কালো রয়্যাল এনফিল্ড ক্ল্যাসিক বাইকটা আপার্টমেন্টের গ্যারেজে পার্ক করে লিফ্টে ঢুকে সাত তলার বোতাম টিপে দাঁড়াল সৌরজিত। সবে মার্চ মাস, অথচ কলকাতা শহরে এখনই যা গরম পড়েছে ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল ও। হাল ফ্যাশনের লিফ্টে সাত তলা পৌঁছতে সাত সেকেন্ডও সময় লাগলো কিনা সন্দেহ হয়। লিফ্ট থেকে লবিতে বেরিয়ে ডান দিকের ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপতেই পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক মধ্যবয়স্ক , স্থূলকায়, মুখময় কাঁচা পাকা দাড়ি, চোখে চশমা, পরনে টিশার্ট আর জগার্স। দরজার বাইরে সৌরজিতকে দেখে সিগারেট খাওয়া হলদে দাঁত বের করে হেসে বললেন – ‘আরে, কি সৌভাগ্য আমার। ভেতরে এস।’
সৌরজিত-ও ভেতরে ঢুকে এসে একমুখ অমলিন হাসি নিয়ে বলল – ‘কেমন আছেন মুখার্জিদা?’
দরজা বন্ধ করে ওই মধ্যবয়স্ক উত্তর দিলেন – ‘ফেসবুক টা কম খুলি, আর, চার পাঁচজন লোক ছাড়া কারুর সঙ্গে মেলামেশাও করিনা। নিজের মতো করে বেশ ভালোই আছি।’
সৌরজিত মৃদু হেসে বললো – ‘একই রয়ে গেছেন। শুধু ওজনটা একটু বেড়েছে।’
ইশারায় সামনের সোফাতে বসতে বলে মুখার্জি বললেন – ‘তোমার মধ্যেও কি খুব পরিবর্তন ঘটেছে ইন্সপেক্টর ঘোষ? তা আজ কি অফ ডিউটি!’
সৌরজিত – ‘আজ সোমবার, আর পরনে ইউনিফর্ম নেই বলে বলছেন! কিন্তু সেই সুযোগ আমাদের খুব একটা আসেনা।’ বলে নিয়ে একটু হেসে আবার যোগ করলো – ‘তবে আজ আসলে আমি ছুটিতেই ছিলাম, কিন্তু জরুরি তলব, তাই বেরোতেই হয়েছিল। থানা থেকে বেরিয়ে সোজা আপনার কাছেই এলাম।’
মুখার্জি – ‘তা বেশ করেছ। কি খাবে বলো। অন্য কোনো প্ল্যান না থাকলে ডিনার টাও করে যেতে পারো।’
সৌরজিত – ‘সে না হয় অন্যদিন হবে। আপাতত এক কাপ চা বা কফি চলতে পারে।’
মুখার্জি ‘এক মিনিট’ বলে উঠে গিয়ে ভেতরে গেলেন। যে ঘরে সৌরজিতরা বসে আছে, সেই ঘরে ওই একটা লম্বা সোফা ছাড়া, বইতে ঠাসা তিনটে আলমারি, ঘরের কোণে একটা স্ট্যান্ড ল্যাম্প, আর একটা ছোট সেন্টার টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি দুটো সোফার মতো দেখতে চেয়ার আছে। সেন্টার টেবিলের ওপর একটা দাবার বোর্ড, তাতে ঘুঁটি গুলো যেভাবে রয়েছে দেখে মনে হয় এখুনি সেটার মধ্যেই ব্যস্ত ছিলেন সৌরজিতের মুখার্জিদা।
‘কি দেখছো?’ ঘরে ঢুকে সৌরজিত কে দাবার বোর্ডের দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন মুখার্জিদা।
‘এ তো সিসিলিয়ান ডিফেন্স মনে হচ্ছে’ উত্তর দিলো সৌরজিত।
‘হ্যাঁ, পার্টনার তো পাইনা তাই নিজে নিজেই ঝালিয়ে নিই মাঝেসাঝে’ একটু থেমে যোগ করলেন ‘এক দান হয়ে যাক নাকি ইন্সপেক্টর ঘোষ?’
সৌরজিত – ‘আজ! সময় যে হাতে বেশি নেই দাদা।’
মুখার্জিদা – ‘কফি আসতেও তো সময় লাগবে। চলো, তোমাকে চেকমেট দিয়েও মজা পাওয়া যায়, যতক্ষন আছো একটু খেলেই নিই।’
হো হো করে হেসে উঠলো সৌরজিত, বললো – ‘আমি আসলে একটা কেসের ব্যাপারে আপনার থেকে একটু পরার্মশ নিতে এসেছিলাম।’
‘সেটা না হয় খেলতে খেলতেই আলোচনা করা যাবে’ উত্তর দিলেন মুখার্জিদা।
আর কথা না বাড়িয়ে সম্মতি জানালো সৌরজিত। সেন্টার টেবিলের দুপাশে দুজনে মুখোমুখি বসার পর মুখার্জি ‘লাইটার টা কোথায় গেল, খুঁজে পাচ্ছিনা কেন! এখানেই তো ছিল’ বলে একবার ভেতরে গেলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে দেশলাই বাক্স নিয়ে ঘরে এসে, একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন – ‘সাদা তোমার।’
গজের সামনের বোড়ে দু-ঘর এগিয়ে দিল সৌরজিত।
দু সেকেন্ড চুপ থেকে মুখার্জি নিজের কালো সৈন্যের মন্ত্রীর সামনের বোড়ে আর তার সঙ্গে ঘোড়ার সামনের আরো একটা বোড়ে একঘর করে এগিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলেন – ‘কেসটা কি জটিল? তোমার ওপেনিং মুভ তো এরকম ছিলোনা আগে।’
‘তা তো একটু বটেই, নাহলে আপনার কাছে আসা কেন!’ অন্য বোড়ে কে সামনে একঘর এগিয়ে উত্তর দিলো সৌরজিত।
‘তা, আমার কাছেই কেন?’ নিজের অপর ঘোড়া কেও সামনে এগিয়ে দিলেন মুখার্জি।
– ‘আপনি স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আজও সি.বি.আই তে আপনার বুদ্ধির এবং কর্মক্ষমতার গুণগান-ই গাওয়া হয় মুখার্জিদা। আমি নিজেও আপনাকে কিরকম শ্রদ্ধা করি আপনি জানেন।’
– ‘বুঝলাম, সেই জন্য কি ডিফেন্সিভ খেলছ?’ সৌরজিতের চালের পরে নিজের ঘোড়া এগিয়ে মুখার্জি যোগ করলেন ‘তা কেসটা কি বলো।’
– ‘একটা খুন।’ বোর্ড থেকে মুখ না সরিয়ে নিজের চাল চেলে সৌরজিত বলে চলল ‘রাসবিহারীতে। নাম সরফরাজ। বড়বাজারে কাপড়ের দোকান। খুনটা হয়েছে গত শুক্রবার। যখন জানাজানি হয় তখন দেখা যায় চেয়ারে বসা অবস্থায় হাত পেছন দিক করে বাঁধা, শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।’
বোড়ে এক ধাপ এগিয়ে মুখার্জিদা বললেন – ‘মার্ডার ওয়েপন?’
সৌরজিত নিজের বোড়ে এগিয়ে বলল ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে রক্তের মধ্যে লিকুইড সায়ানাইড ইনজেক্ট করা হয়েছে।’
মুখার্জিদা শুধু মুখ দিয়ে ‘হুম’ শব্দ করলেন।
চুরুটে এক টান মেরে বললেন – ‘সায়ানাইড। রক্তে মিশে থায়োসায়ানেট তৈরি করে, আর অতিরিক্ত থায়োসায়ানেট ব্লাড-সেলে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে মানুষের শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হুমম, আচ্ছা, সরফরাজের বাড়িতে আর কে কে থাকতো? কোনও ক্লু, কোনও সাসপেক্ট?’
