উত্তরার বিয়ে হয়েছে তাও চার বছর হয়ে গেল । এখনো মাতৃত্বের সুখ থেকে হয়ে আছে বঞ্চিত । অথচ বয়স বেশি নয় । মাত্র পঁচিশ । শরীর স্বাস্থা যথেষ্ট ভালো । ভালো হবে নাই বা কেন ? ন্যাশনাল লেভেলের টেবিল টেনিস প্লেয়ার ছিল দু বছর আগেও । বিয়ের পরেও দু বছর জুনিয়রদের কোচিং করিয়েছে । নিজে প্রতিদিন জিমে সময় দেয় দেড় থেকে দু ঘন্টা । তলপেটে চর্বি জমার কোনো সুযোগই নেই । তথাপি সন্তান রয়ে গেছে অধরা । অথচ দেখ উত্তরার দিদিকে । পড়াশুনোর বাইরে একটা যে জগৎ আছে সে কথাটাই বেমালুম ভুলে গেছিল । তার ওপর ছিল অনিয়মিত পিরিয়ড । ছোট থেকেই মোটাসোটা । এত অল্প বয়সেই পেটে এক তাল চর্বি । সেই মেয়ের বিয়ের প্রথম বছরেই নরমাল ডেলিভারি । জন্ম দিল এক ফুটফুটে সুন্দর সুস্থ সন্তান ।
ফুল্লরার বিয়ে হয়েছে উত্তরার বিয়ের দু বছর বাদে । উত্তরার বিয়ে প্রেম ঘটিত । ছেলেটির নাম রণদীপ । রণদীপও ন্যাশনাল লেভেলের টেবিল টেনিস প্লেয়ার । পরবর্তী কালে উত্তরাদের কোচ ছিল । সেখান থেকেই ভালোবাসার সূত্রপাত । চাকরি করে রেলে । বাড়ির বড় ছেলে । বাড়ির থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছিল । সবাই জানে রণদীপ আর উত্তরার সম্পর্ক । কিন্তু উত্তরা ছোট । তার দিদি আছে । দিদির আগে বোনের বিয়ে হলেই পাত্রপক্ষ অন্য কিছু ভাবে । দিদির তখনো দুটো সেমিস্টার বাকী । নিজে থেকেই বলল । মা , বোনের বিয়ে টা আগে দিয়ে দাও । আমার এখনো বিয়ে করার দেরি আছে । তাছাড়া ছেলের বাড়ির লোক যখন চাইছে , উত্তরার বিয়ে দিতে অসুবিধা কোথায় ? এরপরে আর কোনো অসুবিধা থাকলো না । বিয়ে হয়ে গেল উত্তরার । প্রথম দু বছর কোচিংয়ের জন্য এত ব্যস্ত ছিল যে ইচ্ছে করেই প্রেগনেন্সি নেয় নি । এরপর যখন দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়লো , বিধি বাম । কিছুতেই কিছু হয় না ।
শুরু হলো ডাক্তার দেখানো । ডাক্তার মানে একগাদা টেস্ট । হলো টেস্ট । খেলো গুচ্ছের ওষুধ । লাভ কিছু হলো না । এর মধ্যে ফুল্লরার বিয়ে হয়ে গেল । বাচ্চাও হয়ে গেল এক বছরের মাথায় । একদম নরমাল ডেলিভারি । এরপর থেকেই মনের ওপর চাপ পড়তে লাগলো উত্তরার । অযাচিত উপদেশ ধেয়ে আসতে লাগলো একের পর এক । কেউ বলে জিম কর । আবার কেউ বলে যোগা কর । মানুষ যখন নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে , তখন অন্যের উপদেশ শির ধার্য করে নেয় । মাস কয়েক জিম করে ফেড আপ । ছেড়ে দিল জিমে যাওয়া । এবার শুরু হলো যোগা । উত্তরার শ্বশুর বাড়ি বালি তে । মুশকিল হলো বালিতে ভালো যোগার ট্রেনার নেই । খোঁজ লাগাতে শুরু করলো । টবিন রোড ছাড়িয়ে মালো পাড়ায় এক যোগ কেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া গেল । এটা একটা আশ্রম । নিয়ম কানন একটু আলাদা । প্রথমে অনেকটা হাসপাতালের আউটডোরের মত । খুব সকালে গিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হয় । তারপর সমস্যা অনুযায়ী ঘর আলাদা । প্রত্যেকটা ঘরেই আলাদা আলাদা ইন্সট্রাক্টার । পুরুষদের জন্য সন্ন্যাসী ট্রেনার আর মহিলাদের জন্য মহিলা ট্রেনার ।
নিয়ম করে চলল মাস তিনেক । কিন্তু রোজ এত সকালে এতদূরে আশ্রমে আসা খুবই অসুবিধার । ট্রেনারকে সে কথা বলল উত্তরা । ট্রেনার বাড়িতে আসতে রাজী । সপ্তাহে একদিন করে । মাসে পাঁচশো টাকা । আসা যাওয়ার খরচ একশো টাকা আলাদা । উপায় নেই । তাই মেনে নিল উত্তরা । যোগ ব্যায়াম করতে অসুবিধে নেই । অসুবিধা হলো খালি পেটে ধৌতি করা । ধৌতি হল খালি পেটে তিন চার গ্লাস জল খেয়ে মুখের ভেতর দুটো আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করতে হবে । অর্থাৎ পেটে জমে থাকা সমস্ত আবর্জনা জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া । অসম্ভব কষ্ট হয় উত্তরার । কান্না পেয়ে যায় । তবুও করে । যদি সুফল পাওয়া যায় । কিন্তু সুফল পাওয়া গেল না । যে জন্য এত কষ্ট সহ্য করা সেটাই রয়ে গেল অধরা । আস্তে আস্তে কমিয়ে দিল লোকের বাড়ি যাওয়া । এটার পেছনে অবশ্য অন্য একটা কারন আছে । ছোট থেকেই খেলা ধুলো করেছে । আর পাঁচটা মেয়ের মত পি এন পি সি করার মত সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না । নিজের খেলা আর প্রাকটিস এই ছিল তার দুনিয়া । এখানে সঙ্কীর্ণতা কম , খোলামেলা ভাবটাই বেশি ।
একবার এক কাজিনের বিয়েতে গেছিল । থাকতে বাধ্য হয়েছিল বৌভাত পর্যন্ত । গায়ে হলুদের সময় হঠাৎ পাশ থেকে এক পিসিমা আর তার ছেলের বৌ একঘর লোকের মাঝে সরাসরি বলে বসলো , বাজা মেয়ে ছেলেদের শুভ কাজে থাকতে নেই । কথাটা যা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা সেটা বুঝতে উত্তরার একটু সময় লেগেছিল । এই কথার মানে তার কাছে অজানা । কাজেই সে আগের মত কাজিনকে হলুদ মাখাতে লাগলো । পিসিমার ছেলের বৌ এগিয়ে এসে খপ করে ধরলো উত্তরার ডান হাতটা । বলল , তুমি এখান থেকে চলে যাও । তোমার শ্বাস লাগলে আমাদের মেয়ের অমঙ্গল হবে ।অবাক হয়ে গেল উত্তরা । তারপরেই ছুটে বেরিয়ে গেল । নিজের ঘরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানার ওপরে । কাঁদতে লাগলো অঝোরে ।
এরপর থেকেই লোকের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিল । গুটিয়ে নিতে শুরু করলো নিজেকে । উত্তরার মা একদিন এসে বললেন , উত্তরা , একজন ভালো জ্যোতিষীর সন্ধান পেয়েছি । প্রতি মঙ্গল আর শনিবার বসেন । গণনা করে একেবারে অবর্থ ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে । উত্তরার ইচ্ছা ছিল না যওয়ার । তার মা তাকে এত জোরা জুরি করতে লাগলো যে সে বাধ্য হয়ে গেল । জ্যোতিষীর ঘরের বাইরে অনেক ভিড় । ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে উনি একজন একজন করে ভেতরে ডেকে নেন । যার সমস্যা সে একা যাবে । সাথে যেই আসুক , সে বাইরে থাকবে । একজন মহিলা চলে যাবার সময় কেন জানি না উত্তরাকে ইশারা করে ডাকলো । একটু দূরে ফিসফিস করে বলল , যেও না । লোকটার স্বভাব একদম ভালো না । মা কে ডেকে ফিরে গেল বাড়ি । দেখায় নি জ্যোতিষীকে । মা খুব রেগে গেছিল । বলল , কে কী বলল আর তুই চলে এলি । তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি । এই ঘটনার মাস খানেক বাদে মা নিয়ে গেল এক মন্দিরে । সেখানে একটা বট গাছে লাল সুতোয় বাঁধা প্রচুর ঢিল ঝুলছে । মা বলল , উত্তরা , তুই মানত করে মায়ের নামে গাছের ডালে একটা ঢিল এই লাল সুতোয় বেঁধে ছুড়ে দে । দেখবি , কোল আলো করে আমার নাতি আসবে । উত্তরা তেমন টাই করলো ।
ফুল্লরার ছেলের অন্নপ্রাশন । সপরিবারে এল নেমন্তন্ন করতে ।
উত্তরা বলল , আমি যাবো না , দিদি । কিছু মনে করিস না ।
কেন , যাবি না কেন ?
