কোড নেম প্রমিথিউস
আমি চমকে উঠে বসলাম। সমুদ্র দেখলাম, মাথা নাড়ছে। তারপর ক্রিসকে খানিকটা গম্ভীর হয়েই বলল, “পাওয়া গেলেই ভাল। আসলে চোর যে এখানেও থাকে, সেটা বোঝা উচিৎ ছিল।“
আমি দেখলাম, ক্রিস বেশ লজ্জিতই হয়েছে। খানিকটা আমতা আমতা করেই বলল, “কি আর করব বলুন। চোর সব দেশেই থাকে। আমাদের দেশেই বোধহয় তাদের বিড়ম্বনাটা একটু বেশি। ওসব ছাড়ুন, আপনারা আগে ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর চলে আসুন আমাদের ঘরে। আমি ততক্ষণ বাবাকে জাগাই। বেশ বেলা হয়েও গেছে।“ এই বলে সে দরজার দিকে এগোল।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বর্ণালী এসে ঢুকল ঘরে। মুখ চোখ লাল, সদ্য রোদে পুড়ে এসেছে যেন। ঢুকেই একটা চেয়ারে বসে বলল, “এক গ্লাস জল দে রে অয়ন। এই চোরের থেকে যদি না আমি আমার ব্যাগ উদ্ধার করেছি তো দেখ…”
আমি বললাম, “কি হয়েছে বলত? তোর কি ব্যাগ চুরি গেছে?”
বর্ণালী উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, “আর বলিস কেন? আসলে অজানা, অচেনা জায়গা। তাই বেশি ঘুমও হয়নি। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সমুদ্রকে নিয়ে একটু গিয়েছিলাম কাছাকাছি ঘুরতে। তুই ঘুমোচ্ছিস দেখে আমরা আর তোকে ডিস্টার্ব করিনি। ক্রিস গিয়েছিল সাথে গাইড হিসাবে। এবার বাসের মধ্যেই পার্সটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন এক স্টপেজ থেকে চোরটা উঠেছিল খেয়াল করিনি। ভিড় বাসের মধ্যেই হাতে একটা ঝটকা টান। কিছু বোঝার আগেই দেখি পার্সটা নেই। সঙ্গে সঙ্গেই গোলমাল শুরু করে দিই, আর দেখি, ভিড় বাস থেকে একটা লোক নেমে রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা হাওয়া।“
“যাই হোক, এই ফিরলাম পুলিশ ষ্টেশন থেকে। আশা করি, স্যারের কথা আর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ব্যাটাকে ধরা যাবে।“ সে বলে।
আমি খানিকটা উত্তেজিত হয়েই বললাম, “ব্যাগে কি দামি কিছু ছিল?”
বর্ণালী ভেবে বলল, “নাহ, সেরকম কিছু না। দু-চারশ টাকা। আর কিছু কাগজ…সেরকম দামি না। তবে যাই হোক, পার্সটা আমার কাছে খুব দামি।“
বলেই সে তাকাল সমুদ্রের দিকে করুণ দৃষ্টিতে। বুঝলাম, পার্সটা সমুদ্রেরই দেওয়া। দেখলাম, সমুদ্র মাথা নেড়ে বলল, “আমরা এই শহরে নতুন, কিছুই জানি না। ছাড় বাদ দে, পেলে পাব, না পেলে না পাব। মন খারাপ করিস না, কলকাতায় ফিরলে আরেকটা কিনে দেব তোকে।“
বর্ণালীর মুখ থেকে মনমরা ভাবটা তাও গেল না।
দুই
ক্রিসের বাবা, মিঃ জুলিয়াস রস এর অবস্থা বেশ জর্জরিত। পার্কিনসন্স বেশ ভালভাবেই গেড়ে বসেছে ওনার শরীরে। যাই হোক, ওষুধের প্রভাবে অনেকটাই সুস্থ এখন। বয়স পঞ্চান্ন ছাড়ালেও চেহারাটা খুব ভেঙ্গে পড়েনি। আমাদের দেখে প্রথমটা চিনতে পারেননি। পরে ক্রিস আমাদের সাথে ওনার আলাপ করিয়ে দিতেই ওনার মুখে হাসি ফুটল।
ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বললেন, “আচ্ছা, তাহলে তোমরা এখানে এসেছ ম্যাডামকে ফিরিয়ে দিতে, তাই তো?”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “খানিকটা তো তাই। তবে এই ব্যাপারে স্যারের সাথে খুব একটা কথা বলা হয়নি। সেটা বলা দরকার। তাহলে হয়ত বোঝা যাবে স্যারের মেয়েকে ফিরে পাওয়া যাবে কিনা।“
বর্ণালী এই সময় প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, আপনার কাছে ঝিনুকের ছবি আছে? না মানে, আসলে আমরা কেউই তার ছবি দেখিনি, কাজেই চিনি না তাকে।“
জুলিয়াস তখন তাকাল ক্রিসের দিকে। ক্রিস সঙ্গে সঙ্গেই আমাদেরকে বলল, “দাঁড়ান। রিসেন্ট ঝিনুকের জন্মদিন গিয়েছে। তাই ছবি তোলা হয়েছিল। আমার ফোনেও সেই ছবি আছে। এই দেখুন।“
ক্রিস পকেট থেকে একটা ফোন বার করে, বারদুয়েক খুটখাট করে তার ফোনসুদ্ধু হাত বাড়িয়ে ধরল আমাদের দিকে। আমরা তাকিয়ে দেখলাম সেই ছবিটা। দেখলাম, স্যারের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে, হাতে কেক কাটার ছুরি। খুব সম্ভবত বার্থডে কেক কেটে উঠে ছবির জন্য পোজ দিয়েছে সে।
বর্ণনায় যাব না সেই মেয়ের। শুধু অপূর্ব সুন্দরী বললেও কম বলা হবে ঝিনুককে। লম্বা, ফর্সা, কালো রঙের চুল। চওড়া কপাল, আর উজ্জ্বল বাদামি দুই চোখ। লম্বায় প্রায় স্যারেরই সমান সে।
জুলিয়াস বলল, “দেখুন না, যদি ঝিনুক ম্যামকে আপনারা খুঁজে আনতে পারেন।“
আমরা তখনও বোধ হয় তখনও ঘোরে ছিলাম। তবু এর মধ্যেই আমি কোনমতে আমার ভাষা খুঁজে পেলাম। বললাম, “অবশ্যই, মিঃ জুলিয়াস। আমরা ঠিক খুঁজে আনব ঝিনুককে।“
জুলিয়াসের ঘর থেকে বেরিয়ে বর্ণালী প্রশ্ন করল, “বলে তো এলি, পারবি, কিন্তু শুরু করবি কোথা থেকে?”
“সবার আগে স্যারের সাথে কথা বলা দরকার। উনিই আমাদের সবথেকে বেশি সাহায্য করতে পারেন।“ আমি বললাম। “কেনই বা এই অপহরণ, আর কিই বা তার লক্ষ্য এটা স্যার ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না।“
সমুদ্র আর বর্ণালী দুজনেই মাথা নাড়ল। সমুদ্র বলল, “ঠিক বলেছিস। চল স্যার কোথায় খুঁজে বার করা যাক।“
“তার দরকার বোধহয় হবে না।“ গুরুগম্ভীর স্বরে চমকে উঠেছিলাম আমরা তিনজনেই। দেখি, স্যার এসে দাঁড়িয়েছেন করিডরের সামনে, আর মিটিমিটি হাসছেন। কখন এলেন উনি?
স্যার যেন আমার মনের কথাটা পড়ে নিয়েই বললেন, “আসলে তোমাদের কথাই ভাবছিলাম। তার ওপর বর্ণালীর পার্স চুরি। তাই খানিকটা টেনশনই হচ্ছিল। ভাবলাম, তোমাদের কাছেই আসি, এই কদিন ধরে যা চলছে, সব বলে হালকা হই। তোমাদের ঘরেই যাচ্ছিলাম, তারপর দেখি, তোমরা জুলিয়াসের ঘর থেকে বেরোচ্ছ। চল, এই ব্যাপারে ডাইনিংরুমে কথা হোক।“
আমি বললাম, “হ্যাঁ চলুন। যাওয়া যাক।“
স্যারের পেছন পেছন এসে ডাইনিং রুমে ঢুকলাম। জায়গাটা বেশ বড়। একটা সেন্টার টেবিলের চারপাশে বারোটা চেয়ার, আর চেয়ারগুলোর গায়ে কাঠের কাজ দেখে পবাক হয়ে যেতে হয় শুধু। ঘরটার দেয়ালগুলো নিরাভরণ, কিন্তু দামি ওয়ালপেপার লাগানো। শুধু একটা দেওয়ালে একজন ভদ্রমহিলার ছবি লাগানো। দেখলাম, ঘরে ঢোকা থেকেই স্যার একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন ছবিটার দিকে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওনার মুখের সাথে ঝিনুকের মুখশ্রীর আশ্চর্য মিল। সেই এক নাক, সেই এক চোখের রং, এক চওড়া কপাল, এবং একই রকম ফর্সা।
আমি বললাম, “স্যার, উনি কি..”
স্যার খানিকক্ষণ সময় নিলেন উত্তর দেবার জন্য। তারপর যখন উত্তর দিলেন, দেখলাম, ওনার গলা ধরে গিয়েছে। উনি থেমে থেমে উত্তর দিলেন, “উনি আমার স্ত্রী। বহুদিন আগেই গত হয়েছেন।“
আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললাম, “সরি স্যার। না জেনে অনেক আঘাত দিয়ে ফেললাম।“
স্যার আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ না না, ঠিক আছে। আফটার অল, সে তো আর ফিরে আসবে না। আঘাত লাগার প্রশ্ন নেই। বল, তোমাদের কি কি জিজ্ঞাস্য আছে। আমি যতটা সম্ভব উত্তর দেবার চেষ্টা করব।“
তারপর স্যার বসলেন টেবিলের লাগোয়া একটা চেয়ারে। আমরাও খানিক ইতস্তত করে বসলাম পাশের চেয়ারগুলোয়। খানিকক্ষণ কিভাবে শুরু করব বুঝতে বুঝতেই কেটে গেল। আসলে, এই রকম কাজ আমাদের জীবনেও প্রথম, আর আমরা কেউই পুলিশ বা ডিটেকটিভের কাজ করিনি। তাই…
অবশ্য প্রথম প্রশ্নটা সমুদ্রই করল, “আচ্ছা স্যার, ঝিনুক কি আপনার দত্তক কন্যা?”
স্যার দেখলাম, উত্তর দিতে একটু দেরি করলেন। তারপরই বললেন, “হ্যাঁ এবং না। দত্তক হলেও আমার নিজের মেয়ে সে। তার সমস্ত দায়দায়িত্ব আমার ওপরেই বর্তায়।“
“মাফ করবেন, এর পরের প্রশ্নটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, কেন দত্তক নিলেন স্যার?”
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৪) ~