কোড নেম প্রমিথিউস
হঠাৎ দেখলাম, পাখিটা উড়ে এসে আমার কাঁধে বসল। বসতেই, একটা অদ্ভুত রকম অনুভূতি টের পেলাম কাঁধের ওপর। যেন, আমার পাশেই একটা গরম চুল্লি রয়েছে, অথচ সেটা দেখতে পাচ্ছি না। তাপটা তীব্র হলেও তাতে কোনও কষ্ট হচ্ছে না আমার। তবে কি পাখিটা থেকেই তাপটা আসছে? কিন্তু, পাখিদের রক্ত গরম হলেও এতটা তো হয় না। ধুর… ওসব মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিলাম।
দেখলাম, পাখিটা উড়ে এসে বসায় জিপসির চোখ মুহূর্তের জন্য কুঁচকে উঠেছিল। কিন্তু যখন আমি কোনও রকম কিছু করলাম না, তখন জিপসির মুখটা হাসিতে ভরে গেল।
সে বলল, “মিস্টার, জাইফনের আপনাকে পছন্দ হয়েছে। জানেন তো, জীবজন্তুরা সবসময় ভাল মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করে। জাইফনও তাই করছে। আপনি ভয় পাবেন না কিন্তু।“
আমার বেশ আনন্দই লাগছিল। আমি পাখিটার মাথায় হাত বোলালাম। বেশ গরম ওর মাথাটা। সেই চুল্লির মত গরম ভাবটা আর নেই। একবার শিসও দিল মাথায় হাত বোলানোর সময়।
আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইতস্তত করে বললাম, “এবার…”
জিপসি হাত নাড়ল। “আমার পয়সা লাগবে না, মিস্টার চৌধুরী। ওসবে আমার প্রয়োজন আর নেই। আর ভাগ্য যদি আপনার সাথ দেয়, তাহলে পাঁচদিন পরেই তোমার সাথে আমার দেখা হবে ঠিক এখানেই। সূর্যোদয়ের ঠিক আগে। বয়স তো যথেষ্ট হল, এবার এই ভবিষ্যৎ দেখায় কয়েকদিনের বিশ্রাম দেওয়ার কথা ভাবছি। ঠিক করেছি, ঐদিনই এখান থেকে চলে যাব। তবে, যাওয়ার আগে তোমার সাথে দেখা হবে, এটাই আমার বিশ্বাস।“
কেন জানি না, নিজে থেকেই আমি হাতটা করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলাম। জিপসি আমার হাতটা ধরল।
আমিও বললাম, “আমারও তাই বিশ্বাস। মেকরি না ডুওমে যানা।“
জিপসি একটু অবাকই হল। আমি অল্প গ্রিক ভাষা শেখার চেষ্টা করছি, এটা বোধহয় ভাবতে পারেনি। গ্রিক ভাষায় কথাটার মানে, “আবার দেখা হবে।“ তারপর হাসতে হাসতে সেও আন্তরিকভাবেই বলল, “মেকরি না ডুওমে যানা।“
জাইফন একটা শিস দিয়ে উঠল। দুরের অস্তমিত সূর্যের আলোয় আকাশ লাল হয়ে উঠেছে।
ফেরার সময় জিপসির মনের কথাগুলোই ভাসছিল। কার কথা বলতে চাইছিল জিপসি? যাকে ফিরে পাবার কথা বলছিল, সে না হয় ঝিনুক। কিন্তু কোন মগ্নমৈনাকের কথা জিপসি বলতে চাইছিল, আর কেই বা তার আঘাত এড়াতে চায়।
রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে আচমকা দেখি, সামনে একটা বড় টিভির শোরুমের সামনে বিশাল ভিড় জমে গেছে। কি মনে হতে এগোলাম কি হচ্ছে দেখার জন্য। ভিড়ের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি এক বীভৎস দৃশ্য। একটা পুরনো বাড়িতে বিশাল বড় আগুন লেগেছে, আর তার মধ্যেই বার বার বিস্ফোরণের শব্দ। লোকজন ছুটে ছুটে পালাচ্ছে, পুলিশ পুরো জায়গাটা কর্ডন করে দিয়েছে, আর দমকলের লোক উঠছে বাড়ির ভেতর। বাড়ির ঠিকানাটা দেখে চমকে উঠলাম, এ তো সেই জায়গা যেখানে আজ স্যার আর সমুদ্র গেছে।
সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রকে ফোন করলাম। জান যায় যাক, ওকে না ফিরিয়ে আনলে কাকু কাকিমার সামনে মুখ দেখাব কেমন করে?
প্রথমবার ফোন ধরল না সমুদ্র। রিং হয়ে হয়েই কেটে গেল। দ্বিতীয়বার রিং ধরল। ওপাশ থেকে “হ্যালো” বলতেই আমি চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “সমুদ্র, তোরা সব ঠিক আছিস তো? টিভিতে দেখাচ্ছে, তোরা যেখানে গিয়েছিলিস, সেখানে বম্ব ব্লাষ্ট হয়েছে মনে হয়। সব ঠিকঠাক আছে?”
সমুদ্র চেঁচিয়েই বলল, “ঠিকঠাকই আছি সব। ফোন রাখ। বাড়ি গিয়ে কথা বলছি। তুই ইমিডিয়েটলি বাড়ি যা। গিয়ে বর্ণালীকে বোঝা। নয়ত মেয়েটা বিশাল সিন ক্রিয়েট করবে।“
ফোনটা কেটে গেল। বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটা লাগালাম। বলা বাহুল্য, সমুদ্রর আশঙ্কাই ঠিক। এর মধ্যেই ক্রিস আর বর্ণালী ফিরে এসেছিল। আর যেই ওরা টিভি চালিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই ওরা দেখে ঐ পুরনো বাড়িতে বিস্ফোরণের খবর। বর্ণালীকে তখন সামলানো যাচ্ছিল না। ওরা প্রায় বেরিয়েই আসছিল গাড়ি ধরে স্পটে আসার জন্য, আমি গিয়ে পৌঁছতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না তার। অনেক কষ্টে ওকে থামালাম। সমুদ্রের সাথে ফোনে যা কথা হয়েছে, খুলে বললাম। তাও আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না বলে, সমুদ্রকে আবার ফোন করিয়ে কথা বলালাম ওর সাথে। তখন শান্ত হল ও।
তিন চার ঘণ্টা পর সমুদ্র আর স্যার ফিরলেন অ্যাম্বুলেন্সে করে। স্যারের মাথায় বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা। অ্যাম্বুলেন্সের লোকগুলো এসে শুইয়ে দিয়ে গেল ওনাকে ওনার ঘরের বিছানায়।
কেন ওনার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, জিজ্ঞেস করাতে সমুদ্র বলল, “বোমা ফাটার সাথে সাথে স্প্লিনটার ছিটকায়, সেটাই মাথায় লেগেছে।“
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আর ঝিনুক?”
সমুদ্র বলল, “জাস্ট নিখোঁজ। স্পটে কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।“
বর্ণালী বলল, “কি হয়েছিল, খুলে বলবি?”
সমুদ্র বলল, “বলছি, আগে এক গ্লাস জল দে।“
যেহেতু, ক্রিস আর জুলিয়াস আমাদের সাথেই বসে ছিল, তাই আমাদের কথাবার্তা ইংরাজিতেই হল।
জল খেয়ে সমুদ্র বলল, “আসলে পুলিশের স্পাই খবর দিয়েছিল যে আজ সকালেও ঐ মেয়েটাকে দেখা গেছে ঐ বাড়িতে। তাই পুলিশ বিশাল রেইড করেছিল। এবার পুলিশের দেখা পেতেই কিডন্যাপাররা গুলি চালাতে শুরু করে। গুলির আঘাতে পুলিশবাহিনীর পাঁচ-ছয়জন বেশ ভাল রকমই জখম হয়। বেশ ভালই গুলি বিনিময় চলছিল, কিন্তু অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে এবার র্যাফ চলে আসে স্পটে।
লাস্টে ওদের পাঁচজনকে মেরে দিয়েছিল পুলিশ। শুধু একজন বেঁচে ছিল, কিন্তু তার অবস্থা এতটাই আশঙ্কাজনক ছিল যে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও সময় দিত না। তাই তার ওখানেই মৃত্যুকালীন জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছিল। আর স্যার তখন ঢুকেছিলেন বাড়িতে উইটনেস হিসাবে, সাথে ডিসিপি আর কয়েকজন বড় অফিসার ছিলেন। আমিও ছিলাম সাথে।“
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “লোকটা কি বলল যে ও কার হয়ে কাজ করছে? বা ওর মোডাস অপারেণ্ডি কি?”
“হ্যাঁ।“ সমুদ্র হিমশীতল কণ্ঠে উত্তরটা দিল। “হাইনরিখ হাইন বলে একজন ওদেরকে ভাড়া করেছিল। ওরা আসলে ভাড়াটে মার্সিনারি। বর্ডারে থাকা জঙ্গিগোষ্ঠীদের সাথেও ওদের যোগাযোগ আছে। তাই এত অস্ত্রশস্ত্র ছিল ওদের কাছে। ওদের কাজ ছিল ঝিনুককে কিডন্যাপ করে একটা দ্বীপের কাছে ছেড়ে দিয়ে আসা। দ্বীপটা এখান থেকে বেশ দূরে। অ্যান্টিকাইরারও দক্ষিণ পশ্চিমে। কিন্তু ঠিক লোকেশনটা লোকটা কিছুতেই বলল না। লোকটার কথামত, বাকিটা হাইনরিখই সামলে নিত ওখান থেকে।“
“কিন্তু হাইনরিখ তো জেলে। কি করে ছাড়া পেয়েছে সে?” আমি প্রায় হতভম্ব। ঘরে বাকিদের অবস্থাও আমার থেকে খুব ভালো নয়। শুধু জুলিয়াসই শান্ত হয়ে বসে আছে। ভাবলেশহীন সেই মুখে শুধু ঝড় ওঠার আগের পূর্বাভাস।
“ছাড়া পায়নি, তবে জেল ভেঙ্গে বেরিয়েছে।“ জুলিয়াস কাটাকাটা স্বরে উত্তরটা দেয়।
আমরা তিনজনেই অবাক হয়ে যাই। এই কথাটা তো জুলিয়াস আমাদেরকে বলেনি। আমি তখন জুলিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি অবিশ্বাসের সাথে, “তুমি জানতে?”
“জানব না? স্যারের জীবনটা তো ঐ ছারখার করে দিয়েছে। স্যারের যে প্রথম মেয়ে, তাকে তো ঐ রাসকেলটাই খুন করেছে। ঐ জন্যই তো ম্যাডাম আর এই জগতে নেই।“ জুলিয়াস উত্তেজিত হয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু শরীর দুর্বল থাকার জন্য সে চেয়ারে থপ করে বসে পড়ে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “স্যার জানতেন?”
“হ্যাঁ, উনি জানতেন।“ জুলিয়াস হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দেয়। “উনি খবর রাখতেন ওই জানোয়ারটার। দুবছর আগে যখন জেল ভেঙ্গে পালাল হাইনরিখ, ওনাকে ফোন করে আমিই জানিয়েছিলাম। সেটা জানতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে উনি এখানে চলে এলেন তোমাদের দেশ থেকে।
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৮) ~