কোড নেম প্রমিথিউস
ডানা আর লেজের পালকগুলো লাল, ঝুঁটিটাও লাল, কিন্তু গলা আর পেটের পালকগুলো আগুনরাঙা হলদে। হয়ত কোনও প্রজাতির ফেজান্ট( মুরগি জাতীয় পাখি) হবে, ওরকম করে রেখেছে খাঁচার মধ্যে।
যেটা আমার সবথেকে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করল, সেটা হল, জিপসিকে ঘিরে বেশ বড় একটা জটলা তৈরি হয়েছে। একটু কৌতূহলীই হলাম। ভিড়ের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করতে তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে যা বললেন, তার মানে হল, এই জিপসি একজন ভবিষ্যদ্বক্তা। শুধুমাত্র হাত ধরেই উনি বলে দিতে পারেন আগামী তিন দিনে কি কি হতে চলেছে কারোর জীবনে। উনি সবসময় এখানে থাকেন না। মাঝে মাঝেই আসেন, আর চলে যান মাসখানেকের মধ্যেই। এবারে আসতে উনি একটু দেরি করে ফেলেছেন, তাই লোকের এত ভিড়।
আমি চিরকালই এসব বুজ্রুকিতে অবিশ্বাসী। কারন এই ধরনের ভদ্রলোকদের অধিকাংশই সস্তা উপার্জনের জন্য ভণ্ডামি করেন। অন্তত আমি একজনকেও দেখিনি যিনি সঠিকভাবে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। একবার একজন আমার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, যে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী হব। মনে আছে, সেদিন বাড়ি আসা অবধি সারা রাস্তা ঐ কথাটা মনে পড়লেই প্রাণ খুলে হাসছিলাম।
আমি তাই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলাম। আমার চারপাশের লোকজন হয়ত একটু রেগেই গেল হয়ত, কিন্তু আমার ওতে অতটা ভ্রূক্ষেপ নেই। জিপসি তখন সবে একজনকে দেখে আড়মোড়া ভাঙছেন। তারপর আমাকে দেখেই ভাঙা গলায় ইংরাজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “বিদেশি?”
আমি মাথা নাড়লাম। আচমকাই দেখলাম, জিপসির চোখদুটো আমার ওপরেই নিবদ্ধ। পূর্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে যেন। মিনিটখানেক এভাবেই আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর দেখলাম, জিপসির মুখে এক রহস্যময় হাসি। তারপর সে গম্ভীরভাবে সবাইকে বলল, “আজ আর কারোর ভবিষ্যৎ দেখব না। জিউসের নামে, তোমরা এখন আসতে পার।“ পুরো ভিড়টার মধ্যে একটা আলোড়ন উঠল, কিন্তু, জিপসির হাতের একটা ইশারাতেই সেটা থেমে গেল। তারপর ভিড়টা আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে শুরু করল।
আমিও উঠে আসছিলাম, কিন্তু বুড়ো জিপসি আমার ডানহাতটা খপ করে ধরে নিল। বুড়ো হলে কি হবে, যা আন্দাজ করেছিলাম, জিপসির শক্তি একটুকুও কমেনি বয়সের ভারে। তারপর আমাকে ইশারা করল তার সামনে বসার জন্য।
আমি জিপসির সামনে রাখা পাতা মাদুরটার ওপর বসলাম। আদতে সেটা কতগুলো ছেঁড়া কাপড়কে জোড়াতালি দিয়ে মাদুর বানাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাও তাতে বসলাম আমি। জিপসি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার নীল চোখদুটো যেন আমাকে অতিক্রম করে আমার ভবিষ্যৎ দেখছে বলে মনে হল আমার। এই প্রথম একটা গা ছমছমে ভাব লাগছিল।
জিপসিই প্রথম মুখ খুলল। “কি ভাই, মনে হচ্ছে তুমি আমার ব্যাপারে যা যা শুনেছ, সেগুলো বিশ্বাস কর না।“
আমি বললাম, “না করার যথেষ্ট কারন আছে। মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, কারন ভবিষ্যৎ কখনোই স্থির নয়। অনেক সিদ্ধান্তের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত সেটা। সেখানে একটা সিদ্ধান্ত যথেষ্ট ভবিষ্যৎ পুরো পাল্টে দেবার জন্য।“
জিপসি হাহা করে হেসে উঠল। ড্রাইভের রাস্তায় সেই সময় লোকজনও সেই সময় অনেক কমে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছিল। রাস্তার ধারের লাইটগুলো এক এক করে জ্বলতে শুরু করেছে। একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
তারপর জিপসি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, “বাহ। তোমার ব্যাখাটা চমৎকার। এটা সত্যি, যে একটা সামান্য ঘটনাই বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে আগামীর ওপর। কিন্তু…” একটু ঝুঁকে পড়ল সে আমার ওপর, কথাগুলোও ফিসফিসে হয়ে এল ওর, “আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে যে, আমি ভবিষ্যৎ কি কি দিকে যেতে পারে, সব দেখতে পাই। ঠিক যেমন দেখতে পাচ্ছি, ভবিষ্যৎ তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে, অসম্ভবের রূপ নিয়ে। এক দারুন ঝড় বয়ে যাবে তোমার ওপর দিয়ে। যা ঘটবে, তাকে তোমার অসম্ভব মনে হলেও, জেনে রাখো, এই পৃথিবীতে সবকিছুই সম্ভব, কারন মানুষের কাছে অসম্ভব বলে কোনও শব্দ নেই। পারবে তুমি, পারবে এই রহস্য ভেদ করতে?“
জিপসির চোখের দিকে তাকিয়ে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। মানছি, জিপসির কথার মধ্যে একটা তীব্র সম্মোহনী ভাব রয়েছে, কিন্তু তাই বলে আমার মন এতটাও ঠুনকো নয় যে সম্মোহিত হয়ে পড়ব।
তাই আমি হাসলাম জিপসির দিকে তাকিয়ে।
“বেশ তো, বলুন না, কি রহস্যের মুখোমুখি হতে চলেছি আমি আগামী তিন দিনের মধ্যে?” আমি চ্যালেঞ্জই করলাম জিপসিকে।
জিপসিও হাসল। অস্ফুটে গ্রিক ভাষায় কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলল, যেটা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু ভাব দেখে মনে হল, সে আমার এই আস্ফালনটায় বেশ মজাই পেয়েছে।
জিপসি তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে স্পষ্ট করে বলতে থাকল, “তোমরা এসেছ তিনজন, ফিরবে চারজন। যে হারিয়েছে, সে ফিরবে। যে ডুবোপাহাড়কে এতদিন এড়িয়ে গিয়েছিল, তার ওপর চরম আঘাত আসবে সেই ডুবোপাহাড়ের থেকেই। জ্ঞান সবসময় ভাল হয় না। কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো।“
আমি খানিকটা চমকেই গিয়েছিলাম। এই জিপসি কি করে জানল, যে আমরা ঝিনুককে খুঁজছি? কে ডুবোপাহাড়কে এড়িয়ে গিয়েছে? কোন জিনিস অজানা থাকাই ভাল? নাহ, হয়ত জিপসি ব্লাফ দিচ্ছে। এই কিডন্যাপিং এর খবর নিশ্চয়ই কাগজে বেরিয়েছে। সেখান থেকে পড়েই এই জিপসি এমন ভাব দেখাল, যে ও সব জানে। বেশ ভালভাবেই আমাকে ঠকাল।
জিপসি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল এতক্ষণ। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নিজে থেকেই সে হাসল । আমি একটু রেগেই জিজ্ঞাসা করলাম, “ কি হল? হাসছেন যে?”
“হাসব না? এতদিন পরেও মানুষের স্বভাব পালটালো না একটুও। সত্যিকেও আজকাল পরখ করে বিশ্বাস কর তোমরা।“ জিপসি হাসতে হাসতেই বলে।
“হতেই তো পারে, আপনি কাগজ দেখে…” আমি বলতে গেলাম, কিন্তু, জিপসি মুখে একটা তীব্র হুইসল দিল। ফেজান্ট জাতীয় পাখিটা, যেটা পাশের খাঁচায় ঘুমোচ্ছিল, সে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠল। আর তারপরই পাখিটা পরপর দুবার শিস দিল। অত সুন্দর শিস দিতে পারে পাখি, এই প্রথম দেখলাম।
জিপসি হয়ত কিছুক্ষণের জন্য নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিল, তারপর নিজে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “মাফ করবে, আমি আসলে পুরনো কথা ভাবছিলাম। হ্যাঁ, কোথায় যেন ছিলাম? আচ্ছা, আমি যদি কাগজ দেখেই থাকি, মেয়েটার অপহরণের ব্যাপারে জেনে থাকি, তাহলে এটা আমি কি করে জানব যে তোমরা সংখ্যায় তিনজন এসেছ?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে কিছু উত্তর দিতে পারলাম না। সত্যিই তো, এটা তো জিপসির পক্ষে কিছুতেই জানা সম্ভব নয়। তাহলে?
আমি যতক্ষণে, এসব কথা ভাবছিলাম, ততক্ষণে জিপসি খাঁচা থেকে পাখিটাকে বের করে নিজের হাতের ওপর রাখল। পাখিটা জিপসির গায়ের আলখাল্লাটায় ঠোকর দিচ্ছিল আলতো করে।
আমি এতক্ষনে পাখিটাকে পুরো দেখলাম। আকারে একটা ঈগলের থেকে বেশ বড় আর লম্বাও। লেজটাই আকারে আমার হাতের সমান। এতক্ষণ খাঁচার মধ্যে ছিল বলে বোঝা যায়নি।
আমি মুগ্ধ হয়ে বলেই ফেললাম, “কি সুন্দর পাখি, তাই না?”
জিপসি সপ্রশংস দৃষ্টিতে বলল, “ওয়ান অফ এ কাইন্ড। ওর প্রজাতিতে আরও অনেক সদস্য আছে, কিন্তু এই ব্যাটা আমার সাথেই থাকতে ভালবাসে। মিস্টার, এ হল আমার জাইফন। জাইফন, ইনি হলেন মিস্টার… ইয়ে, তোমার নাম?”
“অয়ন, অয়ন চৌধুরী।“ আমি বললাম।
জিপসি পাখিটাকে আদর করতে করতে বলল, “দেখলে তো, তোমাদের মধ্যে পরিচয় হয়েই গেল।“
দেখলাম, পাখিটা আমাকে এক দৃষ্টিতে দেখছে। পায়রারঙা টকটকে লাল চোখদুটোতে যেন অসীম কৌতূহল।
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৭) ~