আমি এখন আর কোথাও যাই না ।
সে অন্য কোথাও না যাও , তোমার দিদির বাড়িতে তো যাবে । আর তুমি তো আমার অর্ধাঙ্গিনী ,তুমি না গেলে কী আমার ভালো লাগবে ?
দুই বোনের কথার মাঝে ফস করে বলে বসলো ফুল্লরার স্বামী প্রনবেশ | একটু তির্যক দৃষ্টিতে ফুল্লরা তাকালো তার স্বামীর দিকে । প্রনবেশ বুঝতে পারলো ঝপ করে কথাটা বলা ঠিক হয় নি । তাড়াতাড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলা শুরু করলো , তোমরা এখনকার মেয়ে । তার ওপর তুমি তো আবার খেলা ধুলো করতে । এ রকম গেঁয়ো দের মত কাজ করছো কেন ? বিজ্ঞান কোথায় এগিয়ে গেছে । এখনকার দিনে এগুলো কোনো ব্যাপার না কি ? কত রকম পদ্ধতি এসে গেছে । একটু খরচ হবে । হোক । IVF পদ্ধতিতে প্রচুর ভালো রেজাল্ট আসছে । পার্কস্ট্রিটে আমার জানা শুনো এরকম ভালো ডাক্তার আছে । যদি চাও ঠিকানা এনে দিতে পারি ।
মনে মনে খুব রাগ হলো উত্তরার । মুখে বলল ,ঠিক আছে আপনি রনদীপকে বলবেন । আমি এসব ভালো বুঝি না ।
এটা যদি নাটকের রিহার্সাল হয় তাহলে আসল নাটক হল অন্নপ্রাশনের দিন । সবার অনুরোধে উত্তরা গেল ফুল্লরার ছেলের অন্নপ্রাশনে । একটা ঘরে চুপচাপ বসে মোবাইল ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল । নিজের ছায়া পড়তে দেয় নি শুভ কাজে । এখন সে জেনে গেছে যে শুভ কাজে বাজা মেয়েদের থাকতে নেই । কী দরকার তার পরের বাচ্চার অমঙ্গল করার ? ফুল্লরার ননদ শুভমিতা প্রায় উত্তরার বয়েসী । খুব হাসিখুশি মেয়ে । উত্তরা কে খুব ভালোবাসে । এতজন লোকের মাঝে বাচ্চাটা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল । শুভমিতা ওকে কোলে নিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করতে করতে এসে ঢুকলো উত্তরা যে ঘরে বসে ছিল সেই ঘরে । উত্তরা কে দেখে বলল , ও মা ! তুই এখানে । আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি । এক মিনিট ধরতো পুঁচকে টাকে । আমি একটু শাড়িটা ঠিক করে নি । ধরলো উত্তরা বাচ্চাটাকে । ঠিক সেই মুহূর্তে ফুল্লরা দুধের বোতল নিয়ে এসে হাজির । বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে । উত্তরার কোলে বাচ্চাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দিল । প্রথমেই এক ঝটকায় বাচ্চাটা উত্তরার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বলল , তুই বাচ্চাটাকে ধরলি কোন সাহসে ? জানিস , তোর বাচ্চা ধরা এখন নিষেধ । তোর ছোঁয়ায় আমার ছেলের ক্ষতি হতে পারে । তুই কী আমার সর্বনাশ করতে এসেছিস ?
