সেদিন শয়নে সহসা নয়নে অজাতশত্রু নরেশ,
দণ্ডায়মান আমারে শুধান কি হেতুক দাও ক্লেশ !
জ্ঞাত আছে মোর অতি ঘনঘোর কৃষ্ণবর্ণ চিত্র,
তব মনোপটে অঙ্কিত বটে সংশয় নাই মিত্র।
নরাধম অতি মোর দুর্মতি সেইহেতু পিতা ক্লিষ্ট,
ইতিহাস তাই ক্ষমা করে নাই আখ্যা লভিনু দুষ্ট।
তত্রাপি লোভী মোরে লয়ে কবি কর ছন্দের সৃষ্টি,
মম সুকৃতি ছড়ায়েছে দ্যুতি ভারতভূমিতে কৃষ্টি।
কত যুগ ব্যাপী পশ্চাত্তাপই সহন করিনু বক্ষে,
সুবিচার তরে আসিনু শিয়রে আজিকে তোমার কক্ষে।
তনয় সত্তা পিতারে হত্যা করিতে কভু সে নারে,
সত্য ঘটনা কর হে দ্যোতনা ছন্দের মায়াডোরে।
হতবাক আমি মগধের স্বামী হিয়ায় এতেক ব্যাথা !
লিখিব যতনে সত্য কথনে দিলেম তাঁহারে কথা।
দেব তথাগত কত কাল বীত অতীতকে পিছে দেখা,
তখনও খ্রীষ্ট নাহি ভূমিষ্ঠ ইতিহাস আছে লেখা।
মগধ নৃপতি নির্দয় অতি অজাতশত্রু নাম,
কিন্তু তাঁহার অরিকে প্রহার কাটিত অষ্টযাম।
বৈশালী কাশী কোশলেরও রশি অজাতশত্রু করে,
লিচ্ছবি পতি তাঁহারও যে নতি মগধের হুঙ্কারে।
করিয়া ফন্দী পিতাকে বন্দী ছিনিয়া সিংহাসন,
কারাগার মাঝে প্রভাতে কি সাঁঝে করিতেন নিপীড়ন।
রাজার বসন শিরের ভূষণ সবই লইলেন কাড়ি’,
কহে ইতিহাস আত্মজ ত্রাস বিম্বিসারের অরি।
এও কি সত্য শ্রেণিকাপুত্র পিতাকে করেন হত্যা !
করিব সৃজন সেই অঘটন নহে সেটি কোনো মিথ্যা।
দ্বিপ্রহরে অজাতের ক্রোড়ে তাঁহার জীবন জ্যোতি,
সুত নবজাত নহে মোটে ভীত জীবনধর্মে ব্রতী।
পিতা স্নেহভরে শিশুটির শিরে দিলেন দীর্ঘ চুম্ব,
আর্দ্র বসন করেন শাসন কোথায় নৃপের দম্ভ !
শুধান–জননী,স্নেহরূপ খনি এহেন কি কোনো পিতা
এই ধরাধামে একটিও আছে–জ্ঞাত আছ নাকি মাতা !
হাসেন জননী চেলনা নাম্নী–ওহে মগধের বিভু,
বিম্বিসার জনক তোমার–স্নেহ কি লভ নি কভু !
তব অনামিকা অনলের শিখা করিল যেদিন গ্রাস,
পিতা স্নেহময় হিয়া নির্ভয় রোধেন সর্বনাশ।
মুখগহ্বরে অনামিকাটিরে করেন শ্রেণিকা শোষণ,
তব শৈশবে স্নেহের প্রভাবে এমত সতত পোষণ।
নীরব রাজন ওঠে আলোড়ন কঠোর হৃদয় মাঝে,
পিতা স্নেহময় তাঁহারে কি হায় এত নিপীড়ন সাজে !
‘আমি যে রিক্ত করিব মুক্ত জনক বিম্বিসারে’,
নয়নে অংশু শালপ্রাংশু লহমায় কারাগারে।
জীবনধর্মে লোলচর্মে বৃদ্ধ বিম্বিসার,
রোদনে হৃদয় দু:সহ হায় সুতের অত্যাচার।
বসি কারাগারে হিয়া হাহাকারে আঁখিজলে যান ভাসি,
এমত সময় অজাত উদয় কোমরবন্ধে অসি।
হেরিয়া তাঁহারে ভাবেন শিয়রে শমন দাঁড়ায়ে বুঝি,
লইবে কি প্রাণ ক্রুর সন্তান পিতৃদেবেরই আজি !
করে অঙ্গুঠী বিষাক্ত গুটি নিমেষেই ভক্ষিত,
একদা নরেশ অবসান ক্লেশ মগধ সূর্য মৃত।
অজাত সত্তা পিতৃহত্যা করে নাই সেটি সত্য,
কিন্তু নৃপতি নির্মম অতি উদ্ধত উন্মত্ত।
ক্ষমতার লোভ অহেতুক ক্ষোভ উগ্র স্বভাব হায়,
তাঁহারই অংসে সেহেতু দংশে পিতৃহত্যা দায়।
কারণ যে তিনি সংশয়হীনই পিতার আত্মহননে,
তাই ত’ তাঁহারে ইতিহাস স্মরে নৃশংসতার গহনে।
হে বীর নরেশ মিথ্যার লেশ নাহি মোর কোনো ছন্দে,
অপযশ যাহা যথার্থ তাহা সত্যেরই জয় দ্বন্দ্বে।
জৈন মহাবীর মহাস্থবির তাঁহাদের সমসাময়িক,
তথাপি অজাত হিংসায় স্নাত ইতিহাস দেয় ধিক্।