আজ আমার ছুটি। না,ক্যালেন্ডারের তারিখ আজ লাল নয় অথবা নয় কোন হরতাল। অনেকদিন পরে ছুটি নিয়েছি, একেবারে অকারণে। বেশ লাগছে…সবাই ব্যাস্ত, আমি বেকার।
সকালে উঠে চায়ের বাতিক নেই আমার। আলসেমি উপভোগ করি তিন-চারটে সিগারেট সহযোগে। টেলিভিশন একটা আছে কিন্তু বিঞ্জাপনের প্রবল আক্রমণের ফাঁক দিয়ে যৎসামান্য অনুষ্ঠানের কিঞ্চিত রসাস্বাদনের দুর্লভ ক্ষমতা দিয়ে পাঠানোর ব্যপারে, আমার বেলায়, বিধাতা বেশ কার্পন্য দেখিয়েছেন। টেলিফোনে এমন কোন বেকার বন্ধু-বান্ধবকে পেলাম না যার সঙ্গে নিদেন পক্ষে ঘন্টা খানেকের একটা আড্ডা মারা যায়। অগত্যা নিজের কিছু ভালোলাগার কাজ নিয়ে কাটবে আজকের দিনটা।
গণশা আমার বাজার-হাট, রান্না-বান্নার দিকটা দেখাশোনা করে আর আমার অকর্মণ্যতাকে করুনা দেখিয়ে সব ফাই ফরমাশ খাটে। কিন্তু আজ তারও ছুটি। আমি বাড়িতে থাকবো জেনে সে গেছে তার দেশের বাড়িতে, ফিরবে সেই রাত্রে। এখন আর কারুর আসার কোন সম্ভাবনা নেই। বেলা বাড়ছে, শীতের বেলা। দেরীতে হলেও মিঠে রোদ উঠেছে। অনেক পাঁচিল আর ছাতের পাশ কাটিয়ে তারই এক অচেনা টুকরো আমার ঘরের মেঝেয় লুটিয়ে আছে।
বেল বেজে উঠলো। কে আবার এই সময়। নিশ্চয়ই কোন সেল্সম্যান বা সেল্সগার্ল। একটু বিরক্ত হয়েই দরজা খুললাম। যা ভেবেছি তাই, সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহিলা। জিঞ্জেস করলাম, “কাকে চাই?”
আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। এইটুকু সময়ে যা দেখেছি তাতে আমার মতো পুরুষের চোখে তিনি সুন্দরী। শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে রূপ-যৌবণ পুরুষের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট। আমার জিঞ্জাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার জানতে চাইলাম, “কাউকে খুঁজছেন?”
এবার উত্তর এলো, “আপনাকে।“
“আমাকে?” সবিষ্ময়ে আমার প্রশ্ন।
”হ্যাঁ আপনাকে।“ তাঁর মুখের মৃদু হাসি আমার চোখ এড়ায়নি।
“আমি আপনাকে ঠিক….“ আমার কথা শেষ না হতেই জবাব এলো,
“কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।“
“আমি তো কোন সেলিব্রিটি বা নেতা-টেতা নই। কি ভাবে চিনলেন আমাকে?
