ও যখনই চায়ের ঠেলা নিয়ে বসে ,সব সময় লখ্য থাকে দুর্নিবারের কোন বন্ধু বান্ধব আছে কিনা। কিন্তু না, তারা তো সব পাশ করে বেরিয়ে গেছে। ওর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কান্না পায় । বুকের ভিতর খুব কষ্ট হয়। কাউকে বলতে পারেনা মনের কথা। দুর্নিবার কি তবে ওকে ভুলে গেছে? নাকি ফেরেই নি? পাড়ার কিছু বখাটে ছেলে ওর পেছনে লাগে,

-” কিরে বড় ঘরের মাল পাকড়াও করেছিস। আমাদের মালকড়ি আছে। এদিকেও একটু চেয়ে দেখ। ”

জাহ্নবী ওদের পাত্তাও দেয়না। শাড়িটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে যায়। পাড়ার এক মাসি ওকে একদিন বলে,

-” এত রূপ থাকতে কেন খেটে মরিস লা?

জাহ্নবী উত্তর দেয় ” খাব কি?”

” কেনো আমি কি মরে গেছি? এ পাড়ার কত মেয়েকে কাজ জুটিয়ে দিলাম আর তোকে তো সব লুফে নেবে।”

মাসির কথা শুনে ও ঘৃণায় উত্তরই দেয় নি। পাড়ার ওই সব মেয়েদের ও দেখেছে বেশ সেজে গুঁজে রোজ দুপুরে বেরোয়। বলে, “কলকাতায় পার্ট-টাইম চাকরী করি “।  এখন জাহ্নবী বুঝতে পারল যে কি চাকরী ওরা করে। জাহ্নবী প্রতিদিন ঠেলা নিয়ে যায় আর ইউনিভার্সিটির বাইরে চারিদিক ওর চোখ খোঁজে দুর্নিবারকে। ও অনেক বার ফোন করেছে ওকে, প্রতিবারই সুইচ অফ বলে। ওর বাড়িও চেনে না জাহ্নবী, তাই নিজেকে বড় অসহায় লাগে। রোজ বাড়িতে ফিরে আসে মনমরা হয়ে। দুর্নিবারের ওপর ওর ভীষণ অভিমান হয়। কোনো খবর কি ও দিতে পারেনা? ঘরে শুয়ে শুয়ে ও লুকিয়ে কাঁদে। এভাবেই আরও দুবছর কেটে যায়। গলা দিয়ে ওর  খাবার নামে না। একদিন মামা বলে ” কিরে শরীলটার কি দশা করেছিস? আয়নায় দেখ একবার।” মামা সব বুঝতে পারে। বলে, “বড় লোকেদের খেয়াল বুঝলি? ” ও কোন উত্তর দেয়না। নতুন আশায় বুক বেঁধে তবুও ঠেলাটা নিয়ে যায়। এদিক অদিক তাকাতেই অসীমদাকে দেখে ও যেন হাতে স্বর্গ পায়।

“অসীম দা…? ও অসীম দা…?”

-“কিরে কেমন আছিস?” অসীম এগিয়ে আসে। জাহ্নবী উত্তেজনা আর আবেগে ওর হাতটা ধরে বলে, “তুমি ওর কোন খবর

জানো অসীমদা?”

-“কেন তুই জানিস না?” ও তো ব্যাংকে চাকরী পেয়েছে। কিছুদিন আগে বিয়েও করেছে।” জাহ্নবীর মাথাটা টলে উঠে।

পৃথিবী দুলছিল। সবকিছু ঝাপ্সা লাগছিল চোখের সামনে। একটা বোবা কান্না ওকে চেপে ধরে। অসীম কখন চলে গেছে ও জানেইনা।

সেদিন কিভাবে বাড়ি ফিরেছিল বলতে পারবে না।যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। বড় গম্ভীর দেখাচ্ছিল ওকে। ঘরে যা খাবার বেচে ছিল তাই দিয়ে ও মামা কে খেতে দেয়। ও শুধু ভাবে দুর্নিবার কেন এমন করলো ওর সাথে। মামা কত সম্বন্ধ এনেছিল ওর জন্য , ওকে রাস্তায় দেখেই কতজন বাড়িতে বিয়ের কথা বলতে আসে। যদিও ওরা ধনী ঘরের নয় তবুও তো ওর একটা নিজের সংসার হতো! যার জন্য ও কারো দিকে মুখ তুলে দেখেনি পর্যন্ত, সেই কিনা ওর সাথে এমনটা করতে পারল?!  মামা নানা রকম প্রশ্ন করছিল ও তার কোন উত্তরই দেয়নি। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ও ভীষণ কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ওর হেঁচকি উঠে যায়। পরের দিন সকালে বেশ দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে ও।  মামা বলে,” দোকানে যাবি কখন?” ও উত্তর দেয় ,” আর দোকানে যাব না মামা।” মামা মুখ খিঁচিয়ে বলে,” খাবি কি?”

