে পড়ে দেখলো তখনও প্রাণ আছে । ওদের মধ্যে দুজন তুলে নিল ছেলেটাকে । ছুটতে শুরু করলো বড় রাস্তার দিকে । বাকিরা বলল ,পুলিশ কেস কিন্তু । বিপদে পড়ে যাবো । উটকো ঝামেলায় ফেঁসে যাবো আমরাই । পুলিশ আমাদেরকেই চালান করে দেবে খুনি বলে । কে শোনে কার কথা ? ছেলেটাকে বাঁচাতে ওই দুজন মরিয়া । পেয়ে গেল একটা অটো । সোজা হাসপাতালের পথে । রাস্তার আলোয় একজন চিনতে পারলো । বলল , আরে ! এ তো আমাদের কুশল । খবর চলে এল মিলে । ইউনিয়নের দাদারা সব ছুটে এল হাসপাতালে । খবর গেল কুশলের বাড়িতে ।ছুটে এল কুনাল । পার্টির নেতারা এসে গেল । পুলিশের ঝামেলা সামলালো পার্টির নেতারাই । প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে খবর এল কুশল মারা গেছে ।
পরের দিন মিলে বন্ধ ডাকলো । রাস্তা অবরোধ । যান চলাচল ব্যাহত । সন্ধ্যের পর থেকে মুহুর্মুহু বোমা পড়তে লাগলো । তার সাথে চলতে লাগলো বন্দুকের গুলি । বিশাল পুলিশ বাহিনী নামানো হলো । জারি করা হলো ১৪৪ ধারা । এক সময় সব শান্ত হলো । আবার সূর্য উঠলো পুব আকাশে । পাখি ডাকলো । হুটার বেজে উঠলো মিলে । শুরু হল নতুন সকাল । নির্দিষ্ট দিনেই ভোট হলো আর কুশলের ইউনিয়নের দাদারাই জিতলো বিপুল ভোটে ।
এক সময় কুশলের মা র চোখের জল শুকিয়ে গেল । কুশলের বৌ সুস্থ হয়ে উঠলো আস্তে আস্তে । স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগলো রোজকার জীবন । একদিন মিল থেকে এল ইউনিয়নের দাদারা । কুশলের সমস্ত পাওনা গন্ডা দিয়ে যেতে । তাদের দাবি মেনে মিল মালিক কুশলের জায়গায় কুণালকে চাকরি দিতে রাজি হয়েছে । শুধু কতগুলো সই সাবুদ করলেই হবে । বাকি কাজ তারা করে নেবে । কুনাল রাজি নয় । সে মিলের কাজ করবে না । তার বুক স্টলই ভালো । যেমন বুকস্টলে কাজ করছে তেমনই করবে । খুশি হলেন সুজিতদা কিন্তু দুঃখী হলেন কানাইদা |
প্রায় বছর খানেক বাদে একদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে কুনালের মা কুণালকে ডেকে বললেন ,
একটা কথা ছিল তোর সাথে ।
কুনাল বলল , বলো ।
বৌমা আর বাচ্চাটার কথা কিছু ভেবেছিস ?
কী ভাববো ?
ওর পুরো জীবনটা পড়ে আছে । একা একা কী ভাবে কাটাবে ? কী আর এমন বয়স ওর । তুই ওকে বিয়ে কর , বাবা ।
চমকে উঠলো কুনাল । মা বলে কী ! এতো শোনাও পাপ । বৌদিকে সে বিয়ে করবে ? ছি ছি ছি ! মার কী মাথা খারাপ হয়ে গেল ? অসম্ভব । মরে গেলেও সে এই অন্যায় কাজ করতে পারবে না । মা যাই বলুক সে কোনো মতেই মা কে সমর্থন করবে না ।সেদিন কথা সেখানেই শেষ হয়ে গেল । না , শেষ হয় নি । কচি মেয়েটার মুখের দিকে কুশলের মা তাকাতে পারছে না । তাছাড়া কুশলের ছেলে আছে ওর কাছে । বয়সের দোষে যদি ভালো মন্দ কিছু একটা করে বসে ? অল্প বয়সী বিধবা মেয়েদের বিপথে টেনে নিয়ে যাওয়ার লোকেরও অভাব নেই । সুলেখার বাড়ির লোকের সাথে কথা বললেন কুনালের মা । তাদের বোঝালেন । মেয়ের ভবিষ্যতের কথা বললেন । অবশেষে রাজি হলো তারা । এরপর মত নিতে হবে সুলেখার । প্রথমে সে তো কানে আঙ্গুল দিয়ে বসলো । এ সব খারাপ কথা সে শুনবে না । কত মেয়েই তো একা একা জীবন কাটায় । তাদের তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না । ভগবান তার কপালে স্বামীর সুখ লেখে নি । সে কী ভাবে তার ভাগ্য কে পাল্টাবে ? কুণালকে সে বিয়ে করতে পারবে না । শ্বাশুড়িও ছাড়বার পাত্র নয় । বেশ , তাহলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে তো আপত্তি নেই । চুপ করে আছে সুলেখা । শ্বাশুড়ি এগিয়ে এলেন সুলেখার কাছে । গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , ছেলেটার কথা তো ভাববি । ওকে কে দেখবে ? ওর ভবিষ্যৎ কী হবে ? তাছাড়া , এটা তো মানবি যে শরীরের একটা প্রয়োজন আছে । আর তখন যদি কিছু ভুল করে বসিস ? তার খেসারত তোকে সারা জীবন ধরে দিতে হবে । যদি এখানেই থাকবি ঠিক করিস তাহলে বলি , আমি আজ আছি কাল নেই । কুনালের বিয়ে হবে । নতুন বৌ আসবে । তখন তো তোর অবস্থা হবে আরো শোচনীয় । তোকে তো কাজের লোক বানিয়ে ছাড়বে । কেঁদে কেঁদে জীবন কাটাতে হবে । যার স্বামী মারা গেছে সমাজে তার মত দুঃখী আর কেউ নেই । তুই আর না করিস না । আমার কথা শোন , তোর ভালোই হবে ।
কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সুলেখা তার শ্বাশুড়ির বুকে ।
সমাজের কিছু গণ্যমান্য মানুষের সাথে এই বিষয়ে কথা বললেন কুনালের মা । অবাক হলেন তারা একজন সাধারণ গ্রামীণ মহিলার মনের প্রসারতা দেখে । তথাকথিত শিক্ষা তার নেই কিন্তু তার যা মনের চিন্তা ভাবনা এবং যুক্তি তা তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় । ধন্য ধন্য করলেন তারা । এদের মধ্যে একজন ছিল সুজিত , বুক স্টলের মালিক । সবার আগে সে সমর্থন করলো কুনালের মায়ের এই প্রস্তাব । দায়িত্ব নিল কুণালকে বোঝাবার । কাজ হলো । রাজি হয়ে গেল কুনাল । সামাজিক নিয়ম মেনেই কুনাল এবং সুলেখার বিয়ে হয়ে গেল ।
নদী যেমন এঁকেবেঁকে চলে আমাদের জীবনটাও সে রকম । কখন যে কোথায় বাঁক নেবে কেউ জানে না । এগিয়ে চলাই জীবন । সাময়িক স্তব্ধ হতে পারে কিন্তু থেমে থাকে না । নদীর পরিণতি সাগরে আর জীবনের পরিণতি মরনে । নদী যেমন একূল ভেঙে অকূল গড়ে , জীবনের ধারাও সে রকম – গড়া আর ভাঙার । জন্ম আর মৃত্যু যেন একই মুদ্রার দুটো দিক । আগমন ঘটলো পরিবারে নতুন অতিথির । কন্যা সন্তানের পিতা হল কুনাল । তার কয়েক মাস বাদেই মৃত্যু হলো কুনালের মায়ের । সংসারে সাময়িক স্তব্ধতা । কালের নিয়মে থেমে থাকা নয় । সম্মুখে এগিয়ে চলা ।
সুলেখার বড় ছেলের নাম কুন্তল আর মেয়ের নাম খুশি । খুব মিল দুই ভাই বোনে । দুজনেই পা রাখলো শিক্ষার আঙিনায় । কুন্তল আগে , খুশি পরে । মেধার দিকে দিয়ে খুশি এগিয়ে । কুনালের মতই তার পড়ার আগ্রহ । বইয়ের প্রতি ভালোবাসা । বার্ষিক পরীক্ষায় তার ফল পাওয়া যেত । স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কুন্তল ভর্তি হলো কলেজে । ক্লাস করার দিকে তার মন নেই । জুটে গেল কিছু বন্ধু । যাদের ভালোবাসা অন্য কোথাও , অন্য কিছুতে । কোনো মতে এক বছর কলেজে থেকে পড়াশুনোকে বিদায় জানিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো পাড়ার চায়ের দোকানে । হাবভাব , আচার আচরণও গেছে তার পালটে । মুখের ভাষায় এসেছে বৈচিত্র । সেই ভাষার প্রয়োগে জ্বালা ধরে যায় শ্রোতার কান । তার রাগ তার মায়ের ওপর । কেন সে কাকাকে বিয়ে করলো ? তার স্থির বিশ্বাস মায়ের সাথে কাকার অবৈধ সম্পর্কের জেরে তার বাবাকে মরতে হয়েছে । সে কোনো দিন তার মা কে ক্ষমা করতে পারবে না । কাকা এমনিতে খুব ভালো । তাকে ভালোবাসে কিন্তু মার জীবন সে নষ্ট করেছে এই কথা ভাবলেই তার মাথায় খুন চেপে যায় ।
