দুই
খেতে খেতে অনুপম লক্ষ্য করলো মেয়েটা বেশ খাচ্ছে, কাঁটা, চামচ, ফর্ক… সবই ছিল কিন্তু সুচরিতা সিম্পলি হাত দিয়ে চিকেন নিয়ে চিবোচ্ছে। কাবাবগুলো করেছেও ভালো, অনুপম অবশ্য কাটা চামচ দিয়েই চালালো কারণ সবই বোনলেস চিকেন কাবাব। সুচরিতার খাওয়াটাকে খাওয়া না বলে গোগ্রাসে গেলা বলা যেতেই পারে, অনুপমের চোখটা আবার একটু কুঁচকে গেল, খেতে টেতে পায়না নাকি? ফেসবুকের ফটো দেখে-তো বেশ ভালো ফ্যামিলিরই মনে হয়েছিল … এখানে কথা বলে কেমন ওলট পালট লাগছে। চিন্তাটাকে মাথার মধ্যে থেকে সরিয়ে দিয়ে অনুপম টুকটাক কথাবার্তার সঙ্গে খাওয়াটা শেষ করলো।
খাওয়া শেষ হতেই অনুপম পার্সটা হিপ পকেট থেকে বার করে ডেবিট কার্ড দিয়ে টেবিলে বসেই পে করে দিল। এতো সাবধানতা সত্ত্বেও হাতে একটু আধটু কাবাবের রস লেগেছে, অনুপম তাই নিজেকে এক্সকিউজ করে বাথ্রুমের দিকে গেল, সুচরিতা অবশ্য খাওয়ার পরেই ভালো করে হাত ধুয়ে এসেছে। একটু আনমনে সে পাশের টেবিলের দিকে তাকাল, ভদ্রমহিলা কখন উঠে গেছেন, ওখানে এখন চার বন্ধু বসে আলোচনায় মত্ত। সে আবার সামনে তাকাল, অনুপমের পার্সটা ঠিক ওর ডিসের পাশেই পরে আছে, সেই সঙ্গে ওর নতুন কিছু কেনা পলিথিনের প্যাকেটটা। পার্সটা বেশ মোটা, এদিক থেকেও কিছু নোটের কোনা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
সুচরিতা আরো একবার এদিক ওদিক তাকাল, সবাই যে যার মতো ব্যাস্ত, এদিকে কারুর মন নেই, বাথ্রুমের সামনে অবশ্য লম্বা লাইন, কাজেই অন্তত তিন চার মিনিটের আগে অনুপমের ফেরার চান্স নেই। সুচরিতা নিজেকে সামলাবার একটু চেস্টা করলো, অনুপম নেহাতই একটা ভালো ছেলে, হয়তো একটু গবেট কারণ ফেসবুকের সবকিছুই বাইবেলের মতো বিশ্বাষ করেছে। সে ঘার ঘুরিয়ে আবার একবার বাথ্রুমের দিকে তাকাল, সেখানে অনুপমকে এখনো লাইনের মাঝামাঝি দেখা যাচ্ছে। ওর দামি সার্টটার দিকে তাকিয়ে সুচরিতার মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেল, এই ছেলে কি আর তাকে পছন্দ করবে। আর এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছে যে সে ফেসবুকে মিথ্যে কথার ঝুরি লিখেছে, সুতরাং আজকের পর আর কোনদিন দেখা করবে না।
সুচরিতার চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল, তার হাত দুটো আলতো করে টেবিলের ওপর উঠে এলো, অনুপমের নতুন কেনা সার্টের কাপড়ের প্যাকেটটা নারতে নারতে ডান হাতটা মানি ব্যাগটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল। আবার ঘার ঘুরিয়ে দেখলো যে অনুপম এখন বাথ্রুমের মধ্যে ঢুকেছে কিন্তু তাও অন্তত দের দু মিনিটের ধাক্কা। ঘারটা আবার টেবিলের দিকে ঘুরিয়ে সুচরিতা পলিথিনের প্যাকেট দিয়ে পার্সটাকে আরাল করে ডান হাতের দুটো আঙুল দিয়ে বেশ কয়েকটা একশো টাকার নোট মুহুর্তে বার করে নিল, তারপর হাতটাকে মুঠো করে নিজের সস্তা হ্যান্ড ব্যাগে চালান করে দিয়ে পার্সটাকে আবার আগের মতো রেখে একটু রিল্যাক্স করে বসলো, যদিও তার বুকের ধুকপুকুনি তখন বেশ জোরে চলছে।
অনুপম যখন রুমাল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে টেবিলে ফিরে এলো তখন সুচরিতা আবার ফুললি কনফিডেন্ট। সে তার হাসিটাকে যতটা সম্ভব মিস্টি করে বললো – আপনার সার্টের কাপড়টা খুব সুন্দর, কোথা থেকে কিনলেন?
অনুপম তার ট্রেডমার্ক হাসি হেসে বললো – একটা কাজে অফিসের পর গড়িয়াহাটে এসেছিলাম, ওখানে একটা রেমন্ডের শোরুম থেকেই পেয়ে গেলাম।
এরপর ওরা আরো কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে দুজনে দুটো ফ্যান্টা ধ্বংস করে আমিনিয়া ছেড়ে রাস্তায় বার হোল। তারপর দুজনে মোবাইল নাম্বার এক্সচেঞ্জ করে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। সুচরিতার আবার একটু তাড়াতাড়ি, বাড়ী গিয়েই এখনকার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে আবার একটা অন্য নামের নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
***
ঘরে ফিরে অনুপম হাত পা ধুয়ে জামা কাপড় ছেরে এক কাপ কফি নিয়ে সোফায় বসলো, এখনো সে একাই থাকে। আজকের এই ডেটিঙের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে ও কফিতে চুমুক দিচ্ছিল … ঘড়িতে এখন সময় প্রায় পৌনে দশটা। এমন সময় পবন মেহতার কথাটা মনে পরে গেল, যাচ্চলে, এখনই ওকে একবার ফোন করা দরকার, কাল সকালেই তো ব্যাপারটা অফিসে হ্যান্ডল করতে হবে। কাপটা পাশের টেবিলে রেখে অনুপম বিছানার ওপর ছেরে রাখা প্যান্টের ভিতর থেকে পার্সটা বার করলো। মি. মেহতার কার্ডটা এর ভেতরেই কোথাও থাকার কথা, কিন্তু আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। অনুপমের হঠাৎ মনে পরলো তাড়াহুড়োতে সে কার্ডটা টাকার নোটগুলোর মধ্যেই রেখে দিয়েছিল। আসলে আজকের ডেটিঙের জন্য ও দুটো পাঁচশো টাকার নোট ভাঙিয়েছিল আর নিজের আরো কিছু ছিল, তার মধ্যেই মেহতার কার্ডটা ছিল। কিন্তু কোথায়, মাত্র দুটো একশো টাকার নোট আর কিছু খুচরো পরে আছে। আমিনিয়ার বিল তো হয়েছিল চারশো টাকার কাছাকাছি, তাহলে?
আবার ভুরুটা কুচকে অনুপম সোফায় বসে পরলো, হিসাবে বেশ গণ্ডগোল। আসলে আজ সন্ধ্যে থেকেই তার হিসাব সব ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে, কিছুই মিলছে না। সে মাটির দিকে তাকিয়ে মিনিট দুয়েক চুপ করে বসে থেকে নিজের মোবাইলটা তুলে নিল, সত্যি সত্যিই তাকে এবার একটা কল করতে হবে।
***
সুচরিতা মেসেজ-টা বেশ কয়েকবার পড়লো। ছোট কিন্তু বেশ সোজাসুজি – “আপনার পছন্দের সাথে আমার পছন্দ বেশ মিলে যায়, তাই আপনাকে বন্ধু হিসাবে পেলে খুব ভালো লাগবে। যদি আপত্তি না থাকে এই শনিবার অফিসের পর কোথাও মিট করা যেতে পারে। অসুবিধা না থাকলে লিখে জানাতে পারেন কখন, কোথায় ইত্যাদি। আমার ফোন নাম্বার …”।
মাস দেরেক আগের ডেটের কথা সুচরিতার ভালোই মনে আছে। ছেলেটা বেশ ভালোই ছিল, ভালো খাইয়েছিল। কিন্তু অত ভালো ফ্যামিলী থেকে কি আর তাকে নেবে, তাই শেষমেশ ওর মানিব্যাগ থেকে কয়েকটা পাত্তি সরাতে হয়েছিল, ও তো বুঝতেই পারলো না। অবশ্য ও আর কত টাকা, ও তো ভাইয়ের ছোট ছেলেটার একটা প্যান্ট আর একটা সার্ট কিনতেই ফুড়ুৎ। আর ভাই তো ভাই, গ্রামেই থাকে কিছুই করে না কিন্তু বিয়ে করে ফেলেছে, তাই দিদির কাছেই হাত পাতা।
সুচরিতা আবার মেসেজটার দিকে তাকাল, নাঃ, এমন মওকা ছাড়া যায় না, বিশেষ করে সুচরিতার মতো মাসে সাত হাজার নশো টাকার টাইপিস্টের পক্ষে তো নয়ই। হ্যাঁ, তাকে যেতে হবে, জীবনে কখন কি ঘটে বলা তো যায় না … আবার যদি ছপ্পড় ফাড়কে কিছু এসে যায় … হয়তো একটা সত্যি প্রেমই এসে গেল, তাহলে?
***
জায়গাটা সুচরিতা নিজেই ঠিক করেছিল, গড়িয়াহাটের আনন্দমেলা দোকানটার ঠিক সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। সময়টা তখন প্রায় সোয়া সাতটা, আর সে কি ভিড়, বাপরে। এই সময় এখানে এতো ভিড় হয় জানলে সে এখানে মিটিং ঠিক করতোই না, হয়তো বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সামনেটা এই সময় কিছুটা ফাঁকা পাওয়া যায়। অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতেও হোল না, ঘড়িতে তখন সাতটা বাইশ, একজন বেশ লম্বা টাইপের ভদ্রলোক তার পাশে এসে দাঁড়াল – “কি, সুচরিতা রায় তো”? সুচরিতা মুখ ফিরিয়ে তাকাল, তার থেকে কিছুটা লম্বা, একটু মোটা টাইপের লোক, মুখে ঘন চাপ দাড়ি, মাথায় বেশ লম্বা চুল, হাতে একটা পাতলা চামড়ার ব্যাগ। হ্যাঁ, ইমেলের ফটোতে তো এই রকমই ছিল, হয়তো চুল বা গোঁফের স্টাইলটা একটু আলাদা।
to be continued …