সেদিন ছিল জানুয়ারী মাসের কুড়ি কি একুশ তারিখ। একে কনকনে শীত, তার ওপর আবার নিম্নচাপের বৃষ্টি। সকাল থেকেই কখনো রিমঝিম, কখনো ঝমঝম করে ঝরেই যাচ্ছে। কিন্তু এষাকে ত’ কলেজ যেতেই হবে। সেই বারুইপুর থেকে বালীগন্জ সায়েন্স কলেজ। অনেকটা পথ। কিন্তু উপায় নেই। আজ কলেজে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস রয়েছে।এষা মুখার্জি।সে ভূগোলের ওপরে স্নাতকোত্তর করছে। আজ সে তার বাবার সঙ্গে গাড়ীতে এসেছে। তার বাবা সুধাংশুবাবু নরেন্দ্রপুর মহা বিদ্যালয়ের ইংরাজী বিভাগের প্রধান। কলেজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ও কয়েকটি বই কেনার জন্য তাঁরও এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে কলকাতায় আসতে হয়েছে।

এষা যখন বালীগন্জ ফাঁড়ির সামনে গাড়ী থেকে নামল,তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে এগারটা । অনদিনে যথেষ্ট ভীড় থাকে, কিন্তু আজকের দিনটিই অন্যরকম, রাস্তায় বেশী লোকজন নেই। হাঁটতে হাঁটতে যখন প্রায় কলেজের কাছে পৌঁছে গেছে এষা, তখনই হঠাৎ পিছন থেকে একটা টান অনুভব করল। পিছনে তাকিয়ে চমকে উঠল, সেই লোকটা তার হাত ধরে টানছে আর বলছে – কিরে আমাকে বাড়ী নিয়ে যাবি না ! লোকটাকে গত তিন চার দিন ধরে সে কলেজের আশেপাশে ঘুরতে দেখেছে । দেখলে ত’ বয়স্ক বলেই মনে হয়, তবে  শক্ত সমর্থ লম্বা চেহারা আর বেশ ফর্সাও। কিন্তু পরণের জামাপ্যান্ট একেবারে নোংরা।আর যেন কতদিন কিছু খায় নি । এষা চেঁচিয়ে উঠল-কি হচ্ছে কি ! হাত ছাড়ুন। এষার চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে হঠাৎই বেশ কিছু মানুষের আবির্ভাব এবং তারপর যা হয়। লোকটির ওপর যারপরনাই কিল চড় ঘুষি, সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। এষা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটিকে তারা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল।

অশান্ত মনে এষা কলেজে ঢুকল। সেদিন এষার ভালভাবে পড়া শোনা হল না । আর খারাপ আবহাওয়ার হেতু কলেজেও আগে ছুটি হয়ে গেল। কলেজ থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে এসেই সে আবার লোকটিকে দেখতে পেল। ফুটপাথের এককোণে গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে। জামা প্যান্ট সব ছিঁড়ে গেছে। শরীরের চতুর্দিকে আঘাতের চিহ্ণ। বৃষ্টি হয়ত রক্ত সব ধুয়ে দিয়েছে। এষা ভেবেছিল লোকটি অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখল – না লোকটার জ্ঞান আছে, ঠাণ্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে। কিন্তু তাকে দেখে সেই একই কথা – কিরে আমাকে বাড়ী নিয়ে যাবি না ! এষার খুব কষ্ট হচ্ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে তার বাবাকে ফোন করল।

“ বাবা, তুমি কোথায়। এক্ষুণি আমার কলেজের কাছে আসতে পারবে !”

