একটা আওয়াজে চেয়ে আনা খবরের কাগজের পাতা থেকে মুখ তোলে স্বপন| বারান্দার থামে বাঁধা তারে কাপড় মেলছে প্রতিমা| স্বপনের দ্বিতীয়া স্ত্রী| যদিও প্রতিমা কে ওভাবে ভাবতে পারে না স্বপন এখনো| নিজের অজান্তেই চোখ ঘুরে যায় ভেতরে দেয়ালে টাঙ্গানো শিপ্রা র ছবির দিকে| একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুকের ভেতর থেকে|
সুন্দরী শিপ্রা বাবা মা’র অমতে কারখানার লেবার স্বপন কে বিয়ে করেছিল| শিপ্রা র পরিবার ধনী না হলেও মোটের ওপর স্বচ্ছল ছিল, শিপ্রা র বাবা তখনো চাকরি করতেন, বাজারে দাদা র দোকান টা চলত ভালই| ওর বাড়িতে সবাই আশা করেছিল দাদার বন্ধু রাজেন কেই শিপ্রা বিয়ে করবে| রাজেনের মুদিখানার দোকান আর জেরক্স মেশিন রমরম করে চলত| সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে শিপ্রা যখন জেদ করে স্বপন কেই বিয়ে করে বসল তখন তাই ওদের বাড়ি থেকে ওর সাথে সমস্ত সম্পর্কের ইতি টেনে দেওয়া হয়েছিল| স্বপনের তো কেউ ছিল না তিন কুলে, বুড়ি ঠাকুমা গত হয়েছিলেন অনেক বছর| তারপর শিপ্রার দাদা এক দিন এসে বলে গিয়েছিল পাড়া ছেড়ে চলে যেতে| “এমনিতেই তো তোর কল্যাণে পাড়ায় মুখ দেখানো দায় হয়েছে| চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করলে যন্ত্রণা বাড়বে বই কমবে না| যা টাকা লাগবে দিয়ে দেব|”
টাকা নেয়নি স্বপন, ফোরম্যান অতীনদা যে বাড়িতে থাকে সে বাড়িতে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে উঠে এসেছিল| অশান্তি কে চায়| সুখে না হোক স্বস্তিতে সংসার করতে চেয়েছিল| কিন্তু চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে যে ফারাক থেকে গেল বিস্তর| সর্বদা হিসেব করে চলার সংসারে একটু হাঁপিয়ে উঠছিল শিপ্রা, তাও চলছিল| মেয়েও হল এক বছর বাদে, সুপর্ণা নাম রাখল শিপ্রা ই পছন্দ করে| তারপর এক দিন প্রায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ডেঙ্গু এসে ধরল শিপ্রা কে| সরকারি হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফেরাতে পারল না স্বপন তাকে, দেড় বছরের সুপুকে মাতৃহীন করে দিয়ে চলে গেল শিপ্রা| সেদিন অতীনদা আর ঝুমা বউদি ছাড়া কেউ দাঁড়ায়নি স্বপনের পাশে|
সুপুকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে বউদি জিজ্ঞেস করলেন একদিন রাতে, “স্বপন কিছু ভাবলে সুপুর দেখাশোনা নিয়ে? কারণ এভাবে তো..”..সুপুর দেখাশোনা তখন প্রায় বউদি র ওপর, চাকরি সামলে স্বপন আর কত পারে| কিন্তু বউদির ও তো ঘরের কাজ থাকে, তারপর সেলাই স্কুলের দিদিমণির কাজটাও..স্বপনের মাথা হেঁট হয়ে যায় কৃতজ্ঞতায়, অসহায়তায়| “আমি বলি কি স্বপন, তুমি বিয়ে করো আবার| মেয়েটার কি হবে নাহলে বলো|”” বিয়ে? বলেন কি বউদি? সৎ মা আনব মেয়ের?” ছিটকে ওঠে স্বপন| অতীনদাও যোগ দেন সঙ্গে, “কি যে তুমি বল ঝুমা, মেয়েটাকে মারবে নাকি শেষে!” বউদি স্থির দৃষ্টিতে তাকান, “কেন, সৎ মা ভালো হতে পারে না? কোন পুঁথিতে লিখেছে? শোনো স্বপন -“, বউদি মুখ ফেরান স্বপনের দিকে,” আমার কাছে সেলাই শেখে একটা মেয়ে..
“অতীনদা ঝাঁপিয়ে পড়েন সুযোগ বুঝে, “তাই বলো, তুমি আটঘাঁট বেঁধে ঘটকালি করতে নেমেছ?” বউদি যেন শুনতেই পানিনি, এমন ভাবে বলেন, “খুব ভালো মেয়ে স্বপন| আমার কথা শুনে দেখ তুমি, ঠকবে না| সুপুকে আপন করে নেবে দেখো| তুমি বিয়ে করলে মেয়েটাও বেঁচে যায়| আমি মানুষ চিনি স্বপন, শোনো আমার কথা|” অনেক রাত অবধি গড়ায় কথা, সুপু বউদির কোলে ঘুমিয়ে কাদা| স্বপন শেষে নিমরাজি হয় একবার দেখা করতে| তখন বউদি হাত তুলে বলেন, “কিন্তু দুটো কথা| প্রতিমার বুড়ি মা আছেন, তাঁকে সঙ্গে না রাখতে পারলে ও রাজি হবে না|” স্বপন হাত নাড়ায়, ” সে পরের কথা পরে বউদি| যদি সত্যি-ই তেমন মেয়ে হয়..নিজের মা হলে কি রাখতাম না বলুন|” মনে মূহুর্তের জন্য ভেসে ওঠে আট বছর বয়সে হারানো মা’র ঝাপসা মুখ| “আরেকটা কথা কি বললেন না বউদি?” বউদি একটু আমতা আমতা করেন এবার, উঠে দাঁড়িয়ে বালিশ বিছানা গোছাতে গোছাতে বলেন, ” প্রতিমাকে কিন্তু খুব, খুব খারাপ দেখতে|”
সত্যি-ই খারাপ দেখতে প্রতিমা, অনুজ্জ্বল পোড়া তামাটে গায়ের রং, মাথায় চুল কম, দাঁত, হনু উঁচু, হাড়গিলে চেহারা, গোদের ওপর বিষফোড়ার মত ডান হাতের সামনে দিকে বেশ কিছুটা চামড়া পোড়া| দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে স্বপনের মনে আনন্দ বা আশা কোনোটাই ছিল না বলে স্বপন নিজে মনে করে, তাই প্রতিমাকে প্রথম বার দেখে বুকের ভেতরে দপ করে যেটা নিভে গেল, সেটার নামকরণ করার চেষ্টা সে আর করেনি| অনাড়ম্বর, নিরানন্দ এক না-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তার অসুন্দর নতুন স্ত্রী ঘরে এল| ক’দিনের অগোছালো স্বপনের সংসার কখন যে তার অলক্ষ্যে আবার লক্ষ্মীশ্রী ফিরে পেল সে স্বপন গুছিয়ে বলতে পারবে না| প্রথম প্রথম যতক্ষণ বাসায় থাকত শ্যেনদৃষ্টিতে লক্ষ্য করত সুপুর সাথে প্রতিমার ব্যাবহার, হাজার হোক সৎ মা তো| সে দৃষ্টি শিথিল হয়ে এল ধীরে ধীরে যখন চোখে পড়ল কি পরম মমতায় রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া সুপুকে বুকে চেপে বেসুরো গলায় গান গেয়ে ঘুম পাড়ায় প্রতিমা, দুধের গ্লাস, ভাতের থালা নিয়ে দৌড়োয় সুপুর পেছনে, আর সুপু দু:খে কষ্টে ব্যথায় ছুটে আসে প্রতিমার কাছে, বাবাকেও সরিয়ে দেয় অনেক সময়ে, সদ্য ফোটা বুলি তে ফুঁপিয়ে খোঁজে, “মা, মা”|
প্রতিমা শান্ত, চুপচাপ, কথা বেশি বলে না| তার মা ভগবতী যেন ঠিক উল্টো| বকবকে রসিক মানুষ, দিদা খুব কম সময়ের মধ্যে সুপুর বন্ধু হয়ে বসলেন| বাড়ি র দিকটা নিয়ে আর চিন্তা রইল না স্বপনের| টাকাপয়সার চিন্তা থাকত, কিন্তু প্রতিমা বিয়ের পর থেকেই শাড়িতে ফলস বসানো, পিকো করার কাজ শুরু করে| কারখানা থেকে ফিরে মুড়ির বাটি হাতে বসে স্বপন দেখত, সুপু রামায়ণের গল্প শুনছে দিদার কাছে বসে, দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছেন ভগবতী, আর ভেতরে ক্ষিপ্র হাতে শাড়িতে সূঁচ চালাচ্ছে প্রতিমা| সুপু ডেকে উঠত মাঝেমাঝে, অকারণেই, “ও মা”| প্রতিমার উত্তর আসত সঙ্গে সঙ্গে, “হ্যাঁ মা?” তারপর এক দিন দেখল সেলাই মেশিন, সেকেন্ড হ্যান্ড, হাতের দু’টো চুড়ি বন্ধক দিয়ে কিনেছে প্রতিমা| এখন অনেক কাজ আসে, রবিবার দিন প্রতিমা আশেপাশের পাড়ায় বাড়ি গিয়ে কাজ নিয়ে আসে| মেয়ের জন্য বিকেলে ফল আসে, রাতে একটা করে ডিম সেদ্ধ|
এক দিন অতীনদার বেড়াতে আসা মাসিমা বলছিলেন, এবার একটা ছেলে হলে ভরা সংসার| স্বপনের মনটা ভাল ছিল সেদিন, পুজোর বোনাস পেয়েছিল, পরের মাস থেকে মাইনেও অল্প বাড়ার কথা| রাতে সুপু ঘুমিয়ে পড়ার পরে প্রতিমার পাশে ঘন হয়ে বসে বলেছিল, “ইয়ে, মানে লোকজন বলে আর কি এবার সুপুর একটা ভাই হলে বেশ হয়”|