আমার পাশের ফ্ল্যাটের দরজা একটু ফাঁক হয়ে বন্ধ হলো। ভেবে দেখলাম একজন অচেনা মহিলার সঙ্গে এই ধরনের কথপ কথন দরজার বাইরে বেশীক্ষণ চালিয়ে গেলে অনেক মিষ্টি গুজব ছড়ানোয় ইন্ধন যোগাবো আমি।
“আপনার আপত্তি না থাকলে বরঞ্চ ভেতোরে এসে বসুন না।“ সবিনয়ে বললাম আমি।
“বোধ হয় সেইটাই আপনার পক্ষে safe হবে।“ মুখের কাছে উত্তরটা যেন তৈরী ছিল মহিলার। আর ছিল তাঁর মুখের সেই চটুল হাসি।
“হঠাৎ সক্কালবেলা উঠে আমার safety আপনার মাথা ব্যাথার কারন হয়ে উঠলো কেন বলতে পারেন?” এবার আমার ভাষায় ছিল স্পষ্ট বিরক্তি।
“আপনি রাগ করলেন?” আমি কিন্তু আপনাকে সেইভাবে কিছু বলিনি।“ ভদ্র মহিলার সাবধানী উক্তি।
“এটা রাগের কথা নয়। এখনও আপনি বলেননি আপনার আসার কারন। তাছাড়া আমি জানিনা আপনি কে। আমি আপনাকে চিনি না অথচ আপনি আমাকে ভালোই চেনেন।“
এরই মধ্যে ভদ্রমহিলাকে বাইরের ঘরে এনে বসালাম। জানলা দিয়ে আসা দিনের আলোয় তাঁকে আরো ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। এখন মাথাটা সামান্য নীচু করে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন। মনে হলো মহিলা অবিবাহিতা, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। যে অস্বস্তিকর গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল আমার বিরক্তি মেশানো ভাষায় সেটা কাটিয়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করলাম।
“চা খাবেন?” নীরবতা ভাঙলাম আমি।
“আপনি আবার চা খেতে শুরু করলেন কবে থেকে?”
আবার আমার বিষ্মিত হওয়ার পালা।
“আশ্চর্য, আমি যে চা খাই না, আপনি জানলেন কি করে?”
“এর উত্তর কিন্তু আমি আগেই দিয়েছি, আমি আপনাকে চিনি।“ বললেন আগন্তুক।
“চিনতে পারেন কিন্তু চা-এর ব্যাপারটা জানার জন্যে যতোটা নৈকট্যের প্রয়োজন ছিল, ততোটা থাকলে আপনাকে আমিও চিনতাম।“ একটু ঝাঁঝানো উত্ত্র ছিল আমার।
“আচ্ছা, এমন তো হতে পারে, আপনি আমাকে চিনতেন কিন্তু কোন কারনে ভুলে গেছেন অথবা এইসব টুকু চেনা বড় বেশী একপেশে ছিল। যাকগে ওসব কথা, চা-টা হবে, না শুধু ঝগড়া করবেন।“ বললেন মহিলা।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ভদ্রমহিলার টোল খাওয়া গালের হাসি আমার সব বিরক্তিকে জল করে দিলো।
“প্রশ্নটা আবার এড়িয়ে গেলেন, তাইতো?” হাসি মুখে বললাম আমি।
“আপনি তো চা করতে জানেন না।“
আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলাম।
“তাহলে অফার করলেন কেন?”
“ওটা ভদ্রতা।“ বললাম আমি।
“রান্না ঘরটা দেখিয়ে দিন, আমি করছি চা। বুঝতেই পারছি বাড়িতে আপনি এখন একা। আর তাই আমাকে নিয়ে আপনি পড়েছেন এতোটা ফ্যাসাদে।“
এবার লজ্জিত হওয়ার পালা আমার, ধরা পড়ে গিয়ে।
রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের সরজ্ঞাম খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হলো, গণশাটা যে কোথায় কি রেখে যায়…
“আপনি কি দুধ চা খান?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“থাক, আর ভদ্রতা করার দরকার নেই, দুধ বোধহয় আপনার ঘরে নেই।“
“নাঃ, আপনি আমাকে ভাবিয়ে তুললেন, আপনি কি আমার সব খবর নিয়ে তবে এসেছেন? বিশ্বাস করুন আমার ভিষন জানতে ইচ্ছে করছে আপনি কে। পুলিশের লোক নন তো?”
পুলিশের আপনাকে আর প্রয়োজন নেই। সে প্রয়োজন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে, তাই না?” ফস করে বলে বসলেন মহিলা।
“এই কথার অর্থটা ঠিক বোধগম্য হলো না যে।“ বললাম আমি।
“একটু ভাবুন বুঝতে পারবেন, খুব একটা কঠিন কথা কিছু বলিনি।“ একটু হেসে বললেন মহিলা।
“ভাবতে আর দিচ্ছেন কোথায়, একটার পর একটা শুধুই surprise.” আমি বললাম।
আমার দিকে পিছন করে চা করছেন মহিলা। নিশ্চয়ই মুচকি হাসছেন আমার কথা শুনে।
চা হয়ে গিয়েছিল।
“ওই হারমোনিয়ামটা আপনার?” মহিলার প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গেলাম। একটু সামলে নিয়ে বললাম, “আমার বাড়িতে হেমন্ত মুখুজ্জে তাঁর হারমোনিয়াম রেখে যাবেন কেন। এখানে যখন রয়েছে তখন ওটা আমারই।“
“না, আমি ভাবলাম আপনার স্ত্রী বা আর কারুর হতে পারে।“
“এই দেখুন, আমার এতো খবর রাখেন অথচ বিয়ে করিনি খবরটা রাখেন না, এটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?” বললাম আমি।
‘’কিছু যদি না মনে করেন একটা কথা জিঞ্জেস করবো?’’ আবার চটুল হাসি মাখানো প্রশ্ন।
“নির্ভয়ে করে ফেলুন।“ বললাম আমি।
“বিয়ে করেননি কেন?” মহিলার প্র্শ্ন্।
“বিয়ে করতে হলে একজন পুরুষের নিদেন পক্ষে একজন মহিলার প্রয়োজন হয়, অন্ততঃ আমি তাই জানি। কিন্তু তিনিটি কোথায় বসে আছেন এ অভাগার গলায় মালা দিতে?“
আবার সেই খিলখিলিনি হাসি আর প্রশ্ন, “আপনি কি বলতে চান দেশে মেয়েদের খুবই আকাল?”
“আকাল হয়তো নয়, কিন্তু আমি পাচ্ছি কোথায়।“
“আর সবাই যেমন করে পায়।“ মহিলার সোজাসাপটা উত্তর।
“কি করে পায়, প্রেম করে?” আমি বললাম।
“ওটাই একমাত্র্র পথ এ কথা আমিতো বলিনি।“ মৃদু হাসির রেখা এখন তাঁর মুখে।
“তাহলে আমি একটা কাজ করি। দেখুন মেয়ে খুঁজে বেড়ানোর এই পদ্ধতিটা আপনার কেমন লাগে বলবেন। মনে করুন কাল সকালেই রাস্তার চার মাথার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে গলায় একটা পোস্টার ঝোলাই। পোস্টারে লেখা থাকবে, “সুন্দরী পাত্রী চাই”। তার সঙ্গে গলা ছেড়ে চ্যাঁচাবো, ওগো শুনছো গো, কে আছো গো, আমাকে বিয়ে করবে গো। কেমন লাগলো প্ল্যানটা? দারুন না?
“দারুন।” হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছেন মহিলা। মাথার চুলের কয়েক গোছা তখন কপালে এসে পড়েছে। হাসির দমক তখনও থামেনি। আমি অজান্তে কখন টোল পড়া গালে হাসির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। সম্বিত ফিরলো তাঁর গলার স্বরে।
“কি দেখছেন অমন করে?”
থতমতো খেয়ে অস্বস্তিতে চোখ সরালাম।
“মেয়েদের দিকে অমন করে তাকাতে নেই মশাই, বিশেষ করে যখন সে এতটাই অচেনা।“ কেমন যেন আবেশ মাখানো কন্ঠস্বরে বললেন মহিলা।
“মাপ করবেন আমায়।“ আমার গলায় স্পষ্ট অস্বস্তি।
“না না অমন করে বলবেন না, মাপ করার মতো অপরাধ আপনি করেননি। কিন্তু একটা কথা খুব সাবধানে এড়িয়ে গেলেন বেশ।“
“কি কথা? এমন কোন গোপন কথা তো আমার নেই যা এখন লুকোবার দরকার হয়েছে।“
“কেন গানের ব্যপারটা?”
“আপনি কি আমাকে এ কথা বিশ্বাস করতে বলেন যে এর উত্তর আপনার জানা নেই?” আমি বললাম।
“তাহলে এটা কি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে শুভ্রবাবু এখনও গানের চর্চাটা রেখেছেন।“
“আমার নামটাও তাহলে আপনার জানা। এরপরেও আপনি বলবেন না আপনি কে, কি সূত্রে আপনি আমাকে এতটা চেনেন।“বললাম আমি।
“গানের গলাটা ছিল আপনার অপুর্ব, কিন্তু স্বভাবের মধ্যে কোথায় একটা কাঠখোট্টা ভাব ছিল, কেমন যেন রুক্ষ। সেটা এখনও মাঝেমাঝে উঁকি মারে আপনার ভাষায়। কি বৈপরিত্য! ঈশ্বরের সৃষ্টিতে কি আশ্চর্য বৈচিত্র। তাই না?” ভদ্র্মহিলার উক্তি।
এর মধ্যে আবার ঈশ্বর এলেন কোত্থেকে। মানুষের স্বভাব, মানষিকতা ইত্যাদি গড়ে ওঠার ব্যপারে একটা scientific analysis নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু সেখানে ঈশ্বর বা মন গড়া কোন শক্তির স্থান থাকতে পারে না। আপনার আঙুলে পাথর বসানো একটি আংটি শোভা পাচ্ছে। ওটা কি আপনার দূর্ভাগ্যের দায় ভার বহণ করছে, নাকি শুধুই শোভা বর্ধনের জন্যে। দেখুন, কিছু মনে করবেন না , আমি বিশ্বাস করি এবং ইতিহাস বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করতে পারি যে ঈশ্বর বিশ্বাস এবং যেকোন অন্ধ বিশ্বাস, আঙুলে পাথর বসানো আংটির ওপর আপনার অগাধ আস্থার মতোই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। আপনি ঈশ্বরকে শুধুই বিশ্বাস করেন, শুধুই যুক্তিহীন বিশ্বাস, কোন প্রশ্ন নেই। এই সংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাস থেকে মানুষের মুক্তি একান্ত কাম্য। কথাটা হয়তো এখানে অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু বলে ফেললাম।“ এক নাগাড়ে বলে গেলাম আমি।
হাততালির শব্দে চমকে তাকালাম সোফায় উপবিষ্ট আগন্তুকের দিকে।
হাততালি দিতে দিতে বললেন, “রাজনীতির জীবনে ঠিক বক্তব্য রাখার মতো শোনালো। এই জায়গাটায় খুঁচিয়ে দেখলাম তোমার চিন্তা-ভাবনার দূঢ়তায় তুমি একই রকম আছো। ভিষন ভালো লাগছে শুভ্র, তুমি একটুও বদলাওনি।“
“অজান্তে বা অসতর্ক মূহুর্তে একটা ভুল করে ফেললেন না তো।“ আমার জিজ্ঞাসা।
“কোনটা ভুল, তোমার…মানে আপনার সম্মন্ধে ধারনায়?” একটু লজ্জা জড়ানো উক্তি।
‘’তুমিটা আপনার মুখে বেশ লাগছে কিন্তু…ওটাই থাক না, আমার কোন আপত্তি নেই।“ থতোমতো খাওয়া মুখে যে লজ্জার রঙ ধরেছিল, সেটা আমার চোখ এড়ায়নি।
“আর গানের কথা বলছিলেন? বাথরুমে গান গাইতে গাইতে আমার মতো অনেকেই নিজেকে হেমন্ত মুখুজ্জের সমগোত্রিয় মনে করেন। ঠান্ডা লেগে গলাটা নাকে হয়ে গেলে আমিতো চুটিয়ে শ্যামল মিত্রর গাওয়া অনবদ্য সব পুরণো দিনের গানগুলোই গেয়ে যাই। বাথরুমে তখন আমিই বা কে আর শ্যামল মিত্রই বা কে।“
“রজনী গুপ্ত লেনের এক সন্ধে বেলার জলসায় আপনার গান শুনেছিলাম। অনেক গুনমুগ্ধ শ্রোতার ভীড়ে আমিও ছিলাম এক কোণে। সন্ধেবেলা প্রায়ই আপনার ঘর থেকে গান ভেসে আসতো। রজনীগুপ্ত লেনের বুক চাপা আলো-আঁধারি আর আপনার গান এক অনবদ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতো। আড়ালে আপনার একটা নাম দিয়েছিলাম আমরা, আপনি কি জানেন?”
“গানদা।“ আমি ফস করে বলে দিলাম হাসতে হাসতে।
“এ মা আপনি জানতেন? নিশ্চয়ই জয়ন্তীটা বলে দিয়েছিল।“ আবার টোল পড়া গালে মৃদু হাসি।
তাঁর চোখের ওপর চোখ রেখে বললাম, “আপনি জয়ী অর্থাৎ জয়ন্তীর বন্ধু, তাই না? জয়ী আর আমি পিঠোপিঠি ভাই বোন।“
“তবুও আপনি আমাকে চেনেন না। কখন দেখেছেন বলেও মনে হয়না।“ বললেন মহিলা।
“আপনি কি রজনীগুপ্ত লেনে থাকতেন? বোধ হয় না।“ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“থাকতাম না তবে জয়ন্তীর সূত্রে যাতায়াত ছিল যথেষ্ট।“
“আমার এমন আদ্য-প্রান্ত খবরের সূত্র তাহলে আপনার বন্ধুটি অর্থাৎ আমার বোন?“
“১৯৭০-৭১ সাল। একদিকে পুলিশ আর অন্যদিকে পার্টির অতিবামদের হাত থেকে বাঁচতে আপনি গা ঢাকা দিলেন। কোথায় হারিয়ে গেলেন জানতে পারলাম না। দাদার কাছে না না অছিলায় জানবার চেষ্টা করতাম যদি আপনার কোন হদিশ পাই।“
“আপনার দাদা…কি নাম?” আমার সবিষ্ময় প্রশ্ন।
“বললেই আপনি চিনতে পারবেন। চঞ্চল…চঞ্চল রায়।“
“আশ্চর্য চঞ্চল আপনার দাদা? কেমন আছে চঞ্চল?”
“আপনারা হরিহর আত্মা ছিলেন। দাদাদের সঙ্গে আপনার মত বিরোধ চরমে পৌঁছেছিল। একসময় ওরা আপনাকে… …“
“বাদ দিন ওসব কথা। চঞ্চল এখন কি করে?”
“দাদা বিয়ের পর আলাদা থাকে। একটা ওষুধের কোম্পানীর সেলস রেপ্রেসেন্টেটিভ। দাদা কেমন যেন হয়ে গেছে। দিনের অনেকটা সময় পুজো-আচ্চা নিয়ে কাটায়।“
‘’পুজো-আচ্চা? কি বলছেন। না… এটা আমি ভাবতে পারছিনা।“ আমার সবিষ্ম্য় উক্তি।
“কেন, পুজো-আচ্চা তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যপার। দাদার রাজনৈতিক ভাবনার তাতে কোন রদবদল ঘটেনি।“ মহিলা বলে গেলেন।
“দেখুন বামপন্থা মানুষের মনে একটা কমিটমেন্টের জন্ম দেয়। সেখানে ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোন স্থান নেই। বিশেষ করে সেই বিশ্বাস যদি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছনর পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়। আমি আগেও বলেছি, কোন অলৌকিক বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে থাকা মানে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং জীবনের সব রকম মানবিক প্রতিশ্রুতি থেকে পালিয়ে যাওয়া। তাই বামপন্থা আর অলৌকিক বিশ্বাস পরস্পর বিরোধী। আপনার ধৈর্য এবং মানুষের প্রতি সামান্য কোন মানবিক প্রতিশ্রুতি যদি থাকে তবে এই বিষয়ে আরো গভীর ভাবে একদিন আলোচনা করতে আমার কোন আপত্তি নেই।“
“সব কিছু যে খুব গভীর ভাবে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারছি তা নয় কিন্তু শুনতে বেশ লাগছে। মনে পড়ছে কতোদিন আগের কথা। দাদা আপনার মধ্যে কতো রাজনৈতিক আলোচনা হতো। ভিষন তর্ক করতেন আপনি। যুক্তিতে দাদা বেশীরভাগ সময় পেরে উঠতো না আপনার সঙ্গে। অপুদের বাড়ির এক তলার পিছন দিকের একটা ঘরে প্রায়ই আপনাদের মিটিং হতো। সেখানে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। না সব কিছু বুঝলেও বেশ লাগতো এই পরিবেশ।“ মহিলা বলে চললেন।
“আমি তো আপনাকে কোন গান শোনাইনি যে বেশ লাগবে আপনার। এটা আপনাকে ভাললাগাতে আমি কোন প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করেও শোনাইনি। এটা সত্য, এটা বাস্তব।“ আমি বললাম।
আপনি এখনও একই রকম রুক্ষ…কঠিন। মেয়েদের স্পর্শ কাতর মনের খবর আপনার বোধগম্মের বাইরে থেকে গেছে চিরকাল। আমার বেশ মনে আছে, দাদা একবার আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছিল একটা বই গোপনে আপনাকে পৌঁছে দিতে। শাড়ির ভেতরে বইটা লুকিয়ে আমি গিয়েছিলাম আপনাদের বাড়িতে। জয়ীকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার কথা। আমি অবশ্য আপনার গানের গলা পেয়েছিলাম নীচ থেকেই। জয়ী আমাকে নিয়ে গেল দোতলায় আপনার ঘরের সামনে। আমি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আপনার গান শুনছিলাম চুপটি করে। গানটা শেষ হতেই ডাকলাম। ডাকতেই চমকে তাকালেন আমার দিকে। আপনার তাকিয়ে থাকা দেখে হাসি পেলো আমার। বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘দাদা পাঠালো।“ আপনার পরের প্রশ্নটা আন্দাজ করেই বলে ফেললাম, “আপনার বন্ধু চঞ্চল আমার দাদা।“ আপনি আমাকে এড়িয়ে শুধু বই-এর পাতা উল্টোতে থাকলেন। আমি চলে এসেছিলাম কোন কথা আর না বাড়িয়ে। তারপর হঠাৎ কেমন সব বদলে যেতে থাকলো। কলকাতা হয়ে উঠতে থাকলো এক দুঃস্বপ্নের শহর। পাড়া ছেড়ে চলে গেলেন আপনি।
“এবার কিন্তু বেশ লাগছে আপনার মুখে এত কথা শুনতে। তারপরে…আর কিছু বলবেন না? আপনি বরঞ্চ ঝগড়া করুন আমি শুধু শুনি।“ বললাম আমি।
“দুর বোকা, একা একা কোনদিন ঝগড়া হয় কখন? আসলে চির কালই এক নম্বরের ঝগড়ুটে আর দাম্ভিক ছিলেন আপনি। ভাল গান গাইতেন বলে কি এত দম্ভ আপনার? ছোট বেলাতেও আপনি ছিলেন ছেলেদের দলে পাণ্ডা আর খেলার জায়গা নিয়ে কেবল ঝগড়া করতেন আমাদের সঙ্গে।“ মহিলা বলে গেলেন একটা চটুল হাসি মুখে মেখে।
“আপনি কি মেয়েদের পাণ্ডা ছিলেন?” হাসতে হাসতে বললাম আমি।
“না মশাই, আমি খুব শান্ত ছিলাম। আর ঝগড়া করতে কোনদিন পারতাম না।“
“হ্যাঁ যা নমুনা দেখলাম এতক্ষণ ধরে।“ মৃদু হেসে, গলা নামিয়ে বললাম আমি।
“কেন আমি ঝগড়া করলাম কখন।“ একটা অভিমানের সুর আগন্তুকের প্রশ্নে।
“ঘাট হয়েছে, স্বীকার করছি, কেবল ঝগড়া আমি করেছি। এবার মাপ করে দিন।“ আমি বললাম।
“ছিঃ, এমন করে বলবেন না। আমি আপনাকে হয়তো হঠাৎ এসে বিব্রত করছি।“ মহিলা বললেন।
“আপনিটা কিন্তু তুমি হলো না এখন। আর নিজের নামটা বলতে এত আপত্তি কেন।“ বললাম আমি।
আমি অদিতি। তুমিটা তো এক তরফা হয় না শুভ্র। আমি তো তবু অসতর্ক মূহুর্তে বলে ফেলেছি একবার।
“অদিতি অসতর্কে বলোনি, তোমার মন চেয়েছিল তুমি বলতে, তাই বলেছিলে আর তোমার মুখে ওই একটি শব্দ আমাকে অঢেল সম্পদের অধিকারী করেছে।“ বললাম আমি।
অদিতি এবার উঠে দাঁড়িয়েছে। “তোমার গণশা এবার এসে পড়বে। আমাকে তোমার সঙ্গে একা দেখলে কি ভাববে। আমি এবার চলি।“
“এখন বলোনি কিন্তু কি করে আমার বাড়ি খুঁজে পেলে।“
“বলতে পারি একটা সর্তে।“ অদিতির গলায় কেমন এক আবেশ।
“সর্তটা কি আগে শুনি”
অদিতি মাথা নীচু করে কি যেন ভাবছে।
“কি হলো, বলবে না, কি সর্ত।“
“আমি তোমার আর একটু কাছে গিয়ে যদি বলি, তুমি কি কিছু মনে করবে?” আবেগে অস্পষ্ট হয়ে এলো অদিতির গলা।
“মনে করবো? কি বলছো অদিতি! কাছে এসে বলো, যা বলবে বলে এতদিন আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছ।“ আমি বুঝতে পারছি আমার ভিষন ভাল লাগছে। একটা চাপা ভাল লাগা ভাষা হতে চাইছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না ভাষা।
অদিতি এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে আমার কাছে, আমিও একটু এগিয়ে ছিলাম বোধহয়। এখন অদিতির দুটো চোখ আমার চোখে কি খুঁজছিল আমি জানিনা। শুধু চোখের ওপর চোখ রেখে কাটলো একটু সময়। কখন জানিনা জিজ্ঞেস করলাম, “বলবে না কি সর্ত?”
“কথা দাও… আমাকে ছুঁয়ে, তোমার ঠিকানা না জানিয়ে আমাকে ছেড়ে কোথাও তুমি যাবেনা। কথা দাও শুভ্র।“ অদিতির ঘন নিঃশ্বাস আমাকে স্পর্শ করছে।
আমাকে ছুঁতে হয়নি, অদিতির স্পর্শ আমার শরীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। তার উষ্ণ ঠোঁটের কোমল স্পর্শ তখন আমার বুকে।
শুভ্র কথা দিয়েছিল কিন্তু কথা রাখেনি। বিয়ের তিন বছর পরে যেখানে সে চলে গিয়েছিল, সেই ঠিকানা শুভ্ররও জানা ছিল না।