আজ বিছানাটা বড় ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে বেশ আরাম করবে।বাঃ বালিশটা তো বেশ নরম, বিছানার গদিটাও তো বেশ নরম, যদিও বলে রাখা ভালো যে আদৌ এই বিছানা অমিতের কাছে নতুন নয়, আর এর গদি আর বালিশ দুটোরই বয়স বছর দুই হতে চলল। এরপর তার চোখ গেল বিছানার পাশে বুক শেলফে রাখা গল্পের বইগুলোর দিকে, একটা নিয়ে পড়তে শুরু করল। ভালোই লাগল তো ,বেশ আগ্রহ নিয়ে আরো কয়েকটা গল্প পড়ে ফেলল ও,যদিও বইগুলোরও বয়স হয়েছে,পাবলিশের থেকে নয়, ওর কেনার সময় থেকেই বছর দুই। গল্পের বই পড়ার আগ্রহ ওর কোনদিনই ছিল না। তারপর চোখ পড়ল টেবিলে রাখা পড়ার বইগুলোর ওপর, কিন্তু ওগুলো আজও খুব একটা ভালো লাগলো না।যদিও এটা নতুন কিছু না।পড়ার বই পড়তে ভালো লাগে এটাই খুব অবাক লাগে ওর, সেটার কোনো ব্যতিক্রম হল না। কোনোকিছুই ওর ঘরে নতুন নয়, যেটা নতুন সেটা হল একটা গভীর হতাশা। ওর বয়স উনিশে পড়ল। বয়সটা বলার কারণ আর কিছুই না ,যাতে সবাই আন্দাজ করতে পারে যে হতাশা বা মন খারাপ যাই বলা হোক না কেন সেটা কোন বিষয়ে।সবাই বোধহয় বুঝতেই পেরেছে যে সেটা প্রেম ভালোবাসা সম্পর্কিত। আজকের দিনে এই সম্পর্ক ভাঙাগড়ার গতি এত বেশি হয়ে গেছে যে তা রসায়নের তথাকথিত দ্রুত গতি সম্পন্ন অম্ল ক্ষারের বিক্রিয়ার গতিকেও হার মানিয়ে দেয়। এই ঘটনার জন্যই আজ সবকিছুই নতুন লাগছে। বড় কঠিন লাগে এগুলোকে মেনে নেওয়া। এত ভুলবোঝাবুঝি আর ভালো লাগে না।
বিষয়টা এরকম যে একটা মেয়েকে তার ভালো লাগে,তার নাম মণীষা।তার সঙ্গে ও বন্ধুত্ব করে।ভালো কথা। কথা বলাবলি বাড়ে ওদের মধ্যে।এই পর্যন্ত ঠিক আছে। তার পর হঠাৎ একদিন বলে ফেলল যে ভালো লাগে মণীষাকে।যদিও মনে ভয় ছিল প্রচন্ড, এতটাই যে মৌখিক পরীক্ষায় যে প্রফেসর সবথেকে বেশি অপমান করে তার সামনে যেতেও তার এত ভয় লাগেনি। প্রায় ভোর ৪ টে পর্যন্ত জেগে প্র্যাকটিস করেছে “মণীষা ,আমি তোকে ভালোবাসি।”না না হচ্ছে না। আর একবার “মণীষা তোকে একটা কথা বলবো।” উঁহু এটাও ঠিক আনা যাচ্ছে না।শেষে দেখল যে এসব করে কিস্যু হবে না ,তার চেয়ে নেট প্র্যাকটিস না করে একদম মাঠে খেলব। এরকম ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন দেখল আকাশ পরিষ্কার ,যদিও এখানে আকাশ পরিষ্কার বলতে মণীষার খুব কাছের বন্ধু তৃণাকে বোঝানো হয়েছে। আজকে বলতেই হবে, যতই মনে করুক এসব তার কাছে বিষয়টা সোজা ছিল না। অমিত কথা বলে বটে ওর সাথে কিন্তু ,ওই ‘ভালোবাসা’ উচ্চারণ করতেই তার ঘাম ঝরে কপাল দিয়ে ,শরীরটা খুব দুর্বল লাগে।মানে ওই সুগার ফল হবার লক্ষণ দেখা দেয় আর কী, যদি দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় একটু বসলে হয়তো আরাম পাওয়া যেত। মোটকথা যে এই কথা উঠলে অমিতের যে চেহারা হত ,তাতে মেডিক্যাল স্টুডেন্ট কম পেশেন্ট বেশি বলে মনে হত। কী বা করা যাবে ,হয়ত এটাও একটা রোগ।
তাও সেদিনটা ছিল নিশ্চিত কোনো এক দুর্যোগের, যদিও আমাদের গ্রহ পৃথিবীতে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরাখবর পাইনি টিভি চ্যানেলে তাও আমার বিশ্বাস ,অন্য কোনো গ্রহে নিশ্চয় কিছু তো হয়েছিলোই। কারণ ,কোনো দুর্যোগ ছাড়া মণীষা বেঞ্চ থেকে বের হতে গিয়ে হোঁচট খেতেই পারে, এমনকি অমিত তাকে ধরে ফেলতেও পারে কিন্তু দুর্যোগব্যতীত কোনো দিনে ,”মণীষা ,আমি তোকে ভালোবাসি।” এসব দুর্বাক্য(ওর মতে) ওই রকম আপাত নিরীহ বালকের মুখ থেকে নিঃসৃত হতে পারে না। একবার ঝুলি থেকে বেড়াল যখন বেরিয়েই পড়েছে তখন বেড়ালকে আবার ঝুলিতে ঢোকানোর মানে হয় না। সে চেষ্টা করলও না অমিত।যেন বেশ একটা অন্যায় কাজ করেছে এমন মুখ করে তাকিয়ে থাকল মনীষার দিকে। হোঁচটের জন্য এমনিতেই মাথাটা নড়বড় করে উঠছিল, তারপর এরকম একটা অত্যাশ্চর্য এবং বিরল ঘটনার কেন্দ্র হবার পর মাথাটা কাজ করাই ছেড়ে দিল। সেদিনকার মত কথা শেষ।
পরদিন আবার কলেজ।আজ অমিতের অবাক হবার পালা।কাল থেকে ও মনস্তাপে ভুগছে।আজ ‘সরি’ বলতে গেল বটে কিন্তু বলা আর হল না,কারণ মণীষা কাল থেকে থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সবুজ আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ঢুকল কি ঢোকেনি চারিদিক থেকে চিৎকার উঠল ,”ভাই পার্টি চাই”,”খাওয়াবি না মানে ” ইত্যাদি ইত্যাদি। আর মণীষার কিছু পাণিপ্রার্থী চুপ করে থাকল। সারা হোস্টেল জুড়ে গরম খবর এটা। মানে এত বড় সাহসিকতার নিদর্শন দেখানোয় তাকে কোনো সাম্মানিক চক্র দিয়ে দেওয়াই হত ,নেহাত ওটা দেশের জন্য যুদ্ধ না হয়ে জীবনযুদ্ধ হওয়ায় পেল না।
তা হোক। এই কদিন রোজ ওরা পাশাপাশি বসেছে, আড্ডা মেরেছে,দুজন দুজনের সাথে আরো ভালভাবে মিশেছে।এতদূর পর্যন্ত যে চ্যাপ্টারে ছিলাম তাতে ঘর্ষনবলকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। কিন্তু এবার সেটা দৃশ্যে এল এবং প্রভাব ফেলা শুরু করল।বিষয়টা হল মনীষা চায় না ওকে যে ভালোবাসবে সে অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে ।শুনে বেশ সোজা মনে হলেও বাস্তবে যথেষ্ট কঠিন ব্যাপার। কারণ আমাদের এই ঈশ্বরপ্রদত্ত চোখটার ঘূর্ণন ক্ষমতা বেশ ভালোই আছে। আর চোখের দৃস্টি সর্বদা সোজা তাই চোখের সামনে কোনো মেয়ে চলে এলে, দৃষ্টিটাকে শরীরের পরিধি বরাবর ঘুরিয়ে তার পেছনের জিনিস দেখা সম্ভব নয়। তাই চোখ পড়বেই।
ব্যাস ,অমিত আর কথাটা রাখতে পারল না। মনীষার দিন দিন দূরত্ব বাড়তে শুরু করল অমিতের সাথে। অমিত রোজ কলেজে আসে আর মণীষা বাড়ি ফেরার সময় ওকে বলে “আজ বিনীশার দিকে সাত মিনিট, দেবলীনার দিকে পাঁচ মিনিট……. মোট এক ঘণ্টা সতেরো মিনিট। এতবার তুই অন্য মেয়ের দিকে তাকিয়েছিস। কী আছে বলত ওদের মধ্যে যে এতখানি সময় তুই আমার দিকে তাকাসনি।” অমিতের গলাটা চুলকে উঠল এটা বলতে যে “যে চার ঘন্টা তাকিয়েছি তার গুরুত্ব নেই?” তাও বলল না এই ভয়ে যে মনীষা রেগে যাবে। কিন্তু কতদিন আর এভাবে চলবে? চললও না ,অমিতের মধ্যে সুপ্ত প্রতিবাদী চেতনাটা জেগে উঠল। যেন সমাজের এক ভয়ংকর অবক্ষয়ের উন্নতির লক্ষ্যে সে এগিয়ে এসেছে, ও বলেই ফেলল ,”রোজ রোজ একই খাবার খেতে ভালো লাগে ?” সেরেছে! আর কিছু পেলি না ? নাটকীয় বক্তব্যটা কি বলতেই হত। এবার হয়ত মহাপ্রলয় হয়ে যাবে এই ভয়ে,অন্তত যারা কথাটা শুনতে পেয়েছিল তারা শক্ত করে বেঞ্চের পায়া ধরে থাকল, না জানি কোন প্রলয় আসবে ,যদি উড়ে যায়? কিছুই হল না,ধীরে ধীরে মনীষার চোখদুটো বিস্ফারিত হল, আবার নর্মাল হল, তারপর বলল ,”তুই আমার সাথে আর কথা বলবি না।তুই আমাকে ভালোবাসিস না।”
বাইরে যতই শক্ত ভাব দেখাক ভেতরটা যে পুড়ে যাচ্ছে অমিতের সেটা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক আমি বুঝলাম।অন্তত রুমমেট হয়ে এটুকু বুঝতে পারি।যে সারাদিন একটা মেয়ের কথাই বলে যায়, এতটাই বেশি যে শুনতে শুনতে কানের বারোটা বেজে যায় ,সে কিনা ভালোবাসে না।থাক নারীদের সাথে ঝামেলা করতে যাব না। গল্পের শুরুতে অমিতের যে লক্ষণগুলো বলা হয়েছে সেটা সেদিনের পর থেকে অমিতের মধ্যে দেখা দিয়েছে। আমি রুমমেট হয়েও সাহায্য করতে পারছি না দেখে আমারই খুব খারাপ লাগছে। এই কদিন একটাও কথা বলেনি মণীষা। যদি একবার দেখতে পেত ছেলেটার অবস্থা।
তিনদিনের দিন এসে মনীষা বলল”সরি, আমার ভুল হয়েছে।আমি বাকি চার ঘণ্টার কথা ভাবিনি। আমরা আবার বন্ধু হতে পারি ?” অমিতের মুখে ভাবের পরিবর্তন হল না,গম্ভীরভাবে বলল” আমার একটু সময় চাই।” মনীষা “ঠিক আছে।”বলে চলে গেল।সারাদিন মুখটা বেশ গম্ভীর ভাব করে রাখল।কথাও কম বলল।
শেষে বিকেলে ফিরে বললাম,”কীহে বৎস ,মণীষার ওপর থেকে ভক্তি কি ঊর্ধ্বলোকে গমন করেছে ? এবার হেসে ফেলল ,”তুই কি ভাবিস বলতো আমাকে ,তুই তো জানিস ওকে আমি কত ভালোবাসি, আজ না হয় একটু ভাব দেখালাম। ও ‘সরি’ বলতেই তো আমারই অনুতাপ হতে লাগল।নেহাত কেঁদে ফেলিনি , আমি কালকেই ওকে আবার হ্যাঁ বলব।”একটু হেসে আমি সম্মতি দিলাম।
অমিতের চোখের আড়ালে আমার মনে একসাথে হাসি কান্না জন্ম নিল। হাসিটা এইজন্যে যে মনীষা ইচ্ছে করেই এরকম করেছিল ,দিয়ে আমাকে বলেছিল যে আমি যেন দেখি ওর আচরণ কেমন যাতে ভালবাসার গভীরতা ও নির্ণয় করতে পারে,ও কত ফুট কি মিটার পেয়েছে আমি জানি না।, আর কান্নাটা ? মণীষাকে আমিও ভালোবাসি, বড় দুর্বল ওর চোখ ,দেখতে পায় না আমার চোখ ভেদ করে আমি কাকে ভালোবাসি, ও কেবল আমাকে অমিতের খবরাখবরের জন্য কথা বলে, কিন্তু বোঝে না আমার মনকে। সে না বুঝুক ,যা হবার সে তো আর পাল্টানো যাবে না ,হয়তো এটাই ভালো। বইটা খুলে পড়তে বসলাম , থাক আপাতত বিষয়টা নিয়ে ভাবব না।
প্রেমের ফাঁদে
Subscribe
Login
0 Comments
Oldest