আজ সকলকে বলবো এক অদ্ভুত কাহিনী। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাহিনী। এই কাহিনীর কিছুটা ইতিহাস নির্ভর, আরবাকীটা অবশ্যই কল্পনার মিশেল।লৌকিক আর অলৌকিকতার মেলবন্ধনে এক অশ্রুতপূর্ব অনবদ্য উপাখ্যান।
গ্রামটির নাম বীরনগর বা উলা বীরনগর। চুর্ণী নদীর তীরে অবস্থিত বর্তমান নদীয়া জেলার অন্তর্গত এই জনপদটির ইংরেজআমলের পূর্বে নাম ছিল উলা।উলা নামটি সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ আছে। কারও কারও মতে উলুবনাকীর্ণ এক বিস্তীর্ণ চরের আবাদথেকে এই জনপদটির পত্তন হয়। তাই এর নামকরণ হয় উলা। আবার কেউ কেউ বলেন যে পারসী শব্দ আউল অর্থে জ্ঞানীকথাটি থেকে উলা নামটির পত্তন। সেই সময় ঐ অঞ্চল নাকি অনেক জ্ঞানী মানুষের বাস ছিল। কিন্তু একসময় জায়গাটিতেভয়ানক ডাকাত তথা দস্যু দলের উৎপাতে স্থানীয় অধিবাসীরা খুবই ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন। ইংরেজ আমলে সেই সব ভয়ানক দস্যুদমনে স্থানীয় বাঙালী যুবকদের বীরত্ব দেখে ইংরেজরা এর নামকরণ করেছিল বীরনগর বা উলা বীরনগর।
উলা বা বীরনগরের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে মোটামুটি ৩৬৫ বছর। সালটা ১৬৫৭ যখন শান্তিপুরের‘গুরুমহাশয়’ মোহন মিত্র এবং তাঁর আরও চার ভাই টেকা থেকে উলাতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন উলা ছিলহুগলী নদীর পূর্ব তীরের এক ছোট্ট ও অপরিচিত গ্রাম। উলাতে সব থেকে পুরানো যে মন্দিরের খোঁজ পাওয়া যায় সেটা হল মিত্র–মুস্তাফি বাড়ির উত্তর–পূর্ব দিকে অবস্থিত বিষ্ণু মন্দির। এই বিষ্ণু মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন “ছোট মিত্র” বা পণ্ডিত মোহনমিত্রের ছোট ভাই কাশীশ্বর মিত্র। যদিও মন্দিরের হাল এখন খুবই খারাপ।
মিত্র বংশের খ্যাতি ও মর্যাদা রামেশ্বর মিত্রের সময় থেকেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। রামেশ্বর মিত্র ছিলেন পণ্ডিত মোহন মিত্রেরছেলে। এক কথায় খুব শিক্ষিত ও সম্মানীয় ব্যক্তি। তখন ভারতের রাজ করছেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। বাংলার গভর্নর পদেঔরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান। রামেশ্বর মিত্র বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ ও শায়েস্তা খানের কোষাধ্যক্ষ আবার হিসাবরক্ষকওছিলেন। ১৭০৪ সালে নিজের কাজের পারদর্শিতার জন্যে তিনি সরাসরি মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে ‘মুস্তাফি’ উপাধিলাভ করেন। সাথে সাথে স্মারকচিহ্ন হিসাবে একটা সোনার পাঞ্জাও উপহার পান। বর্তমানে ‘মুস্তাফি’ উপাধিটা থেকে গেলেওস্মারকচিহ্নটি কার কাছে বা কোথায় আছে সেটা জানা যায়না। ১৬৮৪ তে এক অপরূপ চণ্ডীমণ্ডপ তৈরি করেন রামেশ্বর মিত্রমুস্তাফি। শোনা যায় যে এই চণ্ডীমণ্ডপের সৌন্দর্য্য দেখতে অনেক দূর দূর থেকে লোকে আসত। সেই সৌন্দর্যের নজির এখনওপাওয়া যায় নবনির্মিত চণ্ডীমণ্ডপের ভেতরে রাখা সেই সময়ের তৈরি বিনষ্ট প্রায় কাঠের স্থাপত্য দেখে। পরে অবশ্য নতুন করেওচণ্ডীমণ্ডপ তৈরী হয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসবো। রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফির আর এক সৃষ্টি হল মিত্র–মুস্তাফি বাড়ির রাধা–কৃষ্ণ মন্দির।তখন বাংলায় ‘একবাংলা’ বা ‘দোচালা’ মন্দিরের চল ছিল। ১৬৯৪ সালে রামেশ্বর তৈরি করান জোড়া বাংলা ঘরানার রাধা–কৃষ্ণমন্দির যা শুধু তখনকার দিনেই নয় এখনও খুব কম দেখা যায় বাংলাতে। মুস্তাফিদের এই রাধা–কৃষ্ণের মন্দির ছাড়া পশ্চিমবঙ্গেরএকমাত্র বিষ্ণুপুরে এই ঘরানার মন্দির দেখা যায়, যা ১৬৫৫ সালে তৈরি করেন মল্লভুমের রাজা রঘুনাথ সিংহ দেব। সাধারণতদুটি দোচালা ঘর পাশাপাশি তৈরি করে এই আকারের মন্দির নির্মাণ করা হত। সামনের দোচালা ঘরটি হল অলিন্দ বা নাটমন্দিরআর পিছনের দোচালা ঘরটি হল মন্দিরের গর্ভগৃহ। এক কথায় বাংলার এক অনন্য নির্মাণকৌশল।
