প্রিয় দিনলিপি,

১৩ই সেপ্টেম্বর:- আজ বহুদিন পর সমস্ত স্মৃতিরা একজোট হয়ে মুহূর্তে পরিণত হল। সৌদামিনী প্রায় একবছর পর বাড়ির বাহিরে পা রাখলেন। বদ্ধ বাড়ির চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে বসবাস করতে গিয়ে তার প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। বাহিরের মুক্ত বাতাস তার মনের সমস্ত গ্লানিগুলিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল। তার প্রশ্বাস নেওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হল তিনি যেন আজ মুক্ত বিহগ। যদিও তার বাড়ির কাননটি খুব বড়ো নয়, কিন্তু তবুও তিনি কাননের এপ্রান্ত হতে সেপ্রান্তে বিচরণ করতে লাগলেন। বাড়ির বাগানের শিউলি গাছটির দিকে একবার
চকিত দৃষ্টিতে তাকালেন, তারপর উনি হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা একটি শিউলি কুড়িয়ে, সেটির ঘ্রাণ নিলেন। শিউলির গাছটিতে বেশ কয়েক বছর পর আবার কুঁড়ি ধরেছে।

১৭ই সেপ্টেম্বর:- আজ সৌদামিনী আবার তার বাগে উপস্থিত হয়েছেন। শিউলির গাছটিতে বেশ কয়েকটি ফুল ফুটেছে। আমি তবে, এযাত্রায় রক্ষা পেলাম না, তার চোখে হয়তো ধরা পরে গেলাম। ছাদে ঘুড়ি উড়ানোর থেকে বেশ অনেক্ষণ ধরে ওনার দিকেই মোহ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম। তাই বোধহয়, এই ঘটনাটা ঘটল।”জানিনা, উনি কিছু মনে করলেন কিনা!”

২০শে সেপ্টেম্বর:- আজ বাতায়নের পাশে সকাল থেকেই বসে আছি ওনার অপেক্ষায়, কিন্তু ওনার দেখা নেই। ওনার বাড়ি হতে একটি ক্ষীণ সেতারের সুর ভেসে আসছে, বেশ মনোরম ও মায়াময়, একাগ্র চিত্তে তাই কর্ণপাত করে রইলাম। চোখ বন্ধ করতেই ওনার মোনহর, মায়াবিনী বদনটি ভেসে উঠল। একাগ্র হৃদয় সেই সুরটি শুধুই অনুসরণ করলাম।

২৪শে সেপ্টেম্বর:- আজ লিখছিলাম একটি কবিতা, লিখেছি সবে চারটি লাইন।
“তাহার রূপশ্রী বদন, মায়াময় হৃদয়,
চকিত করে মোরে, মোহ জন্মে;
মোর তৃষ্ণা মেটে না, চাহিয়া রহিলেও,
যাহার আকর্ষিত দৃষ্টি, খুঁজি হন্যে।”
হঠাৎ তার দেখা মিলল আবার সেই শিউলির উদ্যানে, আমি একইভাবে বসে রইলাম বাতায়নের পাশে।

২৫শে সেপ্টেম্বর:- আজ সকাল থেকেই সৌদামিনীকে দেখার জন্য মন আমার ছটফট করছিল। আগামীকালই আমাকে বোম্বাই শহর যেতে হবে আপিসের কাজে। একটি চিঠি লিখলাম ওনার জন্য। লেখা রইল তাতে আমার অর্থাৎ ‘সৌরশীষ রায়ে’র জমানো অনুভূতিগুলির কথা তার জন্যে। একটি ঢিল বেঁধে চিঠিটি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে সৌদামিনীর কাননে ফেলে দিলেম। কিচ্ছুক্ষণ পরই সৌদামিনী বাগানে এসে চিঠিটি দেখতে পেল, আমার দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হেসেও ফেললো।

২৬শে সেপ্টেম্বর:- আজ সকালের ফ্লাইটে করে কলকাতা থেকে বোম্বে চলে এসেছি। কলকাতা আর সৌদামিনী দুইজনকেই খুব মনে পড়ছে। আপাতত দিনলিপির পাতা এখানেই স্তব্ধ রইলো।

১০ই অক্টোবর:- আজ আবার কলকাতায় ফিরেছি। দুই বাড়িতে চিঠির কথাটি নিয়ে ভেবেছিলাম তোলপাড় কান্ড হবে, কিন্তু কেউই চিঠির ব্যাপারে কিছুই জানে না। আশ্বাস পেলাম চিঠিটি সৌদামিনীর কাছে নিরাপদে ও যত্নে রাখা রয়েছে।

১১ই অক্টোবর:- আজ পঞ্চমী সৌদামিনীর শিউলি গাছে অজস্র ফুল ফুটেছে। সৌদামিনী আমাকে তার বাগান থেকে ইশারায় নীচে ডাকল, আমি যেতে আমার হাতে একটি চিঠির কাগজ ধরিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেলো।

১৪ই অক্টোবর:- আজও পর্যন্ত সৌদামিনীর লেখা চিঠিটি আমার পড়া হয়ে ওঠেনি, বোধহয় ভয়ে। পাড়ার পুজোয় ঢাকের শব্দে পুষ্পাঞ্জলীটাও সৌদামিনীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কেটে গেল। যদিও রাত্রে বন্ধুদের সঙ্গে অনেকগুলো প্যান্ডেলে ঘুরেছি, জানিয়েছি তাদের সৌদমিনীর কথাও। তারা সবসময়ই আমার কথা হাসি-ঠাট্টায় উড়িয়ে দিয়েছে, এবারেও তার বিপরীত হল না। যাইহোক, সৌদামিনীকে আজ অপরূপা লাগছিল সকালে, অঞ্জলী দেওয়ার মুহূর্তে।

১৬ই অক্টোবর:- আজ বিজয়া দশমী ‘মা’য়ের বিসর্জন বাজনায় সৌদামিনীর মনে যেন কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। তাকে আজ শুধু অপরূপা, মায়াবিনী, রূপমোহিনী সাজেই লাগছিল না শুধু, ‘মা’কে বরণ করার সময় তার দুই চোখের অশ্রু বুঝিয়ে দিয়েছিল আমায়, তার হৃদয়টাও সাদা কাগজের মত নির্মল, কোনো মলিনতা নেই সেই পত্রে।

২০শে অক্টোবর:- মায়ায়, মোহয় আমি কখন ওনাকে তুমি বলতে শুরু করেছি, সেটি আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। চিঠিটা আজ পড়লাম, লেখাছিল তাতে,
“আমি মুক্ত হতে চাই এই মায়ার বাঁধন থেকে, আমায় জটে বেঁধো না সৌরশীষ। আমি বোধহয় খুবই স্বার্থপর।
-ইতি সৌদামিনী মিত্র”

২১শে অক্টোবর:- সৌদামিনীর বাগানে আমি উপস্থিত ছিলাম আজ, কথাও হল আমাদের, সেই গোপন-অজানা ভালোলাগার কথা। আজ আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার স্বচ্ছ কাঁচের মতো।

সৌদামিনী বলল,”কেন আমাকে ভালোবাসো সৌরশীষ? আমার রূপ দেখে মোহিত হয়েছ, নাকি এই বাড়ির লালসায়?”

আমি বললাম,”কোনোটাই নয়, শুধু তোমার পাশে থাকতে চাই চিরদিন, আর কিছু চাই না!”

সৌদামিনী বলল,”আমার পাশে তুমি চিরকাল থাকতে পারবে না হে, আর আমিও তোমার পাশে নহে। তাই হারিয়ে যাও সৌরশীষ তুমি তোমাতে, আর মুক্তি দাও আমাকে। আমার মস্তিকে শিরা-উপশিরা-ধমনী সব জট পাকিয়ে গেছে। আমি বোধহয় খুবই সীমিত।”

২৯শে অক্টোবর:- টানা কয়েকদিন ধরে সৌদামিনীর থেকে দূরে বাস করছি আমি আবার, বোম্বে শহরে, আপিসের কাজে। বাড়িতে শুনলাম আমার জন্য পাত্রীও ঠিক হয়ে গেছে। “তবে কী আমার জীবনে ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই?” তাই এখানেই দিনলিপির পাতা বন্ধ রাখলাম কিছুদিনের জন্য।

২রা ফেব্রুয়ারি:- কলকাতায় ফিরে শুনলাম সৌদামিনী মুক্তি পেয়েছে। তার স্বপ্নের দুনিয়ায় সে মায়ার বাঁধন ত্যাগ করে ভেসে গেছে। আমার বিয়েও ঠিক হয়েছে বাবার প্রিয় বন্ধুর কন্যার সাথে। কালই সৌদামিনীর শ্রাদ্ধ ঐ বাড়িতে, আর ৪ঠা মার্চ আমার গায়ে হলুদের দিন ঠিক হয়েছে।

৪ঠা মার্চ:- আজ বসন্তের ভাব ফুটে উঠেছে আকাশে- বাতাসে।
“চিঠিরা থেকে গেলো নিশ্চুপ,
হারিয়ে গেলো মুহূর্তেরা স্মৃতির দুনিয়ায়।”
আমি হারিয়ে ফেললাম সৌদমিনীর স্বপ্ন। আজ তারই বাগে আমি উপস্থিত, দাঁড়িয়ে দেখি শিউলির বীজ হতে নূতন চারা গাছ জন্মেছে উদ্যানে। শিউলিরা সব ঝরে গেছে কবেই। শত শত প্রজাপতির ভ্রূণ শিউলির পাতার তলায় লেগে রয়েছে। চড়ছে শুঁয়োপোকা গাছের ডালে, পাতার শিরায় শিরায়। দুটি প্রজাপতি পাখা মেলে উড়ে গেলো অন্তহীন আকাশের নীড়ে, শিউলির বাগিচা হতে।
আমার হৃদয়ে একটি সুরই বাজছে এখন, “কাছের সুরে দূরের ধ্বনি যত, হারিয়ে খুঁজি তোমায় তোমার মতো।”

“আজ থেকে আমার দিনলিপির পাতায় চিরদিন সৌদমিনীর স্মৃতিরা আবদ্ধ থাকলো।”
-ইতি সৌরশীষ রায়।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleProtidan
Next articleপদাবলি – ১
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments