এ রোড টু ওয়াশিংটন ডিসি

আপাতত গন্তব্য স্থল দুবাই। ঢাকা দুবাই প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট। ভ্রমণে জানালার কাছে বসা আমার খুব পছন্দের একটি বিষয়। হোক তা গাবতলি গুলিস্তান রুটে মিনিবাস বা বোয়িং ৭৭৭ এর মতো অত্যাধুনিক বিমান। নিজের পছন্দমতো জানালা কাছেই সিট নিয়েছি। পাশে তারেকের সিট। ভীষণ ফুর্তিবাজ  তারেক। পুরো একটি মাস আমেরিকার মাটিতে মাতিয়ে রেখেছিলেন আমাদের। হোটেলের লবিতে গল্প করতে করতে অনেকদিন মাঝ রাত পার করে দিয়েছি। আমাকে ঘুম এবং ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন করলেও তারেককে কখনই ক্লান্ত হতে দেখিনি। হি নেভার গিভ আপ ইন এনি সারকামসট্যান্সেস-এমন একজন মানুষ তিনি।

ইমিরাতের লাগেজ হারানো একটি বদনাম আছে। বেশ কয়েক বছর আগে ইমিরাতের ফ্লাইটে দুবাই হয়ে মিশর যাবার সময় আমার সহকর্মী জনাব হক তার লাগেজ হারিয়েছিলেন। তিনি সহি সালামত এর সাথে ঢাকা ফিরে আসলেও তার লাগেজ কিন্তু অদ্যাবধি ঢাকা ফিরে আসেনি। মাঝে মধ্যে জনাব হকের সাথে আলাপকালে প্রসঙ্গটি নিয়ে আমরা বেশ মজা করি। জনাব হকের পরামর্শ মতো আমি দেশের বাইরে থেকে বাচ্চার জন্য শপিং করলে তা ক্যারি অন বা হ্যান্ড ব্যাগে রাখি। অন্যান্যদের জন্য কেনা গিফট আইটেম রাখা হয় চেকড-ইন লাগেজে। সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা যাতে এর ওপর দিয়ে যায়। হারালেও যেন তা মনঃপীড়ার কষ্ট না হয়।

 

দুবাই বিমান বন্দরের অভ্যন্তরভাগ

দুবাই বিমান বন্দর মনে রাখার মতো একটি অনবদ্য স্থাপনা। এর আগে একবার দুবাই হয়ে মিশর গিয়েছিলাম। আরবরা যে ভালো কাজ করতে পারে তার উত্তম প্রমাণ হচ্ছে দুবাই এয়ারপোর্ট। সময়ের সাথে সাথে দুবাই বিমান বন্দরের আকার ও সৌন্দর্য দুটোর বাড়ছে। ইমিরাতের ট্রানজিট যাত্রীর জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সাধারণত লাগে না, তবে সময়ে সময়ে এ নিয়মের পরিবর্তন ঘটতে পারে। ইমিরাতের যাত্রী হলে দুবাইয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য অবস্থান করা যায়। টিকেটের সাথে আপনি পাবেন দুবাই এয়ারপোর্ট সংলগ্ন মিলেনিয়াম হোটেলে ফ্রি থাকা এবং খাওয়ার সুযোগ।

এরাবিয়ান গালফের (ইরানীয়ানরা বলেন পারসিয়ান গালফ) তীর ঘেঁষে অবস্থিত শহরটা দুবাইয়ের শেখরা ছবির মতো করে সাজিয়েছে। আরব মুসলিম দেশ হলেও শহরের বৈশিষ্ট্য পশ্চিমা দেশগুলোর মতোই। শপারদের জন্য দুবাই স্বর্গ হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীর সব জায়গা থেকে এখানে লোকজন আসে শপিং করতে। শপিং এর আকর্ষণ আরও বাড়ানোর জন্য দুবাইয়ে আবার বিশেষ শপিং মেলা বসে বছরের জুন জুলাই মাসে। এ সময়ে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে প্রচণ্ড গরমে থাকায় তাদের অনেকেই এখানে আসেন আরাম আয়েশ আর শপিংয়ের জন্য।

দুবাইয়ের সিটি সেন্টার, মেরিনা মল, নায়েফ মার্কেট, বার দুবাই, গোল্ড মার্কেট, লামসি প্লাজা, ইত্যাদি শপিং এলাকাগুলো সারা বিকেল এবং সন্ধ্যা অব্ধি ঘুরে দেখলাম আমরা। লাগেজ ভারী হওয়ার ভয়ে কোন কিছু কিনলাম না এখান থেকে। তারপর আবার যাচ্ছি আমেরিকায়। ওখানকার ওয়ার্ল্ড মার্ট, জেসি পেনি, মার্কস এন্ড স্পেন্সার, কে মার্ট ইত্যাদি থেকে শপিং করতে হবে এমন বাসনা মনে আগে থেকেই উঁকি ঝুঁকি মারছিল।

 

দুবাই টু লন্ডন

দুবাই থেকে পরদিন সকালে ইমিরাতের লন্ডন গামী ফ্লাইটে চেপে বসলাম। প্রায় ছ’ঘণ্টার লম্বা পথ। ফ্লাইটে খাওয়া দাওয়ার কোন কমতি ছিল না। হারাম হালাল সব ধরনের খাবারই এখানে পাওয়া গেল। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমি ভীষণ উদার ছিলাম। আমার উদারতার কারণে উদরে গিয়েছে দুনিয়ার প্রায় সব খাবারই। আয়েস করে কফি খাওয়ার ফাঁকে জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম।

বিমান তখন সৌদি আরবের দাম্মাম শহরের ওপর দিয়ে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় ঘণ্টায় নয়শ কিলোমিটার গতিতে ছুটে যাচ্ছে। নিচে শুধুমাত্র আঁকাবাঁকা ধু ধু মরুভূমির কতকগুলো রেখা নজরে আসলো, শহরগুলো মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের পাহাড়ে স্তূপীকৃত কতকগুলো ঝিনুক। ক্রমাগত ঢেউয়ের আঘাত যেন তাদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে রেখেছে। আকাশে সাদা মেঘে মেঘে যেন রচনা করেছে স্বপ্ন পুরী মেঘমালা। মনে হলে এ মেঘমালা মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়া যায় রহস্যের কোন এক অজানা চোরাগলিতে। সেখানে রাজা আছে, রাণী আছে, স্বর্ণখচিত প্রাসাদ আছে, সেই সাথে রয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।

কিছুক্ষণ পর বেশ তেষ্টা পেল। বিয়ারে এলকোহলের পরিমাণ খুব কম, শতকরা পাঁচ ছয় ভাগ মাত্র। নেশা টেশা খুব একটা হয় না। তবে এক ধরনের তন্দ্রা মনকে আচ্ছন্ন করে। আমি প্রথম বিয়ারের স্বাদ পাই ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেবার সময়ে। ওখানে থাকতাম হোটেল ‘সী ভিউ’তে। পাশেই কোল্ড স্টোরেজ নামের বিশাল ডিপার্টমেন্টাল শপ। পানি এবং বিয়ার এর দাম কাছাকাছি। হরেক রকম বিয়ারের সমাহার দেখলাম কোল্ড স্টোরেজে। প্রমোশনাল সেলে দাম কম হওয়ায় জামাইকা থেকে আসা শিক্ষার্থী এন্ড্রু ফোর্থ এর সাথে ভাগাভাগি করে কিনে ফেললাম এক কার্টুন অস্ট্রেলিয়ান ফোস্টার বিয়ার। বিয়ার খাওয়ার মাধ্যমেই এন্ড্রুর সাথে আমার ভীষণ বন্ধুতা হয়, যেমনটি হয় স্মোকারদের বেলায়। এ কারণে এন্ড্রুকে ডাকতাম বিয়ার ফ্রেন্ড বলে।

ছোট বেলায় যখন দেখতাম আকাশের মেঘ চিরে বিমান প্রচণ্ড শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে, তখন থেকে বিমান চলার রহস্য নিয়ে মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতো। বিমান ভ্রমণ সুখকর এবং এতে অনেক এক্সাসাইটমেন্ট থাকলেও  লম্বা পাল্লার বিমান ভ্রমণ আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর মনে হয়। দু তিন ঘণ্টার যাত্রা হলে বেশ আনন্দদায়ক মনে হয়। এর বেশি হলেই হাত পায়ে খিল ধরে যায়, মাথা ঝিম ঝিম করে এবং মেজাজটাও তিরিক্ষি হয়ে যায়। মাটির মানুষ মাটিতে ফেরত যাবার জন্য মনটা তখন বড়ই আকুল হয়ে যায়। এ কাজে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মনকে উস্কে দেয়। মনের সাথে তখন শুরু হয় নীরব যুদ্ধ।

বিকেল তিনটার দিকে ইমিরাত আমাদেরকে হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছে দিলো। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর হিথ্রো। পিঁপড়ার মতো সারি বেঁধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আকারের বিমান উঠছে আর নামছে। নানা বর্ণ আর সজ্জার যাত্রীরা নিজ নিজ টার্মিনালে যাবার জন্য ব্যস্ত। ট্রানজিট যাত্রীর সংখ্যা নজরে পড়ার মতো। লন্ডন যাদের শেষ গন্তব্য তারা ইমিগ্রেশন এর পথ ধরে হাঁটছেন। যাত্রীদের জন্য হিথ্রো বিমান বন্দরে প্রচুর সুযোগ সুবিধা রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের যাত্রীদের প্রার্থনার জন্য রয়েছে মাল্টি ফেইথ রুম। এখানে অনেকে নামাজ পড়ছেন, কেউবা স্রষ্টাকে পবিত্র মন নিয়ে স্মরণ করছেন।

ইউরোপের মাটিতে প্রথমবারের মতো পা দিলাম। হাতে ঘণ্টা চারেক সময় ছিল। মনে হল লন্ডন শহরটা একটু চক্কর দিয়ে আসলে মন্দ হতো না। কিন্তু ব্রিটিশ ভিসা না থাকায় সে ইচ্ছা পূরণ হল না। লন্ডন আমার কাছে মনে হয় কলোনিয়াল দাদা বাড়ির মতো, আর ব্রিটেনের রানী যেন দাদীমা। ব্রিটিশ রাজ পরিবার নিয়ে বিভিন্ন গসিপ এবং দুর্নাম থাকলেও অজানা কারণেই কেন জানি মহামহিম রানীর প্রতি আমার ভীষণ শ্রদ্ধাবোধ আছে। বন্ধুরা বিষয়টি আমার আহাম্মকি বলে মন্তব্য করতে দ্বিধা করে না। এতে অবশ্য আমার কোন দুঃখ নেই। কিছু বিষয় থাকে একান্ত নিজস্ব, সহজবোধ্য ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে।

লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দর

সময় হাতে থাকায় ঘুরে ঘুরে বিমান বন্দরের বিভিন্ন অংশ দেখলাম। হিথ্রো আমার আছে কেন জানি এলোমেলো মনে হল। পৃথিবীর হরেক রকমের মানুষে গিজগিজ করছে পুরো এয়ারপোর্ট, তাদের সরব পাদচারণা সর্বত্র। তবে সেপ্টেম্বর ১১ ঘটনার পর সারা বিমান বন্দরে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বহাল করা হয়েছে। মাইক্রোফোনে প্রতি দু মিনিট পর পর নিরাপত্তা সংক্রান্ত হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে। যাত্রীদের বলা হচ্ছে তারা যেন মালিক বিহীন কোন লাগেজ পেলে সাথে সাথে তা কর্তৃপক্ষের নজরে আনে। চলার সময়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম আশেপাশে কোন আনএটেন্ডেন্ট লাগেজ আছে কিনা। এক ধরনের লাগেজ ভীতি মনে স্থান করে নিলো।

মতে মিল না হওয়ায় আমরা চারজন যার যার মতো টার্মিনালে ঘোরাফেরা করতে থাকলাম। এটা বাঙালি বৈশিষ্ট্য। আমরা মতগত মিলের চাইতে অমিলেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যাহোক সময়মত ডালাস গামী ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোর্ডিং গেটে সবাই একত্রিত হলাম। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। চুপচাপ দোতালায় সাইলেন্স জোনে গিয়ে ছোট্ট একটা ঘুম দেবার পরিকল্পনা করলাম। মনে মনে ভয়ও হল। ঘুমের পরিমাণটা যদি দীর্ঘ হয় তাহলে আমাকে আর আটলান্টিক পাড়ি দিতে হবে না। দাদা বাড়ি থেকে সোজা নিজের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে হবে। এ কারণে ঘুমাতে পারলাম না। আমার মনে প্রশান্তি না থাকলে ঘুম চোখে ভর করে না, শত মাইল দূরে সরে যায় ঘুম। সাথে লাগেজটা নিয়ে ভয়ও ছিল। দু’বছর আগে হিথ্রোতেই আমার এক সহকর্মী তার ল্যাপটপ হারিয়ে ছিলেন। এ ঘটনার পর পরই মনে হয়েছিলো হিথ্রো চোর বাটপারে ভর্তি,
আমাদের ব্যস্ত বাস বা ট্রেন স্টেশনের মতো।

 

 

~ ট্রাম্প ওবামার দেশে: বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleFailure is not a block but a stepping stone to success
Next articleট্রাম্প ওবামার দেশে: বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা (২য় পর্ব)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments