রাত শেষ হওয়ার অনেক আগেই ঘুম ভেঙে যায় চম্পারাণীর । বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ঘুমটা পাতলা হয়ে আসছিল । আধোঘুম আর আধোজাগরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে আসত রাত । এখন রাতের তৃতীয় প্রহর থেকেই ঘুম উধাও । বিছানায় শুয়ে শুধুই এপাশ ওপাশ ।
চম্পারাণী বোঝে বয়স আবার ছোবল দিচ্ছে । এক সময় এই শরীরটাতেই বয়সের কূট কামড় টের পেয়েছিল চম্পারাণী । সেই কামড়ে শরীর জেগেছিল আর ডানা মেলেছিল মন । আর আজ ! এতদিন পর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বয়সের পদচিহ্ণ । হাঁটতে কষ্ট, বসতে কষ্ট, উঠতে কষ্ট । ধূসর দুচোখে আজ আর জ্বলে ওঠে না কামনার বহ্ণিশিখা ।
আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙ্গে পৃথিবীর । শেষবারের মতো ডেকে ওঠে রাতপাখিরা । ঝোপেঝাড়ে ঝিঁঝিঁর ঐকতান ঢিমে হয়ে আসে । চম্পারাণী জেগে জেগে শোনে বেঁচে থাকার শব্দ । স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ফাস্ট ট্রেনের হুইশল । দ্রুত পায়ে মানুষের হেঁটে যাওয়া । প্রভাত পাখিদের ঘুম ভাঙ্গা কণ্ঠের কলরব । চম্পারাণী বিছানায় উঠে বসে । তারপর মাথার দিকের জানালাটা হাট করে খুলে দেয় । উন্মত্ত পুরুষের মতো হামলে পড়ে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া । অতি কষ্টে বিছানা থেকে নেমে দরজা খোলে চম্পারাণী । মনের সামান্য ইচ্ছায় যে শরীরটা একদিন হিন্দোলিত হয়ে উঠত, সেই শরীরটাই এখন আর মনকে পাত্তা দেয় না ।
আস্তে আস্তে কাটতে থাকে রাতের আঁধার । কালো গাছ-গাছালির উপর দুধের সরের মতো আলো জাগে । চম্পারাণী দজায় দাঁড়িয়ে দেখে আধো অন্ধকারে ছায়ার মতো কে যেন হেঁটে যাচ্ছে সদর দরজার দিকে ।
চম্পারাণী হাঁক পাড়ে, ক্যা যায় রে ?
– আমি গো মাসী, রতন । ছায়াটা থমকে দাঁড়ায় ।
– অঃ রতন, তাই বল, টগরীর ঘরে ছিলি বুঝি ?
– হ্যাঁ গো মাসী ।
হঠাৎ কী মনে হতেই চম্পারাণী হুট করে বলে বসে, তা রতন, তোর বউটা আর ফিরলো না কেন রে ?
রতন কথাটায় আমল না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় ।
ওকে একরকম পালাতে দেখে চম্পারাণীর বাসি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে ।
বেলা-টগরীরা এখন বাইরেও খেপ খাটছে আবার সারা রাতের নাগরো জোটাচ্ছে , বাইরের খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে চম্পারাণী নিজের মনেই কথাটা বলে । ক’দিনের আর শরীর ! ধ্বস নামলেই চিত্তির । মৌমাছি তো দূরের কথা, একটা মাছিও বসবে না । চম্পারাণীর মতোই অবস্থা হবে ওদের । দুহাতে কোমরটা চেপে আস্তে আস্তে দাওয়ায় বসে পড়ে চম্পারাণী, বড্ড কষ্ট উঠতে বসতে ।
রোদ উঠতেই মদন এসে হাজির । একেবারে তেড়িয়া মূর্তি । রাগে ফুলে ফুলে উঠছে শরীরের পেশী । টগর-বেলারা তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা করছিল, মারমুখী মদনকে দেখে চুপ । একবাটি মুড়ি আর চা নিয়ে দুয়ারে বসেছিল চম্পারাণী । সবেমাত্র এক চুমুক চা পেটে গেছে, মদন তেড়ে এল ।
-এই যে চম্পামাসী, রতনকে তুমি কী বলেছিলে ?
মদনের রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল চম্পারাণী । বলে, কিছু বলিনি তো বাবা ।
পা ফাঁক করে চম্পারাণীর সামনে এসে দাঁড়ায় মদন । উঠোনে ভিড় করে বেলা-টগরীরা । মদনকে ওরা যমের মতো ভয় পায় । আবার মদনের মুড ভাল থাকলে রসের কথাও হয় । প্রথম প্রথম চম্পারাণীকেও ভয় পেত ওরা । কিন্তু সময় বদলেছে, ক্ষমতা চলে গেছে মদন-ন্যাপলাদের হাতে । হাজার হোক ওরা হল পার্টির ডাকাবুকো নেতা বিষ্টু গড়াই এর ডানহাত-বাঁহাত ।
মদন চিৎকার করে ওঠে, সত্যি তুমি কিছু বলনি রতনকে ?
– না তো বাবা ।
– রতন মিছে কথা বলল, আর তুমি সতী বেহুলা ? তুমি বলনি, ‘রতন, তোর বউটা আর ফিরলো না কেন রে ?’ কি, ঠিক বলছি তো ?
এবার যেন একটু একটু করে মনে পড়ে চম্পারাণীর । কী যে ভুলোতে ধরল, এই বলছি, আর এই ভুলে যাচ্ছি, মনে মনে বলে চম্পারাণী । তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে, বলেছি বাবা ।
– কেন বলেছ ? হুঙ্কার দেয় মদন ।
ভয়ে কেঁপে ওঠে চম্পারাণী । মদনের পেশীবহুল হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু ভেবে বলিনি বাবা । অমন লক্ষীমন্ত বউ, কী যে ছাই হল, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল ।
লাল চোখে চম্পারাণীকে মাপতে মাপতে মদন বলে, তোমায় শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি, খদ্দেরকে উল্টোপাল্টা কিছু বললে একেবারে চিরে ফেলব, মনে থাকে যেন কথাটা । তারপর উঠোনের ভিড়টার দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দেয়, দাঁত কেলিয়ে মজা দেখছিস ? যা, নিজেদের কাজ কর । মদন বড়ো বড়ো পা ফেলে দুয়ারে রাখা একটা চেয়ারে বসে ।
একটু বেলাতেই দিন শুরু হয় কুঞ্জভিলায় । তারপর কলের জল নিজেদের মধ্যে খেস্তাখেস্তি । পরে ঝগড়া মিটিয়ে একে একে স্নান । এই সময়টা হাতে চায়ের গ্লাস নিয়ে বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে মদন । চম্পারাণীকে কড়া ডোজ দিয়ে চায়ের গ্লাসে লম্বা চুমুক দেয় সে । চোখ দুটো কিন্তু পদ্মর দিকে । পদ্ম তখন কলতলায় দাঁড়িয়ে গায়ে জল ঢালছিল । আদুর গায়ে শুধু শাড়ীটা জড়ানো । বুকের একটা অংশ উদোম । পাতলা শারীর উপর দিয়ে জল গড়াচ্ছিল । স্পষ্ট হয়ে উঠছিল শরীরের চড়াই-উতরাই । বিভোর হয়ে সেইদিকেই তাকিয়েছিল মদন ।
জুঁই, টগর আর শেফালি মদনের এই অবস্থা দেখে হেসে ফেলে । হাসিটা বোধহয় একটু জোরেই হয়েছিল । মদন থতমত খেয়ে চায়ের গ্লাসে ঘনঘন চুমুক দেয় ।
টগর বলে, ও মদনদা, কী দেখছিলে গো ? পদ্মের পাপড়ি ?
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে শয়তানি হাসি ঝুলিয়ে মদন বলে, বুঝলি টগরী, তোরা যা ভাবছিস, তা নয় । পদ্মটা আর কদ্দিন মাল কামাতে পারবে, তাই জরিপ করছিলাম ।
টগরী দাঁত টিপে আস্তে আস্তে বলে, এক নম্বরের ঢ্যামনা ।
মদন উঠে পড়ে । সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বলে, এত সিনেমাহল, রেস্টুরেন্ট, হোটেল রয়েছে । ভাল করে খেপ-টেপ মার । শুধু রাতের বেলা চিৎ হলেই চলবে ?
মদন চলে যেতেই ওরা সমস্বরে হেসে ওঠে । পদ্ম কোমরে একটা ঢেউ তুলে বলে, ব্যাটার ফণা ওঠে না, গোখরো সাজার শখ ! মরণ দশা !
দুপুরের দিকে নির্জন হয়ে যায় বাড়িটা । যে যার মতো বেরিয়ে পড়ে গৃহবধূ কিংবা কলেজ গার্ল সেজে । ওরা জানে, গৃহবধূ কিংবা কলেজ গার্ল দেখলে শুধু ছেলে-ছোকরারাই নয়, হাড়-হাভাতে বুড়োগুলোরও নোলা ছোঁক ছোঁক করে ওঠে । তাছাড়া, ঘরের চেয়ে এখন বাইরের ধান্দাটাই সুবিধাজনক । সিনেমাহলের নীল অন্ধকারে আর রেস্টুরেন্টের নির্জনতায় অল্প আয়াসে বেশি মাল কামানো যায় । সারারাত খেটেও কুঞ্জভিলার তেলচিটে বিছানা ওদের এত টাকা দেয় না ।
দুপুরেও ঘুম আসে না চম্পারাণীর । দুয়ারের এক কোণে দেওয়ালে পিঠ বসে বসে ঝিমোয় । এখান থেকে সদর দরজাতেও নজর চলে । মাঝে মাঝে নিস্তব্ধ দুপুরের মাদকতা ভেঙে ছুটে যায় বাস কিংবা ট্রাক । দূরের কয়লাখনিতে শিফট পরবর্তনের ভোঁ বাজে । বসে বসে সব শুনতে পায় চম্পারাণী ।
কুঞ্জভিলা থেকে একটু দূরেই পীচরাস্তা, স্টেশন ছাড়িয়ে চলে গেছে সীতারামপুরের দিকে । চম্পারাণী বসে বসে ঝিমোতে থাকে, মুখে ঠাসা জর্দা পান । জর্দার মৌতাতে তার মনে ডানা মেলে স্মৃতির পাখিরা । আহা ! কী সব দিন ছিল । কুঞ্জভিলায় তখন যেন চাঁদের হাট । ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল ছবিরাণী । আহা, কী রূপ ! গয়না আর বেনারসীতে সাজলে যেন জমিদার গিন্নি । গোলগাল চেহারা । টানা টানা চোখ, পানের রসে চোবানো কমলালেবুর কোয়ার মতো টুসটুসে ঠোঁট । ছবিরাণীর ঠাটবাটই ছিল আলাদা রকম । আর মেজাজও ছিল বলিহারি, যেন জমিদার বাড়ির বউ । মেয়েদের ট্যাঁ ফুঁ করার জো ছিল না । ঘুম থেকে উঠেই গুনে নিত মেয়েদের রাত মজুরীর পয়সা । ফাঁকি দেওয়ার উপায় ছিল না । ঠিক ধরে ফেলতো ছবিরাণী । আর ধরা পড়লেই শাস্তি । খদ্দের বসানো বন্ধ, রাতভর ছবিরাণীর পদসেবা ।
চম্পাকে একটু আলাদা চোখে দেখত ছবিরাণী । কেমন যেন একটা টান ছিল চম্পার উপর । প্রায়ি বলত, কী আর করবি বল চম্পা । আমাদের জন্মই ঢ্যামনাদের সেবা করার জন্যই । না হয়, ভাতারের সঙ্গে শুতিস, তার বদলে মিনসেগুলোর সঙ্গে শুতে হচ্ছে । সেই তো একই তো হল, থোড়-বড়ি-খাড়া, নয়ত খাড়া-বড়ি-থোড় । বুঝলি চম্পা, ভাতারের কাছে শুয়ে লাথি-ঝাটা খাওয়ার চেয়ে এটা বেশ । ভালই আছি । কেমন স্বাধীনে ।
স্বামীর অত্যাচারে এককাপড়ে ঘর ছেড়েছিল চম্পা । তারপর ভাসতে ভাসতে এই কুঞ্জভিলায়, ছবিরাণীর সংসারে । বয়স তখন অল্প, শরীরে যৌবনের কূট কামড় । তার উপর পিঠে গরম শাবলের দাগ । ছবিরাণীর কথাগুলোকেই তখন সত্যি মনে হত ।
ছবিরাণীর কথা ভাবলেই কান্না পায় চম্পারাণীর । এখন কিছুতেই ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না । হয়ত ও মন থেকে কথাগুলো বলত না, মেয়েদের সান্ত্বনা দেবার জন্য বলত । আসলে কান্না জমতে জমতে পাথর হয়ে গেলে ঘর-বার সব একাকার হয়ে যায় । তখন আর ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বোধটাই থাকে না । আজ ছবিরাণী বেচে থাকলে চম্পা তাকে জিজ্ঞাসা করত, আচ্ছা ছবিদি, তুমি নিজে বিশ্বাস কর ওকথা ?
একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল চম্পারাণীর । দরজা ঠেলার শব্দে ধড়মড় করে জেগে ওঠে । চোখ তুলে দেখে দুটো কলেজ ছোকরা, পিঠে ব্যাগ । এক পলক তাকিয়েই আবার হাটুতে মাথা গোঁজে চম্পা । ছ্যা, ছ্যা ! এদের মা-মাসী জ্ঞানও নেই । থুঃ থুঃ করে একদলা থুথু ফেলে চম্পা ।
তখন দরদ ছিল । সুধীনবাবু, গোলক চৌধুরী, রমেন বোস ……… কত নাম । আজ আর মনে পড়ে না । টাকা দিত, কিন্তু দরদ দিয়ে, ভালোবেসে । হোক না কয়েক রাতের সম্পর্ক, তবু মনে হত নিজের সোয়ামী । সুধীনবাবুর চওড়া বুকে মুখ গুজে চম্পা তখন পাখি হয়ে যেত । ভুলে যেত সম্পর্কটা নেহাতই কয়েকটা টাকার । কত কথা, কত স্বপ্ন ! সুধীনবাবু বলতেন, চল চম্পা, তোকে বিয়ে করি । চম্পা সুধীনবাবুর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠত, ওকথা বলতে নেই রাজাবাবু । রেবাদি আছে না ?
সুধীনবাবু এই কথা শুনে হাঁফাতে হাঁফাতে বলতেন, তুই কত ভাল চম্পা, কতদিকে তোর নজর । চম্পা নিশ্চুপ হয়ে শুনতো আর দুচোখ বেয়ে নেমে আসত ক্ষীণ জলের ধারা । ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত বাসী রজনীগন্ধার মৃদু সুবাস ।
এখন আর সেদিন নেই । শুধু দাও আর নাও । কোন অতীতে হারিয়ে গেছে বেল ফুলের গন্ধ । রাতের অন্ধকার আর সুবাস বিলোয় না । শরীর থেকে ভেসে আসে না আতরের মাতাল করা গন্ধ । মাতাল শরীর জুড়ে শুধু মাংস খাবলানো খিদের গন্ধ । থুঃ থুঃ করে আবার একদলা থুথু ফেলে চম্পা । অস্ফুটস্বরে বলে, কুঞ্জভিলাকে তোরা শেষ পর্যন্ত মাংসের দোকান বানিয়ে ফেললি মদনা ? ছ্যা ছ্যা ।
ঘড়িতে এখন রাত এগারোটা । কিন্তু, কুঞ্জভিলায় এখন রাত কিশোরী । হঠাত এক অল্পবয়সী বউকে নিয়ে মদন এসে হাজির । চম্পারাণীর ঘরের সামনে এসে মদন হাঁক পাড়ে, কাকী ও কাকী ।
সন্ধ্যা নামলেই চম্পা নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে । কারণ, অতীতের সেই সাজানো রাজপ্রাসাদ আজ আর নেই, পড়ে আছে শুধু তার ভাঙা কাঠামোটা । বিছানায় শুয়ে মুখে জর্দা পান ঠেসে মৌতাত করছিল চম্পারাণী । এমনসময়ে ‘কাকী ও কাকী’ বলে মদনের চিল চিৎকার । মৌতাত মাথায় উঠল । চম্পারাণী ভাবে, হারামীটা নির্ঘাত মাল ফাঁসিয়েছে, নইলে ‘মাসী’ ছেড়ে ‘কাকী’ ডাকে । কষ্টে সৃষ্টে দরজা খুলে বাইরে বেরোয় চম্পারাণী ।
দরজার কাছ দাড়িয়েছিল মদন । পাশে একটা অল্পবয়সী বউ । বেশ ডাগর-ডোগর চেহারা । তাকিয়ে আছে মাটির দিকে, ভয়ে জড়োসড়ো । মদনের দিকে তাকিয়ে চম্পারাণী বলে, এত রাতে ?
– দেখনা কাকী, এই ভদ্রমহিলা লাস্ট ট্রেন ফেল করেছেন । আমি স্টেশনেই ছিলাম । বললাম, রাতবিরেতে কোথায় বিপদে পড়বেন, কাছেই আমার কাকীর বাড়ি । সেখানেই রাতটা কাতিয়ে ভোরের ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবেন । তাই তোমার কাছেই নিয়ে এলাম কাকী । একেবারে পাকা অভিনেতার মতো কথাগুলো বলে চুপ করে মদন ।
– শোন কাকী, আজ রাতটা ইনি তোমার কাছেই থাকুন । কাল সকালে ট্রেনে তুলে দেব ।
মদনের কথা শুনে মনে মনে হাসে চম্পারাণী । আহা ! ঢ্যামনাটার কত ঢং । ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে ! ন্যাকা চৈতন । বল, রাত হলেই বিছানায় তোলার ব্যাবস্থা করবি । কিন্তু ওসব কথা মনেই থেকে যায় । মুখে বলে, আহা বেচারা ! থাক, মদন ও আজ রাতটা এখানেই থাক । তারপর বউটার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি আমার ঘরে এসো মা ।
রাত এখন যুবতী, তবু চম্পারাণীর চোখে একটুও ঘুম নেই । কুঞ্জভিলার ঘরে ঘরে এখন যৌবন বিক্রির হাট । জড়ানো গলায় দরদাম চলছে । ভেসে আসছে রসের গান । চম্পারাণীর বিছানার এককোণে মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে । ঘরে চিঁড়ে-কলা ছিল । মেয়েটি খেতে চায়নি, সে ও আর জোর করেনি ।
মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকায় চম্পা । আহা! কী সুন্দর ঢলঢলে মুখ, রাত আলোর মায়াবী আলোয় যেন রূপের হাট । শরীরটাও ভরাট, কোথাও বাহুল্য নেই । চম্পা ভাবে, মেয়েটি কি বুঝতে পেরেছে , ওর আবভাব দেখে মনে হয় একটু আধটু বুঝতে পেরেছে, ও এখন কোথায় । মুখটা ভয়ে শুকনো, মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে । চম্পা ঘুরে শোয়, কি হবে এসব কথা ভেবে । কত এল আর কত গেল । সেই এক নিষ্পাপ, ভিতু চাহনি । কি হল ? এই যে টগরী, পদ্ম । এদের এখন দেখলে মনে হবে, এই চম্পারাণীর ঘরেই একসময় এরা কত কেঁদেছিল । পদ্মটা তো আবার তার পা-দুটো জড়িয়ে ধরেছিল । বলেছিল, আমায় বাচাও মাসী ।
ওরা তো দিব্বি বেঁচে আছে । এখন ওসব কথা তুললে ওরাই হেসে উঠে বলে, কী বোকাই না ছিলাম তখন । তাই না মাসী ?
নাঃ যা হবার হবে । চম্পারাণী আবার ঘুমাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঘুম আর আসে না, শুধু এপাশ-ওপাশ করাই সার ।
মেয়েটি এবার কাঁদছে । চম্পা ওর কান্নার শব্দ শোনে । একবার ভাবে, ওকে জিজ্ঞাসা করলে হত কোথায় ওর বাড়ি, কে কে আছে । পরক্ষণেই ভাবে, কী হবে । কালই হয়ত একে চালান করে দেবে মদনা, অন্য কোথাও । আবার চোখ বোজে চম্পা, চোখের সামনে শুধু মেয়েটারই মুখ ভাসে ।
বাইরের ঘড়িতে তখন রাত দুটো বাজার শব্দ । মেয়েটি কী যেন বলছে বিড়বিড় করে । চম্পা মাথা তোলে । দেখে, মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে । সেই ঢলঢলে মুখ । একমাথা চুল । ডাগর দুটো চোখে জল । এ যেন তারই অতীত, এখন বর্তমান হয়ে তারই সামনে বসে, এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ণ হয়ে । মনের মধ্যে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা পাক খেতে খেতে উঠে আসে । চম্পারাণী বলে, কিছু বলবে মা ?
মেয়েটি হঠাৎ কেঁদে ফেলে । বিল্টু আমাকে ছেড়ে একটা রাতও একা থাকতে পারে না । ওর বাবা নেই, একা কী করছে ছেলেটা !
চম্পারাণীর হৃদয়ে কীসের এত তোলপাড় ? কেন এত কান্না ? তবে কি পাথর হয়ে যাওয়া কান্নারা আবার মুক্তি পেতে চাইছে ? এটাই কি তবে অপত্যস্নেহ ? কিন্তু, চম্পারাণী তো কারও মা নয় । মরার আগে ছবিরাণী বলেছিল, বড় কষ্ট রে চম্পা, বড় কষ্ট ।
চম্পা বলেছিল, কোথায় কষ্ট ছবিদি, আমায় বল, কোথায় কষ্ট ?
ছবিরাণীর গলার স্বর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছিল ।
– জানি না রে……… তুই পালা চম্পা, পালিয়ে যা ।
চম্পারাণী পালাতে পারে নি । কিন্তু সেই রাতে ছবিরাণী সবাইকে ছেড়ে পালিয়ে গেল । ছবিরাণী তার কষ্টটাকে বুঝতে পেরেছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু চম্পারাণী বুঝেছিল । এ কষ্ট জীবন্ত দেহের মধ্যে একটা মৃত বিবেক নিয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট ।
রাত শেষ হওয়ার আগেই পথে নামল চম্পা । কোমর থেকে পা পর্যন্ত অসহ্য যন্ত্রণা । তবু হাঁটছে । ওর অশক্ত হাত ধরে রেখেছে মেয়েটার একটা হাত । গভীর মমতায় । ওরা হাঁটছে । রাত শেষ হওয়ার আগেই ধরতে হবে ফার্স্ট ট্রেনটা । দূর থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখির ডাক । দূর আকাশে আলো ছড়াচ্ছে উজ্বল শুকতারা ।
মেয়েটি বলে, ওরা যদি জেনে ফেলে ?
– জানুক, আর চম্পারাণী ভয় পাবে না ।
– যদি ওরা মারে ?
– মারুক, চম্পা কবেই মরে গেছে ।
– ওরা যদি তোমায় ঘর থেকে বের করে দেয় ?
– দিক, আসল ঘর তো কবেই ছেড়ে এসেছি ।
আঁধার কাটছে । শুরু হচ্ছে নতুন দিন । পুবের আকাশে অস্ফুট রঙের আলপনা ।
ভোরের প্রথম ট্রেনে মেয়েটিকে তুলে দিল চম্পা । ট্রেনে ওঠার আগে চম্পারাণীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল মেয়েটি । চম্পারাণীর দুচোখে জল । এ জল কান্নার নয় । তার চোখের এই জল বিল্টুর জন্য, তাকে আর একা থাকতে হবে না ।
ট্রেন চলে গেছে । যাত্রীরা পৌঁছে যাবে যে যার ঠিকানায় । ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে একা দাঁড়িয়ে চম্পা । ঠিকানাহীন । অশক্ত পা, অশক্ত হাত । দুচোখে কুয়াশা । চম্পারাণী দেখে, সে এক অন্ধকার কানাগলিতে দাঁড়িয়ে । তবে একা নয় । পিছনে দীর্ঘ এক সারি, যেন অসংখ্য মুখ দিয়ে গাঁথা এক বাসী ফুলের মালা ।