নিখিলেশ দত্তগুপ্ত। উত্তর কোলকাতার একটা শতাব্দী প্রাচীন বাড়ির বাইরের গেটের পাশের নেম প্লেটে বাড়ির নাম ‘নিরালা’র তলায় বড়ো বড়ো করে এই নামটাই লেখা। অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী। এখন এক এন জি ও-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে সপ্তাহে দু’দিন করে অনাথ শিশুদের পড়াতে যান। স্ত্রী ঊর্মিমালা। স্বতন্ত্র – সুশ্রী – রুচিশীল এবং তৎকালীন ফিজিক্সে মাস্টার্স বলেই হোক বা যে কোনো কারণে যথেষ্ট দর্পের অধিকারী। দুই ছেলে। বড়ো ছেলে সৌম্যরূপ আর ছোটো ছেলে সৌম্যদীপ। দুজনেই বিবাহিত। বড়ো ছেলের দুই মেয়ে। আর ছোটো ছেলের বিয়ে হয়েছে এই শেষ ফাল্গুনে। এবছরই বিয়ের পর ওদের প্রথম পুজো। স্বভাবতই একটা আলাদা উন্মাদনা। আর তার ওপর আবার এই বাড়িতে এমনিতেই পুজো নিয়ে একটা বাড়তি উত্তেজনা থাকে। হাজার হোক, নিখিলেশ নিজে পাড়ার বারোয়ারি পুজোর চেয়ার পার্সন বলে কথা!
সুরঙ্গনা – সৌম্যদীপের স্ত্রী, স্নান সেড়ে ঘরে ঢুকতেই পেছন থেকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে ঘরের দরজাটা আটকে দিলো সৌম্যদীপ।
‘আরে, কী হচ্ছে কী? এ আবার কী অসভ্যতা?’ সুরঙ্গনা প্রায় আঁতকে উঠলো।
‘অসভ্যতার কী আছে? আমার বউ আমি জড়িয়েছি তো কার কী? বলেই মাথাটা আলতো করে ঠুকলো সুরঙ্গনার মাথায়।
‘কী ব্যাপার বলোতো? হঠাৎ এত্তো প্রেম?’ সুরঙ্গনাও এতক্ষণে নরম।
‘ধুর, ভালো লাগছে না যেতে। তুমিও যেতে পারতে তো আমার সাথে’ সৌম্য-র গলায় অভিযোগ।
‘হ্যাঁ সেই। তুমি চব্বিশ ঘন্টা অফিসের কাজ নিয়ে ছুটে বেড়াবে আর আমি হোটেলে বসে টিভি দেখবো।‘
‘মোটেও না। দেখতে আমি ঠিক সময় বার করে তোমায় নিয়ে বেড়োতাম’ যেন প্রায় প্রতিবাদ করে উঠলো সৌম্য।
‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। দু’দিনের তো ব্যাপার! পরশুই তো চলে আসবে। তাতেও এতো দুঃখ?’ মুচকি একটা হাসি হেসে সৌম্যকে ঠেলে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো সুরঙ্গনা।
‘আচ্ছা শোনো না। লাইটটা একবার অফ করে দাও না প্লিজ।‘
সুরঙ্গনা আকাশ থেকে পড়ে। – ‘এই ভর সন্ধ্যেবেলায় লাইট অফ করবো কেনো?’
‘এতো প্রশ্ন কেনো করো তুমি? করোই না অফ’ চোখ টিপে কথাটা বলেই জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সৌম্যদীপ।
সুরঙ্গনা লাইটটা অফ করতেই যেন ম্যাজিক! গোটা ঘরটা চাঁদের আলোয় ভরে গেলো। পশ্চিমের জানলার বাইরে ফুটে আছে অজস্র কামিনী ফুল। তার গন্ধে গোটা ঘর ম ম করছে। আর তার পেছনে কারোর বাড়ির ছাদে যাওয়ার সর্পিল সিঁড়ি আর পুরোনো পলেস্তার খসে পড়া দেওয়ালের পেছন থেকে ঠিকরে পড়া ঔজ্জ্বল্য নিয়ে স্ব-মহিমায় প্রকাশিত হচ্ছেন চন্দ্রদেব। আজ পূর্ণিমা। আর ঠিক পঁয়তাল্লিশ দিন পরই মহালয়া।
জানলার সামনে সৌম্যদীপ চাঁদের আলোর দিকে চেয়ে বসে থাকে আর মুগ্ধ হয়ে তার সেই দেবতুল্য শান্ত সৌম্য কান্তির দিকে তাকিয়ে থাকে সুরঙ্গনা।
‘কী হলো? এখানে এসো। পাশে’ – সৌম্য সুরঙ্গনার দিকে তাকিয়ে এক সুক্ষ্ম ঈশারা করে।
এই ঈশারা প্রত্যাখ্যান করা যায়না। সুরঙ্গনা এগিয়ে আসে। ওর ভেজা চুলে তখন কামিনীর স্নিগ্ধতা।
নীচে বৈঠক খানায় তখন জোড়ে রেডিও বাজছে। রবি ঠাকুর ভেসে আসে। – ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’।
সন্ধ্যে আট’টা নাগাদ সৌম্যদীপ বেড়িয়ে যায়। সাড়ে দশটায় ফ্লাইট। দু’দিনের জন্য অফিসের কাজে দিল্লী যেতে হবে ওকে। মা-বাবা’কে প্রণাম করে সবাইকে বলে যখন ও বেড়োচ্ছে, তখন সদরেরে একপাশে একটা থাম জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুরঙ্গনা। সৌম্যদীপ বুঝতে পারে ওর মন খারাপ। বিয়ের পর থেকে এই প্রথম ওকে ছাড়া দু’দিন কাটাতে হবে। সৌম্যরও কেমন একটা ফাঁকা লাগে। গাড়িতে ওঠার আগে সবার অলক্ষ্যে সুরঙ্গনার হাতে একটা টুকরো কাগজ গুঁজে দিয়েই গাড়িতে উঠে পড়ে সৌম্য। চোখের কোণে জল আর ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি নিয়ে সৌম্য বেড়িয়ে যেতেই কাগজটা নিয়ে ছুটে নিজের ঘরে চলে যায় সুরঙ্গনা। দরজা বন্ধ করে কাগজটা খোলে। দেখে ভাঙা ভাঙা হস্তাক্ষরে লেখা ‘দু’দিন মাত্র। ফিরে এসে অনেক আদর। তৈরী থেকো’। ওটা দেখেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে ও। কামিনী ফুলের গন্ধটা এখন যেন আরও উগ্র হয়ে গেছে। সৌম্য-র পারফিউমের স্মিত গন্ধটা যেন ওতে ঢাকা পড়ে যায়।
রাত ন’টা নাগাদ সবাই খাবার ঘরে জড়ো হয়। এবাড়িতে নিয়মের এদিক ওদিক হয়না। সমস্ত কাজই সময় মতন। সুরঙ্গনা আর সুদীপ্তা, ওর বড়ো জা – দু’জনে মিলে খাবার বাড়তে থাকে। তখনও রেডিও চলছে। নিখিলেশ একটু উশখুশ করতে থাকে সৌম্যদীপকে ফোনে পায়না বলে। ‘এয়ারপোর্টে পৌঁছল কিনা কে জানে? এতো দেরী করে বেড়োয় সব! একটা কথা শোনেনা’ এসব গজগজ করতে করতে যখন নিখিলেশ ফোনটা নিয়ে এদিক ওদিক করছে, ঠিক তখনই ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। মাইক্রো ওভেনে গরম করা মাছের ঝালের বাটিটা এক হাতে নিয়েই অন্য হাতে ফোন’টা ধরলো সুরঙ্গনা। ওপারে কোনো এক অপরিচিতের গলা।
‘হ্যালো, এটা কি সৌম্যদীপ দত্তগুপ্তের বাড়ি? আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাগুইআটি থানায় চলে আসুন-
সুরঙ্গনা আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলোনা। ওর মাথা ধরে আসছিলো। চোখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। হাত কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে মাছের ঝালের কাঁচের বাটিটা পড়ে ছিটকে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। গোটা ঘরে মাছের টুকরোগুলো ছিটিয়ে গেলো। নিখিলেশ, ঊর্মিমালা আর সুদীপ্তা যতক্ষণে সুরঙ্গনাকে ধরে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়াচ্ছিলো, ততক্ষনে সৌম্য-র দাদা ফোনটা রিসিভ করেছে। মুখ চেপে আটকে আসা গলা নিয়েই ছুটে বেড়িয়ে গেলো ও।
বডি আইডেন্টিফিকেশনের জন্য।
সেই রাতে কার আক্সিডেন্টে মারা যায় সৌম্যদীপ। পোস্টমর্টেম-র পর যখন বডি আসে, তখন পরদিন বেলা বারোটা। সকাল থেকে বাড়িতে ভীড় উপচে পড়ে। ‘নিরালা’ যেন প্রাণহীন, স্পন্দনহীন। সাদা মালা, ফুল, ধূপের গন্ধ আর অন্ত্যেষ্টির সামগ্রীতে যেন গা ঘোলায়, বমি পায়। সুরঙ্গনার হুঁশ আসেনা আগের রাত থেকে। ঊর্মিমালা স্থির, পাথর হয়ে থাকে। নিখিলেশের প্রতাপ, দাম্ভিকতা যেন উধাও হয়ে যায় কোনো অজানা উদ্দেশ্যে। সৌম্যরূপ ডুকরে কাঁদে ভাইয়ের মৃতদেহের ওপর পড়ে। ওর ছোট্ট মেয়েদুটো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। শোবার ঘরে সুরঙ্গনা তখনও অচৈতন্য। টেবিলের ওপর তখনও গ্লাস চাপা দিয়ে রাখা সেই টুকরো কাগজটা। তাতে লেখা – ‘দু’দিন মাত্র। ফিরে এসে অনেক আদর। তৈরী থেকো’।