প্রলয়ের মনটা আজ ভাল নেই। বাবা-মা, বাড়ী বিশেষ করে গার্লফ্রেন্ড রেখার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। সবেমাত্র ৭ দিন হল ব্যাঙ্গালোরে এসেছে সে। কিন্তু, মনটা পড়ে আছে আসানসোলে। এই বছর বি টেক পাশ করে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ব্যাঙ্গালোরে একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায় সে। মোটা অঙ্কের অফার তাকে এই দুই হাজার কিলোমিটার দূরে নিয়ে আসতে প্রলুব্ধ করে।
ব্যাঙ্গালোর শহরটা যদিও তার বেশ ভালই লেগেছে। আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক, রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিছন্ন। কোম্পানি তাকে ডায়মন্ড ডিসট্রিক্ট নামক এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ভিতর একটা ফ্ল্যাটে রেখেছে। এপার্টমেন্ট যে এত সুন্দর হয় তা আগে তার জানা ছিল না। জলে টইটম্বুর নীল সুইমিং পুল, বাচ্চাদের খেলার সুন্দর পার্ক, বিশাল জগিং ট্র্যাক, টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট তাকে বিমোহিত করেছে। টেনিস কোর্টগুলি কোম্পানির ফ্লাটের ব্যালকনি থেকে দেখা যায়। সকালে বেশ কয়েকজন টেনিস খেলে। স্নান করার আগে প্রান ভরে তাদের খেলা দেখে সে। যদিও এখানে থাকার মেয়াদ আর বেশিদিনের নয়। পরবর্তী ৮ দিনের মধ্যে তাকে নতুন আস্তানা খুঁজে নিতে হবে। কলেজের সিনিয়রদের মাধ্যমে সে একটা থাকার ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা করে এনেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সে ডিসিশন নিতে পারবে।
অফিসে এখন কাজের চাপ কম। ফ্রেশার বলে কাজের ট্রেনিং শুরু হয়েছে। আজ সকালে তিন ঘণ্টার একটা ট্রেনিং হবার কথা ছিল। সেইমতো রেখার সাথে ভিডিও চ্যাট করার কথা ছিল বিকেল ৪টে থেকে। কিন্তু, ট্রেনারের ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য দুপুর ২টো থেকে ক্লাস শুরু হয়। ফলে বানচাল হয়ে যায় চ্যাটের প্ল্যান। রেখা কলেজে থাকায় তাকে সে জানাতেও পারে নি এই পরিবর্তনের কথা। চ্যাটে প্রলয়কে না পেয়ে রেখা ভীষণ দুঃখ পায়। একের পর এক দুঃখ-অভিমান ভরা রেখার এসএমএস প্রলয়ের মনটা খারাপ করে দেয়। ক্লাস শেষে মোবাইলে রেখার কান্না শোনার পর থেকে সে ভীষণ আপসেট হয়ে আছে।
‘ব্যাঙ্গালোরে আসা কি তার ঠিক হয় নি?’ এই প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতে সে অফিস থেকে বাড়ী ফিরছে। ডায়মন্ড ডিসট্রিক্টের ২নম্বর গেট দিয়ে ঢোকার মুখে এক আপরিচিত কণ্ঠস্বর তার প্রবেশ রোধ করল –“ওঃ ভাইয়া!”
পিছন ফিরে তাকিয়ে সে দেখল সম্বোধনকারী একজন মাঝবয়সী পুরুষ – রোগা, গায়ের রঙ তামাটে, মাথায় সাদা পাগড়ী, মাথার বেশিরভাগ চুল পাকা, দাড়ি-গোঁফ সাদা ও বেশ কয়েকদিন না কাটা, পরনে সাদা অপরিষ্কার পাঞ্জাবি ও সাদা ধুতি, মুখটা উদ্বিগ্ন ও বিষণ্ণ।
প্রলয় ফিরে তাকাতেই আগন্তুক জিজ্ঞেস করল-“হিন্দি? মারাঠি?”
এই কয়েকদিনের থাকার মধ্যে এখানকার ভাষার সমস্যা সম্বন্ধে তার ধারনা হয়েছে। সে বলল – “হিন্দি।“
আগন্তুক হিন্দিতে কথোপকথন শুরু করল।
“আপনি খুব দয়ালু আদমি। ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন। আমাদের জন্য আপনি যা করলেন এই ঋণ আমি কোনদিন ভুলব না। আমি অসৎ নই। গ্রামে পৌঁছে আমি আপনার টাকা কোনভাবে ঠিক ফিরত দেব। আপনি একটা কাগজে আপনার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার লিখে দিন। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকা জোগাড় হলে আপনাকে পাঠিয়ে দেব।”
আগন্তুক-“ভাইয়া, আমার নাম বাবুরাও মুণ্ডে। এই আমার স্ত্রী ও আমাদের দুই ছেলে।“
প্রলয় লক্ষ্য করল বাবুরাওর পিছনে একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা ও দুটি বার-তের বছরের ছেলে। তাদের মুখগুলিও শুকনো।
বাবুরাও বলে চলল- “আমরা মহারাষ্ট্রের রত্নাপুরা গ্রামের বাসিন্দা। ওখানে চাষবাস করে দিন কাটাই। পরিবার নিয়ে তিরুপতি বালাজির দর্শনে বেরিয়েছিলাম। রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের সমস্ত টাকা ও জিনিষপত্র চুরি হয়ে গেছে। টিকিট চেকার আমাদের কথা বিশ্বাস না করে স্টেশানে নামিয়ে দিয়েছে। পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম – গরিব মানুষ বলে ওরাও তাড়িয়ে দিয়েছে। সাহায্যের জন্য সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। গরিব মানুষ বলে কেউ সাহায্য করছে না।“
বলতে বলতে বাবুরাও কেঁদে উঠল। তার বৃত্তান্ত শুনে প্রলয়ের মনটা আর খারাপ হয়ে গেল। দুপুরের পর থেকে ভাল কিছু তার সাথে ঘটছে না।
বাবুরাও ধুতির কোন দিয়ে চোখ মুছে আবার বলা শুরু করল- “সকাল থেকে পেটে একটা দানাপানি পড়ে নি। আমরা বড়, আমাদের উপোষের অভ্যাস আছে। বাচ্চা গুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছে। সারাদিন না খেয়ে ওদের মুখ শুকিয়ে গেছে। আমাদের বালাজি দর্শনের আশা চুকে গেছে। এখন আমরা যে কোন ভাবে গ্রামে ফিরে যেতে চাই। আপনি যদি কিছু সাহায্য করেন।“
প্রলয়ের মনে পড়ে গেল পুরানো কথা। একবার কলকাতার বাসে তার পকেটমার হয়ে গিয়েছিল। একজন দয়ালু ভদ্রলোক তাকে বিশ্বাস করে তার ফেরার ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তা খুব বেশি টাকা ছিল না। এখানে চারজনের ফেরার খরচ, সঙ্গে কিছু খাবার জন্য টাকাও দিতে হয়। কত টাকা দেওয়া উচিত তা সে ভাবতে থাকল।
বাবুরাও প্রলয়কে চুপ থাকতে দেখে বলল – “ভাইয়া আমি সত্যি কথা বলছি। আমি আমার ছেলের মাথার শপথ নিয়ে বলছি এই সব সত্যি ঘটনা। আমি একটুও বানিয়ে বলছি না।“
প্রলয় নিজের ম্যানিব্যাগটা বার করে দেখল ভিতরে একটা পাঁচশো টাকা আর তিনটে একশ টাকার নোট পড়ে আছে। সে বাবুরাওর হাতে পাঁচশো টাকার নোটটা দিয়ে বলল –“এতে তোমাদের যাওয়া হয়ে যাবে, আর রাস্তায় কিছু খেয়ে নিও।“
বাবুরাও আবার কেঁদে ফেলল। প্রলয়ের হাত ধরে বলল – “আপনি খুব দয়ালু আদমি। ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন। আমাদের জন্য আপনি যা করলেন এই ঋণ আমি কোনদিন ভুলব না। আমি অসৎ নই। গ্রামে পৌঁছে আমি আপনার টাকা কোনভাবে ঠিক ফিরত দেব। আপনি একটা কাগজে আপনার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার লিখে দিন। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকা জোগাড় হলে আপনাকে পাঠিয়ে দেব।“
প্রলয় ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করে নাম, ফোন নাম্বার লিখে বাবুরাওর হাতে দিল। বাবুরাও আর কয়েকবার তাকে ধন্যবাদ জানাল। প্রলয় গেট দিয়ে এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢুকে গেল।
বাবুরাও পাঁচশো টাকার নোটটা পাঞ্জাবির মধ্যে সযত্নে রেখে দিয়ে স্ত্রী ও ছেলেদের দিকে তাকাল। তাদের মুখে হাসি দেখা দিয়েছে। সে ধুতিটা দিয়ে নিজের চোখ ভাল করে মুছে নিয়ে বাকীদের সাথে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকল।
ডায়মন্ড ডিসট্রিক্টের ১নম্বর গেটের কাছে আসতেই সে তার ডান হাতে ধরা প্রলয়ের নাম-ফোন নাম্বার লেখা কাগজটা মুড়ে রাস্তায় ফেলে দিল। গেটের দিকে ধাবমান পিঠে ল্যাপটপ ব্যাগ নেওয়া এক কমবয়সী যুবককে উদ্দেশ্য করে সে বলল –“ওঃ ভাইয়া!”