– ‘না। সরফরাজ একা থাকতো।’
সৌরজিত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু ওকে থামতে হলো কারণ ভেতর থেকে বছর কুড়ির এক ছেলে এসে দু কাপ কফি রেখে আবার ভেতরে চলে গেলো। সৌরজিত ভেতরের ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল – ‘একে তো দেখিনি আগে।’
মুখার্জি নিজের চেয়ার থেকে উঠে একটা বই-এর আলমারির ওপর থেকে ash-tray নিয়ে ফেরত আসতে আসতে বললেন – ‘আমার গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশীর ছেলে। এখানে কলেজে পড়তে এসেছে, থাকার আলাদা ব্যবস্থা হয়নি, তাই আমার সঙ্গে থাকে।’ মুখার্জি ash-tray টা কফি কাপের পাশে রেখে, তাতে চুরুটের ছাই ফেলে আবার নিজের জায়গাতে বসলেন।
সৌরজিত কফিতে এক চুমুক মেরে বললো – ‘নিন , আপনার চাল।’
মুখার্জি নিজের মন্ত্ৰী তিন ধাপ এগিয়ে বললেন – ‘ওই ফ্ল্যাটের সি.সি.টি.ভি ফুটেজ আছে?’
– ‘না। সিসিটিভি নেই। তবে, ওয়াচম্যান বলেছে খুনের দিন সকালে ওনার সঙ্গে দুজন দেখা করতে এসেছিল। একজনের খোঁজ পাওয়া গেছে, এবং প্রমাণস্বরূপ উনি নির্দোষ। অন্য ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায়নি। রেজিস্টারে লেখা ফোন নাম্বারও ভুল। সুতরাং, ধরে নেওয়া যায় ওই দ্বিতীয় ব্যক্তিই খুনি।’
মুখার্জি কতক গম্ভীর হয়ে নিজের বোড়ে সৌরজিতের সাদা ঘোড়ার কোনাকুনি রেখে, কফির কাপ হাতে তুলে নিলেন, জিগ্যেস করলেন – ‘ওই দ্বিতীয় ব্যক্তির বর্ণনা!’
সৌরজিত কফিতে আরো এক চুমুক দিয়ে – ‘ওয়াচম্যান বলছে , ইসলাম ধর্মীয়। মুখভর্তি দাড়ি, পরনে আলখাল্লা, অনেকটা মৌলবী বাবাদের মতো চেহারা।’ একটু থেমে বললো – ‘কিন্তু সেই বাবাকে বেরোতে দেখেনি ওয়াচম্যান।’
মুখার্জি বললেন – ‘ছদ্মবেশ। কিন্তু কেন? কে এই লোক? তুমি কোনোরকম ক্লু পাওনি?’
সৌরজিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়লো।
সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতায় আরো দুটো চাল খেললেন দুজনে। সৌরজিত বোর্ডের E6 পজিশনে মুখার্জির কালো বোড়ে কাটল নিজের সাদা বোড়ে দিয়ে। মুখার্জিও পরের চালে নিজের কালো বোড়ে দিয়ে B5 এর সাদা ঘোড়া কাটলেন। সৌরজিত বলল – ‘ব্যক্তিটি, খুনি হোন বা না হোন, সন্দেহের পাত্র তো বটেই। এবং উনি হিন্দু।’
মুখার্জি – ‘কিভাবে?’
সৌরজিত – ‘সময়টা ছিল দুপুরবেলা, সরফরাজ তখন নামাজ পড়ছিল বা নামাজ পড়বার উপক্রম করেছিল। সরফরাজের প্রার্থনার আসন, অর্থাৎ জা নিমাজ তখনও পড়েছিল মেঝেতেই। যদি, ওই দ্বিতীয় ব্যক্তি কট্টর ইসলাম ধর্মী হন, তাহলে তারও ওই সময় নামাজ পড়বার কথা।’
– ‘হিন্দু কেন! ইসলাম ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্ম হতে পারে ইন্সপেক্টর ঘোষ।’
‘তা হয়তো পারে। কিন্তু, সরফরাজের ঠোঁটের বাঁ দিকটা কাটা ছিল। সম্ভবত কোনো সবল ব্যক্তি সজোরে ঘুষি মারার ফলেই এটা ঘটেছে। এবং, ভালো করে দেখলে বোঝা যায় যে হাতে এই ঘুষি মারা হয়েছে, তাতে আংটি ছিল। এই দেখুন।’ এই বলে সৌরজিত পকেট থেকে ফোন বের করে সেটায় একটা ফটো খুলে মুখার্জির দিকে এগিয়ে দিল।
মুখার্জি মন দিয়ে ফটো দেখতে দেখতে বললেন – ‘হয় খুনি বেশ লম্বা। নাহয়, ঘুষিটা চেয়ারে বসা অবস্থায় মারা হয়েছে।’
– ‘আমারও সেটাই মনে হচ্ছিল। এখন সিওর হলাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন, এই সরফরাজকে ঘুষি মারা হলো, আর ও কি বাধা দিলোনা! এ তো সম্ভব নয়। আর, খুনি খুব বেশি লম্বা নয়, অন্তত ওই দ্বিতীয় ব্যক্তির যা বর্ণনা শুনলাম। আর সরফরাজের উচ্চতা ছিল ছয় ফুট এক ইঞ্চি।’
মুখার্জি – ‘সঙ্গে কি তাহলে আরও কেউ ছিল, যে খুনি কে সাহায্য করেছে সরফরাজকে চেয়ারে বাঁধার জন্য!’ চুরুটে টান মেরে মুখার্জি বলে চললেন ‘নাকি, চেয়ারে বাঁধার আগেই সরফরাজ কে অজ্ঞান করা হয়েছে!’
সৌরজিত মুখার্জির দিকে তাকিয়ে থেকে , একটু হেসে যোগ করলো- ‘এই জন্যই আপনার কাছে আসা। পরের ছবিতে যান। ডান দিকে স্লাইড করুন।’
মুখার্জি – ‘করলাম।’
সৌরজিত কফিতে শেষ চুমুক মেরে বলল – ‘ঘাড়ের কাছে ছোট স্পটটা দেখতে পাচ্ছেন?’
মুখার্জি চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে সেল-ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন – ‘অর্থাৎ, কিছু একটা দিয়ে পেছন থেকে এসে সরফরাজের ঘাড়ের পেছনে ইনজেক্ট করা হয়েছে। তারপর সরফরাজ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় তার শরীর টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে হাত পা বাঁধা হয়েছে।’
সৌরজিত হাত বাড়িয়ে মুখার্জির থেকে ফোনটা নিয়ে বলল – ‘রাইট। আমার বিশ্বাস সরফরাজের নামাজের সময়েই পেছন থেকে এসে ইনজেক্ট করা হয়েছে।’
দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আরো একবার চুরুট টেনে মুখার্জি বললেন – ‘সৌরজিত তুমি কিন্তু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ।’ এই বলে তিনি নিজের কালো ঘোড়া দিয়ে সৌরজিতের সাদা বোড়ে কাটলেন।
সৌরজিত হেসে বললো – ‘এবারই তো মন দিতে পারছি।’
মুখার্জি ওর দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘ক্লু পেলে?’
সৌরজিত নিজের সাদা মন্ত্রী দিয়ে কালো বোড়ে কেটে বলল – ‘অন্ধকার কিছুটা কাটছে। খুনি সরফরাজের খুব চেনা কেউ। যখন খুনি সরফরাজের বাড়ি গেল, তখন সরফরাজের নামাজ পড়বার সময়। এটা খুনি জানতো। সরফরাজ তাই ওই পরিচিতকে বসতে বলে নামাজ পড়তে যায়। এবং তখন, খুনি পেছন দিক দিয়ে এসে ঘাড়ে লিকুইড সায়ানাইড ইনজেক্ট করে। সায়ানাইড রক্তে মিশতে সময় নেয়, এবং তার মধ্যে খুনি ওকে চেয়ারে বেঁধে হয়তো কিছু প্রশ্ন করে। হয়তো কিছু জানাবার ছিল খুনির। তখনই ওকে ঘুষি মারা হয়।’
মুখার্জি শুধু ‘হুম’ বলে দাবার বোর্ডে মনোসংযোগ করলেন। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ চাল বদল করলেন। মুখার্জি কালো ঘোড়া দিয়ে E4 পজিশনে সাদা গজ কাটলেন। পরক্ষনেই সৌরজিত সাদা মন্ত্রী দিয়ে B6 পজিশনে কালো বোড়ে কাটলো।
মুখার্জি সৌরজিতের দিকে না তাকিয়েই জিগ্যেস করলেন – ‘সরফরাজের বাড়ি কোথায়? বাড়ির লোকজন ট্রেস করা গেছে? বা কোনো কাগজপত্র পাওয়া গেছে? আইডেন্টিটি প্রুফ!’
সৌরজিত বললো – ‘প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স সবকিছুতে রাসবিহারী ফ্ল্যাটের ঠিকানা। যতজন পরিচিত ট্রেস করা গেছে, সবার কাছে জানা গেছে সরফরাজের বাড়ি লখনৌ। কিন্ত এর বেশি কেউ কিছু জানেনা।’
মুখার্জি দু-সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন – ‘বাড়ি লখনৌ, আইডেন্টিটি কার্ডে ঠিকানা কলকাতার। সুতরাং, গন্ডগোল। হয়, আসল পরিচয় গোপন করা, নাহয় লখনৌ-এর কথা বানিয়ে বলা।’ একটু থেমে চুরুটে একটা টান মেরে যোগ করলেন – ‘আমার মন বলছে সরফরাজের আধার কার্ড, প্যান কার্ড-ও ডুপ্লিকেট।’
সৌরজিত – ‘কি করে? এবং কেন? মোটিভ কি?’
-‘এসপিওনাজ বোঝ ঘোষ? আই বিলিভ, ইটস এ কেস অফ এসপিওনাজ।’
– ‘আপনি সিওর হচ্ছেন কি করে? এত কম এভিডেন্স।’
– ‘সরফরাজের সব কন্ট্যাক্ট খুঁটিয়ে দেখ। এভিডেন্স কিছু না কিছু পাবেই। ওর ফ্ল্যাটে সন্দেহজনক কিছু পাওনি বলছো?’
সাদা মন্ত্রী দিয়ে কালো ঘোড়া কেটে সৌরজিত মুখার্জির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল – ‘পেয়েছি। আঙুলের ছাপ এবং প্রেডিকশান।’
মুখার্জি সৌরজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘ব্র্যাভো ইয়ং ম্যান। আমি আশা করি, তুমি খুনিকে খুঁজে বের করবে।’
‘আমিও তাই আশা করি।’ তৎক্ষণাৎ উত্তর সৌরজিতের।
মুখার্জি দাবার বোর্ডের দিকে দেখে মুখে হাসি এনে ‘কিন্তু আজ আবার তোমার পরাজয়ের পালা’ বলে কালো মন্ত্রী দিয়ে E2 পজিশনে সাদা বোড়ে কেটে, চুরুটটা ash-tray তে নিভিয়ে সৌরজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘চেক, এন্ড মেট মাই ফ্রেন্ড।’
সৌরজিত শুষ্ক হাসি হেসে ‘ওয়েল প্লেড মুখার্জিদা, আজ আমি উঠি’ বলে উঠে পড়লো।
মুখার্জি-ও উঠে পড়ে ওকে দরজা অব্দি ছাড়তে এগিয়ে বললেন – ‘আঙুলের ছাপ থেকে তুমি নিশ্চয়ই কিছু লিংক পাবে। তবু, একবার খুঁটিয়ে দেখতে পারো এসপিওনাজ নিয়ে যেটা বললাম। সরফরাজের আসল পরিচয় খুঁজে বের করা দরকার।’
সৌরজিত ‘হুমম’ বলে ঘাড় নেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দু-সেকেন্ড থমকে দাঁড়ালো।
মুখার্জি জিগ্যেস করলেন – ‘কি হলো।’
সৌরজিত ওঁর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল – ‘একটা জিনিস নিয়ে যাচ্ছি।’ এই বলে পকেট থেকে সাবধানে রুমাল দিয়ে ধরে যেটা বের করলো সেটা হলো ওর মুখার্জিদার শখের লাইটার। মুখার্জি অবাক হয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন, কপালের মাঝে ভ্রুকুটি। নিজের অস্বস্তি ঢাকতে কোনোরকমে জোর করে থমথমে মুখে হাসি এনে বললেন – ‘আরে, সে নিয়ে যাও। কিন্তু তুমি তো স্মোক করোনা।’
সৌরজিত সোজাসুজি তাকিয়ে বলল – ‘আমি স্মোক করবওনা। এটা আমি ল্যাবে পাঠাবো। ফিংগার-প্রিন্ট যাচাই করার আছে।’
মুখার্জি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে শান্ত গলায় বললেন – ‘কি বলতে চাইছো তুমি? ওটা আমাকে দাও।’
সৌরজিত একটু পিছিয়ে গিয়ে, কোমরের পেছন থেকে সার্ভিস রিভলভার বের করে ওর মুখার্জিদার দিকে তাক করে শান্ত ভাবে বলল – ‘চেক-মেট মিস্টার মুখার্জি।’
মুখার্জি কিছুক্ষন চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন – ‘তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?’
সৌরজিত রিভলভার তাক করা অবস্থাতেই বলল – ‘আমার প্রথম সন্দেহ হয় যখন আমি সরফরাজের প্রতিবেশীর ফোনে একটা ফটো দেখেছিলাম। প্রতিবেশীর ছেলের জন্মদিন ছিল। একটা মাত্র ফটোতে এক কোনায় আপনি ফ্রেমের মধ্যে চলে এসেছিলেন। প্রতিবেশী বলেছিলেন যে, সেদিন সন্ধ্যেবেলা যখন সরফরাজকে উনি ইনভাইট করতে গেছিলেন, সেখানে আপনিও উপস্থিত ছিলেন। তাই উনি আপনাদের দুজনকেই ওনার বাড়িতে কিছুটা জোর করেই নিয়ে এসেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, সরফরাজের ফোন থেকে মেসেজ আর কল লিস্ট চেক করে আমরা একটাই মাত্র সন্দেহজনক মেসেজ পাই। ‘Bring package X. See you at park street CCD.’ নাম্বারটা বেনামে নেওয়া হয়েছিল, এবং এখন সেটা ব্যবহার-ও হয়না, সুতরাং, ধরে নেওয়াই যায় যে শুধুমাত্র কার্যসিদ্ধির জন্যই ওই নাম্বারটা নেওয়া হয়েছিল।’ একনাগাড়ে কথা গুলো বলে , লাইটারটা পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে সৌরজিত বলে চলল – ‘যাই হোক, সেই তারিখের ওই সিসিডি আউটলেটের সিসিটিভি ফুটেজে যে আমি আপনাকে আর সরফরাজকে একসাথে দেখেছি মুখার্জিদা। এরপর আমার সন্দেহ হওয়া শুরু হলো আপনার ওপর। আমি আপনার পেছনে লোক লাগিয়েছিলাম। খুনটা হলো শুক্রবার, আর আজ সকালে আপনি একটা প্যাকেট কুরিয়ার করতে গেছিলেন। আপনি জানতেও পারেননি আপনার পেছনে পুলিশের লোক লেগেছে। তাই, যে প্যাকেট আপনি কুরিয়ার করতে গেছিলেন সেটা কুরিয়ার কোম্পানি থেকে হাতে পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। আর তার ভেতরের ডকুমেন্ট দেখার পরে এটা তো বুঝতে কারুর অসুবিধে হবার কথা নয় যে খুনটা হয় আপনি নিজে করেছেন, না হয় করিয়েছেন। আপনি কি অস্বীকার করবেন মুখার্জিদা?’
মুখার্জি আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝের দিকে মুখ নামিয়ে গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করলেন – ‘সবটা যখন জানতে, আগেই বলোনি কেন?’ সৌরজিত বলে চলল – ‘একটু বাজিয়ে দেখছিলাম। আপনার থেকেই যে শেখা দাদা। ওই মেসেজটা ফোনে না থাকলে আমার পক্ষে আপনাকে সন্দেহ করা সম্ভব হতোনা। কিন্তু, আপনি বেনামে ইন্টেলিজেন্স বিউরো-তে সরফরাজের ব্যাপারে সব ডকুমেন্ট কুরিয়ার করছিলেন! আপনি কি করেন মুখার্জিদা, সব খুলে বলুন। চালাকির চেষ্টা করবেননা। নীচে আরও পুলিশ অপেক্ষা করছে, আপনার নামে আরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে আমার কাছে।’
মুখার্জি মুখ নিচু অবস্থায় চোয়াল শক্ত করেই বললেন – ‘শাবাশ তপসে।’
– ‘আপনার থেকে শোনার পালা মুখার্জিদা। এটা কেন করলেন?’
