সঞ্চিতা শতকের পিসতুতো বোন । কলেজে সেকেন্ড ইয়ার । অংকে অনার্স । শারীরিক সৌন্দর্য আশে পাশের অনেককেই ম্লান করে দেয় । তার চেয়েও যেটা বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে সেটা সঞ্চিতার মিষ্টি হাসি । খুবই প্রানোচ্ছল । শতকদের বাড়িতে আজ বাসন্তী পুজো । নিমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড় । ছাদের ওপর প্যান্ডেল । দুপুরের প্রসাদ গ্রহণ সেখানেই । পরিবেশনে নেমে পড়েছে সঞ্চিতা । একটা বাসন্তী রঙের লাল পাড়ের শাড়ি পড়েছে । সাথে ম্যাচ করা ব্লাউজ । শাড়ির আঁচলটা পেঁচিয়ে গুঁজে নিল কোমরে । ঝুঁকে পড়ে খিচুড়ি পরিবেশন করছে । গলার মটর দানা ঝুলছে শূন্যে । বুকের খাঁজটা দৃশ্যমান । হাতটা কেঁপে গেল নির্ঝরের সামনে এসে । সবটাই পড়লো বাইরে , মেঝেতে ।
সামলাতে পারলো না নিজেকে । টেবিলের ওপর বালতিটা রেখে এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে গেল নিচে । কেউ কিছু বুঝতেই পারলো না । একজন বুঝেছে । সে নির্ঝর ।
বছর দুয়েক আগে ঠিক এরকমই বাসন্তী পুজোর দিনে শতকের বাড়িতে আলাপ নির্ঝরের সাথে সঞ্চিতার । নির্ঝর বন্ধুর বোনের প্রতি কোনো রকম দুর্বলতা দেখায় নি । কিন্তু সঞ্চিতার বুকে ভালোবাসার বান ডেকেছিল । জীবনে প্রথম প্রেম । সতের বছর বয়সেই মন দিয়ে বসলো নির্ঝরকে । কিন্তু সবটাই মনে মনে । কিশোরীর লজ্বা আবিরে রাঙিয়েছিল সঞ্চিতার সুন্দর মুখ । প্রেমের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ নির্ঝর টের পেল না সঞ্চিতার বুকে ঝড়ের দাপট ।
সঞ্চিতা ঠিক করেছিল যদি নির্ঝর নিজের থেকে কিছু না বলে তাহলে সে নিজেই সামনের বছর বাসন্তী পুজোর দিন প্রস্তাব দেবে । সুদীর্ঘ এক বছরের প্রতীক্ষা । প্রতিটা দিন অসহ্য ভারী । কিভাবে কাটিয়েছে একমাত্র সেই জানে । পুজোর ছুটিতে দিদি জামাইবাবু বেড়াতে যাবে সিকিম । সঞ্চিতার পরীক্ষা হয়ে গেছিল । সঞ্চিতাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল । কিন্তু তার ভালো লাগছিল না । ভালো লাগতো যদি নির্ঝর থাকতো । তার সমস্ত মন প্রাণ অধিকার করে বসে আছে নির্ঝর ।
বাবা হরভজন সিং মন্দির , জোম্গো লেক দেখে সেদিন বিকেল বিকেল ফিরে এল হোটেলে । দিদি বলল হোটেলে না গিয়ে এম জি মার্গে যাবে শপিং করতে । সঞ্চিতা শপিং করতে খুব ভালোবাসে । এম জি মার্গ খুব সুন্দর জায়গা । দুপাশে সারিবদ্ধ ভাবে সব দোকান । মাঝ খানটায় প্রচুর জায়গা । বসার বেঞ্চ । তাছাড়া খাবার স্টলতো আছেই । ইচ্ছে করেই সঞ্চিতা দিদিকে বলল , তোরা ওই দিকটা দেখ , আমি এই পাশটায় আছি । দিদিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল সঞ্চিতা । অনেক খুঁজে নির্ঝরের জন্য একটা দামি উপহার কিনলো । রুপোর কলমদানি । পেছনে রুমটেক মনাস্ট্রির ছবি । সামনে একপাশে একটা রুপোর কাজ করা পাখির পালক । আর একপাশে পিরিচের মত কলম রাখার স্ট্যান্ড । রুপোর ওপর রঙিন পাথরের কাজ । অসাধারন । প্রথম উপহার নির্ঝরের জন্য । খুব ভালো করে প্যাক করে হ্যান্ড ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলো ।
অবশেষে এল বাসন্তী পুজো কিন্তু এল না নির্ঝর । খুব ব্যস্ত । মন ভেঙে গেল সঞ্চিতার । শতকের কাছ থেকে নির্ঝরের ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করলো নির্ঝরকে ।বলল , কিছু ব্যক্তিগত কাজে খুব ব্যস্ত । একদম সময় হবে না দেখা করার ।
বয়েই গেছে সঞ্চিতার । গরজ তার , সেই যাবে নির্ঝরের বাড়ি । কোনো বাঁধাই মানবে না সে । দাদার কাছ থেকে নির্ঝরের ঠিকানা নিয়ে এক রবিবার চলে গেল নির্ঝরের বাড়ি । বাড়ীর সবাই অপ্রস্তুত এমনকি নির্ঝর পর্যন্ত । প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে ভদ্রতা করলো তার সাথে । হ্যাঁ , স্রেফ ভদ্রতা । খুব দুঃখ পেয়েছিল সঞ্চিতা । নির্ঝরের উদাসীনতা তাকে দুঃখ দিয়েছিল । তাহলে কি নির্ঝর অন্য কারো সাথে , অন্য কোথাও ……। ভাবতে পারছে না সঞ্চিতা। অসম্ভব । নির্ঝর তার । অন্য কারও হতে পারে না ।
বাড়িতে ফিরে নিজেকে ছুড়ে দিল বিছানায় । অনেক্ষন কাঁদলো নিজের মত করে । তারপর ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে বসলো চিঠি লিখতে । মনের কথা দিল উজাড় করে । সাথে লিখলো উপহারের কথা । সিকিমের এম জি মার্গ থেকে কেনা তার জন্য বিশেষ উপহার । দিন পনের বাদে সঞ্চিতার হাতে এল চিঠির উত্তর । অধীর আগ্রহে খাম ছিঁড়ে বের করলো এক টুকরো কাগজ । ঠিক দু লাইন লেখা । উপহার কেনার জন্য ধন্যবাদ । রেখে দাও , বিয়ের পরে স্বামীকে দিও । নিজের গালে নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছে তার । খুব সস্তা করে ফেলেছে নিজেকে । মনে মনে ধন্যবাদ দিল নির্ঝরকে । আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল তার কেনা প্রথম ভালোবাসার উপহার । সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন ।
আজ দু বছর বাদে নির্ঝর এসেছে বাসন্তী পুজোয় প্রসাদ খেতে । হাত তো কাঁপবেই সঞ্চিতার । তবে সেটা দুর্বলতায় না ঘৃনায় , একমাত্র সঞ্চিতাই বলতে পারবে ।