পরবর্তী কালে মিত্র–মুস্তাফি পরিবার ভেঙ্গে যায় ৩ ভাগে। রামেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র বা রঘুনন্দন মিত্র মুস্তাফি ১৭০৮ সালে চলেআসেন হুগলী নদীর পশ্চিম পারের শ্রীপুরে, চতুর্থ পুত্র বা অনন্তরাম মিত্র মুস্তাফি ১৭১২ সালে চলে আসেন হুগলী নদীর পশ্চিমপারেরই সুখরিয়াতে আর বাকি পরিবার বসবাস করতে থাকেন উলা বা বীরনগরেই। ১৭৪৪ সালে মিত্র–মুস্তাফি বংশের শিবরামমুস্তাফি বীরনগরে তৈরি করান দ্বাদশ শিব মন্দির, যা এখনো তার ঐতিহ্য নিয়ে বর্তমান। তবে অবশ্যই কিছুটা হলেও ভঙ্গুরঅবস্থায়।
এই মিত্র মুস্তাফী পরিবারের ধনী হওয়ার পিছনে আরো অনেক গল্প লুকানো আছে। কারো কারো মতে দস্যুদের কিছু লুণ্ঠিত অর্থকোনভাবে মিত্র মুস্তাফী পরিবারের হাতে আসে যা উত্তরোত্তর তাদেরকে সম্পদশালী করে তোলে। এই ধারণাটির সত্যই কোনঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না জানিনা , কিন্তু সেই বিষয়টি নিয়েই আমার আজকের গল্পের অবতারণা।তবে নিম্নে বর্ণিতঘটনাটি নিছকই আমার মনের কল্পনা মাত্র, এর সত্যাসত্য বিচার্য নয়। আর আমার এই কল্পিত কাহিনী যদি কারো মনে কোনআঘাত করে, তাহলে তাঁর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে সেই গল্পে আসার আগে আমরা একবার জেনে নেই এই ঐতিহাসিক স্থানউলার নাম কেন বীরনগর হলো।
অনেকের মতে ১৮ শো শতকের মাঝামাঝি সময় বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ নামে দুই কুখ্যাত ডাকাত ও তাদের দলবল হামলা করেউলার মহাদেব মুখার্জী নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে। কিন্তু মহাদেব মুখার্জীর পরিকল্পনা ও বীর বিক্রমের কাছে তারা হেরেযায়। দুই ডাকাত সর্দার বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের মৃত্যু হয়। বাকি ডাকাতদের প্রথমে কারাবাস হয় ও পরবর্তীকালে মৃত্যুদণ্ড হয়।
আবার নদীয়া জেলার গেজেট অনুযায়ী ১৮৩৫ সালে মিত্র–মুস্তাফি বংশের অন্যতম সফল পুরুষ আনন্দীনাথ মিত্র মুস্তাফিকুখ্যাত ডাকাত শিবেশানীকে হত্যা করেন।মহাদেব মুখার্জীর বীরত্বের কারণেই হোক বা আনন্দীনাথ মিত্র মুস্তাফির সাহসিকতারকারণেই হোক, তৎকালীন ইংরেজ কর্তারা উলার নাম রাখেন বীরনগর।
এবার আসুন আমরা মনোনিবেশ করি আমাদের সেই রূপকথাসম উপাখ্যানটিতে। মিত্র মুস্তাফী পরিবারের এই অন্যতম সফলপুরুষ শ্রী আনন্দীনাথ মিত্র মুস্তাফী একদিন গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড দাবদাহে ঘরে থাকতে না পেরে মধ্যরাত্রে ভাগিরথীর তীরে গিয়েবসেন। ভাগিরথীর একেবারে নিকটেই ছিল তাঁর নিবাস। তখন ভাগিরথী বীরনগর বা উলাগ্রামের পাশ দিয়েই প্রবাহিত ছিল।আজ কালের গতিতে ভাগিরথী কিছুটা দূরে প্রবহমান। তবে এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে যে ডাকাতের খাল ও বারোমেসে খালনামে বিরাট জলাভূমি আছে, অনুমান করা হয় সেটিই ভাগিরথীর প্রাচীন খাত। কথিত আছে যে শ্রীমন্ত সওদাগর যখন সিংহলেবাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন, তখন উলা গ্রামে গঙ্গার ধারে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। শ্রীমন্ত মা চণ্ডীর খুবই ভক্ত ছিলেন। তিনিউলাগ্রামে জাহাজ নোঙর করে গঙ্গার তীরে বটবৃক্ষের নীচে একটি শিলা স্থাপন করে মা চণ্ডীর আরাধনা করেন তাঁর বিপন্মুক্তিরজন্য।শ্রীমন্তের মনস্কামনা মা পূরণ করেন। আজও সেখানে মা উলাইচণ্ডী নিত্য আরাধিতা। কিন্তু তাঁর কোন মন্দির নেই। যেখানেমা পূজিতা, সেই বটবৃক্ষ শোভিত জায়গাটিকে বলা হয় মা উলাইচণ্ডী তলা।
এবার সেই রাত্রের কথায় আসি । সে রাত্রে আনন্দীনাথ কিন্তু হঠাৎই ভাগিরথীর তীরে ছুটে যাননি । ঘুম আসছে না ঠিকমত, ছটফট করতে করতে হয়তো একসময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।এমন সময় মনে হল যেন তাঁর আরাধ্যা দেবী মাউলাইচণ্ডী তাঁর সামনে আবির্ভুতা হয়ে বলছেন – “ ওঠ রে আনন্দী, তোর ভক্তিতে আমি পরম পরিতোষ লাভ করেছি।ভাগিরথীর তীরে যেখানে আমার অধিষ্ঠান, এখনি সেখানে চলে আয়।আর বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাক। তারপর অপেক্ষাকর। আজ আমার কৃপায় তোর জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। যে আর্থিক দুশ্চিন্তায় তুই এখন খুবই উদ্বিগ্ন,সময় এসেছে এবার তারথেকে মুক্তি পাবার। বংশ পরম্পরায় তোদের আর কোন অভাব থাকবে না।” আনন্দীনাথের তন্দ্রার ঘোর কেটে গেল। তিনিপ্রথমটায় খুব অবাক হয়ে গেলেন। ভাবলেন সত্যিই কি মা তাঁকে এইসব কথা বললেন, না কি সবটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এটা ত’ ঠিক যে কিছুদিন হল তিনি বেশ অর্থকষ্টের মধ্যে রয়েছেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি অবশেষে স্থির করলেন যে সেই ত’ ঘরেরমধ্যে ঘুম আসছে না, তবে একবার গঙ্গার ধারে গিয়ে দেখতে দোষ কি ! তিনি মাকে প্রণাম করে ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভাগিরথীরতীরে মা উলাইচণ্ডীর থানের দিকে চললেন।
মধ্যরাত্রি । চতুর্দিক অন্ধকার। তাঁর বেশ ভয় ভয় করছিল। আগেই বলেছি তখন ঐ অঞ্চল এবং আশেপাশে প্রচুর ডাকাত তথাদস্যুদলের উৎপাত ছিল। মায়ের নাম করতে করতে আনন্দীনাথ ভাগিরথীর তীরে পৌঁছে গেলেন। মায়ের কথামত বিশালবটবৃক্ষের আড়ালে তিনি নিজেকে লুকিয়ে বসে রইলেন। কিন্তু গঙ্গার শীতল হাওয়ায় তাঁর ঘুম এসে গেল। হঠাৎ যেন তাঁর মনেহল কেউ তাঁকে বলছেন – “ কিরে আনন্দী, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি ! ওঠ ওঠ , পিছনে তাকিয়ে দেখ, ওরা গঙ্গার তটে কি লুকিয়েরাখছে ! ওরা সব নির্দয় দস্যুর দল। কিন্তু তোর কোন ভয় নেই। আমি তোর সাথে আছি। শোন, ঐ ডাকাতেরা পাশের গ্রামেরজমিদার, তোর একসময়ের বন্ধু রাজনারায়ণ আর তার পরিবারের সকলকে হত্যা করে প্রচুর অর্থ, সোনাদানা, হীরে জহরত লুঠকরেছে। কিন্তু এসবে ত’ ওদের কোন অধিকার নেই । জমিদার রাজনারায়ণ তোর বন্ধু হওয়া সত্বেও তোর সাথে কেবল তঞ্চকতাতথা প্রতারণাই করে নি, তোর বিপদের দিনেও তোর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বরং তোকে অপমান করে তার বাড়ী থেকে তাড়িয়েদিয়েছিল। তাই রাজনারায়ণের অর্থে ঐ দস্যুদের কোন অধিকার নেই । অধিকার বলতে গেলে তোরই আছে। আর ঐ নিষ্ঠুরডাকাতদলের সর্বনাশের ক্ষণ সমুপস্থিত। আমার আশীর্বাদে তোর হাতেই তাদের বিনাশ সুনিশ্চিত। “
আনন্দীর ঘুম ভেঙে গেল। সত্যিই ত’ ! তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ একবার বৃটিশ সরকারের দাবীকৃত বেশ কিছু অর্থ তাদের তহবিলেদিতে অপারগ হলে, তিনি তাঁর সব সঞ্চয় দিয়ে বন্ধুকে সে যাত্রা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। পরিবর্তে তাঁর কৃতঘ্ন বন্ধু ত’ সেই অর্থ কেবল ফেরত দেন নি যে তাই নয়, তাঁর মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে সেই অর্থের দাবী করলে তাঁকে যথেষ্ট অপমানও করেন।তখন থেকেই রাজনারায়ণের সঙ্গে তাঁর আর কোন সম্পর্ক নেই। সত্যিই কি আজ রাজনারায়ণ মৃত ! রাজনারায়ণের জন্য মনটাতাঁর কেঁদে উঠল। হাজার হোক, একসময় ত’ সে তাঁর বন্ধু ছিল। আর বৌঠান অর্থাৎ রাজনারায়ণের স্ত্রীর আতিথেয়তা ত’ ভোলার নয়। শেষবার যখন তিনি রাজনারায়ণের বাড়ী থেকে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন বৌঠানের অসহায়তাএবং অশ্রুসিক্ত আননটি এখনো তাঁকে ব্যথিত করে।
এবার তিনি বটগাছের আড়াল থেকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে জনা দশেক মুখে কালো কাপড় ঢাকা বলশালী চেহারারলোক গঙ্গার তীরে, যেখানে জঙ্গলাকীর্ণ গঙ্গাতট স্রোতের আঘাতে কিছুটা ধসে যাওয়ার কারণে একেবারেই লোক চলাচল করে না, সেখানে অন্ধকারের মধ্যে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি করছে। জায়গাটি কিন্তু কিছুটা বিপজ্জনক, আবার সাপখোপেরও আস্তানা। তিনিবিষ্মিত হয়ে গেলেন এই ভেবে যে ওখানে ভাগিরথীর প্রান্তে তট থেকে নেমে গিয়ে লোকগুলি কি করছে ! গাছের আড়াল থেকেআনন্দীরাম বিশেষ কিছু দেখতে পেলেন না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলেন যে এরা আর যাই হোক, কেউ ভাল লোক নয়। এরানিশ্চয়ই ডাকাত।ভোর হয়ে আসার কারণে লুণ্ঠিত ধনসম্পদ গঙ্গার তীরে লুকিয়ে রাখছে, সুযোগ বুঝে রাতের দিকে এসে সবদখল করবে। দেবীর কথাগুলি তাঁর মনে পড়ে গেল। তিনি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন।দেখাই যাক্ না কি হয় ! মা চণ্ডীস্বয়ং যে তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন। অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি দেখতে পেলেন যে লোকগুলি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করেকিসব কথা বলতে বলতে চলে গেল। মিত্র মহাশয় অনেকটা দূরে লুকিয়ে ছিলেন, ফলে তাদের কথপোকথনের কিছুই তাঁর কর্ণগোচরে আসা সম্ভবপর ছিল না।
তখন ভোর হয় হয়। পুবাকাশে সবে সুর্যদেবের প্রকাশ ঘটছে। ভাগিরথীর জল যেন আলো আঁধারি পরিবেশে এক রক্তিম আকারধারণ করেছে। আনন্দীরাম কেমন বিহ্বল হয়ে গেলেন। এই সময় হঠাৎই যেন কেউ তাঁর কানে কানে বললেন-“কিরে দাঁড়িয়েথাকলে চলবে। সময় খুব অল্প। এর মধ্যেই তোকে যা করার করতে হবে।” তাঁর সম্বিত ফিরে এল।ইতিমধ্যেই সেই লোকগুলি তাঁরদৃষ্টির বাইরে চলে গেছিল। তিনি ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন ভাগিরথীর তীর ধরে সেই জঙ্গলের দিকে। মনে মনে একটা ভয় যেকরছিল না তা নয়, তবে তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে মা উলাইচণ্ডী তাঁর সাথে আছেন, সুতরাং কোন বিপদই তাঁকে স্পর্শ করতেপারবে না।কিছুটা যাওয়ার পরে তিনি সেই জায়গাটিতে এসে পৌঁছলেন যেখানে তীরের বেশ কিছুটা অংশ ধসে গিয়ে বেশ খাড়াইআকার ধারণ করেছে। মনে মনে মা উলাইচণ্ডীকে স্মরণ করে আনন্দীরাম খুব সাবধানে নীচে নামলেন। জঙ্গলের একটি গাছেরউপর নির্ভর করে তিনি আর একটি গাছের একটি ছোট ডাল ভেঙে নিলেন।এবার তটের সেই বিশেষ অংশের কাদামাটি তিনিসেই ডালটির সাহায্যে সরানোর চেষ্টা করতে শুরু করলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল ঐখানে সদ্য সদ্য মাটি লেপন করা হয়েছে ।বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর অনেকটা মাটি ধসে পড়ে ভাগিরথীতে তলিয়ে গেল। কোন রকমে টাল সামলে আনন্দীরাম গর্তেরভিতরে যা দেখতে পেলেন তা তাঁকে বিষ্ময়ে হতবাক করে দিল। তিনি দেখলেন যে সেখানে আটটি বড় বড় কাপড়ের গাঁটরীলুকিয়ে রাখা আছে । গাঁটরীগুলি অত্যন্ত ভারী।আনন্দীরাম সেগুলি ধীরে ধীরে ওপরে তুলে এবার খুব সন্তর্পণে নিজে ওপরে উঠেএলেন। কিন্তু এতগুলি গাঁটরী একা নিয়ে কিভাবে তিনি বাড়ি ফিরবেন ! এবার তিনি তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেইযেন হেসে উঠলেন।
আনন্দীরাম ছিলেন খুবই বলবান, এক অসাধারণ পুরুষ। দশাসই, লম্বা চওড়া চেহারা। বাহুতে যেমন জোর, কাঁধেও তেমন। তাইসাধারণ মানুষের কাছে যেগুলি দুরূহ কর্ম, তাঁর কাছে সেগুলি ছিল নিতান্তই সহজ। তার উপর তিনি মা উলাইচণ্ডীরআশীর্বাদধন্য।অতএব তাঁর বাহুতে, কাঁধে এবং মাথায় সব গাঁটরীগুলি অনায়াসে তুলে ফেলতে বেশী সময় লাগলো না। তখনোভোরের আলো তেমন করে ফোটেনি। অতএব রাস্তায় কোন লোকজন থাকার সম্ভাবনা ছিল না। থাকলে তাঁকে দেখে নির্ঘাতকোন দস্যু ভাবত। আনন্দীরাম অতগুলি ভারী গাঁটরী নিয়েও প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে তাঁর বাড়ী ফিরে এলেন। তাঁর পরিবারের মানুষজনওসকলে ঘুমিয়ে ছিলেন। অতএব তাঁকে কোন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হল না। তিনি সোজা তাঁর ঘরে ঢুকে গাঁটরীগুলি তিনি যেখাটে বিশ্রাম নিতেন তার নীচে লুকিয়ে রাখলেন।