” তোমার কোন চিন্তা নেই মামা, এখন থেকে আরও ভালো ভালো খাবে, খুব ভালো ভালো।”

তারপর ও হাসতে থাকে হাসতে হাসতে ওর চোখে জল এসে যায়। মামা হতবম্ব হয়ে ওর দিকে চেয়ে ভাবে তবে কি মেয়েটা পাগল হয়ে গেল? জাহ্নবী সেই দিনই ওই মাসির কাছে গিয়ে বলে,” মাসি আমি কাজ করতে রাজি।” মাসি তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়। বলে,” ঠিক করেছিস। এমন সুন্দর যার গতর সে কিনা খেটে খেটে মোলো! তবে আজ থেকে তোর নাম হল ‘গঙ্গা’ ।” সেইদিনই জাহ্নবী মরে গিয়ে গঙ্গার জন্ম হল। অর্থ যদিও একই। হঠাৎ লাল রঙের কার ব্রেক কষে জাহ্নবীর গা ঘেসে দাঁড়ায়। জাহ্নবী সচকিত হয়ে যায়। মধ্যবয়সের একজন মোটা সোটা লোক নেমে আসে গাড়ী থেকে। এদিকে দুর্নিবার তখনও চেয়ে আছে ওর দিকে। লোকটার পা দুটো টলছিল। সম্ভবত মদ খেয়েছে। জাহ্নবীর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, ” গঙ্গা ডার্লিং জলদি চলো। বহুত লেট হো গয়া।”

জাহ্নবী শুধু একবার দুর্নিবারের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে চায়। শুধু ওঠার সময় একটু জোরেই বলে,

“বড়োর পিরীতি বালির বাঁধ!”

তারপর একটা তাচ্ছিল্য সহকারে গাড়িতে উঠে বসলো। দুর্নিবারের কানে কথাটা স্পষ্ট এসেছে। দুর্নিবার তখনও চেয়ে আছে ওর দিকে। এদিকে ওর বউ ঝিলিক তখন ওর হাত ধরে টানছে আর বলছে,” এই ওইদিকে দেখনা তো , ওরা লাইনের মেয়ে। চলো এখন চাইনিস খাবো।” দুর্নিবারের চোখে তখন ওই মাতাল লোকটা আর জাহ্নবী চোখে ভাসে। তার জুনিকে কোনও মাতাল এভাবে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ওই দৃশ্যটা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না। একটা পাথর যেন বুকের মধ্যে। শুধু ভাবে তার জন্য জুনির জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। ওর মা যদি মরার হুমকি দিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য না করত তবে তো ওদের জীবনটা আজ অন্য রকম হত! মোবাইলের সিমটাও চেঞ্জ করে দিয়েছিল। ঝিলিক বলে আজ খুব মজা করবো । দিনটা খুব ভালো করে সেলিব্রেট করবো। ও শুধু অস্ফুস্ট ভাবে বলে, ” আজই তো আমার মজা করার দিন, সেলিব্রেট করার দিন!” তারপর দুহাতে নিজের মুখ ঢাকে। ঝিলিক ভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝি ক্লান্ত হয়ে গেছে। ওদিকে গাড়িতে বসে জাহ্নবী ভাবে ওই বউটার জায়গায় তো তার থাকার কথা ছিল। কিন্তু সে কি জানত যে ভগবান তার কপালে কি লিখে রেখেছেন? আসলে দোষ তো তার নিজের। বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখেছিল । দুর্নিবাররা তাদের মতো মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে পারে, ঘরে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না আসলে ওই দুর্নিবারের জাতকে তো ও জানতো না যে তারা এমনি বিশ্বাস ঘাতক হয়। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা তো এরা জানেনা। তাই অবলীলায় এসব করতে পারে। সাইডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বোতল বার করে বেশ কিছুটা মদ ঢক্‌ ঢক্‌ করে গলায় ঢালে। লোকটা বলে ওঠে, ” গঙ্গা ডার্লিং জাদা মত্‌ পিয়ো, নহিতো সারা মজা কিরকিরা হো যায়েগা।”  গঙ্গা হাসে , হাসতে হাসতেই বলে, “মজা তো আজই হোগা বাবু, আজই হোগা।”

তারপর অস্ফুস্ট ভাবে বলে -“জাহ্নবী আজ গঙ্গা”।

দুর্নিবার বলেছিল বড় পবিত্র তোমার নাম। পবিত্রই বটে! তাইতো সারা পৃথিবীর নোংরা সে ধারন করে চলেছে।

ও গেয়ে ওঠে,” রাম তেরি গঙ্গা মেইলি হো গয়ী…”

তারপর হাঃ হাঃ করে হাসতে থাকে। ওর বুকের ভেতরটা যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। যেন এই মাত্র কেউ ওর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে চলে গেল। হঠাৎই ও দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ওঠে। লোকটা ভাবল বুঝি নেশা চড়ে গেছে। সে বিড়বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করে, ” সত্যানাশ হো গয়া। সারা মজা কিরকিরা কর দিয়া।”

কারটা তখন খুব স্পীডে বাইপাস দিয়ে চলতে থাকে।

 

*****

~ অন্য জীবন – পঞ্চম (অন্তিম) পর্ব ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমুখচোরা
Next articleবিদায়বেলা
Rina Acharya
একজন গৃহবধূ। শখ বিভিন্ন ধরনের কবিতা লেখা এবং গান শোনা।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

5 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments