ঠকঠক করে দরজায় দুবার টোকা পড়লো। রামু কাকা এসেছে। অনিমেষের বাড়িতে প্রায় বিশ বছর ধরে কাজ করছে এই রামুকাকা। সকালের ঘুমটা রামুকাকার বেড টি ছাড়া তার ভাঙে না। অর্থাৎ তাকে একরকমের ঘুম তাড়ানোর ওঝা বলা যেতে পারে। সকালের খবরের কাগজটাও তার হাত থেকেই প্রথম পায় অনিমেষ সেদিনেও বিকল্প কিছু ঘটেনি। তবে খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজের ছবিটা দেখেই অনিমেষের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। নিউজটা দেখেই অনিমেষের মুখ থেকে একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল। একটি পঁচিশ বছরের মেয়েকে হাত, পা কেটে খুন করা হয়েছে; এমনকি তার ধর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া মাথাটা বডির আশেপাশে কোথাও পাওয়া যায়নি। ২৫ বছরের সেই মেয়েটির নাম হলো দেবলীনা। অনিমেষ তার চোখের জল মোছার জন্য রুমাল খুঁজতে যাবে, এমন সময় অখিলেশের আবির্ভাব ঘটল। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা অখিলেশ, অনিমেষের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। “ এ কীরে, খবরের কাগজটা এভাবে মেঝেতে ফেলে রেখেছিস কেন? আর তোর চোখে জল কেন?”অখিলেশ হতভম্ব হয়ে বলল। অনিমেষ বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “আজকের খবরটা পড়েছিস? খুনের খবরটা?
অখিলেশ কি যেন একটা ভেবে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, সে আর না পড়ার কি আছে। খুনটা একটু নৃশংস, এটাই যা দুঃখের”।
পরমুহূর্তে সে আবার প্রশ্ন করল, “তুই এতটা আপসেট কেন?”
চোখের জল মুছে অনিমেষ বলল, “আপসেট হতাম না, যদি নামটার জায়গায় দেবলীনা না থাকত”।
“এই দেবলীনা কে?” অখিলেশের এ প্রশ্ন তাকে একটু ভাবিয়ে তুলল।
সে একটা কানের দুল দেখতে দেখতে বলল, “তোকে বলিনি ওর কথা?”
অখিলেশের উত্তর এল, “না”। “কে এই মেয়েটা?” অখিলেশের ভ্রূরু কুঁচকে এল।
“আচ্ছা, তবে শোন পুরো গল্পটা”। অনিমেষ তাকে সমস্ত গল্পটা বলতে আরম্ভ করল।
“ তোকে আজ যা বলব সেটা নিছক একটা গল্প নয়, একটা স্বপ্ন। আমার বয়স তখন তেরো। তখন প্রতি সপ্তাহে আমি ড্রয়িং ক্লাসে যেতাম। সেখানেই আলাপ। তার সরল হাসির ছলকানি আমার মনকে এক অদ্ভুত আনন্দ দিত। তার শরীরে দুশো ছয়টি হাড় ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হত না। ভগবান যেন তার মন গড়তে গড়তে হাড়ের উপর প্রলেপ দিতে ভুলেই গেছেন। কিন্তু যেটা দিয়েছে সেটা বড়ই সুন্দর; তা হল তার হাসি। একটা বছর প্রায় সংকোচের মধ্যে দিয়েই কেটেছে। তারপর ধীরলয়ে সম্পর্কের ভিতটা মজবুত হতে লাগল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো থেকে শুরু করে উপহার আদান-প্রদান সবই চলত। বছরগুলো চলে যেতে লাগল। মানসিক, শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে ভাবনাগুলোও পরিবর্তন হতে লাগল। সে আমার এই বেসুরো জীবনে সুরের পাখি হয়ে এসেছিল। কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা কিছু প্রশ্নের ভার নিয়ে একদিন হটকারিতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে, সে আমার সঙ্গী হবে কিনা। প্রথমটা না বুঝতে পারলেও, পরে সে অবশ্য সন্মতি দিয়েছিল।
যাই হোক, তিনটি বছর তিনটি ভাষায় তিনটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের কেটেছিল। দেখতে দেখতে চারটে বছর কেটে গেল। ড্রয়িং এর ক্লাস পড়ার চাপে বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। দেবলীনা একটাও খবর নেয়নি। আমি তাই একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে তাকে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম যে, তার নতুন কোনও সঙ্গী হয়েছে কিনা। হ্যাঁ উত্তরটা শুনে আমি ফোনটা কেটে দিলাম। আমার সামনে থাকা ডায়রিটার খুলে রাখা পাতা নোনা জলে ভিজে নীল কালিতে লেখা অক্ষরগুলো ফুটে উঠল। এরপরে নতুন সঙ্গীর নামটাও জেনেছিলাম; সৌরিক সেন। আমি কোনোদিনই ত্রিকোণ প্রেমের সদস্য হতে চাইনি। আমি তাকে শেষবারেরে মতো একটাই কথা বলেছিলাম যে, আমি তাদের মাঝে কোনদিন বাঁধা হবো না। আমি চেয়েছি তার ঠোঁটে যেন কোনোদিন হাসির অভাব না হয়। এখন তার দেয়া উপহারগুলো তার অস্তিত্বের ভার বহন করছে,” অনিমেষ একনাগারে বলে গেল।
তার চোখ থেকে একফোঁটা জল সামনে থাকা চায়ের উপর পড়লো। অখিলেশ মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, বুঝলাম”।
বিষাদগ্রস্থ চোখ নিয়ে অনিমেষ বলল, “এই হল আমার চার বছরের স্বপ্নের কথা”।
“তবে তুই এই মৃত্যুতে বেশ খুশি হয়েছিস, তাই তো?” অখিলেশের এই প্রশ্নটা শুনে এতক্ষণ নত হয়ে থাকা অনিমেষের মাথাটা উঠল।
“তুই পাগল হলি নাকি,”ভ্রূরু কুঁচকে অনিমেষ বলল। “ও যে আমার স্বপ্ন, আর স্বপ্নকে কি কেউ নিজে হাতে ভাঙতে চায়। ওর ক্ষতি আমি কোনোদিন চাইতে পারব না”।
এরপর, অখিলেশের বলে যাওয়া কথাগুলো শোনার জন্য অনিমেষের কান ঠিক প্রস্তুত ছিল না।
“তোর খুশী হওয়ার জন্য এত কিছু করলাম, আর তুই বলছিস……। একটা পোড়ো বাড়ি জোগাড় করে, তারপর তাকে ভাল করে পরিষ্কার করে তোর ওই দেবলীনা্কে নিয়ে এসেছিলাম। তারপর হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে গাছ কাটার যন্ত্র দিয়ে দিলাম সেগুলকে কেটে……। তারপর ভাবলাম সব যখন দেখেই নিয়েছে, তাহলে মাথাটা আর বাদ কেন; দিলাম সেটাকেও উড়িয়ে”। অখিলেশ শয়তানের হাসি হেসে পুরোটা বলল।
“তুই সৌরিক সেনকে না মেরে দেবলিনাকে কেন মারলি?” অনিমেষের কানের পাশে তখন ঘাম জমেছে।
“আমি তোকে মিথ্যা বলেছি। এটা নিয়ে প্রায় বারোবার, তুই আমাকে দেবলিনার কথা বলেছিস। তোর আমার এই বন্ধুত্তের মাঝে বারবার এই একটা মেয়ের গল্প শুনতে একদম ভালো লাগে না। আর তুই তো জানিস, আমার ওই মেয়েদের প্রতি একটু এলারজি টাইপের আছে আর কি। ভাবলাম ওকে মারলে কিছুদিন তুই দুঃখ পেলেও ধীরে ধীরে ভুলে যাবি”। একটু থেমে অখিলেশ আবার বলতে শুরু করল। “এই মেয়েরা বড়ই অদ্ভুত। কখন যে কাকে চায় কিছুই বোঝা যায় না। তাই সৌরিককে ঠোকানোর আগেই আমি গল্পের মূল নায়িকাকে শেষ করে দিলাম”।
অনিমেষ ফোনটা তুলে পুলিশকে কল্ করতে যাবে, এমন সময় তার মাথার পিছনে একটা শক্ত জিনিস ঠেকল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য অখিলেশ ইতিমধ্যেই রিভলভার তাক করেছে। অখিলেশ ধরা গলাতে বলল, “দেখ, আমি বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাই না। তুই প্লিজ পুলিশকে ফোন করিস না। আমি তো শুধু তোর কষ্টটা কমাতে চেয়েছিলাম”।
অনিমেষ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ছুট মারবে বলে বন্দুকটা সরাতে গিয়েই ঘটল যত বিপত্তি। অখিলেশের হাতে থাকা রিভলভারের টিগারটা প্রেস হয়ে গুলি একদম অনিমেষের মাথাতে লাগল। “না………,এ কি হল। আমি তো এটা চাই নি”। অখিলেশের দুহাত তখন মুখের উপর। “ভুল যখন করেছি প্রায়চিত্ত তো করতেই হবে”।
কিছুক্ষণ পরে, রামুকাকা আর এক পর্ব চা দিতে এসে দরজা খুলতেই হাতে থাকা চায়ের ট্রেটা পরে হাত কাঁপতে লাগল। অখিলেশের বুক থেকে ঝরা রক্তমাখা দেহটা অনিমেষের উপর পরে আছে।
সত্যিকারের ভালোবাসাতে থাকে না কোনও প্রতিহিংসা, কোনও প্রতিশোধের আগুন; যা থাকে তা হল একটু যতন আর একসাথে পথচলার গান। পুনর্জন্ম যদি সত্যি হয় তাহলে আমি তাদের পরের জন্মে এক হওয়ার প্রার্থনা করি। দেবলিনাই ছিল অনিমেষের চার বছরের স্বপ্ন।
~ চার বছরের স্বপ্ন ~