এদিকে তাঁর স্ত্রী সকালবেলা তাঁর ঘরে এসে খাটের নীচে অতগুলি কাপড়েরগাঁটরী দেখে খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। আনন্দীরাম যদিও আন্দাজ করেছিলেন যে গাঁটরীগুলির ভিতর কি ছিল , কারণ মাচণ্ডীর স্বপ্নের কথা তাঁর মনের মধ্যে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু স্ত্রীর কৌতূহল নিবারণের জন্য তিনি সেদিন দ্বিপ্রহরে এক একটিকরে গাঁটরী খাটের উপরে তুলে খুলে ফেললেন। প্রতিটি গাঁটরীতেই যে পরিমান সোনাদানা, স্বর্ণমুদ্রা, হীরে জহরত মণি মাণিক্যতথা অর্থসম্পদ ছিল তা দেখে আনন্দীরামের স্ত্রীর ত’ মুর্ছা যাবার জোগাড়। বস্তুত: আনন্দীরাম নিজেও এত ধনসম্পদের আশাকরেন নি। এ যেন সেই আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের কাহিনী। তিনি মা উলাইচণ্ডীকে মনে মনে প্রণাম করে তাঁর স্ত্রীর কাছেসকল কথার আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করলেন আর সাবধান করে দিলেন যে এ বিষয়ে তিনি যেন কারো কাছে মুখ না খোলেন। যদিকেউ প্রশ্ন করে তাহলে তিনিই তার উত্তর দেবেন।
স্ত্রীকে তিনি বললেন বটে, কিন্তু তাঁর নিজেরই মানসিক ভাবে খুবই দোলাচলের মধ্যে সময় কাটতে গেল। কিভাবে এই সব কথাতিনি সকলের থেকে গোপন রাখবেন তা ভেবে যেন কূলকিনারা পেলেন না। অবশেষে তিনি মা চণ্ডীরই শরণাপন্ন হলেন।সন্ধ্যাবেলায় চণ্ডীমণ্ডপে মায়ের সন্ধ্যারতির অন্তে তিনি সকলের একান্তে দেবীকে তাঁর এই মনোবেদনার কথা জানালেন । সেদিনরাত্রে দেবী আবার আনন্দীর সামনে আবির্ভূতা হলেন। তিনি বললেন-“আনন্দী, তোর ঐ ভাঙাচোরা চণ্ডীমণ্ডপে আমার আরথাকতে ভাল লাগছে না। তোর বাড়ির ঈশান কোণে যে বাস্তুজমি রয়েছে, সেইখানে আমার জন্য একটা সুন্দর চণ্ডীমণ্ডপ তৈরীকরে দে। এ বছর আমার অকালবোধন ঐ নতুন চণ্ডীমণ্ডপেই করিস।” এই বলে মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আনন্দীরামের ঘুম ভেঙেগেল। তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করলেন যে মা হঠাৎ নতুন চণ্ডীমণ্ডপ তৈয়ার করতে বললেন কেন ! তবে কি এর মধ্যে তাঁর কোনপ্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে ! হঠাৎই যেন তাঁর মাথায় বিদ্যুৎ ঝিলিক খেলে গেল।
পরদিন সকালে তিনি তাঁর বিশ্বস্ত লোকজনদের ডেকে তাঁর বাড়ীর উত্তর পূর্বে অর্থাৎ ঈশান কোণে যে বিস্তৃত ফাঁকা জমি পড়েছিল,সেখানে অবিলম্বে একটি অভূতপূর্ব কারুকার্যশোভিত চণ্ডীমণ্ডপ তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে ঐ চণ্ডীমণ্ডপেরঠিক নীচে, মাটির তলায় আরো একটা কক্ষ নির্মাণের আদেশ দিলেন। তবে সেটি তৈরী করতে হবে খুবই সঙ্গোপনে, যাতে কেউজানতে না পারে। ঐ কক্ষটিতে দেবী মায়ের সব আভরণ রাখা থাকবে–এই কথাই তিনি সকলকে বললেন।নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেকারুকার্যখচিত এক অনন্যসাধারণ চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ সম্পূর্ণ হল।সেই সাথে সাথে মাটির নীচের সেই গোপন চোরা কুঠুরীটিও।অসাধারণ স্থাপত্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সেই চণ্ডীমণ্ডপটি দেখে সবার তাক লেগে গেল। আর এ কথা ত’ আমি আগেইবলেছি যে চণ্ডীমণ্ডপ কেবল একবার নয়, পরবর্তীকালেও মিত্র মুস্তাফীরা নির্মাণ করিয়েছিলেন। যাই হোক, দুর্গাপুজা সে বছর ঐনতুন চণ্ডীমণ্ডপে সুসম্পন্ন হল।মায়ের পবিত্র পূজা উপলক্ষে আনন্দীরাম কদিন আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের সকল গরীবমানুষের জন্য অন্নকূটের ব্যবস্থা করলেন। চতুর্দিকে তাঁর নামে ধন্য ধন্য রব উঠল। ইতিমধ্যে আনন্দীরাম অত্যন্ত সঙ্গোপনেএকদিন গভীর রাত্রে সেই দস্যুদের লুণ্ঠিত রাজনারায়ণের সকল সম্পদ, যা মায়ের কৃপায় তাঁর অধিকারে এসেছিল, সেগুলিকেসেই চোরা কুঠুরীতে রেখে এসেছিলেন। তবে ওই কাপড়ের গাঁটরীগুলি নিয়ে তাঁকে তাঁর পরিবারের অন্যান্যদের প্রশ্নের সম্মুখীন যেএকেবারে হতে হয়নি তা নয়। তিনি সকলকে একই কথা বলেছিলেন যে ঐগুলিতে বিভিন্ন দস্তাবেজ,পারিবারিক ব্যবসাসংক্রান্তবহু কাগজপত্র তথা তাঁর পূর্বপুরুষদের তথ্য সম্বলিত অনেক মূল্যবান দলিল আছে। তাঁর কথা যে সকলে বিশ্বাস করেনি, সেটিআনন্দীরামও জানতেন।বিশেষ করে নতুন চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ, ধূমধাম করে মায়ের পূজো,গরীব মানুষদের জন্য অন্নকূটের ব্যবস্থা– এ সব কিছুই তাঁর পরিবারের লোকজন ভাল মনে মেনে নেয় নি। সবার মনেই একটা প্রশ্ন ঘোরাফরা করছিল যে এত অর্থআনন্দীরাম সহসা পেলেন কোথা থেকে ! কিন্তু প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বপূর্ণ এই মানুষটির মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো ছিল না।
আবার একদিন রাত্রে মা উলাইচণ্ডী আনন্দীরামের স্বপ্নে আবির্ভূতা হলেন। তিনি বললেন-“বাবা আনন্দী, আমি তোর ওপর খুবতুষ্ট হয়েছি। তোর বংশ পরম্পরায় আর কোনরকম আর্থিক কষ্ট থাকবে না। কিন্তু তোর ত’ এখনো আরো একটা কাজ বাকী আছেরে। ঐ দস্যুগুলিকে তোকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে হবে । আর আমার আশীর্বাদে তুই সেই কাজে সম্পূর্ণ সফল হবি।” এই বলেমা অন্তর্হিতা হলেন। এত কাজ আর উৎসবের মধ্যেও আনন্দীরাম কিন্তু ডাকাতদের কথা ভুলে যান নি।তিনি এক বিশেষলাঠিয়াল বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন যারা অহোরাত্র তাঁর গৃহ পাহারা দিত। এই বিষয়টিও পরিবার পরিজনদের মনে যথেষ্টসন্দেহের উদ্রেক করেছিল। তবে আনন্দীরাম কারোর ভ্রুকুঞ্চনকেই আমল দিতেন না। চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণের সময় তিনি বেশ কিছুতীক্ষ্ণ বড় বড় পাথরের টুকরো ছাদের উপর জমা করে রেখেছিলেন। এ ব্যাপারে কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন যেঅনাগত ভবিষ্যতই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
সেই অনাগত ভবিষ্যত বলতে তিনি কি বুঝিয়েছিলেন, আসুন আমরা এবার সেদিকে একটু নজর দি। আনন্দীরাম মিত্র এদিকেযখন দেবীর আশীর্বাদে আলোকিত, তখন সেই অন্ধকারের প্রতিনিধি–স্বরূপ দস্যুর দল কি করছিল।
সেটা জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই দিনের কথায়, যেদিন আনন্দীরাম মায়ের কৃপায় দস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিতজমিদার রাজনারায়ণের অর্থ সম্পদ নিজের অধিকারে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। সেদিন মধ্যরাত্রে ডাকাতের দল যখন গঙ্গারজঙ্গলাকীর্ণ তটে এসে দেখতে পেল যে তাদের লুণ্ঠন করা ধনসম্পদ অন্য কেউ দখল করেছে , তারা রাগে আর বিস্ময়ে হতবাকহয়ে গেল। এ ত’ চোরের ওপর বাটপাড়ি ! দস্যু সর্দার শিবেশানী ত’ ক্রোধে একেবারে দিশেহারা। সে কি করবে বুঝে উঠতেপারলো না। প্রথমে সে ভাবলো যে তারই দলের কেউ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু দলের সকলেই তার পা জড়িয়ে ধরেশপথ করলে যে তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। শিবেশানী ছিল খুবই ক্রুর এবং নির্দয়। বিশ্বাসঘাতকের কি শাস্তি, সেটা দলেরপ্রতিটি সদস্যই জানতো। তাই তারা কেউ যে একাজ করবে না, শিবেশানী পরে সেটা বুঝলো। তখন সকলে মিলে পরামর্শ করেএটা স্থির করলো যে তাদের খুঁজে বার করতে হবে যে আশেপাশের গ্রামে কেউ হঠাৎ খুব ধনী হয়ে অকাতরে অর্থ ব্যয় করছে কিনা।অবশেষে সেই সন্দেশ তাদের কাছে এসে পৌঁছাল যে উলা গ্রামের আনন্দীরাম মিত্র মুস্তাফীর হাতে অনেক অর্থ এসেছে যারমাধ্যমে সে যে কেবল এক অপূর্ব চণ্ডীমণ্ডপই তৈরী করেছে তাই নয়, দারুণ ধুমধাম করে দুর্গাপূজা করেছে । এমনকি আশেপাশেরপাঁচটি গ্রামের গরীবদের জন্য অন্নকূটের আয়োজন করেছে ! শিবেশানীর আর বুঝতে কিছু বাকী রইল না। অসংখ্য উৎকোচেরলোভ দেখিয়ে সে ঐ চণ্ডীমণ্ডপ প্রস্তুতকারী সব থেকে দক্ষ রাজমিস্ত্রীর কাছ থেকে এ খবরও জোগাড় করলে যে চণ্ডীমণ্ডপের নীচেমাটির তলায় আনন্দীরাম একটি চোরা কুঠুরী নির্মাণ করিয়েছেন। অতএব শিবেশানীর দুয়ে দুয়ে চার করতে আর বিলম্ব হলোনা। সে সুযোগ খুঁজতে লাগল আনন্দীরামের গৃহ আক্রমণ করার। সে সুযোগও খুব শীঘ্রই তার কাছে এসে গেল।
তখন প্রতি বছর মাঘ মাসের অমাবস্যার রাত্রে উলার পাশের গ্রাম কালীনারায়ণপুরে খুব ধূমধাম করে কালীপুজা হতো। উলা সহআশেপাশের সব গ্রামেরই অধিবাসীরাই এই পূজায় অংশ নিতো। শিবেশানী সেই রাত্রিটাই বেছে নিয়েছিল আনন্দীরামেরবাড়িতে চড়াও হওয়ার জন্য। তবে করিতকর্মা এবং বুদ্ধিমান তথা ধূর্ত আনন্দীরামও চুপ করে বসে ছিলেন না। তিনি যেমনএকদিকে শান্তিপুর থেকে বেশ কয়েকজন দক্ষ লাঠিয়ালকে নিয়ে তাঁর লাঠিয়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন, অপরদিকে গোপনেকয়েকজন চর নিয়োগ করেছিলেন দস্যুদের গতিবিধি জানবার উদ্দেশ্যে। এমনই একজন চরের মারফত তিনি দস্যু শিবেশানীরকথা জানতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে সেদিন ভাগিরথীর তীরে মুখে কালো কাপড় ঢাকা লোকগুলি ছিল ডাকাতসর্দার শিবেশানীরই দলবল। শিবেশানী এবং তার অনুচরেরা যে অত্যন্ত ভয়ংকর, তা তিনি জানতেন। কিন্তু তাঁর স্থির বিশ্বাসছিল যে স্বয়ং মা চণ্ডী যখন তাঁর সাথে আছেন, তখন কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারবে না। আর তাঁর একসময়ের বন্ধুরাজনারায়ণের পরিবারকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তাদের ত’ শাস্তি দিতেই হবে। অমাবস্যার দুদিন আগে তিনি তাঁরপরিবার পরিজনকে শান্তিপুরে তাঁর শ্বশুরবাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল যে সে বছর একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকারকারণে তাঁর পক্ষে কালীনারায়পুরে মা কালীর পূজায় যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই তিনি সকলকে শান্তিপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন যাতেসেখান থেকে তাঁরা ঐ পূজায় অংশ নিতে পারেন। আর তাদের মাধ্যমে ঐ পূজা, মায়ের ভোগ প্রস্তুতি ও উৎসবের হেতু বেশ মোটাঅঙ্কের একটি অর্থও তিনি পাঠিয়ে দিলেন।
মাঘ মাস।সে বছর শীতও পড়েছিল খুব জব্বর। অমাবস্যার রাত। চারিদিক শুনশান। আনন্দীরাম তাঁর কয়েকজন লাঠিয়ালকেছাদে পাঠিয়ে দিলেন। আর বাকীদেরকে বাড়ির পিছনের অংশে লুকিয়ে থাকতে বললেন। সদর দরজায় অবশ্য তালা দেওয়াছিল। তাঁর পরিকল্পনা ছিল যে ডাকাতের দল বাড়ির মধ্যে পাঁচিল টপকে প্রবেশ করলেই ওপর থেকে ঐ তীক্ষ্ণ পাথরের টুকরোগুলি তাদের লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হবে, যাতে তারা পালাবার পথ না পায়। আর সহসা এই আক্রমণে তারা যখন বেসামালহয়ে পড়বে, ঠিক তখনই বাড়ির পিছন দিক থেকে বাকী লাঠিয়ালরা এসে দস্যুদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তাদের অগ্রভাগেথাকবেন স্বয়ং আনন্দীরাম। ইতিমধ্যে ছাদের ওপর থেকে অন্যান্য লাঠিয়ালরাও নেমে আসবে। ফলে এই সাঁড়াশি আক্রমণেরসামনে দস্যুরা যতই ভয়ানক হোক, সকলেই বেসামাল হয়ে পড়বে।
একেবারে আনন্দীরামের পরিকল্পনা মাফিকই কাজ হলো। শিবেশানীর দলবল কল্পনাও করতে পারেনি যে এমন ভয়াবহআক্রমণের সম্মুখীন তাদের হতে হবে। আর সবথেকে সক্রিয় ছিলেন আনন্দীরাম নিজে। তিনি যেভাবে ডাকাতদের সঙ্গেলড়েছিলেন, সেটা দেখে তাঁর লাঠিয়ালের দলও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে তাদের মনে হয়েছিল যে তাদের মিত্রমশাইযেন একা নন, আড়াল থেকে আরো একজন কেউ তাঁকে বুঝি সঙ্গ দিচ্ছে। এদিকে আনন্দীরাম ও তাঁর লাঠিয়ালদের আক্রমণেশিবেশানীর দলবল সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। অনেকেই নিহত হলো, আর বাকীরা হাত পা ভেঙে পড়ে রইলো। তাদের নেতা স্বয়ংশিবেশানী আনন্দীরামের এক ভল্লের আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
পরের দিন যখন সব ঘটনা জানাজানি হলো তখন আনন্দীরাম মিত্র মুস্তাফীর নামে আশেপাশের সর্বত্র আবার ধন্য ধন্য রবউঠলো। বৃটিশ পুলিশরা এসে জীবিত ডাকাতদের গ্রেপ্তার করলো আর নিহতদের শবদেহগুলি নিয়ে চলে গেল। এই ঘটনার পরথেকে উলা থেকে শান্তিপুর তথা আশেপাশের এলাকা, সর্বত্র দস্যুদলের উৎপাত একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। তদকালীন ইংরেজসরকার উলার নাম পরিবর্তন করে নাম রাখলেন উলা বীরনগর। আনন্দীরাম এবং তাঁর লাঠিয়ালের দলকে অনেক পুরস্কারেওসম্মানিত করা হলো।
কিন্তু আনন্দীরাম জানতেন যে এসবই মা চণ্ডীর কৃপা। তিনি সেদিন মায়ের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই ঐ লড়াইটা লড়েছিলেন।এমনকি তাঁরও সেই রাতে মাঝেমাঝে মনে হয়েছিল যে তাঁর পাশে স্বয়ং দেবী চণ্ডী এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
এবার আনন্দীরাম তাঁর পরিবার পরিজনদের সকলকে এতদিন তাঁর সঙ্গে যা যা ঘটনা ঘটেছে সব জানিয়ে দিলেন। তাঁর যা কিছু, তার সবই করুণাময়ী উলাইচণ্ডী মায়ের আশীষেই প্রাপ্ত, সে কথাটি তিনি বারবার জানাতেও দ্বিধা করলেন না। পরবর্তীকালেআনন্দীরাম ঐ দস্যুদলের লুণ্ঠিত অর্থের একটি বড় অংশ তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায়ে লগ্নি করলেও, দেবীর নির্দেশ অনুসারে গরীবনি:স্ব মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজকর্মে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া এবং সর্বোপরি বছরে দুইবার শরৎকালেও বসন্তকালে মা দুর্গার আরাধনার সময় কদিন ব্যাপী অন্নকূটের আয়োজন করা–এসব বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়াকলাপের সর্বদানিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।তবে এর পর থেকে এখনো অবধি দেবীমায়ের কৃপায় তাঁর বংশধরদের আর কোনদিনই কোনআর্থিক দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়নি।
আনন্দীরাম মিত্র মুস্তাফীর জীবনের উপর আধারিত এই অলৌকিক কাহিনীর এখানেই পরিসমাপ্তি। যেখানে ইতিহাস নীরব, সেখানেই ত’ কল্পনার জাল বোনা সহজ। অলৌকিকতার মোড়কে এমনই এক কল্পনার মিশেল আমার এই রূপকথা। একলৌকিক চরিত্রের অলৌকিক উত্তরণ। আজও যখন গ্রামের কোন ধানক্ষেতের মেঠো আলপথে বাঁশির সুর ভেসে আসে, তখনই ত’ তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমন কত অজানা রূপকথার গল্প আমাদের চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। ইট কাঠের শহুরেসভ্যতার একটু বাইরে পা রাখলেই আমাদের জন্য অপেক্ষমান এমনই কত বিস্মৃত ইতিহাস,জীবনের রঙ্গমঞ্চের যবনিকারঅন্তরালে এমনই কত অত্যদ্ভুত উপাখ্যান। আজ তারই এক ঝলক এক কল্পিত অলৌকিক কাহিনীর মাধ্যমে আপনাদের কাছেউপস্থাপিত করলাম। কিন্তু দয়া করে এর সত্যতাকে কোন ভাবেই বিচারের কাঠগড়ায় তুলবেন না।
তবে আজ এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার ধাক্কায় বীরনগরের ইতিহাস কিন্তু অনেকাংশেই ম্লান। কালের স্রোতে বহু নিচেতলিয়ে গেছে মিত্র–মুস্তাফিদের সৃষ্টি। যেমন বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর মাটির বুকে বৃষ্টির চিহ্ণ আর কেউ মনে রাখে না, তেমনইআনন্দীরাম মিত্র মুস্তাফীর এই বীরনগরও আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সকলের কাছে বিস্মৃত, উপেক্ষিত, অবহেলিত। তার কথা আরকেউ মনে রাখে না। সত্যই বাস্তব বড়ই নিষ্ঠুর হয়। তবুও যদি কোনদিন বীরনগরে গিয়ে তার মাটিতে কান পাতেন, তাহলে হয়তো আজো শুনতে পাবেন দেবী উলাইচণ্ডীর সেই কথাগুলি – “ কিরে আনন্দী, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি ! সময় খুব অল্প। এর মধ্যেইতোকে যা করার করতে হবে।”
————————————————————————