বেজায় গরম পড়েছে এবার। বিকেলের দিকে অখিলেশ ভাবল একটু বাইরে ঘুরে আসা যাক।বাড়ি থেকে ৩০ মিনিটের হাঁটা পথ।তার পরেই একটা ফাঁকা ময়দান, চারপাশে শাল আর সেগুন দিয়ে ঘেরা।এই জাগাটাই সে প্রায়ই আসে।খুব বেশি লোকজনের চলাফেরা নেই এধারে। কয়েকটা পাখির ডাক আর ডানা ঝাপটানোর শব্দ ছাড়া বাকিটা নিস্তব্দ।নিস্তব্দ্তা অখিলেশের ভালোই লাগে। সারাদিন খাটা খাটুনির পর এখানে এলে মনে হয় জীবনটা একটু থেমেছে। একটু ভাবার অবকাশ পাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ থাকার পর অখিলেশ ভাবল এবার ফেরা যাক।রাত্রে অনেক কাজ বাকি। নিতাই এর দোকানে এক পেয়ালা চা শেষ করে, আর একটা সিগারেট ধরিয়ে রওনা দিলো সে।বাঁ দিকে একটা পার্ক।এখন সেটা বন্ধ হবার মুখে।পার্কের সামনে মাধবিলতা ঘেরা যে মঞ্চের মত জায়গাটা, সেটাতে কয়েকটা বেঞ্চি পাতা, আগতদের বিশ্রামের জন্য।হঠাৎ সেধারে তাকিয়ে চমকে উঠলো সে।
***
অখিলেশ স্থানীয় খবরের কাগজে সাংবাদিকতার চাকরি করে।বছর পাঁচ হয়ে গেল। কত ঘটনার সাক্ষী থেকেছে, কিছু হ্দৃয়ে দাগ কেটে গেছে, কিছু হারিয়ে গেছে।
প্রায় ২ বছর হোল… উত্তরপাড়ার একটি বছর ১৫ র মেয়ে এক সস্তাহ ধরে নিখোঁজ। পুলিশ ষ্টেশনে কথা বলা, বাবা মা আর জনতার প্রতিক্রিয়া এই সব নিয়ে আরও কিছুদিন গেলো। একদিন অফিসে এসে জানতে পারলো মেয়েটিকে পাওয়া গেছে, নদীর পাড়ে নগ্ন অবস্থায় পড়ে ছিল সে, ৫-৬ দিন ধরে ধর্ষণ আর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়ে। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখল হাসপাতালের বিছানাই মেয়েটি মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে অসহ্য যন্ত্রণাই ছটফট করছে। বুজে আসা কণ্ঠস্বর আর কান্নার মাঝে বেঁচে থাকার লড়াই। কিছুকাল এই পরিবারের সাথে তার যোগযোগ ছিল। কিন্তু সেই যন্ত্রণাই কোঁকড়ানো মুখটা অখিলেশ এখনো ভুলতে পারেনি।
***
হাতের সিগারেটটা ফেলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল সে। ‘কেমন আছো?’ অখিলেশ জানে এটা অপ্রাসঙ্গিক, তবুও। মেয়েটি হঠাৎ চমকে উঠে ভাঙ্গা গলায় বলল – ‘আপনাকে তো ঠিক?’ ‘আমি অখিলেশ মজুমদার-সাংবাদিক, বছর ৩ আগে উত্তরপাড়ায়…’ এই বলেই তাকে থামতে হল। এর বেশি বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মেয়েটি সরল গলায় বলল- ‘ও। ভালো আছেন?’ ‘হ্যাঁ’। কিছুটা স্তব্দ্তা কাটিয়ে অখিলেশ জিজ্ঞাসা করল- ‘তুমি এখানে? কোন কাজে?’
‘না। এই কদিন হোল বিকেলের দিকে বসি এখানটাই। এই যে টিলার মাথায় মান্দিরটা ওটাই দেখি। কি সুন্দর না? প্রত্যেক সান্ধ্যয় কেও বাতি দেয়। বাতাসে বাতি নিভে যায় কিন্তু ঘণ্টাটা বাজতে থাকে। শুনে মনে হয় এখনো আরতি শেষ হয়নি। দেবতা তার প্রাপ্ত অঞ্জলি পাননি এখনো’।
‘বাবা মা কেমন আছেন?’ অখিলেশ জিজ্ঞাসা করল আবার
‘মা, ঐই ঘটনার মাস ২ পরে মারা যান। যতটা যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছি তার থেকে অনেক বেশি অপমান মা কে সইতে হয়েছে। লোকে বলতো আমি ছোটো জামা কাপড় পরি,আমার চরিত্র ঠিক নেই… যেন আমার সাথে যা হয়েছে তা আমার প্রাপ্যই ছিল। মা চলে যাবার একবছর পর বাবা চলে গেলেন। বাবা বলতেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে। তা আর হল কই। বাইরে বেরোলে লোকে অদ্ভুদ দৃষ্টিতে দেখে-আমি যেন ভিন্নগ্রহী কেউ। পারলে তারা আমার চামড়া ছাড়িয়ে দেখবে- কোথাও ধর্ষিত হবার চিহ্ন এখনো রয়েছে কিনা’।
অখিলেশের কাছে এর উওর নেই। তবুও, হয়তো সমাজ পাল্টাচ্ছে। হয়তো এই মানুষগুলোই ওর নতুন পরিচয়টা মেনে নেবে একদিন। এরপর আর মেয়েটির সাথে দেখা হয়নি অখিলেশের।
প্রায় ৩ মাস পর একদিন সন্ধ্যার খবরে অখিলেশ শুনল- উত্তরপাড়ায় কমলিকা পাটক নামে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান মানসিক অস্থিরতার কারনেই মৃত্যু।