তার বাবা তখন কাছেই আনন্দর বইএর দোকানে ছিলেন। তিনি বুঝলেন মেয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে । কালবিলম্ব না করে তিনি মেয়ের কলেজের কাছে চলে এলেন। এষা তাঁকে লোকটিকে দেখাল। সকালের সব ঘটনা এষা বাবাকে বলল। আরও বলল যে লোকটার আজকের এই রক্তাপ্লুত অবস্থার জন্য সেই নাকি দায়ী। অতএব তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।সুধাংশুবাবু প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও মেয়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ছোট থেকেই এষা একটু জেদী। যা বলবে সেটা করেই ছাড়বে।অতএব লোকটিকে নিয়ে তাঁরা বালীগন্জ ফাঁড়ির কাছে একটা ওষুধের দোকানে গেলেন। সেখানে একজন ডাক্তারবাবুও ছিলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা ত’ হল, কিন্তু লোকটিকে নিয়ে কি করা যায়। লোকটির মুখে তখনো সেই কথাটিই লেগে আছে-কিরে আমাকে বাডী নিয়ে যাবি না। আর সে বারবার এষার হাতটাকে চেপে ধরছিল।হঠাৎ এষা বললে-বাবা এঁকে আমাদের বাড়ী নিয়ে গেলে কেমন হয়। সুধাংশু চমকে উঠলেন এষার কথায়। “ সে কি রে-জানা নেই,শোনা নেই-রাস্তার একজন ভবঘুরে, তাকে বাড়িতে নিয়ে যাব।” কিন্তু এষার সেই একই কথা-ওঁকে বাড়ী নিয়ে যেতেই হবে। অনেক ছোট বয়সে এষা তার মাকে হারায়। তাই সুধাংশু হয়ত তাকে একটু বেশী আদরই দিয়ে ফেলেছেন।

তিনি আর না করলেন না। অতএব কালবিলম্ব না করে সোজা বারুইপুর। ইতিমধ্যেই আবহাওয়ারও খানিকটা উন্নতি হয়েছে।বাড়ী পৌঁছে একেবারে মেয়ের স্নেহে লোকটিকে গরম জলে স্নান করিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে এষা যখন তাকে সুধাংশুবাবুর একটা পাজামা পান্জাবী পরিয়ে দিল তখন তাকে দেখে রীতিমত এক ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছিল। লোকটি লম্বা চওড়ায় প্রায় সুধাংশু বাবুর মতই।লোকটির এই সৌম্যদর্শন রূপ দেখে এষার বাবা ত’ একেবারে হতবাক । এবার তাকে এষা খেতে দিল। কিন্তু লোকটি ঠিকমত খেতে পারল না। এমনকি তার নাম কি, তার ঠিকানা , পেশা কিছুই সে বলতে পারল না। এষা এবং তার বাবার আরো অনেক প্রশ্নের জবাবে লোকটির শুধু একটিই উত্তর-আমার কিছুই মনে নেই। এষা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলে লোকটি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। সেদিন রাত্রে এষাদের আর ঘুম এল না। লোকটিকে কি তারা পুলিশের জিম্মায় দিয়ে আসবে নাকি কোন সেবামূলক সংস্থাকে খবর দেবে এসব বিভিন্ন আলোচনাতেই রাতটা প্রায় বিনিদ্রই কেটে গেল।এষার বাবা সুধাংশুবাবু এরপর লোকটিকে নিয়ে কি করবেন কিছুই যেন  বুঝে উঠতে পারলেন না ।

সুধাংশু বাবু আবার আমার ছেলের ইংরাজীর গৃহ শিক্ষক। শিক্ষক হিসাবে তাঁকে আমরা খুবই সম্মান করি। তাঁর সঙ্গেআমাদের পরিবারের সম্পর্কও খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর মেয়ে মাতৃহারা এষাকে আমার স্ত্রী অত্যন্ত স্নেহ করেন।আমাদের বাড়ী থেকেমোটামুটি দু কিলোমিটার দূরেই তাঁর বাড়ী।

এষা যেদিন অপরিচিত ভদ্রলোককে বাড়ীতে নিয়ে গেল তার পরদিন সুধাংশুবাবু আমার বাড়ীতেছেলেকে পড়াতে এসেছিলেন। সেদিন ছিল শনিবার। আমার ছুটি ছিল।সুধাংশুবাবুকে কেমনবিচলিত, অন্যমনস্ক লাগল। তাঁকে দেখে আমার ভাল লাগছিল না। আমি বাধ্য হয়েই তাঁকেশুধালামকি মাস্টারমশাই, শরীর খারাপ নাকি ! সেরকম বোধ হলে বাড়ী চলে যান।তিনি বললেননা না তেমন কিছু নয়। আমি আর কিছু বললাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তিনি স্বত:প্রবৃত্ত হয়েআমাকে এষার সাথে যা ঘটনা গতকাল ঘটেছে,মায় ভদ্রলোককে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে আসা অবধিসবই বললেন।আমি সবটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এমনটাও ঘটে ! তবে এষাকে আমিঅনেকদিন ধরেই চিনি। তার পক্ষে এমন কাজ করাই সম্ভব।

চাকুরীর সূত্রে আমার সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সাথে আলাপ ছিল। কারো কারো সাথে বেশ বন্ধুত্ব গড়েউঠেছিল।এমনই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমার আছে লালবাজারে।বছর পঁয়ত্রিশের এই তরুণটি ইতিমধ্যেই অসীম কর্মদক্ষতায়গোয়েন্দা বিভাগের বড়সড় পদে আসীন। শিবাশীষ মৈত্র।তার সাথে যোগাযোগ করলাম। পুরো ঘটনাটি সংক্ষেপে তাকেজানালাম। সে আমার কাছে ভদ্রলোকের একটি ছবি চাইল। আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে কারও ছবি সংগ্রহ করা কোনব্যাপার নয়।এষার মারফত ভদ্রলোকের ছবিটি পেতে বিশেষ সময় লাগল না। শিবাশীষ আমায় কথা দিল যে সে যত শীঘ্রসম্ভব ভদ্রলোকের সম্বন্ধে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে আমাকে জানাবে।

এরপর প্রায় তিনসপ্তাহ কেটে গেছে। এরমধ্যে ভদ্রলোকের সম্বন্ধে জানবার জন্য এষাদের প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবরা অনেক চেষ্টাকরেছেন। কিন্তু কিছুই জানতে পারেন নি। ভদ্রলোকের পূর্ব স্মৃতি কিছুই মনে নেই। তারপর তিনি কথাও খুবই কম বলেন।তবে সুধাংশু বাবুদের আদর যত্নে মানুষটির শারীরিক অবস্থা কিন্তু আগের থেকে অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে। আমিওএকদিন ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করে এলাম। কথা কম বললেও বাচনভঙ্গী কিন্তু চমৎকার। মনে হয় যেন বেশ শিক্ষিতমানুষ।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্ব স্মৃতি কিছুই তাঁর মনে নেই।

সেদিনটা ছিল রবিবার। বাজার সেরে এসে এককাপ চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছি, এমন সময় গাড়ীর শব্দ। ওমাদরজা খুলে দেখি স্বয়ং শিবাশীষ। তার সাথে আরো একজন ভদ্রলোক। শিবাশীষ পরিচয় করিয়ে দিল। সুকল্যাণকরচৌধুরী। ইনিও লালবাজারে কর্মরত। পদমর্যাদায় শিবাশীষের ওপরে। এরপর শিবাশীষ যা বললে তাতে স্তম্ভিত হয়েগেলাম।

ভদ্রলোক যাঁকে এষা কলেজের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনে তাঁর নাম বারিদ বরণ বসাক। বাড়ী কল্যাণী। কল্যাণীবিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। অধুনা অবসরপ্রাপ্ত। গত প্রায় আট মাস আগে মারণ কর্কট রোগে তাঁর স্ত্রীবনানীর মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে মাস খানেকআগে। তাঁর একমাত্র মেয়ে চিকিৎসক নীলান্জনার সঙ্গে গাড়ীতে যাবার সময় কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে বিপরীত দিক থেকেএকটি ট্রাক এসে ধাক্কা মারে। ফলত নীলান্জনার মৃত্যু হয় সে গাড়ী চালাচ্ছিল। বারিদ বাবুর পিছনে বসে থাকার কারণেতাঁর দেহে বিশেষ আঘাত না লাগলেও মস্তিষ্কে জোর আঘাত লাগে।যার ফলস্বরূপ তাঁর সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। স্থানীয় সরকারী হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসার পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর পরামর্শ দেওয়া হয় কলকাতা বা অন্যত্র আরওভাল চিকিৎসা তথা মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার জন্য। স্থানীয় থানার মারফত বারিদ বাবুর প্রতিবেশীদের বয়ানে যা জানাগেছে তা হল বারিদ বাবুর ভাইপো যে সল্টলেকে থাকে সে নাকি তার কাকাকে নিয়ে ভেলোর গেছে চিকিৎসার জন্য। তাহলেপ্রশ্ন হল বারিদবাবু যদি চিকিৎসার জন্য ভেলোর গিয়ে থাকেন তাহলে তিনি বালিগন্জে কিভাবে পৌঁছলেন !

অতএব আর সময় নষ্ট নয়। সুধাংশুবাবু আর এষাকে সাথে নিয়ে আমরা কল্যাণীর পথে রওনা দিলাম। তবে শিবাশীষদেরপুলিশের গাড়িতে নয়, এষাদের গাড়ীতেই। বুঝলাম কিছু একটা রহস্য আছে।কল্যাণীর অভিজাত এলাকায় পৌঁছে বারিদবাবুর বাড়ী খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। সুদৃশ্য  তিনতলা বাড়ী সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গায় সুন্দর বাগান।দেখেশুনে মনে হল বারিদ বাবুর অনুপস্থিতিতেও বাগানের পরিচর্যায় কোন খামতি হয় নি। দুটো গাড়ী রাখার ঘর যাকেপরিভাষায় বলে গ্যারেজ।অর্থাৎ ভদ্রলোক যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। বাড়ীর সামনে দুজন নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা আছে।বারিদবাবুর এই অবস্থা, তাঁর স্ত্রী একমাত্র সন্তান দুর্ভাগ্যক্রমে আর জীবিত নেই, তাহলে কে এসব দেখাশুনা করছে ! নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সল্টলেক রাজারহাটের  প্রোমোটার স্বরূপ বসাক বারিদবাবুর ভাইপো।এইবাড়ি এখন তারই হেফাজতে। ভদ্রলোকের কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথে কথা বলেও জানা গেল স্বরূপ বসাক মাঝে মাঝেএখানে আসেন।তাঁর কাকা নাকি ভেলোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সুস্থ হতে সময় লাগবে। আর স্বরূপবাবুর অনুমতিব্যতীত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ নিষেধ। বলা বাহুল্য সুকল্যাণ আর শিবাশীষ নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। আমরাবারিদবাবুর বন্ধুএই তথ্যই সবাইকে জানিয়েছিলাম। সবকিছু দেখেশুনে বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। তবে সুধাংশুবাবুআর এষা একেবারেই চুপ। হয়ত মাস্টারমশাই ভাবছিলেন যে এষা নিজের অজান্তে কোন বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল না তো! আর এষাহয়ত সে তার বাড়ীতে থাকা মানুষটির সাথে বারিদবাবুকে একাসনে বসাতে পারছিল না। যাই হোক্, এবারআমাদের ফেরার পালা। ফেরার পথে শিবাশীষ এবং সুকল্যাণ স্থানীয় থানায় গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বারিদবাবুরসম্বন্ধে গোপনে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধানের নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে তাঁর বাড়িতে দিবারাত্র কি ঘটছে, কারা যাতায়াতকরছে সব খবর জানাতে বললেন। এবং অবশ্যই অত্যন্ত সঙ্গোপনে এবং সাবধানে। আমি ওঁদের কার্যকলাপ দেখেএকেবারেই হতভম্ব।

কিন্তু মনের ভিতর একটা রোমান্চ অনুভব করছিলাম। যেন একটা রহস্যের হাতছানির সামনে দাঁড়িয়ে আছি বলে মনেহচ্ছিল।

কিন্তু এর পরে যে সব ঘটনা ঘটতে শুরু করল তা সত্যই গোয়েন্দাগল্পকে হার মানায়। বারিদবাবুর তিনটে ব্যাংকের প্রতিটিতেসেভিংস স্থায়ী আমানত হিসাবে কয়েক লক্ষ টাকা করে জমান আছে। দুটি সরকারী এবং একটি বেসরকারী। বেসরকারী ব্যাংকে তাঁর প্রয়াত কন্যার সাথে যুগ্মভাবে আরও একটি খাতে দু লক্ষ টাকা আছে। ওই ব্যাংকের লকারে সোনারগহনা, নামী সংস্খার শেয়ার সার্টিফিকেট রাখা আছে যেগুলির বাজারদর এই মুহুর্তে যথেষ্ট লোভনীয়। এছাড়া দুর্ঘটনারমাত্র কয়েকদিন আগে  বিমাকৃত রাশি বাবদ প্রায় সাত লক্ষ টাকা বারিদবাবুর নামে একটি ব্যাংকে জমা পড়েছে।সব কিছুমিলিয়ে বারিদ বাবুর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য এখন কোটির অংক ছাড়িয়ে যাবে। আর সেই লোকটি কিনা ঐরকমঅসহায় অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলেন।ব্যাপারটি অত্যন্ত সন্দেহজন এবং দুর্ভাগ্যজনক বটেই।

এবার পুলিশী তদন্তে যে সমস্ত তথ্য প্রকাশ পেল তা সকলকে স্তম্ভিত করে দিল। বারিদ বাবুর ভাইপো স্বরূপের প্রমোটারীব্যবসা সেরকম ভাবে আর চলছেনা অনেক ধার হয়ে গেছে তার বাজারে আসলে আবাসন ব্যবসায় এখন একটা মন্দাচলছে সর্বত্র। তবে কি  বারিদ বাবুর দুর্ঘটনা, একমাত্র কন্যার মৃত্যু এবং তাঁর স্মৃতিবিভ্রম এসবের পিছনে স্বরূপের হাত ! স্বরূপকি অসহায় কাকার একমাত্র অবলম্বনের অভিনয় করে তাঁর সব সম্পত্তি গ্রাস করবার মতলব করেছে! এবার পুলিশ নড়েচড়েবসল। পুলিশি তদন্তে এই তথ্য উঠে এল যে বারিদবাবুর সব ব্যাংকেই তাঁর কন্য নীলান্জনার নামের পরিবর্তে যুগ্মআমানতকারী হিসাবে এখন স্বরূপের নাম। প্রতিটি ব্যাংকেই স্বরূপের পক্ষে বারিদবাবুর সই করা আবেদন এবং তাঁরশারীরিক অসুস্থতার সপক্ষে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের শংসাপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল বারিদবাবুস্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছেন। তাহলে তিনি সই করলেন কিভাবে ! তবে কি তাঁর সই জাল করা হয়েছে ! হস্তবিদ বিশারদগণেরওসেরকমই ধারণা। এদিকে ইতিমধ্যেই বারিদবাবুর আমানত থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা তোলা হয়ে গেছে। পুলিশের আর বুঝতেকিছু বাকী রইল না। বারিদ বাবুদের দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে তাঁর সই জাল করা,ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া, তাঁর বাড়ীরদখল নেওয়া সব কিছুতেই স্বরূপ বসাকের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে এই সন্দেহে এবার পুলিশ আর সময় নষ্ট না করে স্বরূপকেগ্রেপ্তার করল। প্রথমে অস্বীকার করলেও শিবাশীষের কঠোর জেরার সম্মুখে স্বরূপ ভেঙে পড়ল এবং সবকিছু স্বীকার করতেবাধ্য হল।তার বাড়ী থেকে চার লক্ষ টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হল। এক লক্ষ টাকা সে খরচ করেছে বলে পুলিসকে জানাল।স্বরূপের কাছ থেকেই জানা গেল যে সে ভেলোর যাবার নাম করে বারিদবাবুকে সাঁতরাগাছি রেখে দিয়ে এসেছিল।একজনকেতাঁর ওপর নজর রাখতে বলেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ বুঝে ট্রেনের সামনে ফেলে দিয়ে দুর্ঘটনার রূপ দেওয়া। কিন্তু কিভাবেযে অবস্থায় বারিদবাবু সেই সন্ধানী চোখদুটিকে ফাঁকি দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন এবং বালীগন্জে পৌঁছে গেলেন তাকেবল স্বরূপের কাছেই শুধু নয় পুলিশের কাছেও একটা ধাঁধা।আর বারিদবাবুর শরীরের যা অবস্থা,তাঁর কাছে থেকেও কিছুজানা সম্ভব নয়। পরপর দুবার ঈশ্বরের অলৌকিক কৃপায় তিনি তাঁর ভাইপোর কুটিল চক্রান্তের হাত থেকে বেঁচে গেলেন।ইতিমধ্যে কল্যাণীর থানা থেকে তাঁর বাড়িতে স্বরূপের সন্দেহজনক গতিবিধি সম্বন্ধে বিশদ তথ্য লালবাজারের গোয়েন্দাদপ্তরে জানান হয়েছে। অবশেষে স্বরূপের সমস্ত বেআইনি সম্পত্তি ক্রোক করা হল আর বারিদবাবুর বাড়ি ,টাকাকড়ি এমনকিস্বরুপের বাসস্থান থেকে উদ্ধার হওয়া সব অর্থ আদালতের নিযুক্ত অছি অর্থাৎ রিসিভারের উপর ন্যস্ত করা হল।

এদিকে বারিদবাবুর মানসিক অবস্থার আবার অবনতি হচ্ছিল। একদিন খুব ভোরে সুধাংশু বাবু আর এষা আমার বাড়ীতেএসে হাজির।বারিদবাবুর সম্বন্ধে তাঁরা বেশ উদ্বিগ্ন। অতএব আমার বসে থাকলে চলবে না। আমার পারিবারিক বন্ধুবিখ্যাত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ কলকাতার এক নামী বেসরকারী হাসপাতালের অন্যতম প্রধান চিকিৎসক  শ্রী পিনাকি সেনেরকাছে বারিদবরণকে নিয়ে গেলাম। সব দেখেশুনে এবং বিশেষ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীস্নায়ুরোগের শল্য চিকিৎসক তুহিন মিত্র অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। যদিও এর ফলে যে তাঁর স্মৃতি সম্পূর্ণ ফিরেআসবে সেটা সুনিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতেই হবে। ওনার মস্তকে যে সব রক্ত জমাট বেঁধে আছেসেগুলিকে সরিয়ে দিতে পারলে ভাল ফল আশাই করা যেতে পারেউভয় চিকিৎসকই একই মত প্রকাশ করলেন। অবশ্য এইঅস্ত্রোপচারের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খরচ হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হল এত পরিমাণ টাকা কে খরচ করবে ! আবার শিবাশীষের স্মরণাপন্ন হতে হল। এক্ষেত্রেও শিবাশীষের কাছেআমরা পুনরায় কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ হলাম। শিবাশীষের উদ্যোগে কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয় থেকে বিশেষ নির্দেশ এল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। বারিদবাবুর অস্ত্রোপচারের সমস্ত খরচ আদালত বহন করবে। অতএব অস্ত্রোপচার হয়ে গেলএবং সফল ভাবেই আমরা সকলেই মানসিক ভাবে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম আদৌ বারিদবরণের স্মৃতি ফিরবে কিনা এবংফিরলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হবে

বারিদবরণের স্মৃতি ফিরে এল। তাঁর সেই দুর্ঘটনার কথা সবই মনে পড়ে গেল। তিনি তাঁর মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।তাঁকে প্রবোধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল। কিন্তু এভাবে কতদিন চলতে পারে ! তাঁকে সত্যটা জানাতেই হবে। এবারএগিয়ে এলেন :সেন। সেদিন হাসপাতালে বারিদবাবুর ঘরে অনেক লোক। : সেন,:মিত্র সহ  হাসপাতালের আরোকয়েকজন ডাক্তার ,নার্স উচ্চপদস্থ কর্মী, শিবাশীষ তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুকল্যাণ করচৌধুরী এবং আমরা অর্থাৎআমার এষারা তথা এষাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠরা সকলে। বারিদবরণ এত অপরিচিত মানুষ দেখে খুবই অবাক হয়েগেলেন। এতদিন হাসপাতালে আমরা কেউই তাঁর সামনে যাইনি। কেবল শিবাশীষ গিয়েছিল পুলিশের প্রতিনিধি হয়ে।এবার : সেন এতদিন ধরে বারিদবাবুর জীবনে যা যা ঘটেছে, দুর্ঘটনায় তাঁর একমাত্র সন্তানের মৃত্যু এবং তাঁর স্মৃতিভ্রংশহওয়া, তাঁর এষাদের বাড়িতে আশ্রয়ের পিছনের  সম্পূর্ণ ঘটনা এবং তাঁর একমাত্র ভাইপো স্বরূপের হীন চক্রান্তের কাহিনীসবই একেএকে বর্ণনা করে গেলেন। আমাদের সবার সাথেও তিনিই পরিচয় করে দিলেন।তাঁর একটাই শর্ত ছিল বারিদবাবুযেন উত্তেজিত না হন। বারিদবাবু সমস্তটাই ঠাণ্ডা মাথায় শুনলেন। তাঁর অশ্রু যেন বাঁধ মানছিল না। তিনি কেবল একটাকথাই বললেনআমার আর কেউ রইলো না। আমার মৃত্যুই কাম্য ছিল। আমার স্মৃতি কেন ফিরিয়ে দিলেন আপনারা ! এবার এষার পালা এষা বারিদবাবুকে জড়িয়ে ধরে বললেজেঠু, কে বললে তোমার কেউ নেই ! তুমি আমাদের সঙ্গেথাকবে। বারিদবরণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন।

