আগে যা ঘটেছে:
শুভ ও জয়া শঙ্করপুরে বেড়াতে এসে আলাপ গাঙ্গুলি দম্পতি মলয় ও অরুণার সাথে। ডিনারের পর চাঁদনী রাতে চারজনে সমুদ্রতটের দিকে হাঁটে। মলয়দা শোনায় তার এক গল্প, আত্মীয়র বাড়ি থেকে ফেরার পথে সূর্যাস্থের সময় গলা ভেজাতে এক চায়ের দোকানে বিরতি নেয় মলয়দা ও অরুণা, সেইসময় দুজনের নজরে আসে পরিত্যক্ত চৌধুরীদের বাগানবাড়ি। যখন তারা ওই বাড়িটাকে কিভাবে সারাই করে হোটেল করার জল্পনা করছে কোথা থেকে সেখানে উপস্থিত হয় ওই গ্রামের ছেলে কালু, চৌধুরী বাড়ির ইতিহাস বর্ণনার মধ্যে কালু টেনে আনে তার লালকাকার দুঃসাহসিক আফ্রিকার গল্প। এরপর …….
লালকাকা বলেন সলমনের জীবনের কাহিনী যত শুনছি ততই আশ্চর্য হচ্ছি। অশিক্ষিত অথচ কি ধূর্ত কুট বুদ্ধি ওর মাথায়, তেমনই স্বার্থসিদ্ধির জন্য নরকীয় নৃশংশ হতে পারে । যত জানছি ততই চমকে যাচ্ছি আরো কত আশ্চর্য হওয়া বাকি আছে, কে জানে ?
আবার আমাকে অবাক করে সলোমন বলে, আমিই খনি শ্রমিকদের সর্দার, ‘সলমন’ মোসের বাবার নাম, আমার নয়। ভাবছ এতদিন কেন নাম গোপন করেছি? নিজেকে ও মৌরিনকে বাঁচাতে, কেউ না জানতে পারে হীরে নিয়ে পলাতক খনি সর্দার এখনও জীবিত। দলে চারজন শ্রমিককে নিয়েছিলাম, আমি ছাড়া কেউ জানতো না আর কে দলে আছে, সবই আমার ইচ্ছেমতো গোপন ছিল।
সেদিন গভীর রাতে ঘুমন্ত মোসে কে নিয়ে যখন ফিরছিলাম মনে হয়েছিল অন্ধকারে আমার দলের একজনকে যেন দেখলাম। যদি ওই সময়ই ওর মোকাবিলা করে নিতাম! তাহলে আমাকে মৃত্যুভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হত না পরিবারের সকলে জীবিত থাকত । পরদিন মোসের পরিবারের মৃত্যুর খবর চাউর এবং আমার হীরে সমেত অনুপস্থিতি ওকে উৎসাহিত করেছে আমার বিরুদ্ধে যেতে। আমি সঠিক জানি না ওরা বাকি দুজন না মালিকের লেঠেলরা আমার পিছনে। শুধু জানি সর্বদা মৃত্যু আমার পিছনে ধাওয়া করছে আজ তো জানলাম রোগ আমার নাগাল পেয়ে গেছে। একটাই অনুরোধ আমার জীবনের সত্যি যেন তোমার মৌরিনের সম্পর্কে কোন বাধা সৃষ্টি না করে। তোমাকে যা বললাম মৌরিন তার কিছুই জানে না তুমিও ওকে কিছু বোলো না।
কেন জানি না, বোধহয় মৃত্যুপথযাত্রীর অনুরোধ, মৌরিনকে কোনোদিন বলিনি সেদিন ওর মুখে যা শুনেছিলাম। মৌরিনের সাথে আমার বিয়ের দিন আমাকে আবার আশ্চর্য করে বুড়ো। নিজের বুটের ভিতরকার সুকতলা উপড়ে ছোট বড় মিলিয়ে একমুঠো হীরে আমাদের দুজনকে উপহার দেয়।
ওর শেষের দিনগুলো প্রচন্ড যন্ত্রনা ভোগে কেটেছে। ব্যাথায় কুঁকিয়ে বলতে শুনেছি, ‘হে ভগবান আর সহ্য হচ্ছে না, মৃত্যু দাও।’ একদিন ও চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল।
মৌরিনের ভারতে আসার কোনো ইচ্ছে নেই, তাই মোম্বাসাতেই থেকে গেলাম। বেশ আনন্দেই ছিলাম একটা কাজও জোগাড় করে নিলাম। কিছু বছর পরে মৌরিন অন্তসত্তা হল। সব ঠিকই ছিল, হঠাৎ এক রাতে মৌরিনের পেটে প্রচন্ড যন্ত্রনা সঙ্গে ভীষণ জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, রাতে কোন ডাক্তার নেই, পরদিন ডাক্তার এসে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মৃত ভ্রূণ থেকে সারা শরীরে সেপটিক ছড়িয়ে গেছিল । মৌরিন ও সন্তানকে একই দিনে হারিয়ে এক্কেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। বছর লেগে গেল নিজেকে খানিকটা সামলাতে তারপরে ঠিক করলাম দেশে, নিজের লোকেদের কাছে ফিরবো।
মোম্বাসা থেকে বোম্বে ফিরে হীরে বিক্রির টাকায় রাজার হালে দিন কাটছিলো। একদিন আলাপ হল চৌধুরীদের পরিবারের একজনের সাথে। ওদের পরিবারের কেউ গ্রামে থাকে না। জলের দরে এই বাগানবাড়ি বিক্রী করতে চাইছে, ভাবলাম বড় বাড়ি, সকলে একসঙ্গে থাকব, তাই কিনেই ফেল্লাম।
মা তো শুনেই বললে, করেছো কি ঠাকুরপো ওই ভুতুড়ে বাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ যায় না বিক্রি করে দাও। ঐ বাড়িতে কে থাকবে?