শুভমিতা একটু থতমত খেয়ে গেছিল । নিজেকে সামলে নিয়ে ফুল্লরাকে বলল , উত্তরাকে বলছিস কেন ? ও তোর ছেলেকে নেয় নি । শাড়ি ঠিক করার জন্য আমি ওকে ধরতে বলেছিলাম । তো র যা বলার আমাকে বল ।
দেখ শু , আজকের দিনে আমি কোনো গন্ডগোল করতে চাই না । তুই কাজটা ঠিক করিস নি । ভবিষ্যতে আমার ছেলেকে অন্য কারো কোলে দেওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নিবি । আমি চাই না সবার কোলে আমার ছেলেকে দেওয়া হোক ।
প্রচন্ড রেগে গেল শুভমিতা । নিজেকে সংযত রেখে বলল , তুই কী বলতে চাইছিস ফুল্লরা ? উত্তরা তোর নিজের বোন । তুই কী ভুলে গেছিস সে কথা ?
আমি তোর সাথে তর্ক করতে রাজী নই । আমার বোন তো কী হয়েছে ? যে অশুভ সে সবার কাছেই অশুভ । সে বোনই হোক বা অন্য কেউ হোক ।
অশুভ মানে কী ? পরিষ্কার করে বল ?
কেন তুই বুঝতে পারছিস না ? ন্যাকামি করছিস কেন ?
আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে তুই কী কারনে এতবড় কথাটা বললি ? সন্তান হওয়া না হওয়াটা সম্পূর্ণ বায়োলজিকাল ব্যাপার । এটা কোনো অসুখ বা ছোঁয়াচে রোগ নয় যে ছোঁয়া এড়িয়ে চলবো । এর সাথে শুভ অশুভর কী সম্পর্ক ? আর সত্যি কথা বলতে কোনো মেয়েই এর জন্য দায়ী নয় । সন্তান না হওয়াটা তার দুর্ভাগ্য । দুঃখ । কোথায় আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে তাকে আমাদের মধ্যে নিয়ে এসে আনন্দে রাখা , তা না করে তুই ওকে অসম্মান করছিস ?
তোর বক্তৃতা শুনতে আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই । যে চায় তাকে শুনা গিয়ে । আমার শেষ কথা আজকের এই শুভ অনুষ্ঠানে আমি আমার সন্তানের ওপর কোনো রকম অশুভ ছায়া পড়তে দেব না । তা তে কে কী ভাবলো আমার বয়েই গেল ।
সে টা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল । উত্তরা কে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনলি কেন ? ও তো আসতে চায় নি । তুই আর দাদা গিয়ে নেমন্তন্ন করে আসলি । ভাগ্যি ভালো আমি তোর মত অত শিক্ষিত নই , আবার অশিক্ষতও নই । যেখানে উত্তরার সম্মান নেই , আমিও সেখানে থাকবো না । তোরা থাক । চল উত্তরা ।
এতক্ষন একটা কথাও বলে নি উত্তরা । হা করে দেখছিল তার নিজের দিদিকে । শুধু জল ঝরে গেছে দুচোখ দিয়ে । এখন চোখ শুকনো । আর কান্না পাচ্ছে না । দুঃখ হচ্ছে না । কারোর ওপর কোনো রাগও হচ্ছে না । মনে হচ্ছে সে যেন সমস্ত অনুভূতির বাইরে । বুকের ভেতরটা কেমন মরুভূমির মত শুকিয়ে গেছে । মুখটা কেমন থম মেরে । এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস । কেমন একটা ঘোরের ঘরে নেমে এল বিছানা থেকে । দৃষ্টিতে তার শূন্যতা । অনুষ্ঠান বাড়ি তার কাছে উজ্জ্বলতা হীন সাদা ফ্যাকাশে । চলশক্তিহীন এক জড় বস্তুতে রূপান্তরিত উত্তরা এগিয়ে চলল খোলা দরজার দিকে। এক মুহূর্তে অনুষ্ঠান বাড়ির চেহারা গেল বদলে । উপস্থিত অভ্যাগতরা যেন এক মৌনি বাবার নির্দেশে মৌন ব্রত পালনে তৎপর । তবুও তার মধ্যে ফুল্লরার স্বামী প্রনবেশ আর তার বাবা সবাইকেই অনুরোধ করছে আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে । কেউ হলো , কেউ হলো না । ফিসফিস ,গুজগুজ চলতেই থাকলো ।
অনুষ্ঠান বাড়িতে আসতে একটু দেরি হয়েছিল রণদীপের । গেছিল সোনার দোকানে । একটা সোনার চেন অর্ডার দেওয়া ছিল । গতকাল ছিল দেবার ডেট । কী একটা কারনে দিতে পারে নি । পরিচিত দোকান । বহু দিনের দাদা ভাই সম্পর্ক । রাগ করাও যায় না । তাই গেছিল আনতে । উত্তরা কে বলেছিল , তুমি চলে যেও মার সাথে , ঠিক সময় আমি পৌঁছে যাবো । যেতে তো হবেই । শালী বলে কথা । হোক না বড় শালী , শালী তো ? মিষ্টি মধুর সম্পর্ক । রণদীপ খুব ভালোবাসে তার এই বড় শালীকে । মনে মনে শ্রদ্ধা করে । আসলে রণদীপের নিজের পান্ডিত্য কলেজ পর্যন্ত । মানে প্লেন বি এ পাশ । একদম সাধারণ ছাত্র সে । তার এই শালী ডক্টরেট । ফিজিক্স না কেমিস্ট্রি কি সে যেন ডক্টরেট করেছে । এ রকম এক জন শিক্ষিতা মহিলা তার শালী ভাবতেই গর্বে বুক ভরে যায় । রণদীপের নিজের কোনো দিদি নেই । বড় শালিকেই নিজের দিদির মতন ভালোবাসে । সেই ভালোবাসার দিদির প্রথম ছেলের অন্নপ্রাশন । না গেলে চলে ? সোনার চেন যত ছোটই হোক এই বাজারে সোনা সাধারণ মধ্যবিত্তের ধরা ছোঁয়ার বাইরে । সোনায় হাত দেওয়াই মুশকিল । তবু সম্পর্কের খাতিরে দিতে হয় । সোনার দোকান থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা অনুষ্ঠান বাড়ি । খুব ভালো লাগছে । নিজের না হোক বড় শালীর ছেলে তো বটে । মিষ্টি দুধের শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই স্বর্গের সুখ । সেই জন্যই তো বলে শিশুই ভগবানের আর এক রূপ । মনে মনে রণদীপ ভাবছে , উপহারটা সবারই খুব পছন্দ হবে । উত্তরারও ভালো লাগবে । সবাই তাকেই বলবে , কী ভালো উপহার দিয়েছ উত্তরা । দেখলে হবে । দেওয়ার মন চাই । মুচকি হাসবে উত্তরা । যেমন হাসে সে । বলবে , এ বাবা , দিদির ছেলে মানে তো আমারই ছেলে । ওকে দেব না তো কা কে দেব ? আমি আর দিদি আলাদা কিছু ?
ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে হাঁকডাক জুরে দিল রণদীপ । ফুল্লরাকে সে বড়দিদি বলে ডাকে । ডাকলো , বড়দিদি , কোথায় গেলে ? উপস্থিত জনের কেউ বুঝতেই পারছে না রণদীপের এই অদ্ভুত আচরণ । সে কী মানুষ ? সে কি জানে না একটু আগে উত্তরাকে কী অপমানটাই না করলে তার দিদি ফুল্লরা ? তার কী আত্মসম্মান বোধ নেই ? এত কিছুর পরেও সে এসেছে উপহার নিয়ে । ফুল্লরা সামনে আসতেই রণদীপ বলল , সরি দিদি , একটু দেরি হয়ে গেল । সোজা আসছি জুয়েলারি শপ থেকে । একটা চেন অর্ডার দিয়ে ছিলাম । কালকে দেওয়ার কথা ছিল । দিতে পারে নি । আজ কে দিল । আজ সকালে দোকান খোলার পর দাঁড়িয়ে থেকে মাল কমপ্লিট করিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা তোমার বাড়ি ।বলছি , উত্তরা কোথায় ? ওকে একটু ডাকো । উপহারটা ওর হাত দিয়ে দেব । আমাদের সোনা বাবার জন্য একটা সুন্দর উপহার এনেছি ।ওর মাসি ওর গলায় পড়িয়ে দেবে । সেখানে চুপিচুপি এসে দাঁড়িয়েছে প্রনবেশ । রণদীপকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল । খুব সংক্ষেপে জানালো যে তার বোন শুভমিতার সাথে উত্তরার একটু কথা কাটাকাটি হয় উত্তরাকে কেন্দ্র করে । এতে উত্তরা রাগ করে বাড়ি চলে গেছে । নিজের স্ত্রীকে খুব ভালো করে চেনে রণদীপ । তার বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হলো না যে উত্তরাকে ফুল্লরা এমন কিছু সাংঘাতিক কথা বলেছে যে তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব হয় নি । যেখানে তার স্ত্রীর সম্মান নেই সেখানে তার থাকার প্রশ্নই ওঠে না । আর একটা কথাও না বলে ছুটে বেরিয়ে গেল রণদীপ । পেছন পেছন প্রনবেশ আর তার বাড়ির লোক । একটা ট্যাক্সি ধরে রণদীপ ছুটলো বাড়ির পথে । বাড়িতে এসে উত্তরাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল সে । তার প্রাণের প্রিয় উত্তরার এই অবস্থা সে ভাবতেই পারছে না ।
ফোন করলো ডাক্তারকে । লোকাল পরিচিত ডাক্তার । ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন , মানসিক ভাবে খুব আঘাত পেয়েছেন । খুব ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে । আমার জানা দুজন আছে । একজন পার্ক স্ট্রিটে , আর একজন সল্ট লেকে । দুজনেই ভালো । আমি ফোন করে দিচ্ছি । যাকে ফাঁকা পাবে তার কাছেই চলে যাও । আজকেই যাবে ।
সল্ট লেকের ডাক্তার ময়ূরীকে পাওয়া গেল । উত্তরাকে নিয়ে সঠিক সময়ে উপস্থিত রণদীপ । ডাক্তার ময়ূরী উত্তরাকে ভালো করে দেখলেন । বললেন , মানসিক ভাবে খুব শকড হয়েছেন । আঘাতটা বড্ড বেশি । সময় লাগবে । তাতেও পুরোপুরি পেশেন্ট সারবে কি না বলতে পারছি না । হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল রণদীপ । উত্তরাই তার সব । উত্তরাকে ছাড়া সে বাঁচবে কী ভাবে ? উত্তরা পাগল হয়ে গেল । মানতে পারছে না রণদীপ । সে ঠিক করলো উত্তরাকে নিয়ে কোথাও চলে যাবে । একদম নির্জন কোনো স্থানে । জন মানুষ থাকবে না শুধু সে আর তার উত্তরা । সুস্থ সে করে তুলবেই তার জানুকে । এটা তার চ্যালেঞ্জ ।
পরের দিনই গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লো রণদীপ উত্তরাকে সঙ্গে নিয়ে । উত্তরার কোনো বিকার নেই । ডাক্তারের ওষুধে ঘুমিয়েই থাকছে অধিকাংশ সময় । ঘুম ভেঙে উঠে চার পাশটা একবার দেখছে । কোনো প্রশ্ন নেই । কোনো অনুভূতি নেই । ঘোলাটে দৃষ্টি । চেয়ে আছে বাইরের দিকে ।
ঘাটশিলা থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার ভেতরে একটা আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম । দলমা পাহাড়ের পাদদেশে । শাল মহুয়া শিমূল আর গামার গাছের ভিড় । হরেক রকম পাখি । কি মিষ্টি তাদের ডাক । ধু ধু প্রান্তর । তারই এক ধারে গুটি কয়েক মাটির বাড়ি । খড়ের চাল । মাটির দেওয়ালে রঙিন আলপনা । উঠোনে হাঁস মুরগী । গোয়ালে বাঁধা গরু । এরকমই একটা বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল রণদীপ আর উত্তরা । বাইরের বিশেষ করে শহরের মানুষের হঠাৎ আগমনে সন্দিহান হয়ে ওঠে আদিবাসী গ্রাম । গন্ধ পায় কোনো অশনি সংকেতের । আড়ষ্ঠ মানুষগুলোর চোয়াল শক্ত হয়ে ঝুলে পড়ে নিচে । অন্ধকারে ত্রস্ত হাত ঠিক খুঁজে নেয় তীর ধনুক আর টাঙিটা । এসব কিছুই ঘটে নি রণদীপদের সাথে ।
বিয়ের পর এক বন্ধুর পরামর্শে এখানে এসেছিল নতুন বৌকে নিয়ে হানিমুন করতে । সেই বন্ধুও আদিবাসী । এখানে তার মামা বাড়ি । সবাই অবাক ! উত্তরা তো হেসেই খুন । এটা কি একটা হানিমুন স্পট ? জানতে চেয়েছিল উত্তরা । রণদীপ বলেছিল , ভালো লাগবে । প্রকৃতির সাথে আমরা মিশে যাবো । এত নির্জনতা কোথায় পাবে ? ভালো লেগেছিল । খুব ভালো লেগেছিল । এই সহজ সরল মানুষগুলো এদেরকেও ভালোবেসে ফেলেছিল । উত্তরাকে মেয়েরা শিখিয়েছিল সাঁওতালি নাচ আর রণদীপ অনভ্যস্ত হাতে বাজিয়েছিল মাদল । বাঁশি বাজাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারে নি । চলে আসার দিন ওদের চোখে ছিল জল । উত্তরাকে জড়িয়ে ধরে সাঁওতালী মেয়ে বউরা বলেছিল , বিটি , আবার আসবিক বটে । আবার মুরা একসাথে লাইচবো ।
আবার এসেছে উত্তরা আর রণদীপ । কিন্তু এবার তো তাদের বিটিকে অন্য রকম দেখাচ্ছে । হাসতে ভুলে গেছে । কোনো কথা বলছে না । তাকিয়ে আছে উদাস দৃষ্টিতে । কী হয়েছে গো আমাদের বিটির ? জানতে চায় ওরা । তোমাদের বিটি পাগল হয়ে গেছে । এ আর সেই বিটি নেই । কেঁদে ফেলে রণদীপ । তৎপর হয়ে ওঠে এই অনাত্মীয় মানুষগুলো । শুরু করে দেয় ছোটাছুটি । এ যেন তাদের নিজেদের মেয়ে , বোন কিংবা ঘরের বউ । সুস্থ করে তুলতে কোমড় বেঁধেছে সবাই । কেউ ছুটে ডেকে আনে ওঝা ,কেউ ডাকলো পুরোহিতকে । সে আবার গ্রামের মোড়লও বটে । পুরহিত পাথরের বাটিতে লতা ,গুল্ম। পাতা , গাছের ছাল , জড়ি বুটি – এই সব ঘষে ওষুধ বানিয়ে খাইয়েছিল উত্তরাকে । ওঝা ঝাড়ফুঁক দিয়ে তাড়াবার কসরত করেছিল অশরীরী শক্তিকে । তার মতে এই অশরীরী শক্তি হচ্ছে এই অসুখের মূল কারন । তাকে তাড়াতে পারলেই বিটি সুস্থ হয়ে যাবে । উত্তরার কোনো বিকার নেই । কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না । সবেতেই হ্যা । না বলা ভুলে গেছে ।
একদিন বিকেলে একটা শাল গাছের নিচে উত্তরাকে নিয়ে বসে আছে রণদীপ । একটু বাদে এক মাতাজী সাদা ধবধবে শাড়ি পড়ে বেশ অনেকজন নারী পুরুষের সাথে চলেছেন মেঠো পথ দিয়ে । হঠাৎ তার নজর পড়লো বসে থাকা উত্তরার ওপরে । এগিয়ে এলেন মাতাজী । এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন উত্তরার দিকে । উত্তরার কোনো হেল দোল নেই । সে দেখছে দূরের পাহাড় কিংবা কিছুই দেখছে না । মাতাজী কে দেখে রণদীপ উঠে দাঁড়িয়েছে । মাতাজী জানতে চাইলেন উত্তরার সম্পর্কে । রণদীপ বলল উত্তরার দুঃখের কাহিনী । উত্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মাতাজী । বললেন , পাশের গ্রামে আমার আশ্রম । ওকে নিয়ে কালকে চলে এস ।
গেল রণদীপ উত্তরাকে নিয়ে মাতাজী র আশ্রমে । অনেকটা জায়গা নিয়ে আশ্রম । অনেকগুলো মাটির বাড়ি । খড়ের চাল । আশ্রমের সেবক এবং সেবিকারা চুপচাপ নিজের নিজের কাজ করে চলেছে । আশ্রমের মন্দির চত্বরে গিয়ে বসলো । মাতাজী বললেন , উত্তরাকে এখানে রেখে যাও। ও থাকবে আমার কাছে । তুমি মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাবে । তবে দূর থেকে । ওর সামনে আসবে না । সময় হলে আমি তোমাকে বলবো । যতদিন আমি তা না বলবো তুমি ওকে দেখা দেবে না । দেখি , আমার ঠাকুর কিছু করতে পারে কি না ?
কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না রণদীপ । উত্তরাকে ছাড়া বাড়িতে ফিরে যাবে কী ভাবে ? সবাই জানতে চাইবে । মাতাজীর নির্দেশ কাউকে বলা চলবে না । উত্তরার মা বাবা জানতে চাইলে কী বলবে ?
মাতাজী একটু হাসলেন । বললেন , আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা । তুমি একটা কাজ কর । একদিন গোপনে ওর বাবা আর মা কে নিয়ে আস । আমি কথা বলবো ওদের সাথে । শুধু একদিন । যাতে ওরা জানতে পারে যে ওদের মেয়ে বেঁচে আছে । ঠিক আছে । তাহলে তুমি এখন এস ।
প্রথম দিকে রণদীপ ঘন ঘন যেত উত্তরাকে দেখতে । দেখা পেত এক ঝলক । একদল বাচ্চা কাচ্চার সাথে খেলা করছে উত্তরা । এর পর মাতাজী র নির্দেশে যাওয়া কমিয়ে দিল । মাসে একবার । তারপর ছয় মাসে একবার । শেষে বছরে একবার । বছর তিনেক বাদে মাতাজী ডেকে পাঠালেন রণদীপকে । নিয়ে গেলেন মন্দিরে । তখন পুজো করছিল উত্তরা । পুজোর শেষে দরজার কাছে এসে দেখে রণদীপ । মাতাজী বললেন , তোমার স্বামীকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও , মা । উত্তরা রণদীপকে নিয়ে এল নিজের ঘরে । কত কথা বলল উত্তরা । কত হাসি । কত মজা । এসব কিছুই শুনছিল না রণদীপ । সে দেখছিল দু চোখ ভরে তার প্রাণের ভালোবাসার উত্তরাকে । সেই আগের উত্তরা । প্রাণোচ্ছল , বকবকম উত্তরা । আবেগে ,আনন্দে উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরলো উত্তরাকে । তারপর বলল , এবার চল , আমরা ফিরে যাই ।
কোথায় ?
কেন , তোমার নিজের বাড়িতে ।
এটাই আমার নিজের বাড়ি । আমি এখানেই থাকবো ।
আমার তাহলে কী হবে ?
তুমি ফিরে যাবে । আমার কথা শোনো । তুমি আবার বিয়ে করবে । তাকেও আমার মত ভালোবাসবে ।
অসম্ভব ! আমি পারবো না । তুমি কী নিয়ে থাকবে এখানে ?
দেখবে ? দাঁড়াও , দেখাচ্ছি । দরজাটা খুলে কা কে যেন কী বলল উত্তরা । একটু বাদেই পিল পিল করে একদল বাচ্চা অধিকাংশই আদিবাসী এসে ঢুকলো উত্তরার ঘরে । সবার বায়না , মা চল , তোমার জন্য আমরা বসে আছি । এক সাথে খাবো বলে । উত্তরা বলল , তোমরা যাও । আমি এক্ষুনি আসছি ।
চলে গেল শিশুর দল । উত্তরা বলল , বুঝতে পারলে কেন আমি এখানে থাকবো । এই এত গুলো ছেলে মেয়ের জন্য । এরাই আমার সব । তুমিও চল , আমাদের সাথে খেয়ে নেবে । রাগ করো না । তোমার আর আসার দরকার নেই । যেন , তোমার উত্তরা ভালো আছে । তুমি ভালো থেকো ।