পাড়ার একটি মেয়ের সাথে গড়ে উঠলো কুন্তলের প্রেম । প্রেমের গভীরতা বাড়তেই বাড়িতে অশান্তি শুরু করলো ওই মেয়েকে সে বিয়ে করতে চায় । মেয়েটি পাড়ার বলে তাদের পরিবার সম্পর্কে কুন্তলের বাবা মা খুব ভালো ভাবেই জানে । একদম ভালো নয় পরিবারটা । পাড়ার কেউ পছন্দ করে না ওদের । মেয়েটিরও স্বভাব ভালো নয় । এর আগে আরো অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ে ছিল । এবোরশন ও করতে হয়েছে বার দুয়েক । কুন্তল খেপে গেছে ওই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য । অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করা হয় । কুনাল তাকে বলে , আগে তুই কিছু একটা কাজ কর । বিয়ে করে বৌকে খাওয়াবি কী ? তারপর আমি তোর জন্য ভালো ঘর থেকে বৌ নিয়ে আসবো । কুনালের কথায় কাজ হয় । কিন্তু কি কাজ করবে সে ? সুজিতদাকে সে কথা বলতেই সুজিত দা বলল , কানাইদার বয়স হয়েছে । এখন আর পারছে না । আমি নিজেও সুগার আর থাইরয়েড নিয়ে একেবারে জেরবার । তুই , এক কাজ কর , ওকে আমাদের বুক স্টলে নিয়ে আয় । কাজ করুক তোর সাথে । বাপ ব্যাটা এক সাথে কাজ করবি । আমার এখন বিশ্রাম নেবার সময় ।
কুন্তল এল বুক স্টলে । কাজ করতে লাগলো বাবার সাথে । যখন কুনালের মনে হলো যে ছেলে কাজে মন দিয়েছে , ছেলের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলো । পাওয়া গেল একটা মেয়ে । মেয়েটি বেশ পছন্দসই । পরিবারটিও ভালো । তাহলে আর অসুবিধে কোথায় ? হয়ে গেল বিয়ে । মাস দুয়েক বাদে জানা গেল বিয়েটা ঠিক হয় নি । বনিবনা হচ্ছে না কুন্তলের সাথে বৌয়ের । প্রায় রাত্রেই ঝগড়া ঝাটি । মাঝে মাঝে তুমুল আকার ধারণ করে ।বাধ্য হলো কুনাল মধ্যস্ততা করতে । শ্বশুরের প্রতি বৌমার কিন্তু শ্রদ্ধা অটুট । প্রথমে বাধোবাধো ঠেকলেও পরে পরিষ্কার জানালো যে কুন্তলের সাথে পাড়ার ওই মেয়েটার অবৈধ সম্পর্কের কথা । সে আর কুন্তলের সাথে এক ছাদের তলায় থাকবে না । সে ডিভোর্স চায় । চমকে উঠলো কুনাল । বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড । বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলো । লাভ কিছু হলো না । পরের সপ্তাহে বৌমার বাপের বাড়ির লোক একটা ম্যাটাডোর ভর্তি করে নিয়ে গেল বিয়ের সমস্ত দান সামগ্রী । ক্ষতি পূরণ হিসাবে দাবি করলো সাত লক্ষ টাকা । আকাশ ভেঙে পড়লো কুনালের মাথায় । কোথায় পাবে এত টাকা ? এমনিতেই ছেলের বিয়ে দিতে অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে বাজারে । সে টাকা এখনো শোধ হয় নি । অনেক ভেবে শেষে বাড়ির সামনের জমিটা যা তার বাবা বড় শখ করে রেখেছিল একটা দোতালা বাড়ি বানাবে বলে , সেই জমিটা বেঁচে দিল । বাকি টাকা রেখে দিল মেয়ের পড়াশুনো আর বিয়ের জন্য ।
ঘটনা চক্রে সুজিতদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন । দোকান চালাতে অক্ষম । খুব অল্প টাকায় কুণালকে বিক্রি করে দিলেন তার সাধের বুক স্টল । মনে এই টুকুই শান্তি যে কুনাল বড্ড ভালোবাসে বুকস্টল টা । কুনাল বুক দিয়ে আগলে রাখবে তার বুক স্টল কে । কুন্তলের কোনো বিকার নেই । তাদের বইয়ের দোকানের উল্টো দিকে একটা ব্লাউজের দোকান দিয়েছে পাড়ার সেই বখাটে মেয়েটা । ব্লাউজের দোকানের যাবতীয় কাজ দোকানের শাটার তোলা থেকে রাস্তার কল থেকে জগে করে জল আনা সমস্তই করে কুন্তল । আর দোকানে কোনো কাস্টমার থাকলে একটা টুল নিয়ে দরজার বাইরে একটু দূরে বসে খৈনি খায় । সবটাই করে বাবার চোখের সামনে । না , সে আর এখন বাবার বুক স্টলে বসে না । রোজ রোজ এই একই দৃশ্য সহ্য হলো না কুনালের । বিক্রি করে দিল তার আর সুজিতদার ভালোবাসার বুক স্টল । নতুন মালিক বুক স্টল উঠিয়ে একটা জুতোর দোকান খুলেছেন ।
*************