লালকাকা হেঁসে বলে ভূতফুত বিশ্বাস করি না, মিছে তোমাদের ভয়, আজ রাতে ওই বাড়িতে থেকেই তা প্রমান করে দেব।
বিকেলে লালকাকার সঙ্গে চৌধুরীদের বাড়ি অবধি গেলাম ভিতরে ঢুকলাম না। আমাকে ব্যঙ্গ করে ‘ভীতু’ বলে লালকাকা ওই বাড়ির ভেতরে গেল। একফ্ল্যাস্ক চা, রাতের খাবার, টর্চ, দেশলাই আর মোমবাতি নিয়ে। পরের দিন সকালে চা নিয়ে আসব প্রতিজ্ঞা করে বাড়ি ফিরে এলাম।
পরদিন সকালে মা কাকভোরে উঠে দেখি লুচি আলুভাজা করছে। শত হোক হীরেওলা দেওর বলে কথা, যত্নঅর্ধিও সেইমত । ভোর ছটায় লালকাকার জন্য চা জলখাবার নিয়ে পৌঁছলাম চৌধুরীদের বাগানবাড়িতে। শীতের সকাল বাতাসে হিমের পরশ, পাতলা কুয়াশার চাদরে চারিদিক কিছুটা অস্পষ্ট । এর আগে ভয়ে কোনদিন ওই বাড়ির ৫০ গজের মধ্যেই যাইনি, সেদিনই প্রথম এতো কাছ থেকে দেখছি। বাড়ী ঘিরে ১০ ফুটের উঁচু পাঁচিল, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক্কেবারে জরাজীর্ণ। কোথাও ইঁট খসে পড়েছে তো কোথাও আগাছা গজিয়েছে। সামনে মস্ত লোহার রেলিংওলা গেট, অনুমান করতে পারছি দুজন লেঠেল সবসময় এই গেট পাহারায় থাকত। গেট পেরিয়ে মোরাম বিছানো পথ অর্ধচন্দ্রাকারে বাগান পেরিয়ে পৌঁছেছে একেবারে সাহাবী বাংলো কায়দায় তৈরী বিশাল অট্টালিকার গাড়িবারান্দায়। কোনো এক সময় এই বাগানে শীতে মখমলের মতো ঘাসের মাঝে গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা শোভিত আজ আগাছা,বুনো কাঁটাঝোপ ছাড়া কিচ্ছু নেই।
ভাবছি গেটের ভেতরে ঢুকবো নাকি বাইরে থেকেই লালকাকাকে হাঁক দেব । গেটের সামনে কয়েক মূহুর্ত্ত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেট ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ওই দূরে বাগানবাড়ির ডানদিকে ছাদ ভাঙা ঘরগুলো বোধহয় ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। কয়েক পা হেঁটেছি হঠাৎ কোথা থেকে “মিঁয়াও” ডাকে চমকে দেখি আমার সামনে কোথা থেকে উদয় হয়েছে এক কালো বেড়াল। দেখে শরীর কেঁপে ওঠে, গায়ের রং মিশকালো চোখদুটো জ্বলজ্বলে হলুদ সোজা আমার দিকে চেয়ে আছে। কয়েক পা হেঁটে থামে, পিছন ফিরে আমার দিকে তাকায়, আমি তার কাছে পৌঁছলে আবার এগিয়ে চলে। এমনি করে গাড়িবারান্দার কাছে পৌঁছে গেছি, শ্বেতপাথরের পাঁচ-ছ ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে বাড়ীর বন্ধ দরজা পর্যন্ত। ভাবছি ফিরে যাবো নাকি ?
“কালু ! কখন এলি?” ঘুরে দেখি আমার পেছনে লালকাকা। শরীরে স্বস্তি এল, গাছম্ছমে ভাবটা কেটে গেল। গতকালের ছাই রঙের সুটই পরে আছে।
“তুমি কি কোট পরেই ঘুমোও নাকি?”
“রাতে ঠান্ডা ছিল আর জামাকাপড় পালটানো হয় নি।”
“তোমার জন্য চা জলখাবার নিয়ে এসেছি,”
“দারুন, চল ওপরের ঘরে গিয়ে একসাথে বসে খাওয়া যাবে, দেখবি কি বিশাল আমার শোবার ঘর,”
বলতে যাচ্ছিলাম “এখানে বসেই খেলে হত না?”
“ঠান্ডায় এখানে কিরে? ভিতরটা তোকে দেখlতে হবে না?”
লালকাকা সোজা দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। উনি যখন সঙ্গে আছেন ভেতরে যেতে ভয় কি? আমিও পিছু নিলাম। ভারী সেগুন কাঠের দশফুটের দরজা ঠেলে ঢুকলাম। ভেতরটা কেমন স্যাৎস্যেতে, অনেকদিন জানলা দরজা বন্ধ থাকায় ভ্যাপসা গন্ধ। আধো আলোয় চোখ একটু অভ্যস্ত হতে দেখলাম আমি দাঁড়িয়ে দোতলা সমান ছাদের তলায়, ছাদ থেকে ঝুলছে বিশাল বিলিতি ঝাড়লণ্ঠন। এক ইঞ্চি ধুলোজমা শ্বেতপাথরের মেঝের ওপরে সাজানো বাহারি আরাম চেয়ার, রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে করুন থেকে করুণতর তাদের অবস্থা, দেয়ালে বাঘ,হরিনের মাথার সঙ্গে রয়েছে বড় বড় তৈলচিত্র নিশ্চয় চৌধুরী বংশধরদের। ডান দিক থেকে ছফুট চওড়া শ্বেতপাথরের রেলিং দেয়া সিঁড়ি সামান্য ব্যাঙ্ক নিয়ে উঠে গেছে দোতলায়। নীচথেকে দোতলার রেলিং দেয়া দালান দেখতে পাচ্ছি।
লালকাকা “আয়” বলে দোতলায় উঠতে শুরু করেছে ওর সঙ্গে কালো বেড়ালটাও উঠছে।
“বেড়ালটাকে কথা থেকে জোগার করলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“যখন থেকে এ বাড়ীতে এসেছি ও আমার সঙ্গ নিয়েছে।” লালকাকা হেঁসে বললো।
নোংরা ধুলো বালি পড়ে থাকা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমার প্রতি পদক্ষেপে খস খস আওয়াজ হচ্ছে অথচ লালকাকা উঠলো বিনা আওয়াজে ভাবলাম বোধহয় বিলিতি জুতোর কামাল। দোতলার অন্ধকারাচ্ছন্ন দালানটার দুদিকে সারি দিয়ে বন্ধ ঘরের দরজা। শুধু একটা ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আলো এসে বারান্দাটাকে খানিকটা আলোকিত করেছে । লালকাকা আমাকে অনুসরণ করার ইশারা করে ওই ঘরেই প্রবেশ করল সঙ্গে ওই বিটকেল বেড়ালটাও।
দরজার মুখে পৌঁছে দেখলাম সত্যি বিশাল ঘরখানা। বিশাল জানলা গুলোতে রঙিন কাঁচের শার্শি যার অনেকগুলো ভাঙা, সেখান দিয়ে বাইরের আলো এসে ঘরটাকে খানিকটা আলোকিত করেছে। ঘরের এক কোনে বিশাল পালঙ্ক আজ তার দৈন্যদশা। কিন্তু লালকাকা কৈ?
‘লালকাকা’ বলে ডাকতে যাচ্ছিলাম তখনই মেঝের দিকে নজর গেল। যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড়, হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে, মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে। টর্চ, খাবার, ফ্লাস্ক ছড়ানো, লালকাকার নিথর দেহ পড়ে আছে মেঝেতে ভয়ার্ত খোলা চোখ চেয়ে আছে ছাতের দিকে।
টলতে টলতে ছুটলাম সিঁড়ির দিকে। পিছন থেকে হাঃ হাঃ শব্দে মহিলা কণ্ঠে অট্টহাসি। পড়ি কি মরি করে সিঁড়ির মুখে পৌঁছেছি এমন সময় কথা থেকে ওই কালো বেড়ালটা আমার মুখ লক্ষ্য করে ঝাঁপালো। নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়িদিয়ে গড়িয়ে মুখথুবড়ে পড়লাম এক্কেবারে নীচে। আমার মাথার কাছে লাল শাড়ি পরে কে যেন দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেখলাম মহিলা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে, ওর চোখের দিকে তাকাতেই সারা শরীর দিয়ে এক শৈতপ্রবাহ বহে গেল। ওর দুটো চোখই সম্পূর্ণ সাদা তাতে কোন মনি নেই।
জ্ঞান হারাবার আগে আমার মুখ দিয়ে শুধু “পদ্মা” শব্দটা বের হল, এই বলে কালু থামলো।
চলবে…….