হাসপাতাল থেকে বারিদবাবুর ছুটি হয়ে গেল। বারিদবাবু নিজের বাড়ী ফিরে যেতে চাইলেন, কিন্তু এষা তার বাবা এবংআমাদের সবার আন্তরিকতার কাছে হার স্বীকার করে তিনি এষাদের বাড়িতেই রয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে আমাদেরওসখ্যতা গড়ে উঠল। চমৎকার মানুষ। ছুটির দিনগুলিতে আমরা প্রায়ই কল্যাণীতে তাঁর বাড়িতে যেতাম। দিনগুলো বেশআনন্দেই কেটে যেত। ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব সম্পত্তি , টাকাকড়ি বারিদবরণ ফেরত পেয়ে গেছিলেন।বিচারকের রায়ে খুন, তছরুপ সহ বিভিন্ন জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত স্বরূপের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেছিল।

বারিদবাবু এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁর ভাইপো তাঁর সাথে এমনটি করতে পারে। কিন্তু তাঁর সন্তানেরহত্যাকারীকে ক্ষমার কোন প্রশ্নই নেইআদালতে বারিদবাবু এই কথাটি পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন।

দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেছে। এষাদের পেয়ে বারিদবরণ তাঁর স্বজন হারানোর শোক অনেকটাই ভুলতে পেরেছেন।আজ এষার বিয়ে। এষার বিয়ে হচ্ছে ডাক্তার পিনাকী সেনের যোগ্য সহকারী তরুণ স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ : অরণি চ্যাটার্জিরসাথে বারিদবরণের অস্ত্রোপচারের সময় অরণি : সেনের সাথে ছিল। তখনই এষার সাথে তার দেখা। তারপর প্রণয়, আজ সেই প্রণয়ের পারায়ণে দোঁহার শুভ পরিণয়।

বারিদবরণ চেয়েছিলেন তাঁর সুন্দর বাড়ীটা

এষাকে যৌতুক দেবেন। কিন্তু এষা অরণি কেউই রাজী হয় নি।জেঠু,তুমি বরং বাড়ীর ওপরের দুটি তল ভারত সেবাশ্রমকেদান করে দাও”- এষার কথাটা তার জেঠুকে ছুঁয়ে গেছিল। তিনি তার কথাই রেখেছেন। শুধু যে তাঁর গৃহের দোতলা তিনতলা দানই করেছেন ভারত সেবাশ্রমকে তাই নয় , তাঁদের বিশাল কর্মকাণ্ডেও নিজেকে সামিল করেছেন ।আর দুহাত ভরেতিনি নবদম্পতিকে যৌতুক দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। হয়ত নিজের মেয়েকে বিবাহের পিঁড়িতে দেখার অতৃপ্ত আশা তিনি এইভাবেই এষার মাধ্যমে পূরণ করতে পেরেছেন। তবে আজ তিনি সত্যিই সুখী। ভগবান যখন একদিকটা কেড়ে নেন,তখন বুঝিঅপর দিকটা এই ভাবেই ভরিয়ে দেন।

কিন্তু এখনো তিনি মনে করতে পারেন না কিভাবে সেদিন রাতে তিনি সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে অবশেষেবালীগন্জ সায়েন্স কলেজের কাছে যান। হয়ত এটাই বিধির বিধান ছিল। নয়ত এষার সঙ্গে দেখা হবে কি করে ! হয়ত তাঁরঅবচেতন মনে এষাকে দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়েছিল, তাই তার হাত ধরে বাড়ী নিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন।সেদিন যে মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর নতুন জীবনের অবতারণা তার এই সফল পরিণতি ঈশ্বরের অমোঘ লীলা ছাড়াঅসম্ভবএই কথাটি তিনি মনেপ্রাণে স্বীকার করেন। সুধী পাঠকবৃন্দ, আপনাদের কি একই অভিমত !

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবদ্ধ আমি মায়ার জালে
Next articleছুটির ছুটি
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments