পচাকে কি তোমরা কেউ চেনো ! চেনো না আর চিনবেই বা কি করে ! পচা ওর কোন নামই নয়। ওর বাবা মায়ের দেওয়ানামটা হচ্ছে পশুপতি আর পদবী হচ্ছে চাকলাদার। তা এই নাম আর পদবীর প্রথম অক্ষরদুটি নিয়ে আমি ওর একটা বদনামদিয়েছি।পচা।তবে এই বদনামটা ওর একেবারেই অপছন্দ। রাস্তাঘাটে দেখা হলে তাকে যদি পচা বলে ডাকি তাহলে সে কিন্তু খুব অসন্তুষ্ট হয়। সেদিন রবিবার ছিল। গত জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি। সকালবেলা একটা ঠাণ্ডা ঠান্ডা ভাব। বাড়ির কাছে একটাদোকানে  মিষ্টি কিনতে গিয়ে পচার সঙ্গে দেখা। দেখি কোট প্যান্ট পরে পচা একেবারে পরিভাষায় যাকে বলেজেন্টলম্যান আমিমিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করলাম,” কি পচা, কেমন আছ !” পচা রেগে কাঁই। বললেজেঠু, আপনি আমায় আর পচা বলে ডাকবেননা। জানেন, আমি এখন পাঁজা কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ।” যদিও সে কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু তবুওসেই ভাবখানা চেপে আমি বললাম, ” সে তুমি যাই হও না কেন, তুমি আমার কাছে চিরকাল পচাই থাকবে।” পচা মুখে আর কিছুনা বললেও মনে মনে যে বেশ রেগে গেল, তা বুঝতে অসুবিধা হল না।

পচার সাথে মিষ্টির দোকানে দেখা হওয়ার কিছুদিন পরে একদিন হঠাৎ সে আমার বাড়িতে এসে হাজির। দামী গাড়ি, দামীপোশাক। বললে, ” জেঠু, আসছে ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে বিয়ে করছি। সপরিবারে আপনাদের নিমন্ত্রণ। বিয়ে, বৌভাতদুটোতেই। আমাদের কোম্পানীর মালিক তথা চেয়ারম্যান পটকান ঢোল অর্থাৎ হতবুদ্ধি পাঁজার সাথে আপনার ত’ পরিচয়আছে। তাঁর একমাত্র মেয়ের সাথে আমার বিয়ে। আপনাদের আসতেই হবে।” তখনই কথায় কথায় তার কাছ থেকে তার ভাগ্যবদলের ইতিহাসটা জেনে নিলাম।।

তবে সেসব বলার আগে পচা মানে পশুপতি চাকলাদারের ইতিবৃত্ত একটু বলে নেই। পচার সাথে আমার পরিচয় অনেকদিনের।পচা আমার নতুন বাড়ির খুব কাছে এই বারুইপুরেই থাকে। তার বাবা মা নেই। পচা অনেক ছোট বয়সে বাবাকে এবং তারপরমাকে হারায় কাকার কাছে মানুষ। তার কাকা আমার বন্ধু প্রতীম সেইজন্য সে আমাকে ছোট থেকেই জেঠু বলে ডাকে। তারকাছেই শুনলাম যে সে নাকি অতি সম্প্রতি বারুইপুর ছেড়ে একেবারে দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকাবালীগন্জ প্লেসেচলেগেছে

পচা সেদিন অবধিও কলকাতার একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিল্পপতির পি.. অর্থাৎ আপ্ত সহায়ক ছিল। কিন্তু এখন সে নাকি সেইশিল্পপতির কোম্পানীর অর্ধেক অংশীদার ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। সেই শিল্পপতির নাম তোমরা অনেকেই জান। পাঁজার হাজারমলম যেগুলি একসময় বাজারে খুবই প্রসিদ্ধ ছিল সেইচাঙ্গায়নী’ প্রতিষ্ঠাতা সহস্রবুদ্ধি পাঁজার ছেলের নাতি হচ্ছেন হতবুদ্ধিপাঁজা। যিনি সেদিন অবধিওপাঁজা এনটারপ্রাইজেসের’ একমাত্র মালিক ছিলেন। পাঁজার হাজার মলম মানে কিন্তু শুধু হাজারইমলম ছিল তাই নয়, সহস্রবুদ্ধির মাথায় হাজার রকম বুদ্ধি খেলতো। হাজার মলম থেকে ব্যাথার মলম, সবই তাঁরচাঙ্গায়নী” তে তৈরী হত। আর সেই মলমগুলো তখন ভারতবর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সহস্রবুদ্ধির ছেলের নাম ছিল শতবুদ্ধি।বাবার মত বুদ্ধি না থাকলেও তিনি ব্যবসাটা চালিয়ে গেছিলেন। তাঁর ছেলের নাম ছিল সুবুদ্ধি পাঁজা। তখন বাজারে অনেক বড়বড় ওষুধ কোম্পানী এসে গেছিল। তিনি বুঝেছিলেন যে বড় বড় ওষুধ কোম্পানীর সঙ্গে টক্কর দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। তাইতিনি অন্য ব্যবসারও পথ ধরেছিলেন। সম্পত্তির ব্যবসা।কোলকাতা আর আশেপাশে তখন সস্তায় জমি বাড়ি পাওয়া যেত। তিনিসেই ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিলেন।

কম দামি জমি, বাড়ী কিনে বেশী দামে বেচে দেওয়া, সেই সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে বাড়ি ভাড়া দেওয়া, উৎসব উপলক্ষ্যে বাড়ি ভাড়াএসব তাঁর ব্যবসার অঙ্গ ছিল। কিন্তু তাঁর ছেলে হতবুদ্ধি পাঁজার তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না। পেল্লাই মোটাসোটা চেহারা আর সেইঅনুযায়ী বুদ্ধিটাও মোটা ছোটবেলায় তিনি নাকি খুব রোগা ছিলেন। তখন তাঁর একটা কি ভয়ঙ্কর অসুখ করে। প্রায় পটকেগিয়েছিলেন আর কি স্রেফ ভগবানের কৃপায় আর কড়া কড়া ট্যাবলেটের গুণে তিনি বেঁচে উঠেছিলেন। তখন থেকে তাঁর ঠাকুমাতাঁকে আদর করে পটকান বলে ডাকতেন। আর ভাল ভাল খেয়ে তাঁর চেহারাটা ঢোলের মত হয়ে গিয়েছিল বলে মাঝে মাঝে ঢোলবলেও আদর করতেন। সেই থেকেই তাঁর আর একটা নাম হয়ে গিয়েছিলপটকান ঢোল। তা সেই হতবুদ্ধির বাবার ব্যবসাটাচালাতে যখন হিমশিম হতবুদ্ধিকর অবস্থা,সেই সময়ই তাঁর সাথে আলাপ পচার মানে পশুপতি চাকলাদারের।

ঝকঝকে চেহারা, তারপর কথাবার্তায় খুব সপ্রতিভ। তাঁর বিশেষ বুদ্ধি না থাকলেও, তিনি এটা বুঝেছিলেন যে পচার মত ছেলেইতাঁর দরকার ব্যবসা বজায় রাখার জন্য। তিনি তাঁর স্ত্রীর পরামর্শ মেনে এক কথায় পচাকে তাঁর বিশেষ সহকারী করেনিয়েছিলেন। আর তাঁর সেই সিদ্ধান্তে যে কোন ভুল ছিল না, পচা তা প্রমাণ করে দিয়েছিল। পচার হাতযশে আজ হতবুদ্ধিরকলকাতায় কুড়িটা বহুতল বাড়ি যার উনিশটা ভাড়া দেওয়া আর বালীগন্জ স্টেশনের কাছে সবথেকে বড় বাড়িটিতে স্বয়ং হতবুদ্ধিথাকেন সপরিবারে। মানে উনিশ বিশ আর কি। ছাড়া কলকাতা শহরতলীতে পটকানের আছে আরো বিশটি চারতলাসুসজ্জিত বাড়ি যেগুলি কেবল উৎসবের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। পচা তাঁকে পরামর্শ দেয় লোকসানে চলা ওষুধের কোম্পানী বিক্রয়করে সম্পত্তির ব্যবসাতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে। সেই সম্পত্তির ব্যবসা এখন খুবই ভাল চলছে। হতবুদ্ধি এখন পশ্চিমবাংলার অন্যতম বড় প্রোমোটারও বটে। তবে সবকিছুতেই সামাল দেয় পচা। হতবুদ্ধির কোন ছেলে নেই, একটিই  মেয়ে। সেইমেয়ের সাথে পচার বিয়ে দিয়ে তিনি এবার ছেলের সাধ মেটাতে চলেছেন। তবে এবিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল তাঁর মেয়েঝিমলী নিজেই আর পিছনে ছিলেন তাঁর গিন্নী হলাদিনী যিনি প্রথম দিনই পচাকে দেখে মনে মনে জামাই করবেন বলে সিদ্ধান্তেএসেছিলেন।

এই হতবুদ্ধি পাঁজা বলো আর পটকান ঢোল বলো, তাঁর আরো একটা ব্যবসা আছে। স্বর্গরথের ব্যবসা। মানে মানুষ যখন পটকেযায় তখন তাদের শ্মশানে পৌঁছে দেবার কাজটা পটকানের মাধ্যমে হয়। সেই গাড়ী আছে পটকান বাবুর একুশটা। পটকান বাবুরসাথে আমার দেখা হয়েছিল একটা বিয়ে বাড়িতে।আমার পিসশ্বশুরের বেহায়ের মামাতো ভায়ের শালীর নাতনীর বিয়ের জন্যপটকান বাবুর একটা বিয়ে বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। পটকানবাবুকে নিয়ে পচা সেখানে এসেছিল।তখন পচাই পটকানের সাথেআলাপ করিয়ে দিয়েছিল।সত্যিই তাঁর চেহারাটা বিশাল একটা ঢোলের মত। আর গায়ের রঙটা একেবারে আবলুষ কাঠের মত।তাঁকে কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করছিলাম

আচ্ছা , আপনার ত’ বিশটা বিশটা করে বাড়ী , তবে স্বর্গরথের বেলায় একুশটা কেন !” তিনি বললেন– “বুঝলেন না মশাই , বিশে বিশে বিশক্ষয় হয়ে গেলে , একুশ নম্বর স্বর্গরথে চেপেই আমি শ্মশানে যাব। তাই সব থেকে ঢাউস বড় আর ভালগাড়ীটা আমার জন্যে আলাদা করে রাখা আছে, যাতে যাবার সময় আমার কোন কষ্ট না হয়” আমি শুনে হতভম্ব। মরেযাবার পরে আবার কষ্ট কিসের ! এই জন্যই ওঁর আসল নাম হতবুদ্ধি।

সেই পটকান বাবুর প্রচুর পয়সা। শিল্পপতি বলে কথা। তাঁর আটটা গাড়ি আছে। সবথেকে বড় বিদেশী চারটে গাড়ি সাধারণত সেগুলির দুটি গাড়ি পটকান বাবুর জন্য নির্দিষ্ট থাকে। আর একটিতে ওঁর মেয়ে আর একটিতে বৌ চড়েন। আরপটকান ঢোলের বাড়িতে ওঁর এক দূরসম্পর্কের বিধবা দিদি এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন আরও একটি পরিবারথাকেন। পটকানের এক মামা মামী। তাঁদের কোন ছেলেপুলে নেই। এঁদের সবার জন্য তিনটে গাড়ি বরাদ্দ থাকে। আর একটাগাড়ী পর্যায়ক্রমে রাখা থাকে জরুরী প্রয়োজনের জন্য।

    ।প্রথম পর্ব সমাপ্ত।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleSMART PHONE
Next articleনিয়তি
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments