ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল| দুপুর রাত, বাইরে সব শুনশান| চারদিক নিঃশব্দ নিঃঝুম| গোটা দুনিয়াটাই গভীর ঘুমের মধ্যে ডুবে গেছে| এই গভীর রাতেও কেবল একটা ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে, একটা চাপা ব্যস্ততার মধ্যে ঘরের ভেতরের পরিবেশটা যেন থম মেরে আছে| অপারেশন টেবিলের ওপর রোগী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে| শান্ত নিঃশ্বাসের আওয়াজ আর জটিল যন্ত্রপাতির পর্দায় ফুটে ওঠা ছবি দেখে বোঝা যায় জ্ঞান হারানো ছাড়া বাকি সবকিছু স্বাভাবিক আছে| অজ্ঞান করা হয়েছে একদম মাত্রা মেপে ওষুধ দিয়ে| অপারেশনের সময় এক মুহূর্ত নষ্ট করা যায় না| তাতাই আর লাটু দুজনেই খুব ব্যস্ত| রোগী আর কেউ নয়, এদের মা|
গম্ভীর মুখে দ্রুত হাতে কাজ সারছে দুজনে| টেবিলের ওপর থেকে যন্ত্রপাতি তুলে নেওয়া বা টেবিলের ওপরে রাখার হালকা টুং টাং শব্দ আর ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই| ছোট্ট নতুন ব্যাটারিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিল তাতাই, লাটুও মুখ বাড়িয়ে দেখে নিল একবার| চোখের ইশারাতে দুজনেই সম্মতি প্রকাশ করল – সবকিছু ঠিক আছে| পুরানো ব্যাটারিটা বের করা হয়ে গেছে| এবার জায়গামত নতুন ব্যাটারি লাগানোর কাজটা শেষ করে ফেললেই সব ঠিক হয়ে যাবে| চটপট হাত চালায় দুজনে| আধঘন্টার মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে, অ্যাপ্রন খুলে দুজনেই বসে পড়ে চেয়ারে| জ্ঞান ফেরানোর ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়ে গেছে| মা কিন্তু ঘুমোবে সকাল পর্যন্ত| ঘুম ভাঙলে মা দেখবে সবকিছু যেমন ছিল তেমন, বুঝতেও পারবেনা এতবড় একটা অপারেশন হয়ে গেছে রাত্রে| লাটু ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে – “এবার মা ঠিক সেরে উঠবে! কি বলিস দাদা?”
অন্তহীন নৈঃশব্দের মধ্যে লাটুর ফিসফিসে আওয়াজে চমকে ওঠে তাতাই| আসলে একই কথা ভাবছিল সে| চিন্তিত মুখে জবাব দেয় – “মনে তো হচ্ছে| আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টা| গেলবারের কথা মনে নেই?”
মনে আছে বই কি! দিনকে দিন মা বড় খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল| অতি সামান্য কথাতেই রেগে যেত| সবসময় বকাবকি করত অতি তুচ্ছ কারণে| কিছুতেই যেন মনের প্রফুল্লতা নেই| ডাক্তার তাতাই আর ডাক্তার লাটু অনেক ভালোভালো খাবারদাবার, ভালোভালো ট্যাবলেট-টনিক খাইয়েও উপকার পায়নি| মনে হত মায়ের শক্তি যেন আর কুলোচ্ছে না| কুলোবেই বা কি করে? পরিশ্রমের তো কমতি নেই| ঘরে বাইরে সমান তালে মা খেটেই চলেছে – খেটেই চলেছে| খিটখিটে মেজাজের আর দোষ কি?
দুই ভাইয়ের একান্তে বসে অনেক আলাপ আলোচনার পরে এই ব্যাটারির কথাটা প্রথমে বড় ভাই তাতাই-এর মাথায় আসে| ব্যাটারি কমে গেলে ঘড়ির কাঁটাটা একজাগায় লাফাতে থাকে, এগোতে পারে না; সময় গন্ডগোল হয়ে যায়| ব্যাটারি পাল্টে দিলেই আবার তরতর করে এগিয়ে চলে| ব্যাটারি কমে গেলে টর্চের আলো হলদেটে হয়ে যায়, অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করার শক্তিই যেন থাকে না| ব্যাটারি পাল্টে সুইচ টিপলেই বাঘের মত ঝাপিয়ে পরে অন্ধকারের ঘরের ওপর চকচকে ঝকঝকে উজ্জ্বল সাদা রঙের আলো নিয়ে| সব জায়গায় ব্যাটারির খেলা; চার্জ, রিচার্জ, এনার্জি নিয়েই সব কিছু চলছে| ব্যাটারি কমে গেলেই সব গন্ডগোল পাকিয়ে যায় আবার পাল্টে দিলেই সব ঠিকঠাক চলতে থাকে| তাছাড়া দাদুর বুকে পেসমেকার বসানো হয়েছিল, সেও তো ব্যাটারিতে চলে; মেয়াদ অন্তে ব্যাটারি পাল্টে দিতে হয়|
মানুষের মনটাই আসল জিনিস| এই মনটা যদি খারাপ থাকে তাহলে সবই খারাপ হয়| সারাদিন হাজারো ঝামেলা সামলে মনের এনার্জি শেষ হয়ে যায় তো| যেমন স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ফেলে রাখলে টর্চের ব্যাটারি তাড়াতাড়ি ফুরোয়| দাদু আবার মাঝে মাঝে ব্যাটারি গুলো বের করে রোদে রেখে দেন; মানুষের মনের এনার্জিও যদি একটা কিছু করে বাড়িয়ে দেওয়া যেত, খুব ভালো হত|
তাই মায়ের মনের সঙ্গে একটা ব্যাটারি লাগিয়ে দেওয়ার প্ল্যানটা প্রথম মাথায় আসে বড় ভাই তাতাই এর| ছোট্ট একটা অপারেশন দরকার ছিল, সেটার জন্য দুই ভাইই যথেষ্ট| অপারেশনটা যে নির্ভুল ভাবে হয়েছিল তার প্রমাণ গত কয়েক বছরে মা নিজে| মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল ব্যাটারি| ফল পাওয়া গিয়েছিল অপ্রত্যাশিত| মায়ের মেজাজটাই পুরো পাল্টে গিয়েছিল| বহুদিন পরে সদাহাস্যময়ী মায়ের সেই পুরানো রূপ দেখে কি যে ভালো লেগেছিল দু’ভাইয়ের| জড়িয়ে ধরে মাকে শূণ্যে তুলতে গিয়ে মায়ের হাতের চড় খেয়েছিল দুজনেই, কিন্তু সে বড় মিষ্টি চড়| তিনজনেই অনেকক্ষণ ধরে হেসেছিল হা হা করে|
আর এখন …..? এখন মা আবার যেন ক্রমশই নির্জীব হয়ে পড়ছে, শক্তির অভাব ঘটছে শরীরে| ভীষণ ক্লান্ত আর শুকনো মুখের মাকে দেখতে একটুও ভালো লাগেনা| তীব্র অবসাদ যেন মাকে একটু একটু করে গিলে ফেলছে| এই মা বকেও না, চেঁচামেচিও করে না, কথা বলতেই যেন ভীষণ কষ্ট|
তাতাই আর লাটু আবার একসাথে বসে ঠিক করে নেয় পরবর্তী কর্তব্য| আজ রাতেই সেই কাজ শেষ করলো দুজনে| পুরানো ব্যাটারি খুলে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে দিল একটু বেশি পাওয়ারের| ব্যাটারির জোরেই সুস্থ হয়ে উঠবে মা, আবার সুন্দর হয়ে যাবে| মা ঠিক থাকলেই সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে|
চোখে রোদ পড়তেই ঘুমটা চট করে ভেঙ্গে যায় তাতাই এর| ফ্যাল ফ্যাল করে এদিকওদিক তাকায় সে| স্বপ্ন দেখছিল নাকি! পাশে লাটু ঘুমিয়ে কাদা| বারো বছরের তাতাই আর ন বছরের লাটুর অনেক চিন্তা মাকে নিয়ে| মা কেন আগের মত নেই?
দাদুর প্রসন্ন মুখখানা মনে পড়ল| মাথার পাকা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে দাদু বলছেন – “কোনও শুভ কামনাই বৃথা যায় না দাদুভাই|” তাতাই মনে মনে বলল – “মা, তুমি ভাল হয়ে ওঠ তাড়াতাড়ি, ভাল হয়ে ওঠ মাগো, আবার আগের মত হয়ে যাও|”