শুভ ও জয়া ছুটিতে এসেছে শংকরপুর বেড়াতে। দুজনেরই বয়স প্রায় তিরিশ ছুঁই ছুঁই। একই পাড়াতে বসবাস করলেও তাদের প্রথম আলাপ কফি হাউসে পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে। এর পর থেকে গাড়িয়াহাটে প্রায়ই দেখা হত দুজনের। তখন শুভ সিটি কলেজে কমার্স নিয়ে আর জয়া আর্টস নিয়ে স্নাতকের শেষ বছর মুরলীধরে। ওদের বন্ধুত্ব সময়ের সাথে গাঢ় হতে থাকে। দুজনের প্রেম কাহিনী খুব সহজ ছিল না। জয়ারা ব্রাহ্মণ, কায়স্ত জামাইয়ে প্রচন্ড আপত্তি ছিল ওদের বাড়িতে। শুভর মায়ের বিয়েতে আপত্তি না থাকলেও শর্ত ছিল জয়ার মা বাবার অমতে বিয়ে চলবে না।

স্নাতকোত্তর মানাজেমেন্টের পাঠ শেষ করে শুভ একটি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত। স্কুল কলেজে একদা ঢেঙ্গা একহারা তামাটে চেহারায় স্থানে স্থানে মেদ জমতে শুরু করলেও পাজামা পাঞ্জাবিতে তাকে আজও আকর্ষণীয় লাগে। ফর্সা মিষ্টি জয়া বয়সের সাথে আরো সুন্দরী হয়েছে, যেখানেই  যায়  সকলে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে সে পাড়ার রাস্তায় , শপিং মল বা এমনকি ওর ক্লাসের ছাত্ররা।

“আপনার পাঞ্জাবীটা তো ভারী সুন্দর, পাঞ্জাবী হাউসের নাকি?” ডিনারের সময় পাশের টেবিল থেকে মদ্ধ বয়স্ক অচেনা ব্যক্তির প্রশ্নে প্রথমে শুভ-জয়া দুজনে চমকে উঠলেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে শুভ বলে, “জন্মদিনে স্ত্রী ভাগ্যে প্রাপ্তি, কোথা থেকে বা দাম জিজ্ঞেস করা বারণ।”

এই ভাবেই শুভ ও জয়ার সঙ্গে আলাপ গাঙ্গুলী দম্পতি মলয় ও অরুণার। মলয়ের  সঙ্গে মানুষের ভাব জমতে সময় লাগে না, তার মজাদার গল্প  মানুষকে চটপট  আকর্ষিত করে তার দিকে। শুভ-জয়ারও আপনি থেকে তুমি সম্মোধন বা  মলয়দা ও বৌদি ডাকতে বেশিক্ষণ  লাগে নি।

বছর পঁয়তাল্লিশ ছফুটের মজবুত চেহারার, টাক মাথা, মোটা কালো ফ্রামের চশমায়, মলয়দাকে প্রথম দেখলে মনে হয় বুঝি পুলিশে চাকরী করেন। আসলে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিছু বছর হল সরকারি চাকরি ছেড়ে নির্মাণ শিল্পে কন্সালটেন্সির অপিস খুলেছেন। অরুণা বৌদির মুখে সবসময় একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে, উচ্চতা ফুট পাঁচেক, একসময়ের লম্বা চুল আজ কাঁধ পর্যন্ত, হাসলে দুগালে টোল পরে ।

“তা তোমাদের বিয়ে কত বছর হলো?” অরুণা বৌদির প্রশ্নে জয়ার উত্তর “সবে এক বছর হল।”

“সবে এক বছর? তাই শুভর মাথায় এতো চুল। আমার অর্ধেক মাথার চুল শশুরকে বিয়েতে রাজি করাতে আর বাকি বিশ বছর দাম্পত্তের ভারে ফাঁকা হয়ে গেছে।”

“চুপ কর, বেশি বোকো না। তোমাদেরতো টাকের গুষ্টী, তোমার ঠাকুরদা,বাবা, কাকা, কার মাথায় দুর্ব্ব ঘাসের মতোও চুল আছে?” মলয়দার কথা শেষ না হতেই বৌদির আপত্তিসূচক উত্তর।

শুভ ও জয়া হাহা করে হেসে ওঠে, শুধু মলয়দা নিম্ন সুরে বলে, “দাম্পত্য ভাগ্য আমাদের পরিবারিক টাকের কারণ।”

“তোমাদের কি বাড়ির থেকে ঠিক করে বিয়ে নাকি নিজেরাই একে অপরকে পছন্দ করেছ?”

অরুণা বৌদির প্রশ্নের উত্তরে জয়া আর  শুভ বলে কি ভাবে তাদের আলাপ, কলেজের দিনগুলোর কথা, দু পরিবারের আপত্তির কথা ও অবশেষে তাদের বিয়ের গল্প ।

“তোমাদের মত একই পাড়ায় থাকলে আমি কলেজে পড়তেই বিয়েটা সেরে ফেলতাম।” মলয়দা গম্ভীর স্বরে  বলেন।

“তুমি স্কুলেই বিয়ে পাস করে ফেলতে। কলেজ অব্দী যেতেই হত না.” বৌদির হেসে উত্তর।

“বৌদি বল না তোমাদের কি ভাবে বিয়ে হল।” জয়া আবদারের সুরে বলে।

অরুনাবৌদি বলেন, “সে এক ইতিহাস। আমার বাবার  ছিল রেলে চাকরি, পোস্টিং কাটনিতে।  উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ওখানে তেমন পড়ার সুবিধা না থাকায় কলকাতায় রামমোহন কলেজে ভর্তি করে দিলেন। থাকতাম হাতিবাগানের কাছে বড় মাসির বাড়িতে।  মাসির বাড়ির উল্টোদিকে মলয়ের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকতেন।  আমি জানিও না কবে ওখানে এসে আমাকে দেখে ওর ভালো লাগে।  এর পরে নাকি প্রায়ই  ওই আত্মীয়ের  বাড়িতে  হাতিবাগান হাটের ছুতোয় হানা দিত। আমার বড় মেসোর আবার ফুল গাছের শখ ছিল, হাতিবাগান হাটেও যেতেন প্রায়ই  । হঠাৎ এক রবিবার সকালে মলয়কে সঙ্গে করে হাট থেকে ফিরলেন। চা বিস্কুট পৌঁছনোর ভার পড়লো আমার ওপরে। ব্যাস ওই এক মিনিটের ভিতরে আমার নাম, কোন কলেজে পড়ি কখন ছুটি হয় সব জেনে নিলো।  আমিও বোকার মতো গড় গড় করে সব বলে দিলাম। তারপর আর কি? পরেরদিন কলেজ থেকে  বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি হঠাৎ দেখি সামনে মূর্তিমান দাঁড়িয়ে। ওকে দেখেমাত্র  আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে।  একগাল হেসে আমার দিকে একটা ঠোঙা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, সোনপাপড়ি দিয়ে মুড়ি, খেয়ে দেখ, দারুন লাগবে ।  আগে কোনোদিনও জানতাম  না কলেজের পাশেই একটা সোনপাপড়ির কারখানা আছে ।”

“হাউ সুইট, তারপর কি হল বল।” জয়া বলে।

চলবে…………

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleএকুশে ফেব্রুয়ারী
Next articleকরোনা শেষের কথা
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments