।১।
গ্যাণেশ্বর, ওরফে গগাবাবু যাবেন আমেরিকা। নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটান। ছেলে, বউমা, আর নাতির সঙ্গে ছ’মাস কাটিয়ে আসবেন, এই তার বাসনা। গগাবাবুর সদ্য হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেঁচে ফিরে আসার পর ডাক্তার বলেছেন “খুব কষে হাঁটবেন দুবেলা। আর পটিটা যেন ঠিকঠাক হয় রোজ সেটা খেয়াল রাখবেন। পেটে গ্যাস হলে অনেক কমপ্লিকেশান হতে পারে”। আজকালকার ইয়ঙ্গার জেনারেশানের ডাক্তাররা আর পায়খানা, পেচ্ছাপ এসব বলে না। পটি আর পিপি বলে। হয়ত বলতে লজ্জা পায়, ভাবেন গগাবাবু। যাইহোক, উনি ডাক্তারের খুব বাধ্য। বাধ্য না হয়েই বা যাবেন কোথায়? একা একা থাকতে হয়! কিন্তু অনেক ইচ্ছা থাকা সত্তেও দুবেলা হাঁটা হয়ে উঠছে না। কলকাতার গরমে দুবেলা হাঁটা কি চাট্টিখানি কথা? কষে হাঁটা তো দূরে থাক।
থাকেন শ্যামবাজার এলাকার এক গলিতে। সেখানে বড় রাস্তায় গেলেই পথচারির ধাক্কা খেয়ে পরে যাওয়ার উপায়। তার ওপর আবার জঞ্জালের স্তুপ আর অটোরিক্সার ভিড়। ওদের দেখলেই মনে হয় ঘাড়ের ওপর এসে পরবে। তাছাড়াও একটা সমস্যা আছে গগাবাবুর। ইদানিং হয়েছে। গলির মুখ থেকে একটু এগিয়েই মিষ্টির দোকান। সেখানে সারা দিন কচুরী ভাজার গন্ধ উঠছে। কাছে গেলেই গগাবাবুর জিভে জল এসে যায়। আগে এনিয়ে অতো ভাবতেন না। জিভে জল এলেই গিয়ে দু চারটে মেরে দিতেন। একা থাকার তো এই সুবিধা। কিন্তু এখন একা থাকা সত্তেও তা আর করা যাচ্ছে না। প্রানটা তো আগে। এই সব কারনে হাঁটা ওই গলির মুখ অব্ধি। ওইটুকু হাঁটাকে ঠিক কষে হাঁটা বলা চলেনা।
অথচ বাংলা সিনেমাগুলোয় দিব্বি দেখায় যে সৌমিত্র বাবু দাপিয়ে দাপিয়ে রোজ মর্নিং ওয়াক করে বেরাচ্ছেন। এই তো সেদিন বেলাশেষেতে দেখলেন। আজকালকার ডিরেকটার গুলো সত্যিই ফালতু। ওই লেক গার্ডেন আর দক্ষিন কলকাতা নিয়েই পরে আছে। আরে বাবা, উত্তর কলকাতাতেও তো মানুষ থাকে, নাকি? গগাবাবুর খুব রাগ হয় মাঝেমাঝে।
একদিন আর থাকতে না পেরে বউমাকে নিজের এই সমস্যাটির কথা বলে ফেললেন। আগে ছেলেকেও বলেছেন। ছেলে পাত্তা দেয় নি। গগাবাবুর বউমা টিয়া। ছেলে নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে। মেয়েটাকে গগাবাবুর একটু ট্যাঁশ বলে মনে হয়, তবে উনি বোঝেন যে যে মেয়ের আমেরিকায় জন্ম, সে তো ওরকম একটু হবেই। এতে দোষের কিছু নেই। বাঙালি তো নামমাত্র। মেয়েটা যে তাকে সন্মান দিয়ে কথা বলে সেটাই অনেক বড় প্রাপ্য বলে মনে করেন গগাবাবু। টিয়া কলম্বিয়া ইউনিভারসিটির প্রফেসর। খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। জেন্ডার ইকুয়ালিটি না কি সব নিয়ে গবেষণা করে। এই সব নিয়ে যে গবেষণা হয় গগাবাবুর কোনো ধারনাই ছিল না। তার ধারনা গবেষণা অর্থাৎ বিগ্যান। তা সে আর কি করা যাবে। দিনকাল পাল্টেছে। টিয়া গগাবাবুর সব কথা মন দিয়ে শুনলো। তারপর বলল “তোমার অসুবিধাটা বুঝতে পারছি ড্যাড্। দেখি সমরের সাথে কথা বলে”।
তারপর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ফোন। গগাবাবুর আমেরিকা যাবার আমন্ত্রন। ওখানে নাকি হাঁটার অফুরন্ত জায়গা। তা অবশ্য গগাবাবু আগেই জানতেন। ছাত্রাবস্থায় দু বছর কাটিয়েছেন পার্ডু ইউনিভারসিটিতে। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করতে। তবে সে ছিলো ওয়েস্ট ল্যাফায়েট্। উত্তরপাড়া অথবা কোন্নগরের সাইজ। কিন্তু ছেলে তো থাকে ম্যানহ্যাটেনএ। সেখানে কি হাঁটার জায়গা পর্জাপ্ত পরিমান আছে? কষে হাঁটা যাবে? ভাবেন গগাবাবু। প্রথমে গাঁইগুঁই করছিলেন। নানা রকম ছুঁতো বানাচ্ছিলেন। ভোট দেওয়া হবে না, ফিরে এসে কাজের মেয়ে পাওয়া যাবে না, জলের পাইপে জং ধরে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে যখন দেখলেন যে কোনটাই কাজে লাগছে না, তখন মড়িয়া হয়ে বললেন “এই হার্ট নিয়ে প্লেনে ওঠা যাবে না”। টিয়া কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো, কিছু বলল না। পরদিন ভোর হতে না হতেই ফোন। ওপাশে ডাক্তার। “কে বলল আপনাকে যে আপনি প্লেনে ট্র্যাভেল করতে পারবেন না?” মাঝখান থেকে অজুহাত দিতে গিয়ে ডাক্তারের কাছে বেইজ্জত হলেন গগাবাবু। যাইহোক, শেষমেশ বউমার চাপাচাপিতে রাজী হয়ে গেলেন।
ঠিক হোলো যে ছ’মাস কাটিয়ে ফিরে আসবেন। কি আর করবেন? একা একা জীবন। অন্তত কিছুদিন নাতিটাকে কাছে পাওয়া যাবে। মার্চ মাসের ২২ তারিখ যাত্রা। এমিরেটস ফ্লাইট ২৩৪। কলকাতা টু নিউ ইয়র্ক। ডিরেক্ট। দেখাই যাক না, ভাবেন গগাবাবু। এ তো আর প্রথমবার আমেরিকা যাত্রা নয়!
… to be continued