কিছুদিন হোল বিকেলের দিকে বেশ একটা হাওয়া দিচ্ছে। তাই গরমের তেজটা একটু হলেও কম লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম সব্যদা একটু অন্যমনস্ক হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে।
“কি ভাবছিস?”
প্রশ্নটা করলো পার্থদা। আমরা তিনজন আমাদের বাড়িতে বসে আড্ডা মারছিলাম। কথাটা শুনে সব্যদা একটা খামের ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ পার্থদার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি সেটা দেখার সুযোগ পেলাম। কাগজে যা লেখা আছে, তা হল-
রবি ৩ ৮ ১৫ ২১ শুক্র ৪ ৮ ২১ ১৮ ২৫
২ ১৫ ১৮ ৪ ৮ ১৩ ১ ১৪
কাগজে দেখলাম লেখাগুলোর মাঝে যে খালি জায়গাগুলো আছে সেইগুলো সমান না। মানে কোথাও বেশি বা কোথাও কম।
“কি লেখা এইগুলো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কথাটা শুনে সব্যদা আমার দিকে সব্যদা যেইভাবে দেখল বুঝলাম যে আমি বোকার মত একটা প্রশ্ন করেছি তাই আর কিছু বললাম না। লেখাটার মানে আমাদের কারুর মাথায় ঢুকল না। এর পর কথা মতো আমরা গাড়ি করে ডিনার করতে বেড়িয়ে গেলাম। আমি বাকি সময়টা ভাবছিলাম যে লেখাটা কে লিখেছে আর লেখাগুলোর মানে কি? এটাও জানতাম যে সব্যদাও ঠিক তাই ভাবছে। আর কিছুক্ষণ থাকার পর পার্থদা চলে গেলো। যাবার আগে আমাকে বলে গেলো যে যদি কিছু ওই ধাঁধা থেকে উদ্ধার হয়ে তাহলে তাকে জানাতে।
রাতে খাবার টেবিলে হঠাৎ সব্যদা বলল, “কাল সকালে ভাবছি একবার বর্ধমান যাবো!”
এই কথা শুনে আমি জিজ্ঞেশ করলাম, “কেন?”
খেতে খেতে সে বলল, “প্রায়ে দিন কুড়ি আগে আমার কাছে একটা চিঠি আসে”!
“কি লেখা আছে তাতে?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
আমার এই কথা শুনে সব্যদা বলল যে খাওয়া শেষ করার পর সে আমাকে সেই চিঠি দেখাবে। আমি এই কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে সব্যদার সাথে বসার ঘরে এলাম। টেবিলের ড্রয়ার থেকে সব্যদা একটা খাম এনে আমাকে দিল। খামের ভিতরে দেখলাম একটা ভাঁজ করা চিঠি। সেটা বের করে আমি পড়তে লাগলাম। তাতে লেখা আছে,
“শ্রী সব্যসাচী ব্রহ্ম মহাশয়,
নমস্কার
শ্রী প্রভাত চৌধুরীর হয় আমি ওনার ছেলে শ্রী সুকান্ত চৌধুরী জানাচ্ছি যে আমার বাবা শ্রী প্রভাত চৌধুরী একটি বিশেষ কাজে আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক। অতএব আপনি অবিলম্বে এখানে এসে বাবার সাথে দেখা করলে উপকৃত হব। আপনারা কিভাবে আসছেন সেটা নিচে লেখা ফোনে নম্বরে জানিয়ে দেবেন।
ইতি
সুকান্ত চৌধুরী”।
চিঠি থেকে আর কোন তথ্য সংগ্রহ করা গেলনা। আমি সেটা ফিরত দিয়ে বললাম, “ ব্যপারটা কি? কেন তমার সাথে দেখা করতে চাইছে?”
জানলার সামনে দাড়িয়ে সব্যদা বলল, “সেটা ওখানে গিয়েই জানা যাবে। তুই পার্থকে জানিয়ে দে যা কাল আমরা বর্ধমান যাচ্ছি। সে যদি যেতে চায়ে তাহলে সকাল সকাল এখানে যেন চলে আসে!” এই কথা বলে সব্যদা নিজের ঘরে চলে গেলো।
আমি কথা মতো পার্থদাকে ফোনে করে সব কিছু জানালাম। জবাবে সে বলল সকাল সাড়ে আঁটটার মধ্যে সে গাড়ি নিয়ে চলে আসবে।
পরেরদিন সকাল। আমার ঘুম ভাঙল সব্যদার ডাকে। আমাকে বলল, “তানিয়া, কুড়ি মিনিটের মধ্যে তৈরি হতে হবে কারণ আমাদের বেরতে হবে। পার্থকে বলে দিয়েছি সে গাড়ি নিয়ে আসছে!”
আমার তৈরি হবার কিছুক্ষণ পর পার্থদার গাড়ি এলো। যেতে যেতে ভাবলাম একবার সব্যদাকে জিজ্ঞেশ করি যে আমাদের বর্ধমান যাবার কথা ছিল কিন্তু এখন কোথায় যাচ্ছি? এই কথা ভাবছিলাম থিক সেই সময়ে পার্থদা বলল, “কোথায় যাচ্ছি সেটা জানতে পারি?”
একটা সিগারেট ধরিয়ে সব্যদা বলল, “বর্ধমান!”
কথাটা শুনে আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “যদি আমরা বর্ধমানে যাচ্ছি তাহলে এতো তাড়াহুড়ো কেন?”
তার জবাবে সব্যদা জানালো যে সকালে সে যখন সুকান্তবাবুকে ফোন করে জানায়ে যে আমরা আজ সকালে আসছি তখন সুকান্তবাবু বলেন যে রাতে ওনার বাবা মানে প্রভাতবাবু মাড়া গিয়েছেন এবং একটা চাবি চুরি হয়েছে। তিনি পুলিশকেও খবর দিয়েছেন। এটা শুনে আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল।
আমাদের পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা লাগলো। রাস্তায় আমরা সকালের জলখাবার খেয়ে নিলাম। খেতে খেতে আমি বেশ অনেকবার লক্ষ্য করলাম যে সব্যদা বেশ চিন্তিত। কিন্তু চিন্তার বিষয়ে কি সেটা বুঝতে পারলাম না।
রাস্তায় একজনকে ১৬, চৌধুরী লেন জিজ্ঞাসা করতে আমাদের দেখিয়ে দিলো বাড়িটা। একটা মস্ত পুরনো আমলের বাড়ি। গেটের ভিতর দিকে দেখলাম একটা ছোট গুমটি। সেখানে একটা চেয়ার রাখা আছে। বুঝলাম এখানে বাড়ির দারওয়ান বসে কিন্তু এখন নেই। বাড়ির পিছনের অংশে বোধয়ে মেরামতের কাজ চলছে কারণ মইয়ের একটা অংশ আমি সেখানে দেখতে পেলাম। বাগানটা খুব বড় না কিন্তু সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা গেটের সামনে নেমে পরেছিলাম। নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তা পেরিয়ে আমরা বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে একজন মাঝ বয়েশি ভদ্রলোক আর একজন ইনস্পেক্টর এগিয়ে এলো। পরিচয় দেবার সময়ে জানতে পারলাম যে মাঝ বয়েশি ভদ্রলোক হল সুকান্ত চৌধুরী আর একজন ইনস্পেক্টর সুভময় বাগচি।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতালায় উত্তর দিকে একটা ঘরে প্রবেশ করলাম। পুরো ছন্নছাড়া হয়ে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে কেউ কিছু খুঁজছিল। ঘরে একটা বড় আরামকেদারা রয়েছে, তার পাশে একটা পুরনো দিনের খাট, একটা আলমারি যেটা খোলা আর একটা বড় টেবিল আর সেটার সামনে একটা বুক শেল্ফ। টেবিলের উপর প্রচুর বই ছড়ানো আর সেইগুলো শেল্ফ থেকে নামানো হয়েছে। টেবিলের সামনে একটা রিভল্ভিং চেয়ার। সব্যদা আলমারিটা দিকে এগিয়ে গেলো। সেটা দেখা সুকান্তবাবু বললেন, “আলমারির চাবি টেবিলের উপর থাকতো”।
সব্যদা টেবিলের উপর রাখা বইগুলো দেখতে দেখতে সুকান্তবাবুকে জিজ্ঞেশ করল “কি হয়েছিল?”।
সুকান্তবাবু বললেন সকলে বাড়ির চাকর নন্দ সুকান্তবাবুর বাবা মানে প্রভাতবাবুর ঘরে যায় চা নিয়ে সে দেখে তিনি আরামকেদারায় পিছন ফির বসে আছেন। তাকে ডাকতে গিয়ে নন্দ দেখে ওনার মাথা চিত, চোখ দুটো খোলা আর অদ্ভুত ভাবে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয়ে পেয়ে নন্দ সুকান্তবাবুকে কাছে যায়। তারপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
প্রভাতবাবুর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় সেটা পুলিশের ডাক্তার জানিয়েছেন, যদিও তার শরীরর তেমন কোন রোগ ছিল না। মৃত্যুর সময় বারটা থেকে সাড়ে বারটার মধ্যে।
আমরা এখনও প্রভাতবাবুর ঘরে আছি। ঘরটা দেখতে দেখতে সব্যদা টেবিলের নিচে থেকে একটা ছোট কাঁচের টুকরো বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “বোধয়ে ভাঙ্গা কাপের টুকরো!” বাকি ঘড়টা দেখে সে পাশে একটা বন্ধ দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। সেটা দেখা সুকান্তবাবু বললেন, “ওটা বাথরুম”! কিছুক্ষণ থাকার পর বেরিয়ে এসে সব্যদা সুকান্তবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাথরুমের দরজায় ছিটকিনি নেই দেখলাম! সেটা কি সব সময় খোলা থাকে?” এই কথার মধ্যে আমি দরজাটার বেশ কিছু ছবি নিয়ে নিলাম। ছবি তোলার সময়ে শুনতে পেলাম সুকান্তবাবু বলছেন যে, “বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে!”
“বাথরুমের জানলাটার খুব বাজে অবস্থা। যে কেউ বাড়ির পিছন থেকে জানলা দিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে!” সুকান্তবাবু এই কথাটার কোন জবাব দিতে পারলেন না।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, ঘরে একজন নতুন লোক প্রবেশ করেছে। জানতে পারলাম ওনার নাম রঞ্জন সমাদ্দার, প্রভাতবাবুর সেক্রেটারি। তিনি ঘরের এক কোনে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। রোগা ছিপছিপে, মাথার চুল এলোমেলো। পড়নে শার্ট আর প্যান্ট। চোখে চশমা আর গাল ভর্তি দাড়ি।
প্রভাতবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা সবাই নিচে এলাম।
নিচে বসার ঘরে বসে সব্যদা বলল, “আপনাকে কিছু প্রশ্ন আছে!”
সুকান্তবাবু বললেন, “বলুন”।
“আপনি কাল রাতে বারটা থেকে সাড়ে বারটার সময় আপনি কোথায়ে ছিলেন?”
“আমি কাল কাজ সেরে কলকাতা থেকে সোজা এখানে আসি। আসতে আসতে প্রায়ে নটা বেজে গিয়েছিলো। তাই দশটার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পরেছিলাম”।
“চাবিটা কিসের?”
সুকান্তবাবু বললেন, “একটা বাক্সর। ওটার মধ্যে আটখানা পাথর আছে। ওই পাথরগুলো দিয়ে এক সময়ে আমার মায়ের গলার একটা হার বানানো ছিল। কিছু বছর আগে সেটা ছিরে যায় আর তারপর থেকে পাথরগুলো এই ভাবে রাখা আছে!”
“বাক্সটা একবার দেখা যায়ে?”
কথাটা শুনে সুকান্তবাবু রঞ্জনের বলল তার ঘর থেকে ওই বাক্সটা আর ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে আসতে। এই কথা শুনে রঞ্জনবাবু বাক্সটা আনতে চলে গেলেন। সব্যদা জিজ্ঞেশ করল, “আপনার ঘর কি দোতালায়ে?”
“হ্যাঁ। আমারটা দক্ষিণ দিকে”।
“কাল রাতে বারটা থেকে সাড়ে বারটার মধ্যে আপনি কোথায়ে ছিলেন?’
“এগারটার মধ্যে খাওয়া শেষ করে আমি শুয়ে পরেছিলাম”।
“কাউকে সন্ধেও করেন?”
একটু ভেবে বললেন, “সন্দেও করার মতো কারুর কথা আমার এই সময়ে মনে পরছে না”।
এর মধ্যে রঞ্জনবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন। ওনার হাতে দেখলাম একটা বাক্স। বাক্সটা সোনালি রঙের আর ওপরে অনেক কারুকার্য করা। টেবিলের মাঝে বাক্সটা রেখে খোলার পর আমরা যেটা দেখলাম, সেটা মনে হয় খুব কম মানুষই দেখেছে। আটখানা আলাদা রঙের পাথর কিন্তু সবগুলোর সাইজ এক। একটা পাথর দেখলাম, আকারে বেশ বড় আর রঙটা ঝলমলে লাল। আমরা সবাই পাথরগুলো মন দিয়ে দেখে আবার জায়গা মত রেখে দিলাম। রঞ্জনবাবু সেটা রাখতে চলে গেলেন।
পার্থদা বলল, “এতো মূল্যবান জিনিশ আপনি বাড়িতে রাখেন?”
এর উত্তরে সুকান্তবাবু বললেন, “কোনদিনই বাড়িতে কোন চুরি হয়েনি তাই অন্য কোথাও রাখার কথা মাথায়ে আসেনি”।
সব্যদা গলাটা একটু নামিয়ে সুকান্তবাবুকে বলল, “ প্রভাতবাবুর ঘর থেকে যে চাবি চুরি হয়েছে সেটা কি এই বাক্সর?”
সুকান্তবাবু তার উত্তরে “হ্যাঁ” বললেন। তারপর বললেন, “একটি চাবি বাবার ঘরে থাকতো আর অন্যটি আমার ঘরে”।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তারপর সব্যদা সুকান্তবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “পাসে একটা ঘর দেখলাম বন্ধ! সেটা কেন জানতে পারি?”
“ওই ঘড়টা প্রদ্যুৎ থাকতো”।
“প্রদ্যুৎ কে ?”
“প্রদ্যুৎ এমনিতে আমাদের পরিবারের কেউ না। ওকে বাবা অনেক ছোট বেলায় নিয়ে আসে আর সেই থেকে ও এখানেই থাকতো”। “বছর আড়াই আগে সে বলে যে কোথাও একটা ভাল চাকরি পেয়েছে, আর চলে যায়। মাঝে মাঝে আসতো শুনেছি আর এলে এই ঘরেই থাকতো”।
“শেষ কবে এসেছিল?”
“বাবার থেকে শুনেছিলাম মাস চারেক আগে সে একবার এসেছিল কিন্তু এক রাতের জন্য”।
“বাড়িতে কে কে থাকে?”
“বাবা, রজন, নন্দ এই বাড়িতে আর বাড়ির পিছনে মালি আর দারোয়ান। দুজন চাকর আছে যারা সকালে আসতো আর বিকেলে চলে যেত। আমি কাজের সূত্রে কলকাতাতে থাকি। সপ্তাহে দুইবার করে আসি!”
কথা বলতে বলতে আমরা নিচে নেমে এশেছিলাম। এর মধ্যে ইনস্পেক্টর বাগচি চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলো যে যদি তাদের কাছে কোন খবর পেলে আমাদের জানাবে। সব্যদা ওনাকে অনুরধ করলেন যে মৃত প্রভাতবাবুর যে ছবিগুলো ওনারা তুলেছেন সেইগুলো যদি একবার সব্যদা দেখতে পায়ে। উত্তরে ইন্সপেক্টর বাগছি বললেন যে তার হাথে ছবিগুলো এলে তার একটা ডুপ্লিকেট কপি তিনি আমাদের পাঠিয়ে দেবেন।
এবার আমরা বাড়ির পিছন দিকে এলাম। এইদিকে দেখলাম একটা সিঁড়ি যেটা দিয়ে মৃত প্রভাতবাবুর ঘরের বাথরুমে যাওয়া যায়ে। দেখলাম দরজাটা খোলা। সব্যদা দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো। কিছুক্ষণ সেটা দেখে নেমে এসে বলল, “দরজার উপর বেশ শক্তি প্রয়োগ করা হেয়েছিল”।
এই কথা শুনে সুকান্তবাবু বললেন, “কিরে এতো নিশ্চিত আপনি?”
“দরজার কড়া দেখে বঝা যাচ্ছে!” আমি ভাবলাম ইনস্পেক্টর বাগচি আগেই আমাদের একটা ভাঙ্গা তালা দেখিয়েছিল সেটা বোধয়ে এই দরজাতে লাগানো থাকতো যেটা ভেঙ্গে চোর বা খুনি এসেছিল। এর মধ্যে নন্দ এসে সুকান্তবাবুকে খবর দিলো যে তার জন্য টেলিফোন এসেছে তাই সুকান্তবাবু আমাদের বলে বাড়ির ভিতরে গেলেন। সব্যদা একটু এগিয়ে গেলো। কিছুদূর গিয়ে আমাদের ডাকল। আমরা তার পৌঁছতে সে আমাদের মাটিতে একটা জায়েগা দেখাল। জায়গাটাতে দেখলাম হাল্কা একটা জুতোর ছাপ। আমি ছাপটার ছবি তুলে নিলাম।
একটু দূরে দেখলাম একটা একতলা ছোট বাড়ি। সামনে একজন বেশ বৃদ্ধ লোক মাটিতে বসে আছেন। সব্যদা দেখলাম তার দিকে এগিয়ে গেলো। আমরা সব্যদার পিছন পিছন এগিয়ে গেলাম।
আমাদের দেখে সে সেলাম করল। সব্যদা জিজ্ঞেস করল, “আপনার নাম কি?”
“ভগীরথ সাহু”।
আমাকে সব্যদা বলে রেখেছিল যে যদি আমি কিছু দেখি আশেপাশে তাহলে সেটার ছবি তুলে নিতে তাই কথা শোনার সাথে সাথে আমি আর পার্থদা চারিদিকে নজর রাখছিলাম।
“কতদিন এখানে আছেন?
“বছর কুড়ি হয়ে গেলো বাবু”।
“কি কাজ করেন?”
“মালির কাজ করি বাবু”।
ভগীরথ মালির বয়েস হচ্ছে আস্তে আস্তে যেটা তাকে দেখে বোঝা যায়। মাথায় চুল কম আর সেটা বোধয়ে বয়সের জন্য। চোখে কাল রঙের চশমা আর বেশ মোটা কাঁচ তাতে। পান খায়, কারন ঠোটে পানের লাল রঙ লেগে আছে।
“রাতে ঘুমান কখন?”
“আজ্ঞে, এগারোটা- সাড়ে এগারোটার মধ্যে”।
“আপনি কি এখানে একা থাকেন?”
“আমি আর প্রহ্লাদ, এই বাড়ির দারোয়ান”।
“আর আপনার পরিবার?”
“মেদিনীপুরে”।
“কাল রাতে কোন আওয়াজ পেয়েছিলেন বড় বাবুর ঘর থেকে?”
কিছুক্ষণ ভেবে ভগীরথ বলল, “না বাবু। তেমন কিছু শুনতে পারিনি”।
এই বলে আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে আসছিলাম হঠাৎ ভগীরথ ফিরে এসে বললেন, “বাবু একটা কথা আছে”।
সব্যদা ঘুরে বলল, “বলুন কি বলতে চান?”
“কাল বেশ রাতে একবার বড় বাবুর গোলার আওয়াজ পেয়েছিলাম!”
“কার সাথে বা কি কথা কিছু শুনতে পেয়েছিলে?”
“আজ্ঞে না বাবু। তেমন কিছু শুনতে পারিনি!”
কথাটা শুনে সব্যদা বলল, “ধন্যবাদ। দরকার পরলে আবার আসব!” এই বলে আমরা বাড়ির দিকে হাটা দিলাম। হাটার স্পীড আস্তে হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম যে শেষ কথাটা সেটা মালি বলল সেটা ওকে চিন্তায়ে ফেলেছে।
মালির সাথে কথা শেষ করে আমরা দারওয়ানের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ঘর তালা দেওয়া। সেটা দেখে পার্থদা বলল সে বোধয়ে ডিউটি করছে তাই ঘর তালা দেওয়া।
ফিরে আসার সময় দেখি সুকান্তবাবু বাগানে দাড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।। আমরা তিনজন সুকান্তবাবুর সাথে বসবার ঘরে ঢুকে একটা সোফা ভাগ করে বসলাম। সুকান্তবাবু আমার পাশে আরেকটা সোফাতে বসলেন।
নন্দ এর মধ্যে আমাদের জন্য চা নিয়ে এলো।
“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?” চায়ে চুমুক দিয়ে সব্যদা প্রশ্ন করল।
একটু ভেবে সুকান্তবাবু বললেন, “দেখুন, সন্দেহ করার মত আমি কাউকে দেখছি না। নন্দ আর মালি ভগীরথ বহু পুরনো”। “দারওয়ান প্রহ্লাদ আমার এখানে আছে বছর দুই হল। আগে যে ছিল গোপাল, সে বাড়ি চলে যায়ে কারন তার মা মারা যায়ে”। “ড্রাইভার বাবুকে আমি কলকাতা থেকে নিয়ে আসি ওই একই সময়ে!”
“বাকি চাকর যারা আছে তারা সবাই সকালে এসে বিকেলে চলে যায়ে?”
“কিছুদিনের মধ্যে কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার বা কোন ঘটনা লক্ষ্য করেছেন?”
একটু ভেবে সুকান্তবাবু বললেন, “না! আমি তেমন কিছু লক্ষ্য করিনি কিন্তু বাবা মারা যাবার কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলেন যে একদিন বেশ রাতে উনি তার ঘরের বাইরে কাউকে হাটতে দেখেন কিন্তু সেটা কে দেখতে পারেননি”।
সুকান্তবাবু আমাদের জন্য দুপুরের খাবারের বন্দবস্ত করেছিলেন ওনার বাড়িতেই। সেটা সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের প্রায়ে সন্ধে হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে সব্যদা নিজের ঘরে চলে গেলো অ্যাই-প্যাডটা নিয়ে। আমি আর পার্থদা বসার ঘরে বসে পুরো কেসটার ব্যাপারে আলোচনা করতে লাগলাম।
“আচ্ছা পার্থদা তোমার কি মনে হয়ে ধাঁদার চিঠি আর প্রভাতবাবুর খুন, কোন যোগসূত্র আছে?”
“তুই যে কথাটা বললি সেটা যে আমার মাথায়ে আসেনি সেটা আমি বলব না কিন্তু যোগসূত্র যেটা কোথায়ে যদি থাকে সেটা কোথায়ে বুঝতে পারছি না!” এই নিয়ে কথা বলতে বলতে বেশ অনেক্ষন হয়ে গেলো তাই পার্থদা বলল সে এখন যাচ্ছে আর কাল সকালে আসবে কারন পরেরদিন রবিবার তাই পার্থদার পরানোর চাপ কম থাকে।
পরেরদিন সকাল। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি সব্যদা বাড়িতে নেই। জগন্নথকে জিজ্ঞেশ করতে সেও বলল সব্যদা কোথায়ে গেছে জানেনা। কিছু করার নেই দেখে এক কাপ চা নিয়ে আমি ঘরে বসে সব্যদার অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর কলিং বেল বেজে উঠল। আমি দরজা খুলে দেখি সব্যদা।
“কোথায়ে গিয়েছিলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“একটু প্রাতঃ ভ্রমণ করতে!” এই বলে সব্যদা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। ঘরে যাবার আগে টেবিলে একটা বড় খাম রেখে গেলো। এর মধ্যে পার্থদাও চলে এলো।
আমি পার্থদাকে জানালাম যে সব্যদা একটু আগে ফিরেছে কিন্তু কোথায় গিয়েছিলো সেটা আমি জানিনা।
আধা ঘণ্টার পর সব্যদা ঘর থেকে বেরল। বেরিয়ে আগে জগন্নাথকে চা আনতে বলল।
“কিছু এগোল?” পার্থদা জিজ্ঞেস করল।
উত্তর না দিয়ে ভুরু কুঁচকে সব্যদা মাথা নেড়ে “না” বলল। “কিন্তু প্রভাতবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়”।
আমি বললাম, “হ্যাঁ। সেটার আমাদের মনে হয়েছিল কিন্তু তুমি কনফার্ম কি করে হচ্ছ?”
“ওই খামটা খুলে দেখ!” সব্যদা টেবিলের দিকে ঈশার করে বলল।
পার্থদা খামটা খুলল। অনেকগুলো ফোটো বেরিয়ে এলো। আমি দেখে বললাম, “এতো প্রভাতবাবুর ফোটো”। ফোটগুলো দেখে বুঝলাম সকালে সব্যদা ইন্সপেক্টর বাগচির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।
“ফোটগুলো দেখে কিছু অশ্বাস্বাভাবিক লাগছে?”
কথাটা শুনে আমরা ফোটগুলো ভাল করে দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ দেখার পর পার্থদা বলল, “তুই কি ওনার মুখ-চোখের চাওনির কথা বলছিস?”
“ঠিক বলেছিস!” ভুরু কুঁচকে সব্যদা, “কারুর মৃত্যু যদি স্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাকে হয়ে তাহলে ওইরকম চাওনি হয়েনা”।
আমি বললাম, “তাহলে তুমি বলছ ওনার হার্ট অ্যাটাক করানো হয়েছে?”
“ঠিক! কিন্তু এবার জানতে হবে কেন?”
“ওই পাথরগুলোর জন্য হতে পারে”, পার্থদা বলল।
একটু ভেবে সব্যদা বলল, “হতে পারে কিন্তু সেটা আমাদের আন্দাজ!”
কথা শেষ হতে হতে সব্যদার ফোন বেজে উঠল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সব্যদা পার্থদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গাড়ি এনেছিস?”
একটু হকচকিয়ে পার্থদা বলল, “হ্যাঁ…মানে?”
“মানে তুই কি তোর গাড়ি এনেছিস কারন আমাদের এখুনি বর্ধমান যেতে হবে!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন কি হয়েছে?”
“সেটা পরে বলব!” এই বলে আমরা বেড়িয়ে পরলাম। যেতে যেতে জানতে পারলাম যে কাল রাতে চৌধুরী বাড়িতে চোর এসেছিল এবং বাক্স সমেত পাথরগুলো নেই। আমি ভাবলাম প্রথমে খুন আর এখন চুরি, ব্যাপারটা জমে উথছে।
আজ যেন বর্ধমান একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম মনে হচ্ছে। বাড়িটা যেন আজ নিঝুম লাগছে। চারিদিকে যেন শূন্যতা গ্রাস করেছে। এমনকি কোথাও কোন মানুষ পর্যন্ত চোখে পরল না।
ইনস্পেক্টর বাগচীকে দেখলাম বাগানে দাড়িয়ে আছেন বোধয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখে ইনস্পেক্টর বাগচী এগিয়ে এলেন। ওনার থেকে জানতে পারলাম যে গতকাল রাতে কেউ সুকান্তবাবুর মাথায়ে আঘাত করে তার ঘরে থেকে সেই বাক্স নিয়ে পালিয়েছে। সুকান্তবাবুর ঘরে গিয়ে দেখি উনি খাটে শুয়ে আছেন। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। আমাদের দেখে উনি উঠে বসলেন।
সব্যদা চারিদিক জিজ্ঞেস করল, “আপনার উপর হামলাটা ঠিক কখন হয়ে?”
“খুব সম্ভবত তখন ১১ বা ১১:১৫ কারন ওই সময় আমি ঘুমাতে যাই”।
“তারপর কি হল?”
“আমি ঘরের বাইরে পরপর দুবার শব্দ শুনতে পেয়ে বেরিয়ে আসি”।
“বাইরে এসে কি দেখলেন?”
“কাউকে দেখতে না পেয়ে আমি যখন ঘরের দিকে হাটা শুরু করি এমন সময়ে পিছন থেকে মাথায়ে একটা আঘাত তারপর সব অন্ধকার”।
“জ্ঞান ফেরার পর আপনি কি দেখলেন?” সব্যদা একটু চুপ থাকার পর জিজ্ঞেশ করল।
“জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলাম যে নন্দ প্রথমে আমাকে দেখে বারান্দায়ে পরে থাকতে। সেই ডাক্তার ডাকে”।
“বাক্সটা নেই সেটা আপনি কি করে জানলেন?”
“আমি নন্দকে আলমারি খুলে দেখতে বলি”। “সে বলে আলমারি খোলা ছিল আর তাতে বাক্স নেই!”
“বাক্সটার চাবি?”
কথাটা শুনে সুকান্তবাবু দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওটা ওই মা ও বাবার ছবির পিছনে!” কথাটা শুনে আমি আর পার্থদা উঠে গিয়ে ছবিটা নামিয়ে দেখলাম সত্যি ওটার পিছনে একটা চাবি আছে। সেটা নিয়ে ছবিটা আমরা আবার দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দিলাম।
কথা শেষ করে সুকান্তবাবুর ঘর থেকে বেরনর সময়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে সব্যদা সুকান্তবাবুকে জিজ্ঞেশ করল, “আপনি কি সিগারেট খান?”
কথাটা শোনার পর আমরা সব্যদার দিকে তাকালাম। দেখলাম সে বারান্দার এক জায়েগাতে নিচু হয়ে একটা ছোট সিগারেটের টুকরো তুলল।
সুকান্তবাবু বললেন, “কই না! এই নেশা আমার কোনদিন নেই!”
ওখানে দাড়িয়েই সব্যদা জিজ্ঞেশ করল, “আচ্ছা প্রদ্যুতের ঘরের চাবি কোথায় থাকে?”
“সেটা তো ওর কাছে থাকতো!”
এই কথা শুনে আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে সব্যদা আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে সামনের দিকে মানে প্রভাতবাবুর ঘরে দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওই দিকে কি করতে গিয়েছিলে?” কথাটার উত্তর না দিয়ে শুধু আমার দিকে তাকাল। বুঝলাম যে ভুল সময়ে ভুল জিনিস জিজ্ঞেস করেছি তাই চুপ করে গেলাম।
নিচে নেমে সব্যদা ইনস্পেক্টর বাগচিকে জিজ্ঞেশ বলল, “নন্দর সাথে আপনি কথা বলছেন?”
ইনস্পেক্টর বাগচী বলল যে নন্দর সাথে সে কথা বলছে কিন্তু আমরা চাইলে নন্দর সাথে কথা বলতে পারি। সব্যদা একটু ভেবে বলল যে সে একবার নন্দর সাথে কথা বলতে চায়ে। সেটা শুনে ইন্সপেক্টর বাগচি লোক পাঠিয়ে নন্দকে ডেকে পাঠালেন।
“সকালে কখন ঘুম থেকে ওঠ?” সব্যদা জিজ্ঞেস করল নন্দ আসার পর।
“ওই পাঁচটা!” ভয়ে ভয়ে নন্দ উত্তর দিলো
“উপরে গিয়ে ঠিক কি দেখেছিলে?”
আমি আর পার্থদা সব কথা অ্যাই-প্যাডে লিখে রাকছিলাম।
“সকালে সাড়ে পাঁচটা থেকে পৌনে ছটার মধ্যে ছোট বাবুর জন্য চা নিয়ে গিয়ে দেখি ছোটবাবু বারান্দায়ে পরে আছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম মাথার কাছে রক্ত জমে আছে। আমি আর মালি ওনাকে খাটে শোয়াই। তারপর আমি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে আসতে বলি!”
“কাল এগারটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে কোথায়ে ছিলে?”
“রান্নাঘরে। খাওয়া শেষ করে ঘর বন্ধ করে বেরচ্ছিলাম!”
“সেই সময়ে কোন শব্দ শুনতে পেয়েছিলে?”
কিছুক্ষণ ভেবে নন্দ বলল, “না! কোন শব্দ শুনতে পাইনি”।
“বিড়ি বা সিগারেট খাও?”
“ছি-ছি বাবু! আমার ওই নেশা নেই!”
“ঠিক আছে তুমি আসতে পার”। এটা শোনার পর নন্দ চলে গেলো।
“আচ্ছা যেই জিনিসটা দিয়ে সুকান্তবাবুর মাথায় আঘাত করা হয়েছে সেটা পাওয়া গেছে কি?” প্রশ্নটা সব্যদা করল ইনস্পেক্টর বাগচীর দিকে তাকিয়ে।
“না সেটা এখনো পাওয়া যায়েনি যদিও খোঁজ চলছে”।
“আপনার সাথে কি সবার কথা হয়ে গেছে?”
ইনস্পেক্টর বাগচী মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো যে হ্যাঁ, তার সাথে সবার একবার করে কথা হয়ে গেছে আর কেউ ঘটনার ব্যাপারে কোন আলোকপাত করতে পারেনি।
হঠাৎ সব্যদা বলল, “আচ্ছা প্রগতিবাবুর একজন সেক্রেটারি ছিলেন! সে কোথায়?”
ইনস্পেক্টর বাগচী বললেন, “ কে? রঞ্জনবাবু?” “উনি কাল কলকাতায় গেছেন। সুকান্তবাবুকে বলেছেন তার বাড়িতে কেউ অসুস্থ”। কথাটা শুনে দেখলাম সব্যদাকে একটু চিন্তিত লাগলো।
আমাদের সুকান্তবাবু অনুরধ করলেন দুপুরবেলা খেয়ে যেতে কিন্তু সব্যদা বলল যে এমনি তাদের উপর দিয়ে অনেক ঝর বয়ে যাচ্ছে তাই এইসব করার দরকার নেই। এই কথা বলে আমরা চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলাম। সাড়া রাস্তা বেশি কথা হল না। মাঝে একবার সব্যদা ফোন বের করে কাউকে ফোন করেছিল।
বাড়ি পৌঁছে ঠিক হল পার্থদা আমাদের বাড়িতেই খাবে। বর্ধমান থেকে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিলো তাই খেতে খেতে বিকেল হয়ে গেলো। খাওয়া শেষ করে আমরা এখন বসার ঘরে সোফাতে বসে আছি। ল্যাপটপ নিয়ে বসে সব্যদা বলল,“খুব আশ্চর্য লাগছে!”
আমি বললাম, “কি বিষয়ে?”
“বাড়ির বড় মালিক খুন হয়েছেন, ছোট মালিকের উপর হামলা তারপর চুরি! এতো কিছু হবার পর সবার মনে একটা অস্থিরতা আসে কিন্তু একজনকে দেখে সেটা মনে হল না”।
“কার কথা বলছিস তুই?” পার্থদা জিজ্ঞেশ করল।
“সুকান্তবাবুর ড্রাইভার!” “আমরা যখন চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরচ্ছিলাম তখন একবার আমার নজর যায় ওর দিকে। দেখে মনে হল কোন তাপউত্তাপ নেই যেন কিছুই হয়েনি!”
কথাটা শুনে পার্থদা বলল, “আমিও ব্যাপারটা দেখেছি!
আমি ঘটনাটা না দেখেই ওদের সাথে সায়ে দিয়ে বললাম, “সত্যি! কি মানুষ!”
কিছুক্ষণ আই-প্যাড নিয়ে থাকার পর সব্যদা বলল, “আমাদের সাথে এই তিন দিন ঠিক কি কি ঘটেছে একটু বল!”
পার্থদা শুরু করল। “প্রথমে তোর নামে একটা চিঠি আসে”।
আমি বললাম, “হেঁয়ালি চিঠি!”
“পরেরদিন আমরা বর্ধমান গেলাম”।
“কেন?” সব্যদা জিজ্ঞেশ করল।
“তোমার কাছে দিন কুড়ি আগে একটা চিঠি আসে ওখানকার বাসিন্দা প্রভাত চৌধুরীর থেকে। উনি কোন একটা বিশেষ কাজে তোমার সাথে দেখা করতে চায়ে”
“বর্ধমানে গিয়ে জানতে পারি যে তোকে চিঠি লিখেছিল সে খুন হয়েছে”।
“ভুল কথা! মাড়া গিয়েছেন। খুন হয়েছেন সেটা কিন্তু এখনও প্রমান হয়েনি!”
“পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ওনার মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে কিন্তু আমারদের ধারণা সেটা স্বাভাবিক নয়”।
এটা শুনে সব্যদা বলল, “ভেরী গুড! এটা আসল পয়েন্ট!”
সব্যদার কথা শেষ হবার পর আমি বলল, “পরেরদিন খবর আসে যে সুকান্তবাবু মানে প্রভাতবাবুর ছেলের হামলা হয়ে আর পাথর সমেত বাক্স চুরি হয়ে”।
পার্থদা বলল, “এখানে একটা জিনিশ ভুলে গেছিশ তুই!”
আমি বললাম, “কি?”
“প্রভাতবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে ওনার ঘর থেকে বাক্সটার চাবিও চুরি হয়েছে!”
কিছুক্ষণ ঘরে সবাই চুপ। আমরা সবাই কিছু ভাবছি। মাথায়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে।
এক- সব্যদাকে চিঠিটা কে লিখল আর তাতে কি লেখা আছে?
দুই- প্রভাতবাবুর খুন আর সুকান্তবাবুর উপর হামলা, দুটোর কারন কি এক?
তিন- চিঠি আর খুন, কোন লিঙ্ক আছে না ওটা শুধু আমাদের ধারণা?
চার- চৌধুরী বাড়িতে সবাই ভয়ে আছে শুধু ড্রাইভার ছাড়া। সেটা কেন?
এইসব নিয়ে চিন্তা করছি এমন সময়ে হঠাৎ করে কানে ঢাকের আওয়াজ এলো। মনে পড়লো যে দুর্গা পূজো কাছে এসে গেছে কিন্তু তেমন আনন্দ হল না কারন এই জটিল রহস্য।
রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা সব্যদার ঘরে এসে বসেছি। পার্থদাও এখন আছে।
ঘরে পায়াচারি করতে করতে সব্যদা বলল, “মাথায়ে অনেক প্রশ্ন আছে কিন্তু উত্তর একটাও নেই”।“চারিদিক ঘোলাটে!”
পার্থদা বলল, “ওই পাথরগুলোর যা মূল্য, বাজারে বিক্রি করলে যে কারুর জীবন পালটে যাবে”।
“ঠিক বলেছিস কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন বিক্রির খবর আমাদের কাছে আসেনি”।
আমি পাসে বসে মন দিয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে এবার সব্যদা বলল, “তুই যে ফোটগুলো তুলেছিস সেইগুলো প্রিন্ট করেছিস?” আমি বললাম “হ্যাঁ করেছি”। এই কথা শুনে সব্যদা বলল ফোটগুলো নিয়ে আসতে। আমি কথা মতো সেইগুলো নিয়ে এসে ওকে দিলাম। সেগুলো নিয়ে সব্যদা নিজের কাঠের উপর এক এক করে সাজাতে শুরু করলো। আমি আর পার্থদা সেটা পাসে দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
দুটো ফটো সামনে রেখে সব্যদা বলল, “বাথরুমের জানলা ভাঙ্গা আর ছিটকিনি নেই। বাইরে থেকে যে কেউ এসে প্রভাতবাবুকে খুন করে চলে যেতে পারে”।
এই কথা শুনে আমি বললাম, “সেটা যদি হয়ে তাহলে দুটো প্রশ্ন থাকে। এক- বাইরের লোক কি করে জানবে যে বাড়িতে এতো মূল্যবান জিনিশ আছে? দুই- দারওান কি করছিল?”
দুটো প্রশ্নের জবাব পার্থদা দিল। সে বলল, “তোর প্রথম উত্তর হল বাড়ির যদি কোন লোক বাইরে জানিয়ে থাকে যে বাড়িতে কিছু মূল্যবান পাথর আছে যার বাজারে মূল্য অতুলনীয়। দুই- দারওান দেখেও দেখেনি!”
সব্যদা এই কথাগুলো ল্যাপটপে লিখে রাখল। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে সব্যদার ভাল লাগছিল আমার সাহায্য পেয়ে।
“তার মানে তোমরা বলছ এই সব কিছুর সাথে বাড়ির কেউ জরিয়ে আছে?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
সব্যদা তার উত্তরে বলল, “একদম। প্রভাতবাবুর খুন আর চাবি চুরি তারপর সুকান্তবাবুর উপর হামলা আর বাক্স চুরি। এই সবগুলোর সাথে বাড়ির কেউ জরিয়ে আছে!” “এই কথার সব থকে বড় প্রমান এই চটির ছবি!” সব্যদার হাথে দেখলাম সেই জুতোর চাপের ছবি।
ঘরে এখন একটা অদ্ভুত নীরবতা। সব্যদা মন দিয়ে ছবিগুলো দেখছে। আমি আর পার্থদা মনে মনে ভাবছি কি করে সব্যদাকে সাহায্য করতে পারি এই রহস্য সমাধান করার জন্য।
কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, “কিন্তু বাড়ির কাকে তোমার সন্ধেও হয়ে?”
“যতক্ষণ আসল অপরাধী ধরা পরছে সবাইকে সন্দেহ করতে হয়ে!”, সব্যদা বলল।
হঠাৎ একটা ফোটো হাথে নিয়ে সব্যদা জিজ্ঞেশ করলো, “প্রগতিবাবুর ঘরে টেবিলের পিছনে একটা ছোট দরজা আছে সেটা তোরা দেখেছিস?” আমি কথাটা শুনে সব্যদার দিকে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকালাম আর পার্থদা বলল সে দেখেনি। এই কথা শুনে সব্যদা বলল, “যদি কেউ পাসের ঘরে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে মাঝের দরজা দিয়ে এসে প্রগতিবাবুকে খুন করে আবার সেই মাঝের দরজা দিয়ে ফেরত চলে যায়ে তাহলে কিন্তু সেটা কারুর বোঝার ক্ষমতা নেই!”
আমি বললাম, “কিন্তু পাসের ঘর হল প্রদ্যুৎবাবুর আর সে এখানে আসেনা!”
পার্থদা সব্যদার কথা শুনে বলল, “তুই কি কোন আন্দাজ পেয়েছিস যে সেই ঘরে কেউ ঢুকেছিল?”
ভুরুকুচকে সে বলল, “বন্ধ তালায়ে হাথের চাপ!” “কিন্তু সেটা কার? প্রদ্যুৎবাবুর না অন্য কেউ!”
আমি বললাম, “তার মানে তুমি বলছ প্রদ্যুৎবাবু এসে প্রভাতবাবুকে খুন করে চাবি নিয়ে পালিয়ে যায়ে?”
সব্যদা বলল, “হতেই পারে!”
“সেটা হলে অন্য একটা প্রশ্ন উঠে আসে। সেটা হল তাহলে সে বাক্সটা কেন পরে নিল?”, পার্থদা বলল।
দেখলাম এই কথাটা সব্যদাকে বেশ চিন্তায়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর সে বলল, “রঞ্জনবাবুই কি এই সব করেছে?”
আমি এই কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “মানে? সে প্রভাতবাবুর সেক্রেটারি ছিল!”
“প্রভাতবাবুকে মেরে চাবি নিল। সুযোগ পায়েনি তাই বাক্স পরেরদিন নিল সুকান্তবাবুকে আঘাত করে। তার পরে উধাও হয়ে!”
“তুই কি বলতে চাইছিস যে প্রদ্যুৎবাবু আর রঞ্জনবাবুর মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে?”, পার্থদা জিজ্ঞেশ করলো।
“মন বলছে হলেও হতে পারে!” “আর ড্রাইভার নিরুত্তাপ কেন?” “আর সব শেষে সেই হেঁয়ালি চিঠি!”
এই সব কথা শুনে আমার মাথার ভিতরে যেন সব কিরকম জট পেকে যাচ্ছে। অনেক ভাবার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। একটু ভেবে আমি বললাম, “কিন্তু সিগারেটের টুকরোটা কোথা থেকে এলো কারন কোথা অনুযায়ী বাড়িতে কেউ সিগারেট খায়ে না!”
এর উত্তরে পার্থদা বলল, “হয়তো কেউ খায়ে আমাদের বলেনি!”
কিছুক্ষণ চুপ। পার্থদা বলল যে অনেক রাত হয়েছে তার এখন যাওয়া দরকার। এই বলে সে চলে গেলো আর যাবার সময়ে বলে গেলো যে রহস্য কোন দিকে এগোচ্ছে তাকে যেন জানানো হয়ে।
রাতে খাওয়া শেষ করে সব্যদা ল্যাপটপ আর ফোটগুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেখি সব্যদা বসার ঘরে বসে আছে। সামনে টেবিলের উপর দেখলাম অনেকগুলো বাংলা ক্যালেন্ডারের পরে আছে । পাশে কিছু কাগজ যার মধ্যে কিছু লেখা আছে তার সঙ্গে আমার তোলা ছবিগুলো আর ওর নিজের অ্যাই-প্যাডটা। টেবিলে তিনটে খালি চায়ের কাপ।
আমি জিজ্ঞেশ করলাম, “কি করছ এই সব নিয়ে?”
ঠোঁটের কোনে একটা হাসি হেসে সব্যদা বলল, “যে আমাকে চিঠিটা লিখেছিল তাকে আমার নমস্কার! চতুর মানুষ!”
কথাটা শুনে আমি উত্তেজিত ভাবে বললাম, “তার মানে তুমি চিঠির হেঁয়ালি বুঝতে পেরেছ?”
“সেটা বুঝতে পেরেছি কিন্তু বুঝতে দেরি হয়ে গেছে!” একটু দমে গিয়ে সব্যদা বলল।
আমি বললাম, “দেরি মানে?”
সব্যদা ক্যালেন্ডার আর সেই চিঠিটা আমার সামনে রেখে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বুঝতে পারছিশ?”
আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর একটু চেঁচিয়ে বললাম, “আরে লেখাগুলো ক্যালেন্ডার থেকে কেটে লাগানো হয়েছে!”
আমার পিট চাপরে সব্যদা বলল, “এইতো! একদম ঠিক ধরেছিস। লেখাটার ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারছিস?”
কথাটা শুনে আমি আবার ভাল করে দেখতে লাগলাম কিন্তু এবার কিছু বুঝতে না পেরে সব্যদা বলে দিলাম।
“তুই যদি বুঝতে পারতিস তাহলে আমি তোকে প্রণাম করতাম কারণ এটা বুঝতে আমার প্রায়ে সারা রাত লেগে গেছে। ”
“সব বুঝলাম কিন্তু কি লেখা আছে সেটা বলবে?”
পার্থদা এর মধ্যে এসে এসে পরল। এতক্ষণ অবধি কি হয়েছে সেটা তাকে জানালো হল। তারপর সব্যদা আমাকে জিজ্ঞেশ করলো, “ক্যালেন্ডারে কোন দিন দিয়ে সপ্তাহ শুরু হয়ে?”
আমি সামনে ক্যালেন্ডারটা দেখে বললাম, “রবিবার”।
“একদম ঠিক। তাহলে আমরা রবিবারকে ১ নম্বর বলতে পারি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম সেই কথায়ে সায় দিলাম। সেটা শুনে সব্যদা বলল, “তাহলে শুক্রবার কতো নম্বর হয়ে?”
আমি গুনে বললাম, “ছয়ে!”
“তাহলে রবিবার আর শুক্রবার পাশাপাশি রাখলে কত হয়ে?”
“১৬!”
“এই ভাবে ইংরাজি অক্ষরে যদি “A” – “১” হয়ে তাহলে “B” কতো হবে?”
“২!”
সেটা শুনে ও আমাদের দিকে চিঠিটা আর একটা কাগজ আর পেন এগিয়ে দিয়ে বলল, “চিঠিতে যে নম্বরগুলো লেখা আছে সেইগুলিকে ইংরাজি অক্ষরে পরিবর্তন কর!”
আমি কথা মতো কাজ করতে লাগলাম। পাঁচ মিনিট লাগলো। শেষ হবার পর আমার চোখ ছানাবড়া। বললাম, “ 16, choudhury lane আর bordhoman !”
সব্যদা দমে যাওয়া স্বরে বলল, “ঠিক কিন্তু দেরি হয়ে গেলো। যদি আগে লেখাটা বুঝতে পারতাম তাহলে খুনটা হয়েত আটকানো যেতে!”
“কিন্তু এটা কে তোমাকে পাঠালও সেটা কি বুঝতে পেরেছ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে সব্যদা “ সেটা সঠিক ভাবে বুঝতে পারছি না কিন্তু এটা ঠিক যে ওই বাড়ি থেকেই কেউ আমাকে লেখাটা পাঠিয়েছে!” কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সব্যদার ফোন বেজে উঠল। কিছুক্ষণ কোথা বলার পর রেখে দিয়ে সে বলল ইন্সপেক্টর বাগচী ফোন করে জানাল যে এখনও পাথরগুলোর বেচার কোন খবর সে পাইনি। পার্থদা এই কোথা শুনে বলল, “ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যর। বাক্স আর চাবি দুটোই চুরি গিয়েছে কিন্তু পাথরগুলো এখন বেচার চেষ্টা করা হয়েনি কেন?
আমার হঠাৎ করে সকালবেলা চোখের সামনে আবার অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আগে যখন চিঠির হেয়েলি সমাধান হল কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল যেন পুরো কেসটা সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে আমরা যেই তীরে ছিলাম এখনও সেই তীরেই আছে। সব্যদা দেখলাম আবার নিজের আই-প্যাড নিয়ে বসে পরল। আমার আর পার্থদার কিছু করার নেই বলে আমরা একটু বেরিয়ে পরলাম। সামনেই দুর্গা পুজা তাই দুজনে ঠিক করলাম পাড়ার প্যান্ডেলটা দেখে আসি। বেশ ভাল লাগলো নিজের পাড়ার প্যান্ডেল দেখে কিন্তু মন পরে আছে রহস্যর দিকে তাই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে ইচ্ছা করলো না। আসে পাশে পাড়ার প্যান্ডেলগুলো দেখে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলাম। এসে দেখি সব্যদা ঘরে নেই। জগন্নাথকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল সব্যদা একটু বেরিয়েছে কিন্তু কোথায় সেটা বলে যায়নি। শুধু বলে গেছে যে আমরা যেন তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করি।
ঘণ্টা দুয়েক পর সব্যদার ফোন এলো। বলল ঠিক দেড়টার সময়ে পার্ক স্ট্রিট মেট্রোর বাইরে অপেক্ষা করতে। বিশেষ করে বলল যে যেন আমরা গাড়ি নিয়ে না আসি। ঠিক সময়ে মতো আমি আর পার্থদা জায়েগা মতো পৌঁছে গেলাম। পৌঁছে দেখি সব্যদা নেই। তার জায়েগাতে নরেশ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে সব্যদার কথা জিজ্ঞেশ করতে সে বলল যে সব্যদা জন্য একটা রেস্তোরাঁতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা পৌঁছে দেখি সব্যদা একটা টেবিলে বসে আসছে। আমি সেইদিকে এগোতে যাবো কিন্তু দূর থেকে দেখলাম সব্যদা ঈশারা করে আসতে মানা করলো। এর মধ্যে একটা বেয়ারা এসে আমাদের বলল যে আমাদের জন্য অন্য একটা টেবিল বুক করা আছে। লক্ষ্য করলাম যে সব্যদা এক দৃষ্টিতে সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা নিজেদের মতো খাওয়া শেষ করে ওখান থেকে বেরিয়ে পরলাম। রেস্তরাঁ থেকে বেরনোর পর সব্যদা পার্থদার ফোনে জানালো যে সে একটা কাজ সেরে সন্ধ্যার মধ্যে আসবে আর পার্থদাকে বলল যে সে যেন তার জন্য অপেক্ষা করে।
সব্যদা সন্ধ্যাবেলায় ফিরল। দরজা খুলে দেখি ওর হাতে বেশ বড় কাগজে মোড়ানো একটা জিনিস। পার্থদা কথা মতো ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো। বাড়িতে ঢুকে জগন্নাথকে চায়ের কথা বলে ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাথ মুখ ধুয়ে এসে আমাদের সামনে বসল।
একটু গম্ভীর ভাবে পার্থদা বলল, “কি হচ্ছে সেটা কি একটু আমাদের জানাবি?” “আর ওঁটা কি?”
একটু হেসে সব্যদা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “মেঘের আড়ালে একটু সূর্যের আলো দেখতে পেয়েছি।”।“ আশা করছি সেটা ধরে এগোলে পুরো সূর্যের আলো দেখতে পাব”
কথা শুনে বুঝলাম যে সব্যদা রহস্য সমাধানের কাছে এসেছে।
একটু সাহস করে আমি জিজ্ঞেস করলো, “একটু পরিষ্কার করে বলবি ?”
“সময়ে হলে ঠিক জানতে পারবি!”সব্যদা আমার প্রশ্নর জবাব দিয়ে বলল। “আর আমরা কাল সকালে বর্ধমান যাচ্ছি!” এই বলে সে নিজের ঘরে চলে গেলো। যাবার আগে এও বলে গেলো যে আজ সারাদিন ওর খুব খাটনি গেছে তাই সে একটু ঘুমাতে চায়ে। আমি মনে মনে ভাবলাম তিনদিন পরে পঞ্চমী আর এর মধ্যে রহস্য সমাধান মানে পূজো এবার দারুন জমজমাট।
পরেরদিন সকালে কথা মতো আমরা বর্ধমানের উদ্দেশে রওনা হলাম। রাস্তায়ে আমরা সকালের জলখাবার সেরে নিয়েছিলাম। চৌধুরীবাড়ি পৌঁছতে দেখি সুকান্তবাবু বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। আমাদের গাড়ি পৌছাতে তিনি আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
“নমস্কার। কিছু জানতে পারলেন?” সুকান্তবাবু সব্যদাকে জিজ্ঞেস করলেন।
আমরা সবাই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। নিচে বসার ঘরে আমরা তিনজন আর সুকান্তবাবু দুটো সোফা ভাগ করে বসলাম। সব্যদা বলল, “একটা জিনিস পরিষ্কার যে এই বাড়িতে যা খুন, খুনের চেষ্টা আর চুরি হয়েছে তার সাথে বাড়ির কেউ জড়িত আছে বা বাড়ির কেউ করছে!”
একটু অবাক হয়ে সুকান্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি করে বলছেন?”
“ধৈর্য রাখুন। সব ঠিক সময়ে জানতে পারবেন!”
এর মধ্যে নন্দ সবার জন্য চা নিয়ে এলো। একটা কাপ সব্যদা তুলে বলল, “একটা অনুরধ আছে”।
“বলুন”, সুকান্তবাবু বললেন।
“আর আজ রাতটা আমরা এখানে থাকতে চাই। আশা করি আপনার কোন অসুবিধা নেই!”
সুকান্তবাবু বিনয়ের সাথে বললেন, “এটা কি বলছেন! অসুবিধা।হবে কেন? নন্দকে বলে দেব আপনাদের খেয়াল রাখতে কারন আমাকে আজ একটু কলকাতায় যেতে হবে কাজের ব্যাপারে। কাল ফিরব”।
এই বলে সুকান্তবাবু নন্দকে দেকে বললেন আমাদের থাকার জন্য দুটো ঘরের বন্দোবস্ত করতে আর খেয়াল রাখতে যাতে আমাদের কোন অসুবিধে না হয়।
দুপুরে খাওয়ার পর সুকান্তবাবু আমাদের বলে কলকাতার জন্য রওনা হয়ে গেলেন। বিকেলের সময়ে আমরা তিনজন সব্যদার ঘরে বসে কথা বলছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ থাকবে বললে কেন?”
সব্যদা কোন উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি একটু বেরচ্ছি!” “তোরা বাড়িতে থাক। বাড়িতে কেউ নেই। কিছু গণ্ডগোল হলে আমাকে ফোন করিস”।
কথাটা শুনে পার্থদা জিজ্ঞেস করলো, “তুই আবার কোথায়ে চললি?”
“একটু চারিপাশটা দেখে আসছি”। এই বলে সব্যদা বেরিয়ে গেলো।
আমাদের ঘরে বসে কোন কাজ নেই তাই নিচে বাগানে এলাম। ভগীরথ মালি বাগানটার বেশ ভাল করে যত্ন নিতো সেটা বাগানটা দেখ বোঝা যায়ে। ঘুরতে ঘুরতে একবার দেখলাম দারওয়ান একটু অদ্ভুত ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পার্থদাকে বলাতে সে ঠাট্টা মেরে সেটা উরিয়ে দিলো। দেখলাম বাড়ির পিছনে এখনো মই লাগানো আছে কিন্তু পুলিশ কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে তাই দেখলাম মইয়ের নিচে কিছু অর্ধেক খালি অবস্থায়ে রঙের ডাব্বা পরে আছে। বাড়ির পিছন দিকে ভগীরথ মালি দেখলাম কাজ করছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে আবার নিজের মতো তার কাজ করতে লাগলো। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম বাবুকে নিজের ঘর থেকে বেরতে।
ড্রাইভারকে বেরতে দেখে আমার একটু সন্ধেও হল কারন বাবু সুকান্তবাবুর ড্রাইভার। সুকান্তবাবু যদি কলকাতায়ে গিয়ে থাকে তাহলে বাবু এখানে কি করছে?
ঘর থেকে বেরোনো সময়ে দেখলাম সে দরজা একটু ফাঁক করে এদিক ওদিক তাকিয়ে তারপর বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো। আমি আর পার্থদা একটা গাছের আড়াল থেকে সব দেখলাম। গাছের আড়ালে ছিলাম বলে ও আমাদের দেখতে পায়নি। বাবু চলে যাবার পর আমরা আস্তে আস্তে ওই বাড়ির দিকে এগলাম। দরজাতে তালা তাই ঢুকতে পারলাম না। দেখলাম পাশে একটা জানলা খোলা আছে। পার্থদা আর আমি জানলা দিয়ে উকি মেরে ঘড়টা ভাল করে দেখতে লাগলাম। পার্থদা নিজের মোবাইল বের করে ঘড়টার কিছু ফটো তুলে নিল। ঘরের ভিতরে দেখলাম একটা খাট। একটা পুরানো আলমারি। সেটার উপরে একটা রেডিও। আলমারির পাসের দেওয়ালে একটা আয়েনা আর তার পাসে একটা ক্যালেন্ডার। কিছুক্ষণ পর আমরা ওই জায়েগা থেকে বেরিয়ে গেলাম।
বাড়িতে ঢোকার সময়েও দেখলাম দারওয়ান আমাদের দিকে আবার একটা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি আবার সেটা পার্থদাকে বললাম। সেটা শুনে পার্থদা বলল বোধয় সে দেখেছে আমরা জানলা দিয়ে উকি মারছিলাম তাই তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে যাওয়া ভাল। সেটা শুনে আমারও একটু ভয়ে হল তাই চুপচাপ ভিতরে চলে গেলাম।
সব্যদার ফিরতে ফিরতে প্রায়ে সাতটা বেজে গেলো। ফিরে এসে সে নন্দকে বলল তার ঘরে তিন কাপ চা দিয়ে যেতে। কিছুক্ষণের মধ্যে নন্দ চা দিয়ে গেলো। সে চলে যাবার পর আমি সব্যদা বললাম সারাদিন আমরা কি করেছে। সব শুনে সব্যদা ফোটগুলো দেখতে চাইল। পার্থদা পকেট থেকে ফোন বের করে সব্যদার দিকে এগিয়ে দিল।
ফোটগুলো দেখে সব্যদা একটু চেঁচিয়ে বলল, “বাঃ! তোরা দারুন কাজ করেছিস! আর মাত্র একটা সূত্র জানতে পারলেই রহস্যভেদ!”
কথাটা শুনে আমার দারুণ লাগলো। আরও ভাল লাগলো এটা শুনে যে আমরা সব্যদার কাজে লাগতে পেরেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন সূত্রর কথা বলছ?”
“আছে আছে! আর সেই সূত্র বোধয় এই বাড়িতেই পাব কিন্তু কোথায় পাব সেটাই হল……”। কথা বলতে বলতে সব্যদা থেমে গেলো। লক্ষ্য করলাম সে বারান্দায় দাড়িয়ে নিচের দিকে কিছু দেখছে। আমরা উঠে গিয়ে বারান্দায়ে গেলাম। নিচে দেখি একজন দাড়িয়ে আছে। হাতে টর্চ। আর একটা টর্চওয়ালা লোক এগিয়ে এলো।
“ভগীরথ মালি আর বাবু”, সব্যদা ফিসফিস করে বলল।
দুজন দাড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলছে তাতে কোন সন্ধেহ নেই। কিছুক্ষণ পর ভগীরথ মালি চলে গেলো।
ঘরে ফিরে এসে আমি জিজ্ঞেশ করলাম, “কি বুঝলে?”
ভুরু কুঁচকে সব্যদা বলল, “আমি যেটা দেখেছি সেটা তোদের চোখে পরেনি!” এই বলে সে ঘরে গিয়ে নিজের অ্যাই-প্যাড নিয়ে বসে গেলো আর লল তাকে একটু একা থাকতে দিতে। এর মধ্যে গাড়ির আওয়াজ পেলাম। জানলা দিয়ে দেখলাম সুকান্তবাবু। আজ তিনিই নিজেই গাড়ি চালিয়ে কলকাতা গিয়েছেলেন।
রাতে খাবার টেবিলে সব্যদা সুকান্তবাবুকে বলল, “কাল সকালে একটা ছোটখাটো মিটিং করব। সবাইকে হাজির থাকতে বলবেন”।
কথা শুনে সুকান্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “রহস্য উদ্ঘাটিত?”
সব্যদা বলল, “হ্যাঁ প্রায়ে। সকাল নটার মধ্যে সবাইকে আসতে বলবেন”।
সব্যদার এই ধরণের আচরণের সাথে আমি বেশ চেনা। প্রত্যেক বারের মতো এইবারও আমার মনে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হল কারন জানিনা কাল কি হতে চলেছে, কিভাবে সব্যদা রহস্য সমাধান করবে।
পরেরদিন সকাল। আমার তাড়াতাড়ি উঠে পরলাম। বলা যায় সারা রাত ভাল করে ঘুমাতে পারিনি উত্তেজনার জন্য। আমরা যখন পৌঁছলাম, তার আগেই মোটামোট সবাই এসে গিয়েছেন। ইন্সপেক্টর বাগচী দশ মিনিটের মধ্যে চলে এলেন। এসে বললাম তিনি ক্ষমাপ্রার্থী কারন একটা বিশেষ কাজের জন্য তার একটু দেরি হয়ে গেলো।
চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে সে শুরু করলো তার কথা। “আগের মাশে আমি একটা চিঠি পাই প্রভাতবাবুর থেকে। চিঠিতে লেখেন কোন একটা বিষয়ে উনি আমার সাথে দেখা করতে চান। আমাদের আসার কথা সুকান্তবাবুকে জানাতে তিনি বললেন যে ওনার বাবা মানে প্রভাতবাবু আগের দিন রাতে মাড়া গিয়েছেন। এখানে এসে জানতে পারি উনি হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। পুলিশের ডাক্তার এবং রিপোর্টও একাই কথা বলেছে। এও জানতে পারি যে ওনার ঘর থেকে একটা চাবিও চুরি হয়ে। “চাবিটা একটা সোনালি রঙের বাক্সর যার ভিতরে আটখানা পাথর আছে যার মধ্যে একটার সাইজ অনেক বড় আর রঙ লাল”। “এই বাক্স পরবর্তী কালে সুকান্তবাবুর মাথায়ে আঘাত করে আততায়ী চুরি করে”।
সব্যদার কথা এখনও শেষ হয়েনি।
“এর মধ্যে বলে রাখা দরকার যেদিন আমরা ঠিক করেছিলাম এখানে আসবো তার আগের দিন রাতে আমার কাছে একটা হেয়ালির চিঠি আসে। সেটার সমাধান আমি করে ফেলেছি কিন্তু আপসোস যে আগে করতে পারলে প্রভাতবাবুর মৃত্যু আটকানো যেতো!” এই কথা বলে সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
কিছুক্ষণ ঘর একেবারে চুপ। সব্যদা নিজের কথা আবার আরম্ভ করলো। “এই বাড়িতে থাকার মানুষ বলতে প্রভাবতবাবু, যিনি মাড়া গিয়েছেন, চাকর নন্দ, মালি ভগীরথ, দারোয়ান। ড্রাইভার আর সুকান্তবাবু সপ্তাহে দুবার করে এখানে আসতেন”, সব্যদা বলল। “এটা বলা বাহুল্য যে কেউ বাড়ির কাউকে সন্দেহ করবে না”।
“তাহলে আপনি বলতে চান আমার বাবাকে খুন করা আর আমাকে আহত করা, দুটোতেই বাইরের কেউ জড়িত?”, সুকান্তবাবু বললেন।
“আমি শুধু বলছি সন্দেহ করবে না। কাজের সাথে জড়িত না সেটা কিন্তু বলিনি!”
“যাই হোক, প্রথমে প্রভাতবাবুর খুনের ব্যাপারটা দেখা যাক। পুলিশের ডাক্তার বলছে হার্ট অ্যাটাক কিন্তু কোন রোগ ছিলোনা। ছবিতে ওনার মুখের চাওনি কিন্তু অন্য কথা বলছে”। এই বলে সব্যদা সামনে টেবিলে প্রভাতবাবুর ছবিগুলো রাখল। “চোখ মুখের চাওনি বলছে উনি কিছু একটা ভয়েয়াবহ জিনিস দেখেছিলেন। সেই জিনিস দেখে ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল আততায়ী সেইরকম জিনিস নিয়ে কিরে বাড়িতে ঢুকল আর সে কি করে জানলো যে ঠিক সেই সময়ে প্রভাতবাবু ঠিক কি ভাবে কোথায়ে কি করছেন?”
আমরা সবাই সব্যদার কথা শুনছিলাম। সে তার কথা বলতে লাগলো। “এই প্রশ্নটা আমার মাথায়ে যখন আসে তখন আমার প্রথম সন্দেহ হয়ে যে নিশ্চয়ই এই খুনের সাথে বাড়ির কেউ জড়িত আছে কিন্তু সেটা কে?” “এই চিন্তাটা আমার আর জোরালো হয়ে যখন আমার হাথে এই চটির ছবি আসে”। এই বলে সব্যদা পকেট থেকে দ্বিতীয় ছবি বার করলো। এই ছবিটা হল সেই চটির ছবি যেটা আমরা বাগানে দেখেছিলাম। “কিন্তু দারওানকে জিজ্ঞেশ করতে সে বলে যে সে কাউকে সেইদিন রাতে দেখেনি”।
“কিন্তু প্রহ্লাদ তুমি তো সেইদিন রাতে গেটে ছিলেনা তাহলে তুমি কি করে জানলে যে কেউ বাইরে থেকে আসেনি?” কথাগুলো সব্যদা দারওান প্রহ্লাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল।
“মানে কি আপনার? কি যাতা বলছেন? আমি সাড়া রাত বাড়িতেই ছিলাম!” কথাগুলো প্রহ্লাদ বলল কিন্তু তার মুখের ভাব একদম পালটে গেছে।
সব্যদা বলল, “আমি কিন্তু তুমি বাড়িতে ছিলেনা। আমি বলেছি তুমি গেটে ছিলে না কারন তুমি প্রভাতবাবুকে খুন করেছ কিন্তু সেটার দায়ে তোমার উপর একা নয়ে। তোমাকে একজন সাহায্য করেছে আর সেটা কে আমি একটু পরে বলব!” এই কথা শোনার পর দেখলাম দুটো কন্সটেবেল প্রহ্লাদের দিকে এগিয়ে গেলো।
এইসব কথা শুনে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে সবাই চুপ।
“আপনি যা বললেন সেটার কোন প্রমান আছে আপনার কাছে?” সুকান্তবাবু প্রশ্ন করলেন।
“সব্যসাচী ব্রহ্ম বিনা প্রমান ছাড়া কাউকে দোষারোপ করেনা!” এই বলে সব্যদা তৃতীয় ছবিটা বার করে সুকান্তবাবুর দিকে এগিয়ে বলল, “একটু যুম করে দেখুন কি দেখতে পান!” তৃতীয় ছবিটা হল দারওান প্রহ্লাদের ঘরের ছবি যেটা আমরা জানলার বাইরে থেকে তুলেছিলাম। সব্যদা চটির চাপের ছবিটাও ওনার সামনে রেখে বলল, “কোন সিমিলারিটি খুঁজে পাচ্ছেন?”
কিছুক্ষণ দুটো ফোটো দেখার পর সেইগুলো ফিরিয়ে দিয়ে সুকান্তবাবু বললেন, “চটিটা কার সেটা বোঝা যাচ্ছে!”
“এবার প্রশ্ন হল কে প্রহ্লাদকে সাহায্য করেছিল সেই কাজ করার জন্য?”
ঘরে একটা অদ্ভুত পরিবেষ। সবাই চুপ করে সব্যদার দিকে তাকিয়ে কথা শুনছে।
“এখানে একটা ছোট ঘটনা আমি বলি। গত পরশু আমি তানিয়া আর পার্থর পার্ক স্ট্রীটে দুপুরে লাঞ্ছ করার প্ল্যান করেছিলাম। আমি সেই রেস্তরাঁতে পৌঁছে এমন একজনকে দেখি জাকে দেখে আমার খুব চেনা চেনা লেগেছিল কিন্তু কোথায়ে দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। এই কথা শুনে দেখলাম ইন্সপেক্টর বাগচী একজনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। অপরিচিত মানুষটাকে আমি আগের দিন রেস্তরাঁতে দেখেছিলাম সব্যদার টেবিলের সামনে বশেছিল। পার্থদার দিকে ফিরে সব্যদা বলল, “এইগুলো ওনাকে পড়িয়ে দেখ, চিনতে পারিশ কি না!”
পার্থদা দেখলাম ওনার মুখে নকল দাড়ি আর গোঁফ লাগানোর পর সেটা দেখে আমি বললাম, “এতো রঞ্জন সমাদ্দার। প্রভাতবাবুর সেক্রেটারি!”
“রঞ্জন সমাদ্দার ওরফে জয়ন্ত মল্লিক। মৃত প্রভাতবাবুর সৎ ছেলে। এই তথ্য আমি পাই ভগীরথ মালীর থেকে। প্রভাতবাবুর থেকে উনি কোনদিন যোগ্য সন্তানের সন্মান পাইনি সেইথেকে ওনার মনে প্রভাতবাবুর প্রতি ঘৃণা আর সেই থেকেই প্রতিশোধের ভাবনা। উনি জানতে পারেন যে প্রভাতবাবু সেক্রেটারি খুঁজছেন। সেই সুযোগের কাজে লাগিয়ে উনি ছদ্মবেশে রঞ্জন সমাদ্দার নাম নিয়ে এখানে চলে আসেন। চাকরিটাও পেয়ে যান। তারপর নিজের বিশেষ বন্ধু মানে প্রহ্লাদকে নিয়ে আসেন”।
এর মধ্যে রঞ্জনবাবু ওরফে জয়ন্তবাবু চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললেন, “অ্যাবসার্ড কথা বলছেন আপনি। আপনি যা বলবেন আমাকে মেনে নিতে হবে?”
সব্যদা ওনার দিকে ফিরে তাকিয়ে একটা ধমক দিয়ে বললেন, “আমার কথা শেষ হয়েনি। আগে আমি শেষ করব তারপর আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলবেন!” এই কথা শুনে জয়ন্তবাবু চুপ করে মাথা নিছু করে আবার চেয়ারে বসে পরলেন।
সব্যদা নিজের কথা বলতে লাগলো। “প্ল্যান অনুযায়ী পুরো কাজ হল। প্রথমে প্রহ্লাদ রাতেরবেলা বাইরে থেকে বাথরুমের তালা ভাঙল। দেখানো হল বাইরে থেকে কেউ প্রভাতবাবুর ঘরে ঢুকেছিল। এর মধ্যে জয়ন্তবাবু বাড়ির মেন দরজা খুলে রেখেছিল। তালা ভেঙ্গে প্রহ্লাদ মেন দরজা দিয়ে ঢুকে প্রভাতবাবুর ঘরে ঢকে। তার হাতে এটা ছিল”। এই বলে সব্যদা পাসে রাখা একটা বড় প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে একটা বীভৎস মুখোশ বার করে সামনের টেবিলে রাখল। চোখে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেনা যে মুখোশটা কি বীভৎস দেখতে। রাতে যদি কোন বৃদ্ধ দেখে তার মৃত্যু অবধারিত যেমন প্রভাতবাবুর হয়েছে আর আমরা দেখলে আদ-মরা।
“এই জিনিস চোখের সামনে দেখে প্রভাতবাবুর হার্ট অ্যাটাক হয়ে আর ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন”, সব্যদা বলল। “আসা করি জয়ন্তবাবুর পুলিশকে জানাতে কোন অসুবিধে নেই বাক্সটা কোথায়ে আছে!”
সুকান্তবাবু দেখলাম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “কিন্তু তাও দুটো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এক- বাবার ঘর থেকে কি চাবি এরাই চুরি করেছিল? দুই- আমাকে কে আঘাত করলো?”
প্রশ্ন দুটো শুনে সব্যদা বলল, “দ্বিতীয় প্রশ্নর উত্তর আগে দেবো”। এই বলে সব্যদা জামার পকেট থেকে দুটো সিগারেটের টুকরো বার করে টেবিলে রেখে বলল, “একটা পাওয়া গিয়েছিলো সুকান্তবাবুর ঘরের সামনে থেকে আর অন্যটা মেন দরজার সামনে থেকে!” কথা শেষ করে এগিয়ে গিয়ে সব্যদা জয়ন্তবাবুর জামার পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে আমাদের দেখাল। “আসা করি বলার দরকার নেই কে সুকান্তবাবুর উপর হামলা করেছিল! এইটা করার জন্য জয়ন্তবাবু কিন্তু চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতায়ে জায়েনি। বর্ধমানই কোথাও একটা গা-ধাকা দিয়ে অপেক্ষা করছিল”। “জয়ন্তবাবু আর প্রহ্লাদের বন্ধুতের প্রমান আমি পুলিশকে জমা দিয়েছি”।
আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে প্রভাতবাবুর খুনি ধড়া পরল, সুকান্তবাবুর উপরে হামলা যে করে বাক্স চোর ধড়া পরল কিন্তু এখান প্রশ্ন হল চাবি চোর কে?
এই ভাবনা শেষ করতেই সব্যদা বলল, “এবার সুকান্তবাবুর প্রথম প্রশ্নে আসা যাক!” কথা বলে সব্যদা দেখলাম বাবুর দিকে এগিয়ে গেলো। সামনে পৌঁছে সুকান্তবাবুর দিকে বলল, “বাবু হল আপনাদের বাড়িতে বড় হয়া প্রদ্যুৎ”।
প্রদ্যুৎবাবুর পাসে দাড়িয়ে সব্যদা বলতে লাগলো, “উনি আন্দাজ করেছিলেন যে প্রভাতবাবুর জীবন সঙ্কটে আছে তাই আমাকে হেঁয়ালি চিঠি উনি পাঠিয়েছিলেন। তার প্রমান হল এই ক্যালেন্ডার কাটিং যেগুলো ওনার ঘরে থেকে আমি পেয়েছি”। এই কথা বলে সব্যদা প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে অনেকগুলো পুরনো বাংলা ক্যালেন্ডার কাটিং বার করলো।
সব্যদার কথা এখনও শেষ হয়েনি।
“সুকান্তবাবু আপনি জিজ্ঞেশ করেছিলেন আমাকে যে প্রভাতবাবুর ঘর থেকে চাবি কে চুরি করেছিল?”
দেখলাম এই কথা শেষ হবার সাথে সাথে প্রদ্যুৎবাবু একটা চাবি পকেট থেকে বার করে আমাদের সামনে রাখল। সব্যদা এটা দেখে বলল, “উনি এও আন্দাজ করেছিলেন যে বাক্স চুরি হতে পারে তাই সুযোগ পেয়ে উনি চাবিটা আগেই সরিয়ে দিয়েছিলেন যাতে বাক্স চুরি হলেও সেটা খোলা সম্ভব হবেনা”।
সব কিছু সুকান্তবাবু জিজ্ঞেশ করলেন, “আপনি এটা কি করে বুঝলেন যে ড্রাইভার বাবুই হল প্রদ্যুৎ?”
সব্যদা জবাব দিয়ে বলল, “ওনার ঘরে দুলোপরা তালাতে আঙ্গুলের চাপ আর ওনার বা-হাতে খাওার অভ্যাস যেটাও আমি ভগীরথ মালীর থেকে জানতে পারি!”
চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে সুকান্তবাবু বললেন, “আপনাদের জন্য আজ এই চৌধুরী বাড়ির সন্মান রক্ষা পেলো”। গাড়িতে ওঠার পর সব্যদা তার সেই অভিনব স্যালুটটা দিয়ে বলল, “ধন্য এই চৌধুরী বাড়ি!”
কলকাতা ফিরতে ফিরতে মহিষাসুর মর্দিনী গানটা আমার কানে এলো —-কোন প্যান্ডেলে বাজছিল কারন আজ যে পঞ্চমী। আমি সেটা শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে মনে মনে বললাম- এবার পূজো জমজমাট!