ধার্মিক গিরি এক সন্ন্যাসী
তীর্থভ্রমণে তিনি অভিলাষী
ভারতের কোণে কোণে,
তিরুপতি তথা শ্রীক্ষেত্র পুরী
নর্মদামাঈ চারিধাম ঘুরি
অন্তে বৃন্দাবনে।
ব্রজধামি স্থিতি দিনকয় গিরি
ভাবিলেন এবে আশ্রমে ফিরি
ফল্গু নদীর তীরে,
যাইবার আগে মদনমোহনে
চড়ায়ে লাড্ডু উদগত মনে
বাঁকেবিহারীর মন্দিরে।
পরদিন প্রাতে চড়ি’ রেলগাড়ি
চলিলেন সাধু গয়াধাম ফিরি
যবে মুঘলসরাই পরে —
সন্ধ্যা তখন সমাগত প্রায়
ভাবেন সাধুজী কিই বা উপায়
গয়া ত’ অনেক দূরে,
মিনিট তিরিশ দাঁড়াইবে গাড়ী
সন্ধ্যার জপ এখানেই সারি
তারপর কিছু খাদ্য,
লাড্ডু প্রসাদ ঝুলিতেই আছে
দিয়েছিনু পূজা শ্রীহরির কাছে
মিটিবেই ক্ষুধা সদ্য।
যেমনই ভাবনা তেমনই কর্ম
পালন করেন সাধুর ধর্ম
লাড্ডু প্রসাদ হাতে,
দেখেন সেথায় পিপীলিকা ঘোরে
লাড্ডুর মাঝে বাহিরে ভিতরে
বুঝি ছিল সবই সাথে।
যতেক ক্লেশেই একটি বা দুটি
লাড্ডু ভোজন হয় মোটামুটি
তাড়ায়ে পিঁপড়া সারি,
বাকী যাহা আছে ভাবিলেন গিরি
দিবেন বিলায়ে আশ্রমে ফিরি
পিপীলিকা ঝকমারী।
পরক্ষণে সাধু ভাবিলেন হায়
পিপীলিকা সনে কিবা করা যায়
ওদের অসীম পুণ্য,
শ্রীহরির ভূমে জন্ম কর্ম
সত্য তাঁহার কি অধর্ম
ব্রজধাম বুঝি শূন্য।
মোর সাথে ঐ অবোধের দল
অজ্ঞাতে ছাড়ি শ্রীহরির স্থল
আসিল কত না দূর !
কত জনমই লাগিবে যে হায়
কেমনে তাহারা ফিরিয়ে সেথায়
শুনিতে বাঁশির সুর।
ভাবিতে ভাবিতে সাধুর পক্ষে
সহন বুঝি বা দুরূহ বক্ষে
কপোলে অশ্রূধারা,
পাপী আমি যদি ফিরি আশ্রমে
কি জবাব দিব মদনমোহনে
মহারাজ দিশাহারা ।
অবশেষে তিনি করিলেন স্থির
বহমান রবে ফল্গুর নীর
ব্রজধামই মোর ঠিকা,
মুঘলসরায়ে বদলায়ে গাড়ী
বৃন্দাবনেই ফিরিলেন গিরি
সাথে যত পিপীলিকা।
শ্রীহরির ধামে আসিবার পরে
চলিলেন সেই বিপণীর তরে
যেথায় ক্রীত সে মেঠাই,
ভূমি পরে রাখি লাড্ডুর ঝোলা
গিরি সন্ন্যাসী আপনাতে ভোলা
হরি হরি বল ভাই ।
থাকিলেও যবে অন্তরে আশ
তোমার ভূমেতে অধমের বাস
সম্ভব নহে কভু,
কিন্তু আমার নাহি অধিকার
কাড়িতে কাহারো পুণ্যের ভার
যে লভে তোমায় প্রভু ।
পিপীলিকা সবে শ্রীভূমির জীব
হউক তাহারা সততই ক্লীব
তথাপি তোমারই ভক্ত,
তাহাদের লয়ে বহুদূর আমি
গিয়েছিনু হায় অজ্ঞাতে স্বামী
আমি অতি দীন রিক্ত।
হে নারায়ণ, ক্ষমা করো মোরে
পিপীলিকা সবে রবে তব ক্রোড়ে
করো এবে পাপমুক্ত,
দীর্ণ হৃদয়ে মহারাজ গিরি
অঝোর ধারায় ক্রন্দন করি
গৈরিক বাস সিক্ত।
বিপণীর যিনি মালিক বৃদ্ধ
চিন্তনে তিনি অতীব শুদ্ধ
হেরিয়া সাধুর কর্ম,
কহিলেন আসি’-সাধু মহারাজ
মোর হিয়া মাঝে অবিরাম লাজ
করিয়াছি আমি অধর্ম।
পিপীলিকা সহ যতেক মিঠাই
এইক্ষণে আমি ফিরাইয়া লই
লাড্ডু দিবই তাজা,
হইয়াছে মম অপরাধ অতি
মার্জনা মাগি–করিনু মিনতি
ক্ষমা কর সাধুরাজা।
কহিলেন গিরি–হে সুধীজন
কি হেতুক তব অপরাধী মন
মিঠাই ছিল না ক্লিন্ন,
পাপী ত’ আমার নিঠুর চিত্ত
কেমনে করিব প্রায়শ্চিত,
আমি নরাধম ঘৃণ্য।
সাধুর নিকট সব কথা শুনি
বৃদ্ধ মালিক মিঠাই বিপণী
চিন্তায় চঞ্চল,
তাঁহারও নয়নে নামে বারিধারা
সাধু মহারাজ সম্বিতহারা
কণ্ঠেতে হরিবোল।
শুনিবেই যবে শ্রীহরির কথা
বিলীন হইবে চিত্তের ব্যাথা
জয় হরি নারায়ণ,
তিনিই সকল অগতির গতি,
তাঁহার চরণে রাখিবে গো মতি
সমর্পি তনুমন।
গেহ ছাড়ি’ যবে হইবে বাহির
চিত্তকে তবে করিবেই স্থির
ইষ্টে রাখিবে মতি,
“আমার সাথেই থাকিও হে প্রভু
বলিতে এ কথা ভুলিবে না কভু,
তুমিই ধরার দ্যুতি।
সময়ের ঘড়ি প্রভুর দু’ করে,
ফিরিয়া আসিবে যবে গেহপরে,
করিবে তাঁহারে প্রণাম,
জানিবে তিনিও উদ্বেগভরে
অপেক্ষাতেই দাঁড়ায়ে দুয়ারে
ভগবান রাধেশ্যাম।
যদি বোঝ এই কাহিনীর সার,
খুলিবে তবেই হৃদয় দুয়ার,
নচেৎ অলীক চিত্র-
শ্রী হরির নামে হও গো বিদ্ধ,
চিত্ত তখনি হইবে শুদ্ধ,
কৃষ্ণ পরম মিত্র।
———————————————————————————-
স্বপন চক্রবর্তী।