মুখার্জি একটু চুপ থেকে সোফাতে বসে পড়লেন। টিশার্ট দিয়ে চশমার কাচ মুছে চশমাটা আবার পরে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন – ‘আমি যেটা করেছি সেটা আইনের চোখে অবশ্যই দোষের, জানি। কিন্তু, আমি সিবিআই থেকে অবসর নিয়েছিলাম একটা সংকল্প নিয়ে।’ একটু থেমে যোগ করলেন – ‘আমার একটা সংগঠন আছে। সেটা সরকারি মদতপুষ্ট নয়। ইন্ডিপেনডেন্ট। সেখানে আমি ছাড়াও আরো কয়েকজন আছে। সেই সংগঠন কিরকম, তারা কি কাজ করে, কিভাবে কাজ করে সেটা আমি তোমাকে বলতে পারবোনা, আর তুমি জানতেও পারবেনা। তবে, আমরা যা করি বা করেছি, মানে এই সরফরাজের ঘটনা, সেটা দেশের সিকিউরিটির কথা ভেবেই করেছি। সরফরাজ একজন বিদেশি স্পাই। সেটা আমি জানতে পেরেছি। তোমরা পেরেছো? অন্য কেউ পেরেছে? অবশ্য সরকারকে সবসময় দোষ দেওয়া যায়না। কিছু কাজ তো জনগণকেও করতে হয়। তাই, আমি আলাপ করি সরফরাজের সঙ্গে। তারজন্য অবশ্য আমাকে একজন দেশদ্রোহীও হতে হয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। যাই হোক, সরফরাজের ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য, আমি বা আমার সংগঠন যা পেয়েছি সেটাই আমি আই.বি তে কুরিয়ার করতে গেছিলাম, সেটা তো তুমি বুঝেই গেছো। এখন সেই সব ডকুমেন্ট তোমার কাছে। তুমি ভালো জানো, সেসবের কি করা উচিত।’
– ‘কিন্তু আপনি এটা করলেন কেন? এই কাজের দায়িত্ব তো আপনাকে দেওয়া হয়নি। আর ফ্ল্যাটে গেলেন ছদ্মবেশে, কিন্তু সরফরাজের সঙ্গে তো নিশ্চয়ই ছদ্মবেশে দেখা করেননি। পোশাক পাল্টালেন কোথায়?’ সৌরজিত উত্তেজিত হয়ে জিগ্যেস করলো।
একটা প্রাণখোলা হাসি হেসে মুখার্জি বললেন – ‘আমি বললাম যে, আমার সংগঠন। খুনের দিন আমি একা ওই ফ্ল্যাটে গেছিলাম সেটা তোমায় কে বলেছে ঘোষ! তবে, খুনটা আমিই করেছি। লাইটারের ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচ করে যাবে। ভালো থেকো ঘোষ। গুড বাই।’ এই বলে মুহূর্তের মধ্যে নিজের জগার্সের পকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করে নিজের ঘাড়ে ইনজেক্ট করলেন উনি। ছয়-সাত ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সৌরজিত কিছু বোঝার আগেই দেখল সোফার গায়ে ওর মুখার্জিদার শরীরটা এলিয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো ও, কিন্তু ততক্ষণে হাই ডেন্সিটি হাইড্রোজেন সায়ানাইড মুখার্জির রক্তে মিশতে শুরু করে দিয়েছে। সৌরজিত পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে বলল – ‘এম্বুলেন্স। তাড়াতাড়ি। মুখার্জিদার ফ্ল্যাট।’
ফোন রেখে ওর মুখার্জিদার পাশে মেঝেতে বসে হাতটা নিয়ে দেখলো পাল্স রেট খুব কম। সৌরজিত হাতটা ছেড়ে দিয়ে এক হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
The End